ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
শনি গ্রহটা কোন্দিকে হেলেছে ? কেনো হেলেছে ? এটা কী তাহলো শনির দশা বলবো ? কোনো মন্দ শক্তিকে বুঝাতে শনির দশা বলা হয়। ভারতীয় শাস্ত্র মতে, মানুষের কর্মের উপর নির্ভর করেই শনির দশা ভর করে। তাহলে আজকে করোনা ভাইরাস যে গোটা বিশ্বে ভর করেছে, এটা কী বিশ্বের কর্মফল ? ঈশ্বর এতো নিষ্ঠুর তা বলা যাবে না। কিন্তু প্রকৃতিকে একটা ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়- তাই সে মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর আচরণ করে। প্রকৃতির পাঠশালা থেকে মানুষকে পাঠ নেওয়ার দিন কোনোদিন ফুরোবে না। প্রকৃতি থেকে শিক্ষা না নিলে শনিটা এই গ্রহেই হেলবে। আর এই পৃথিবী গ্রহের দিকে হেলে পরা শনির বলয়টা কখন অন্যদিকে মোড় নিবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এখন প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেওয়ার জরুরি সময়। আজকাল বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মহামারির জন্য মানুষ দায়ি। মানুষের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ-লালসা এবং প্রকৃতির ওপর নির্মম আচরণের কারণে প্রকৃতিও মাঝে মধ্যে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতা, বৈরিতা মানুষের প্রতি তার শত্রুতা নয় কিন্তু একটা শিক্ষা মাত্র। প্রতিটি বৈশ্বিক দুর্যোগ, প্রকৃতির গতিবিধি, মহামারি এবং মানুষের তৈরি রাজনৈতিক সংকট বিশ্বে কিছু পরিবর্তন সাধন করে। এবার কী তাই বলবো ?
চিকিৎসা শাস্ত্রে কতো বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু আজ তারা নোভেল করোনা ভাইরাসের কাছে অসহায়। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এই অসহায়ত্বের কারণে বিশ্ববাসী অসহায়। মাত্র দু’টি আন্ত:মহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্রের অর্থে একটা বড় আকারের হাসপাতাল তৈরি করা যেতে পারতো। আজ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন লক্ষ্য কোটি টাকার যুদ্ধ জাহাজ, আনবিক বোমা ও নানা পাল্লার সামরিক অস্ত্রের চেয়ে হাসপাতাল নির্মাণ কতো প্রয়োজন ছিলো। এখন শুনছি মরারকালে হরির নাম। যুদ্ধ, ভূমিকম্প বা দুর্ভিক্ষ আজকের দিনে একটা নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে। এটা একটা বৈষম্যমূলক আচরণ। কিন্তু আজকের এই মহামারি কোনো মানব পরিচয়কে বিবেচনায় আনেনি, কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করেনি, কোনো বিশেষ অঞ্চলের মধ্যে বসে থাকেনি। কোন্ রাষ্ট্র কতো শক্তিধর তাও আমলে আনেনি। আমরা করোনা চরিত্রের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ দেখেনি। কতো সাবলীলভাবে, বিনা বাঁধায় বিচরণ করছে গ্রহময়। যাদের ঘরে ভাত নেই, যারা তৃতীয় বিশ্ব বলে অসহায়, অন্যদিকে যারা প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ, ক্ষমতায় যারা শীর্ষে, যাদের ভাষা যুদ্ধের, যারা ক্ষুধার্তদের পেটের ভগবান- কোনো তফাৎ নেই। বলতে হয়- যারা ভেবেছিলো, ওরাই তো মরবে, আমরা বহাল তবিয়তে থাকবো, দেখা গেলো তারাই আজ বেশি অসহায়।
অনেক উন্নত দেশে দেশপ্রেম বলতে সশস্ত্র বাহিনীকে সবার আগে রাখে। সামরিক বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্তদের জন্য কতো সুযোগ সুবিধা বরাদ্দ থাকে। এখন কী সেই সমস্ত উন্নত দেশ বুঝতে শুরু করেছে- কারা প্রকৃত দেশ প্রেমিক? যারা যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ মারে ? নাকী যারা জীবনবাজি রেখে জীবন রক্ষা করে- সেই ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল কর্মী ? দেখুন এই মরণকালে কারা দেশপ্রেমিক। এই চরিত্র আমাদের বুঝতে সহায়তা করবে যে, কোনো জাতিকে পারমানবিক বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া আর দেশপ্রেম এক নয়, বরং- তার চেয়ে স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকার জন্য যারা নিশ্চিয়তা দিচ্ছেন তারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক। এখানে এটাও মনে রাখতে হবে- মানুষের স্বাস্থ্য, মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা, বিশুদ্ধ পানি, বিশুদ্ধ বাতাস ও প্রকৃতি-পরিবেশকে বাদ দিয়ে অস্ত্রাগার, কলকারখানা চালু রাখার দিন শেষ হয়ে গেলো। রাষ্ট্রের চরিত্রে ও বিবেচনায় আসবে সংখ্যাগুরু প্রজার ভাবনা। উন্নত দেশগুলোকে এবার প্রকাশ্যে স্বীকার করতে হবে যে, তারা বিশ্বে মানববান্ধব নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাহলে কী কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বে ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার কোনো সংস্কৃতি তৈরির সুযোগ এনে দিয়েছে ?
আজকের বিশ্ব সভ্যতার মধ্যেও মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে কতো ভেদাভেদ, কতো বৈষম্য। অনেকের চেহারা দেখেই কোনো জাতি বলে দেয় ওরা তৃতীয় বিশ্বের মিছিল থেকে আসছে। ওরা করুণার পাত্র। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এখন একটা রাজনৈতিক সংস্কার সময়ের ব্যাপার মাত্র। রাষ্ট্র তার মতো করে দেশের আপামর জনগণের পুরো দায়িত্ব নেওয়ার দিন শেষ হবে। কোটি কোটি জনতাকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে রাষ্ট্র বলে দিবে- এটা সত্য আর এটা মিথ্যে, সেই দিনও সামনের দিনে সম্ভব নাও হতে পারে। তথ্য প্রযুক্তি গোটা বিশ্বটাকে একটা পল্লী বানিয়ে ফেলেছে। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের মধ্যে একটা ভারসাম্য ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। আর এই ভারসাম্য গড়ে তুলবে তথ্য প্রযুক্তি। কোনো কোনো দেশ আর্থিকভাবে বেশি স্বচ্ছলতা অর্জন করতে না পারলেও সস্তা প্রযুক্তির বদৌলতে জনগণ তথ্য প্রবাহের মহাস্মরণিতে যুক্ত থাকবে। ফলে সত্যকে গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়ার কৌশল ধাতে টিকবে না। আর যদি সরকার সত্যকে ধামাচাপা দিতে চায় তবে সেটার খেসারত সরকারকেই বহন করতে হবে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে, গণতন্ত্রের কথা বলে, দেশের স্বার্থের কথা বলে বিরোধীদের ধমক দেওয়া, সরকারের হাতে থাকবে না। করোনা ভাইরাস নিয়ে সত্যকে গুজব ব’লে আর তথ্য গোপন ক’রে চীনা সরকার যেসব কৌশল নিয়েছিলো, তার খেসারত দিচ্ছে আজ গোটা বিশ্ব। সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়, এটা প্রমাণিত হলো। একটা দুর্বল রাষ্ট্র যদি এই ধরণের মারাক্তক সত্যকে গোপন করতো, তাহলে এতোক্ষণে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো।
একটা দেশের সরকার কিন্তু রাষ্ট্র নয়। আসল রাষ্ট্র হলো দেশের জনগণ। জনগণের কাছ থেকে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে নাকী সরকার জনগণের ওপরে ? জনগণ সরকারের উপরে। এই প্রশ্নটা আজকের আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিবর্তন আনবে। একটা নির্দিষ্ট দেশের রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনগণের মতামতের মধ্যে যে ফারাক রয়ে গেছে, সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গির এই প্রাচীন কাঠামো বদলের দিন শুরু হয়ে গেছে। পাশাপাশি দেশ ও বার্হিদেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা হবে বলে মনে হয়। ভালো সম্পর্ক না থাকলেও মাত্র মানবতার কারণে চীনা সরকার ইটালিতে করোনা কর্মী ও মালামাল পাঠিয়েছে। কিউবা সরকার ইটালিতে সহায়তা পাঠিয়ে মানবতা দেখিয়েছেন। প্রমাণিত হলো- রাজনৈতিক স্বার্থ-সম্পর্কের চেয়ে মানবতা অনেক ওপরে। কমন দুর্যোগ, বৈরি দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে দিবে। মোট কথা করোনা ভাইরাস বিশ্ব সম্পর্ক ও বিশ্বায়নের ধারনাকে একটা নতুন উচ্চতায় ও নতুন ধারণায় উপনীত করবে। করোনা ভাইরাস ভবিষ্যত বিশ্বের জন্য একটা মানব সেবার দৃষ্টান্ত রেখে যাবে।
আজকের করোনা ভাইরাসের বাস্তবতায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে রাষ্ট্রকে সৃজনশীল হতে হবে। এই রোগের প্রকোপ হয়তো একদিন থাকবে না আর মানুষও পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। তাই শুধু মহামারির কথা বলছি না- যে কোনো জরুরি ও আপদকালীন সময় রাষ্ট্র যেনো তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের গতিবিধি নজরদারি করতে পারেন, এখন এই শিক্ষাটা নিতে হবে। শুধু চোর বদমায়েশ ও সন্ত্রাসীদের অবস্থান জানার জন্য তথ্য প্রযুক্তি নয়- অন্যের উপর খবরদারি করার জন্য তথ্য প্রযুক্তি নয়, সরকারকে মিথ্যা ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য তথ্য প্রযুক্তি নয়, বরং দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। একজনের সাথে থাকা মোবাইল ফোনই জানিয়ে দিবে সে কোথায়, কি করছে। যে চীনের উহান সিটিতে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি, তা ছড়াতে পারেনি সে দেশের অন্যত্র- মাত্র কয়েক’শো কিলোমিটারের মধ্যে, তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত গতিতে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ যদি জানতে পারতো এই আপদকালীন সময়ে কতো লোক বিদেশ থেকে এসেছেন এবং তারা এখন কোথায় কীভাবে অবস্থান করছেন, তাহলে সরকারের পক্ষে জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া অনেক সহজ হতো।
ভ্রমন পিপাসুদের বিলাস আর পর্যটন শিল্পের সস্তা আয়োজন করোনা ছড়িয়ে পড়ার একটা বড় কারণ। উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের জন্য কোনো বাঁধা না থাকায় তারা ঘুরে বেড়াতে পারেন ইচ্ছা মতো। বর্তমান বিশ্বে পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে বেশি লোক এই খাতে নিয়জিত। করোনা পরবর্তী বিশ্বে এই খাতে একটা শৃংখলা ও নতুন নিয়ম ফিরে আসবে। সেই সাথে খোলামেলা সীমান্ত আর না-ও থাকতে পারে।
করোনা ভাইরাস পরবর্তী বিশ্বে অর্থনীতির হিসাব নিকাশ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনই অংক মেলাতে বসে গেছেন। মানুষের পেটে খাদ্য দানার অভাব পড়লে কোনো নিয়ম কানুনই কাজে আসে না, তারা বুঝে গেছেন। তারা অনেকে খাদ্য ঘাটতির মহামারিটি সবার আগে দেখছেন। বিশেষ করে শিল্পন্নোত দেশগুলোর জন্য এই বার্তা ভয়াবহ। সেখানে পণ্য উৎপাদন এখন যেমন ব্যাহত তেমনি বাড়ছে বেকারত্ব। অন্যদিকে কৃষি প্রধান দেশগুলোর জন্য ততোটা ভয়াবহ না-ও হতে পারে। কৃষিপ্রধান দেশগুলোর সরকার এখন করোনা ভাইরাস মোকাবেলার পাশাপাশি কৃষির দিকে নজর বাড়িয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তার মধ্যে অন্যতম। এই অঞ্চলের দেশগুলি, উন্নত দেশ থেকে অস্ত্র আমদানি ও সেই সাথে সামরিক বাজেট কাঁটছাঁট করবে আর ভর্তুকি দিবে কৃষিখাতে, এটা পরিষ্কার। বিশেষ করে বাংলাদেশ সরকার এই বিষয়টির দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ইটালিতে যেখানে মাত্র ছয় কোটি মানুষের বসবাস, সেখানে করোনা যেভাবে তান্ডব চালিয়েছে, বিরোরীতে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে এতোদিনে মৃত্যুর মিছিল দেখতে হতো। এটাকে গরিবের জন্য ঈশ্বরের আর্শীবাদ বলা যেতে পারে। এখানকার আবহাওয়া, জলবায়ূ, মানুষের খাদ্যাভ্যাস করোনা ভ্যাকসিনের মতো কাজ করছে। তবে এই নিয়ে আত্মতুষ্টিতে না ভোগে অবশ্যই সাবধানতা ধরে রাখতে হবে।
বিশ্ব যখন সভ্যতার শিখরে, তখন প্রমাণিত হলো, মানুষ অসীম ক্ষমতার অধিকারী নয়। বুঝিয়ে দিলো প্রকৃতির আদালতে উকিল মুক্তারের প্রয়োজন নেই। সে কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে না, কারো প্রতি পক্ষপাত করে না। নতুন করে জানিয়ে দিলেন এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা একজন। তাঁর চরণে আসতেই হবে। কর্মের সঙ্গে ধর্মের যোগসাধন থাকতে হবে। আমরা বিধাতার অপেক্ষায় থাকলাম- কবে হবে এই কৃষ্ণপক্ষের অবসান। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: