– বিশপ জের্ভাস রোজারিও
নভেল করোনা ভাইরাস বা কভিড-১৯ এখন এক আতঙ্ক ও ভীতিসঞ্চারী নাম। এটি এমন একটি বিপজ্জনক ও ছোঁয়াচে প্রাণসংহারী/মহামারি (Pandemic) রোগ যা অতীতে আর কখনোই দেখা দেয়নি। গত ডিসেম্বরে চীন দেশের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে এই রোগ সর্বপ্রথম ধরা পড়ে এবং সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে। উহান শহরে অনেক মানুষ মারা গেছে। চীনা সরকার প্রথম এই রোগের কথা লুকিয়ে রাখেন ও পরে তা আংশিকভাবে প্রকাশ করেন। কিভাবে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলো তা এখনো জানা যায়নি। শোনা যায় যে, ৩৪ বছর বয়সী চক্ষু বিজ্ঞানী লী ওয়েনলিয়াঙ্গ নামক ডাক্তার এই রোগটি সম্পর্কে প্রথম সতর্ক করেন এবং তিনি নাকি এই রোগের ঔষধও আবিষ্কার করার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু তার আগেই চীনা সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে এবং পরে তিনি এই করোনাতেই মৃত্যু বরণ করেন। পরে অবশ্য দুই মাসের মাথায় চীন তাদের দেশকে মোটামুটিভাবে এই রোগ থেকে মুক্ত করে ফেলে। কিন্তু ইতিমধ্যে আস্তে আস্তে কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবীর ২০০ দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং লাখ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে থাকে ও হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে থাকে। ইউরোপের দেশ ইটালি, স্পেইন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। পৃথিবীর দেশে দেশে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের বাংলাদেশেও আজ এপ্রিলের প্রথমে এসে (০৪.০৪.২০২০) ৭০জন আক্রান্ত ও ৮জন মৃত্যুবরণ করেছে।
এই ভাইরাসটি আসলে কি তার বর্ণনা এখনো স্পষ্ট নয় – আর এটা আসলো কোত্থেকে এসেছে তাও পরিষ্কার নয়। কেউ বলে বন্য প্রাণী থেকে আবার কেউ বলে আসলে এটা আসলে চীন কর্তৃক তৈরি করা ‘বাইয়োলজিক্যাল বোমা’ যা দুর্ঘটনাক্রমে ফুটো হয়ে বেড়িয়ে পড়েছে- আর তাতে চীনসহ সারা পৃথিবীর মানুষ আক্রান্ত হয়ে চলেছে। তবে কোন কিছুই গোপন থাকবে না; ভবিষ্যতে আমরা সবই জানতে পারব এটা বিশ্বাস করতে পারি। এই ভাইরাসটি কেমন তা আমরা এাখনো ভাল করে জানি না। আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসা বিজ্ঞানীর মতে এটা আসলে কোন জীবন্ত কোষ নয়, এটি একটি প্রোটিন অনু (Protein molecule) যা চর্বির আবরণে আচ্ছাদিত থাকে। এটা যদি চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে মানব দেহে প্রবেশ করে তাহলে তা পরিবর্তন হয়ে বা রূপ পাল্টিয়ে আক্রমনাত্মক ও সংখ্যাবৃদ্ধিকারক (aggressor and multiplier) হয়ে ওঠে। যেহেতু এই ভাইরাসটি কোন জীবন্ত কোষ নয়, তাই এটি বিষজাতীয় কোন কিছু দিয়ে মারা যায় না। এটি বিশেষ অবস্থায় নিজে থেকেই নি:শেষ হয়ে যায়। এই ভাইরাসটি ক্ষয়প্রাপ্ত (decays) বা পক্ষভেদ (disintegrates) হয় বিশেষ অবস্থায়: যেমন তাপ, আর্দ্রতা ও কেমন জিনিষের তা অবস্থান করে তার উপর নির্ভর ক’রে। ভাইরাসটির টিকে থাকার একমাত্র কারণ হলো এর চর্বির আচ্ছাদন, তাছাড়া এটি খুবই ভঙ্গুর (fragile)। তাই সাবান বা কাপড় পরিষ্কার করার কোন পাউডার ভাইরাসটিকে ক্ষয় ক’রে বা গলিয়ে ফেলে। তাই সাবান ও পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে অনেক ফেনা উঠিয়ে হাত পরিস্কার করলে এই ভাইরাস আর থাকতে পারে না। উত্তাপে এই ভাইরাস গলে যায়- বা ২৫ ডিগ্রী তাপে এই ভাইরাসটি গলে নি:শেষ হয়ে যায়। আবার এলকোহল (৬৫%) বা লেবুর রসেও তা গলে। তবে সাবান পানিই সর্বোত্তম। ব্লিচিং পাউডার (১/৫) দিয়েও এই ভাইরাসটি ক্ষয় করে বা গলিয়ে ফেলা যায়। এই ভাইরাস কাপড় চোপড়ে ৩ ঘন্টা, তামায় ৪ ঘন্টা, কাঠের উপর ২৪ ঘন্টা, কার্ডবোর্ডে ৪২ ঘন্টা ও প্লাষ্টিকে ৭২ ঘন্টা টিকে থাকে। এসি ও আর্দ্রতার মধ্যে দীর্ঘ সময় এই ভাইরাস টিকে থাকে ও সংক্রমন ঘটায়।
তবে অন্যান্য ভাইরাসের মতই এই ভাইরাসটি খালি চোখে দেখা যায় না, সেহেতু একে ভয় করতেই হবে। এর ঝুঁকি আরও বেশি, কারণ এখনো এর প্রতিষেধক ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। এই জন্য সুরক্ষা (protection) বা নিরোধই (prevention) এই ভাইরাসের সংক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। এই জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশক্রমে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল দেশই এই সুরক্ষা বিষয়টির উপর জোর দিয়েছে। এই সুরক্ষা বা নিরোধ পাওয়ার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হল: (১) সাবান পানি দিয়ে ভাল মত হাত ধোয়া অথবা হাত সেনিটাইজার ব্যবহার করা এবং হাত না ধুয়ে মুখমণ্ডল স্পর্শ না করা (২) মাস্ক দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখা আর হাত মোজা ব্যবহার করা, বিশেষভাবে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় অথবা অসুস্থ মানুষের কাছে গেলে (৩) সামাজিক ও আন্ত:ব্যক্তিক দূরত্ব রাখা বা কোন ধরণের গণজমায়েত না করা (৪) বিদেশ থেকে আসলে বা রোগের লক্ষণ- যেমন সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা, জ্বর, হাচি উঠা, ইত্যাদি দেখা দিলে কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে থাকা (৫) মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দেওয়া, ইত্যাদি।
এর বাইরেও অন্যান্য আক্রান্ত ও ভূক্তভোগী দেশের মত বাংলাদেশ সরকার ঘরের মধ্যে থাকার জন্য নাগরিকদের নির্দেশ দিয়েছেন। শিশুরা ও ছাত্র-ছাত্রীরা যেন আক্রান্ত না হয় সেইজন্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি দেওয়া হয়েছে। তারপর পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে দেখে সরকার ১৪ দিনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। হাসপাতালসহ জরুরী সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ যদিও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে সরকার সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের সরকার প্রায় গোটা দেশেই লকডাউন বা শার্টডাউন ঘোষণা করেছেন। এমনকি পুলিশ ও বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও রাস্তায় নামিয়েছেন মানুষকে কঠোরভাবে এই ব্যবস্থা মানাতে। জাতিকে এই করোনার কঠিন সংকট থেকে রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা অত্যাবশ্যকীয়ই ছিল। আমাদের দেশের সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সকল দপ্তর বিশেষভাবে রোগতত্ব ও রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই জন্য প্রশংসা পেতেই পারে।
তবে এই পরিস্থিতি আমাদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি কিছু চিন্তার ও অনুধ্যানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আমরা এই অবস্থাটা ইতিবাচকভাবেও দেখতে পারিঃ-
১। এই নভেল করোনা ভাইরাস আমাদের সকলকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা ধনী-গরীব সকলেই সমান। সকল প্রকৃতি বা ঈশ্বরের কাছে আমাদের কোনই পার্থক্য নেই। এই ভাইরাস কাউকেই ছেড়ে দেয় না বা সমীহ করে না; রাজা-বাদশা, রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধান, মন্ত্রী-এমপি, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ডাক্তার-নার্স, ধর্মগুরু, শিশু বা বৃদ্ধ, কাউকেই এই ভাইরাস সংক্রমন থেকে বাদ দেয়নি। কোন ধর্মের মানুষকেও ছেড়ে দেয়নি: হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান, ইত্যাদি সকল ধর্মের মানুষকেই কভিড -১৯ রোগটি সংক্রমিত করেছে। তাহলে আমরা কেন পৃথক হয়ে থাকি? কেন আমরা পরস্পরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকতে পারি না?
২। আমরা বুঝতে পারছি যে, আমরা কত ভঙ্গুর- আমরা সকলেই মরণশীল। যে কোন সময় আমরা রোগাক্রান্ত হতে পারি, আর আমরা যে কোন মুহূর্তে মরেও যেতে পারি। এই ভাইরাস রোগে বা অন্য কোন রোগে আমরা কষ্ট পেয়ে মরতে পারি। তার পরেও আমরা কত অহংকারী ও স্বার্থপর- অন্যদের আমরা ভালবাসতে পারি না বা কাছে থাকতে পারি না। আমরা যদি মানব জাতির কল্যাণে কিছু করতে না পারি, মৃত্যুতেই আমরা শেষ হয়ে যাব, কেউ আমাদের আর স্মরণ করবে না।
৩। আমরা প্রকৃতিকে যত্ন করি না, বরং প্রতিনিয়তই আমাদের কোটারী স্বার্থের জন্য বা ভোগবিলাসিতার জন্য এই প্রকৃতির উপর অত্যাচার চালাই। প্রকৃতির নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে, একটা স্বভাব আছে, যা আমাদের বুঝতে হবে এবং সেইভাবে তার যত্ন করতে হবে। যদি আমরা প্রকৃতির নিয়ম না মেনে নিজেদের মনগড়া চিন্তা-ভাবনা দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে বৈরী আচরণ করি তাহলে প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া আমাদের উপর নেমে আসতে পারে। এই করোনা ভাইরাস সেই ধরণের কিছু হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে, পৃথিবীর বনাঞ্চল উজার হয়ে যাচ্ছে, বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল কমে আসছে, বন্যপশুদের মেরে ফেলা হচ্ছে, আর অনেক প্রাণীর বংশ ইতিমধ্যেই নিপাত করা হয়েছে, পৃথিবীর খনিজ পদার্থ নির্বিচারে উত্তোলন করা হচ্ছে, খনিজ তেল পোড়ানো হচ্ছে, গাড়ীর ও কলকারখানার ধোঁয়ায় এবং আরও অনেক ভাবেই প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
৪। পরিষ্কার পচ্ছিন্ন থাকা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হাত ধোওয়া বা স্নান করা আমাদের শুধু ভাল লাগার জন্যই নয়, আমাদের দৈহিক সুস্বাস্থ্যের জন্য অতীব প্রয়োজন। আমরা যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি তাহলে আমাদের শরীরের বা দেহের অবস্থা ভাল থাকে, আর যদি নোংরা অপরিচ্ছন্ন থাকি তাহলে আমাদের বিভিন্ন চর্মরোগ বা উদরাময়ে ভূগতে হয়। সেই রকম আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের আত্মাও পরিষ্কার রাখতে হয়। করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক হাত ধোওয়া বা পরিষ্কার থাকা আমাদের সেই কথাও স্মরণ করায়।
৫। আমাদের স্বাস্থ্য আমাদের দেহের মতই অমূল্য সম্পদ- তাই স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে গিয়ে অবশ্য আমরা অন্যের স্বাস্থ্যের অনিষ্ট করতে পারি না। তাই এই বিষয় চিন্তা করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন আচরণ বা কাজকর্ম করতে হবে- যেন আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা পায়। নিয়মিত কাজকর্ম, দৈহিক ব্যয়াম, বিনোদন, সুষম ও পরিমিত খাদ্য গ্রহন, নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করা, অনিষ্টকর খাদ্য ও পাণীয় বর্জন করে চলা, ইত্যাদি বিষয় আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
৬। এই জগতে যা-কিছুই ঘটুক- তার একটা পারমার্থিক কারণ অবশ্যই আছে। আমরা পার্থিব বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে, পারমার্থিক বিষয় ভাববার সময় পাই না। আমরা ঈশ্বরের উপর আমাদের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। বিজ্ঞান, জ্ঞান-বুদ্ধি, বিদ্যা, ইত্যাদি তো ঈশ্বরেরই দেওয়া। এগুলোর উপর নির্ভর করে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি, আবিষ্কার করতে পারি, যন্ত্র-পাতি বের করতে পারি। কিন্তু শেষে আমরা সৃষ্টিকর্তা যিনি, তাঁকেই ভুলে যাই। আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাই না বলে তাঁকে বিশ্বাস করি না, ভয়ও করি না। কিন্তু করোনা ভাইরাসও আমরা দেখতে পাই না কিন্তু একে আমরা কত ভয় করছি। এই করোনা-সংকটের সময় আমরা কিন্তু মনের অজান্তেই সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে চলেছি।
৭। আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি অথবা দেশি বা বিদেশি আমরা সকলেই সমান। একই ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং সকলকে সমান মানব মর্যাদা ও অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সকলের একইভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যও রয়েছে, যা করতে হবে ঈশ্বর যেভাবে চান সেইভাবে- নিজের স্বেচ্ছাচারী চিন্তা-ভাবনা থেকে নয়। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের ইচ্ছা বাদ দিয়ে আমাদের আত্ম সমর্পণ করতে হয়- ঈশ্বরের কাছে অথবা কর্তৃপক্ষের কাছে। তাই সব সময় আমাদের ভাবতে হবে কিসে সকলের মঙ্গল হবে। করোনা সমস্যা আমাদের সেকথাও মনে করিয়ে দিয়েছে।
৮। আমরা একে অপরের উপর ওতোপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল- তাই আমরা শুধু নিজের উপর নির্ভর করে চলতে পারি না। এখন আমরা যে ঘরে থাকছি এখনো কিন্তু আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে অন্যদের উপর। তাহলে আমরা কেন অন্যদের জন্য কিছু করব না? এই সংকটে ঈশ্বর কি তাহলে আমাদের জন্য এই সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, যেন আমরা অন্যদের জন্য ভাবি এবং তাদের, বিশেষভাবে অভাবী ও দুস্থ ভাইবোনদের জন্য আমরা কিছু করতে পারি এবং আমাদের দূরত্ব ঘুচাতে পারি? এই সময় আমাদের সেসব ভাবতে হবে।
৯। যারা ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশালী তারাও করোনা ভাইরাসের কাছে পরাভূত। নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে তারা কতই না দম্ভ করেন। কিন্তু করোনা ভাইরাস সকলকেই বুঝিয়ে দিল- আমাদের ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি দিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারি না। সুতরাং আমাদের উচিত সকলকে মূল্য ও মর্যাদা দেওয়া বা সম্মান করা।
১০। এই সময় যে আমাদের লক্ডাউন বা শাট্ডাউন করে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে – হয়তো আমরা অনেকেই তা পছন্দ করছি না। আমরা ঘরে বন্দি থেকে হাস ফাস করছি। কিন্তু আমরা কি চিন্তা করে দেখেছি, আমাদের পরিবার ও পরিবারের সদস্যদের আমরা কত অবহেলা করে চলি? এই সময় আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা আমার কত কাছে আছে আমি তো এখন পূর্ণভাবে তাদের দিকে নজর দিতে পারি। তারা অথবা আমার বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন, যাদের ভালবাসা ও আদর যত্ন আমি সব সময় আমার প্রাপ্য বলে ধরে নিই তাদের দিকে দৃষ্টি মেলে দেখতে পারি। পরিবারে সকলের আরও কাছে আসতে পারি, তাদের সঙ্গে থাকতে পারি ও আনন্দ করতে পারি বা তাদের কষ্ট ভাগ করে নিতে পারি, প্রার্থনা করতে পারি, তাদের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে পারি।
১১। এই সময় সকল প্রকার সমাবেশ- সামাজিক ও ধর্মীয় সকল অনুষ্ঠান সীমিত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জায় উপাসনা বা প্রার্থনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের তাতে খারাপ লাগছে। আমরা যারা নিয়মিত প্রার্থনা গৃহে উপস্থিত থেকে উপাসনায় বা ঈশ্বরের আরাধনা করি, তাদের তো খারাপ লাগারই কথা। আর যারা নিয়মিত সেখানে উপস্থিত থাকে না, তারাও কিন্তু বুঝতে পারছে সেখানে যাওয়ার অর্থ কি! যারা ক্যাথলিক খ্রিস্টভক্ত, তাদের অনেকেই যে তাদের যাজকগণ তাদের জন্য যে যজ্ঞোৎসর্গ করেন বা পালকীয় সেবাদান করেন তার মূল্য বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। এই সময় তাদের মনেও একটি উপলব্ধি কাজ করবে যে, যা বিনা মূল্যে ঈশ্বর দিয়েছেন তা তাদের জন্য কত মূল্যবান।
১২। কার দোষে এমনটি ঘটলো বা কার পাপে এই নভেল করোনার অভিশাপ মানব জাতির উপর নেমে এলো, এই প্রশ্ন এখন অবান্তর। এই করোনার সংকট কোন ব্যক্তি বিশেষের বা কোন জাতি-গোষ্ঠীর নয়, এই সংকট গোটা মানব জাতির। এই সংকটের মোকাবেলা করা একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মানব জাতিকেই একতাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের দেশে বা সমাজেও আমরা একতাবদ্ধ হয়েই এই সংকটের মোকাবেলা করব। কাউকে বাদ দিয়ে বা কাউকে পিছনে ফেলে রেখে আমরা দক্ষভাবে বা ফলপ্রসূভাবে এক সংকটের মোকাবেলা করতে পারব না। তাই করোনার এই চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে- যেন আমরা একতাবদ্ধ হতে পারি – একাত্ম হতে পারি।
তাই আমরা যেন আতঙ্কিত না হই, বা কাউকে আতঙ্কিত না করি, বরং যেন সচেতন বা সতর্ক হয়ে চলি। ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। এখনও এই রোগের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোন ঔষধ আবিষ্কার হয়নি- তাই আপাতত: এর কোন ঔষধি প্রতিকার নেই। হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে কোন ভেক্সিন বা প্রতিষেধক পাওয়া যেতে পারে। তবে এ থেকে রক্ষা পেতে কিছু অভ্যাস বা বিধি অনুশীলন করতে পারি যা ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমাদের দেশের সরকারের বা বেসরকারি সংস্থাসমূহের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে ও এখনো হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে: ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা সেনিটাইজার ব্যবহার করে হাত পরিষ্কার করা, হাত না ধুয়ে মুখমণ্ডল স্পর্শ না করা, মাস্ক ব্যবহার করা (দীর্ঘ সময় কড়া রোদে মাস্ক নিরাপদ করা), ঘরের বাইরে গেলে হাত মোজা ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কাউকে স্পর্শ না করা, ঘরেও পরস্পরের কাছ থেকে দূরত্ব বজায়ে রাখা (পরস্পরের জন্য দরদ প্রকাশ করে কাছে থাকুন), অতি প্রয়োজন না হলে ঘরে থাকা, প্রোটিন সমৃদ্ধ ভাল খাওযা (দুধ, ডিম, সব্জি ও ডাল-চালেও তা হতে পারে), ঘন ঘন উষ্ণ পানি পান করা, বাসার বারান্দায় বা ছাদের মত নিরাপদ স্থানে হাটাচলার ব্যয়াম করা, ইত্যাদি।
এই সময় আমরা প্রার্থনাপূর্ণ বিশ্রামে সময় কাটাতে পারি আর অনুধ্যান করতে পারি। মানব জাতির ইতিহাসে মানুষের যেমন অনেক আনন্দের ও সুখের দিন ছিল, তেমনি তার অসংখ্য দুঃখ-কষ্টের দিনও ছিল। তার দ্রুত উন্নতির ও অগ্রগতির সময় ছিল আবার মন্দা ও পতনের দিনও ছিল। তার মানে হল সব সময় মানুষের জীবন ও সময় একই রকম ছিল না; তার উত্থান-পতন ছিল। মানুষের উত্থান-পতন হয়েছে কারণ মানুষ সব সময় দায়িত্বশীল আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনও দেখা গেছে এক কালের মানুষ ঈশ^রের উপর বিশ্বাস ও নির্ভর করেছে আর নিজেদের মধ্যে মিলন ও ঐক্য বজায়ে রেখে একত্রে কঠোর পরিশ্রম করে একটি উন্নত ও সুখের, সভ্যতার বা ঐতিহ্যের জন্ম দিয়েছে; আর তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই উন্নয়নে ও সুখে গা ভাসিয়ে দিয়ে এবং ঈশ্বরকে ভুলে গিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত আচরণ করেছে ও ভোগবিলাসিতা করে সব ধ্বংস করে দিয়েছে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে এরকম অনেক ঘটনা লেখা রয়েছে (যেমন নোহের ঘটনা, আদি ৬:১১-৮:১৯; লোটের ঘটনা, আদি ১৯:১-২৮)। পোপ ফ্রান্সিস আমাদের বলেছেন যেন আমরা ভয় না করি, যেন ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখি আর যেন ভক্তি ভরে প্রার্থনা করি। তাই এই করোনা ভাইরাসের এই সময় ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখি; আমাদের জীবন ও দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা সচেতন হই। আমাদের মন পরিবর্তন করে ঈশ্বরের কাছে ফিরে এসে আমরা পবিত্র জীবনের পথে চলি। সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর যেভাবে আমাদের কাছে চান আমরা যেন সেইভাবেই চলি আর আমরা যেন দায়িত্বশীল আচরণ করি। এইভাবেই আমরা আবার একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে পারি; ভালবাসাপূর্ণ ও মিলনের এক নতুন সভ্যতার জন্ম দিতে পারি।
এর মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে বলে, পাছে না বলে দরিদ্র মানুষ খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। এই কঠিন সময় পার হলে, এর চেয়েও কঠিন সময় আসবে আর তা হলো অর্থনৈতিক মন্দা। অনেক মানুষ চাকুরী হারাবে, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হবে, কলকারখানা আগের মত চলবে না। কিছুদিনের জন্য হাহাকার পড়ে যাবে সর্বত্র। তখন যারা গরীব মানুষ তারাই হবে সব চাইতে বেশি কষ্টের শিকার। তখন আমরা কি করব? আমাদের সেই সময়ের জন্য এখনই প্রস্তুত হতে হবে। ক্যাথলিক মণ্ডলির ভাবনা শুধু বর্তমান নিয়ে বা এখনকার জন্য নয়- আমাদের ভবিষ্যতের জন্যও। আমরা তখন একা কেউ এই সংকট মোকাবেলা করতে পারব না। আমাদের সকলকেই একত্রে মিলে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। তাই এখন থেকেই আমাদের মধ্যে, সকল মানুষের মধ্যে ভালবাসার সংহতি ও মিলনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সহযোগিতা ও সহভাগিতার মাধ্যমে তা বাস্তব করতে হবে। পাঠকদের প্রতি রইলো আমার আর্শীবাদ ও শুভেচ্ছা। প্রার্থনা করি সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
লেখক পরিচিতি: বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ডি.ডি. বাংলাদেশের রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিসের বিশপ। বরেন্দ্রদূত সম্পাদক মন্ডলির বিশেষ অনুরোধে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তাধারা ও অনুধ্যান পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন।

Please follow and like us: