ফাদার সুনীল রোজারিও। রেডিও জ্যোতি, বাংলাদেশ।
তথ্য প্রযুক্তি আজকের বিশ্বে একটা বড় এজেন্ট, যেটাকে সীমান্তের মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্রের খবরগুলো সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে বাইরে চলে যায়। সরকার ব্ল্যাক আউট করার চেষ্টা করলেও বাস্তবে তা সম্ভব হয় না। অল্পদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রকে সত্যের মুখে দাঁড়াতে হয়। এমনটিই ঘটেছিলো চীনের উহান প্রদেশে। ৩৪ বছর বয়সী চক্ষুবিজ্ঞানী লী ওয়েনলিয়াঙ্গ গত বছর ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে এই ভাইরাস সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক হওয়ার কথা বলেছিলেন। হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান সিটিতে এইরকম সাতজনকে তিনি সনাক্তও করেছিলেন। এর চারদিন পর ড. লী’র বিরুদ্ধে সমাজে গুজব ও উত্তেজনা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়। চীন দেশে সত্য বরাবরই একটা গুজব হিসেবে দেখা হয়। চলতি বছর ৩০ জানুয়ারি তার শরীরে রোগ ধরা পড়ে এবং তিনি এই করোনা ভাইরাস রোগে মারা যান। তিনি বেঁেচ থাকলে বলতে পারতেন কার মধ্যে এই রোগের লক্ষণ প্রথম দেখতে পেয়েছিলেন । তাতে করে এর প্রতিষেধক তৈরি সহজ হতো।
করোনা ভাইরাস নতুন কোনো রোগের নাম নয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর একদল ভাইরাসবিদ, নিউজ এ্যান্ড ভিউজ নামক ছোটোখাটো এক প্রবন্ধে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সর্বপ্রথম উল্লেখ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, এটার আকার খুব তীক্ষè বা লম্বাও নয়। তারা এই ভাইরাসকে সৌর জগতের জ্যোতির্বলয়ের মতো আকার বলে উল্লেখ করেছিলেন। ভাইরাসবিদদের আকার ইংগীত থেকে আজকের করোনা জীবানুর আকার খুব দূরে নয়। সেই হিসেবে করোনার বাংলা অর্থ হতে পারে, পুষ্পমুকুট, জ্যোতির্বলয়, রোজারিমালার আকার বা আলোর বেষ্টনী। আজকাল পত্র পত্রিকায় করোনা ভাইরাসের যেসব ছবি ছাপানো হচ্ছে তা করোনার বাংলা মানের সাথে মিলে যায়।
বিশ্ব মনে করেছিলো চীনাদের খাদ্যাভ্যাসের কারণে তৈরি ভাইরাসটা উহান শহরেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু করোনা শেষ পযর্ন্ত কোনো করুণা না করে এশিয়া জয় করে সাত সমদ্দুর তেরনদী পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে। যে দেশের যে পরিবেশ ও জলবায়ু- তার সাথে তাল মিলিয়ে করোনা বহুবার তার জিন্ বদলেছে। ইরানের পবিত্র কুম্ সিটিতে যখন করোনা ধরা পড়লো, বিশ্ব তখন নড়েচড়ে উঠলো। ইরানের এতো শৃঙ্খলার মধ্যে কুম্ শহরে করোনা কীভাবে পৌঁছালো। এরপর শুরু হলো করোনার ইউরোপ অভিযান। এই আলোচনা যখন লিখছি তখন জানা গেলো যে, মৃতের সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে গেলো ইটালি। মোট নিহত ৩,৪০৫ এবং ২০ তারিখে, একদিনেই নিহত ৬২৭জন। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান, অর্থ প্রাচুর্যে ইটালি বিশ্বসেরা, তাহলে কেনো দেশটি করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি- একটা সময় বিশ্লেষণ হয়ে সেটা বেরুবে।
করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে এক মানবিক বিপর্যয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছ থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে। হাসপাতালে মৃতদেহ রাখার জায়গা নেই, কবর বা পোড়াবার লোক কমে যাচ্ছে। মৃতদেহ সৎকারে ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্য ও নিয়ম কানুন মানা সম্ভব হচ্ছে না। ছবিতে দেখলাম ইটালির বেরগামো শহরে ২০টির মতো ট্রাক মৃতদেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী করুণ দৃশ্য। করোনা যোদ্ধারা এতোগুলো মৃতদেহের ভিন্ন ভিন্নভাবে সৎকার করবে নাকী হাসপাতাল সামাল দেবে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবার শেষবারের মতো দেখার সুযোগ পাচ্ছে না।
বাংলাদেশের কী অবস্থা? কেউ নিয়েছেন সিরিয়াসভাবে, কারো কাছে করোনা একটা গুজব। আবার কেউ এটাকে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে নিচ্ছে। বিদেশ থেকে প্রতিদিন করোনা ভয়ে হাজারে হাজারে বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসছে। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে কে কোথায় যাচ্ছে তার সঠিক ও পুরো তথ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হাতে নেই। অথচ বিদেশ ফেরৎ বাংলাদেশিরাই এই রোগটা বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। কর্তা ব্যক্তিদের কথা শুনে মনে হয় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানসমৃদ্ধ দেশ। করোনার সাধ্য কী- কিছু করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এক দুই করে রোগির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। দেশে বাজার, ঘাট, বন্দর খোলা, দিব্যি নির্বাচন হচ্ছে, বিদেশ ফেরতারা বিনাবাধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, ট্রেন-বাস চলছে।
বাংলাদেশে এখনো আসল/সত্য কথার চেয়ে গুজব বেশি ভাইরাল হয়। করোনার কারণে অনেকে রোগ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছেন। ভারতে তো গোমূত্র পান করার এক প্রকার ধর্মীয় উৎসবই হয়ে গেলো। গরু প্রয়োজনে খাল-বিল বা ড্রেনের পচা জল পান করে যে বর্জ্য বস্তুটি নিক্ষেপ করলো, সেটাই হয়ে গেলো মহাঔষধ। কেউ বলছেন রসুন বেটে খাও, রোগে ধরবে না। কেউ আবার বলছেন, আদা-গুল মরিচ একসাথে গুলে খাও- রোগের সাধ্য কী। একজন ফাদার বললেন, গভীর রাতে হৈ হল্লায় তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। শুনতে পেলেন তুলসী পাতা, তুলসী পাতা বলে অনেকের চিৎকার। কেউ গুজব ছড়িয়েছে তুলসী পাতার রস করোনার মহাদাওয়াই। বাঙালি আর যায় কোথায়- মধ্যরাতে তাই অভিযান তুলসী পাতার খোঁজে। বড় কথা, সেটা ছিলো একটা খ্রিস্টান গ্রাম। হে যিশু তুমি রক্ষা করো। অদূর ভবিষ্যতে আরো কোনো প্রকারের বর্জ্য বস্তু ভক্ষণ করার আবেদন আসবে কীনা বলা যায় না। আবার ডাক্তারদের কথায়ও ধন্ধে ধরে। কেউ বলছেন করোনার জীবানু ২৩ থেকে ২৭ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে বাঁচতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটা আশার খবর। আবার পরক্ষণেই দেখি কেউ বলছেন, করোনা নাকী ৭০ডিগ্রি তাপমাত্রায় বেঁেচ থাকে। এখন চলছে হাত ধোয়ার প্রশিক্ষণ- দেখে মনে হচ্ছে, মাত্র হাত দিয়েই রোগটা ছড়ায়। আবার এই সুযোগে ব্যবসায় নেমেছে অনেকে। হাত ধোয়ার এই বস্তুটি আউট অব মার্কেট। মাস্কের দাম ১০ থেকে লাফে ৫০টাকা। সে না হয় বুঝলাম- কিন্তু এর সঙ্গে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কী সম্পর্ক? জাতির জন্য সম্মিলীতভাবে সাহায্য সহযোগিতা বা সেবাদান- কেনো বাঙালির মধ্যে এতো দুর্বল? চীনে যখন করোনা ভাইরাস আক্রমন করলো, আমরা বললাম ওদের ধর্ম নাই, তাই এটা ওদের উপর গজব। আর আমাদের দেশে যখন আক্রমন করলো তখন চীন আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলো- আর বাঙালি স্বার্থের দিকে এগুলো।
পোপ ফ্রান্সিস, এই করোনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছেন। মানুষ যদি সাধু সাধ্বীর কাছে প্রার্থনা করে ফল পান- তাহলে পিতার কাছে কেনো নয়। বাংলাদেশ বসে নেই। দলে দলে শুরু হয়েছে রোজারিমালা, কোথায়ও আবার নভেনা, ক্রুশের পথ। বারুইপুর ধর্মপ্রদেশে বিশপ সব ধরনের ধর্মীয় জমায়েত বন্ধ ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে অদ্য ২১.০৩.২০২০ থেকে পাপস্বীকার থেকে শুরু করে সব ধর্মীয় জমায়েত বন্ধ। বিশপ জের্ভাস রোজারিওর এই নিষেধাজ্ঞা ইতিমধ্যেই মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে গেছে।
রোম নগরীতে প্রচুর ধর্মীয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেখানে চীনা পর্যটকদের আনাগোণা বেশি। বাংলাদেশের অনেক ফাদার ইটালিতে পড়াশুনা করেছেন। তাদের মতে, খুব সম্ভব ১৭ভাগ রোমান ধর্মকর্ম করেন। অথচ এই ইটালিয়ান মিশনারিগণ আমাদের দেশে এসে আমাদের ধর্মকর্ম শিখিয়েছেন। এই রোম নগরীতেই রয়েছে ভাটিকান সিটি। আর এই ভাটিকান সিটি প্রধান পোপ হলেন, বিশ্ব ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সবোর্চ্চ ধর্মীয় নেতা। মানুষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাইÑ এবার কী ধর্মেকর্মে ইটালির মানুষ ফিরে আসবে? দেখেশুনে তাই মনে হচ্ছে। যারা জীবনে ধর্মের ভিটায় আসেনি, তারাও রোজারিমালা হাতে, গীটার হাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছে। ঈশ্বর ভক্তের আকুতি শোনে। তবে তার আগে দেখতে চান, ভক্ত তাঁকে মানে কীনা, ভক্তের বিশ্বাস আছে কীনা। ইউরোপে কী ধর্মের নয়া জাগরণ এই তপস্যাকালেই শুরু হচ্ছে?
তাহলে এখন চীনারা কী করবেন? খাওয়া দাওয়ায় ওদের কোনো বাছ-বিচার নেই। ওরা মনে করে পৃথিবীর সব পোকা-প্রাণী মানুষের খাদ্য। কিন্তু এই পোকা-প্রাণী জাতীয় চৈনিক খাদ্র যাঁর সৃষ্টি, তাঁর প্রতি আবার ওদের বিশ্বাস নেই। তাহলে কী চীন দেশে নতুন কোনো বিপ্লব সন্নিকট। কারো অভিমত, ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল-জুন, বেইজিং শহরের তিয়ানানমেন চত্বরে গণতন্ত্রের দাবিতে কম করে ২,৬০০ ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছিলো। যে দাবিকে বলা হয় Eighty Nine Democracy Movement. এবার উহান থেকে তৈরি করোনা ভাইরাস দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর, চীনে আর একটি বিপ্লব দানা বেঁধে উঠার কারণ তলে তলে জোরদার হচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুমান। এখন থেকে ৪০ বছর আগের বেইডিং শহরের তিয়ানানমেন চত্বর আর আগের ধারনায় নেই- অনেক বদলেছে। পশ্চিমা সংস্কৃতি আর আধুনিক গণতন্ত্রের হেঁচকা হাওয়ায় তিয়ানানমেন আবার সরব হয়ে ওঠতে পারে। উহান শহরে চক্ষু বিজ্ঞানী লী ওয়েনলিয়াঙ্গ নতুন এই ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন- চীনা সরকার সেই সতর্কবাণীর প্রবক্তাকে গুজব ও সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টির অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করেছিলেন। পরে সত্য প্রকাশের পর এই উহান থেকেই জনরোষ গড়ে ওঠতে শুরু করেছে। চীনে এই ভবিষ্যৎ আন্দোলনের মুল বিষয়গুলো হয়তোবা হতে পারে- সত্য প্রকাশে বাক্ স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং এতে করে সাথে থাকতে পারে ধর্মীয় স্বাধীনতা। তাহলে করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব কী নতুন সভ্যতার আলামত দেখতে পাচ্ছে? আসুন নতুন করে অপেক্ষা করি। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: