পোপ ফ্রান্সিসের সার্বজনীন পত্র “তোমার প্রশংসা হোক, হে প্রভু” (Laudato Si)সারা বিশ্বের জন্য একটা জেগে ওঠার ডাক; এই ডাকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রতিবেশ ও নিজের প্রতিবেশীদের প্রতি কি পরিমান ক্ষতি করে চলেছে। এই মূল্যবান দলিলের মধ্য দিয়ে আমরা অনেক দার্শনিক, ঐশতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সকল সৃষ্টির মধ্যে বহুমুখী সম্পর্ক কি তা বুঝতে পারি, শুধু পরিবেশ-পরিবেশই নয়; বিশেষভাবে মানুষের দায়িত্বহীন আচরণের কারণে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের আর মানুষে মানুষে কিভাবে সর্ম্পকের অবনতি হচ্ছে সে বিষয় আমরা আরও সচেতন হতে পারি। আমরা যারা খ্রিস্টবিশ্বাসী, তাদের জন্য এই দলিলের বিষয়বস্তু সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জ। “এই দলিলের মধ্য দিয়ে আমি সকল মানুষের অভিন্ন বাসগৃহ আমাদের এই ধরিত্রীকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংলাপ শুরু করতে চাই” (তোমার প্রশংসা হোক – ৩)। ১৫ মে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই দলিলে পোপ ফ্রান্সিস শুধু খ্রিস্টবিশ্বাসীদেরই নয়, বরং সকল সদিচ্ছা সম্পন্ন মানুষকেই সম্বোধন করেছেন। বিষয়টি গোটা মানব জাতির জন্য এতই গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, সকল মানুষকেই সচেতন করে তুলতে হবে। এর পূর্বে পোপ ২৩শ যোহন তাঁর সার্বজনীন পত্র “পৃথিবীতে শান্তি” (Pacem in Terris) সার্বজনীন পত্রে এমনটি সম্বোধন করেছিলেন।
এই সংলাপের আসল উদ্দেশ্য হলো এই গ্রহ-ধরিত্রীর ভবিষ্যত কি হবে তা ঠিক করা- এর টিকে থাকার একটা স্থায়ী পরিকল্পনা করা। “আমি এমন একটি সংলাপের প্রয়োজন আনুভব করছি, যে সংলাপে সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারে, কেননা পরিবেশগত যে চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে সেই চ্যালেঞ্জ এবং তার মানবিক কারণসমূহ আমাদের সকলকেই ভাবিয়ে তুলছে এবং আমরা সবাই ভুক্তভোগী” (তোমার প্রশংসা হোক – ১৪)। এটাই হলো এই দলিলের মূল বিষয়বস্তু। কিন্তু যারা খ্রিস্টবিশ্বাসী পোপ ফ্রান্সিস তাদেরকেও এই ব্যাপারে মনপরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন।
পোপ ফ্রান্সিস লিখেছেন, “পরিবেশ বিষয়ক সংকট আমাদের কাছে একটি আন্তরিক মনপরিবর্তনের জোরালো আহ্বানও বটে। এই কথা বলা আবশ্যক যে, কিছু সংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ ও প্রার্থনাশীল খ্রিস্টবিশ্বাসী বাস্তববাদ ও প্রয়োগবাদের পরিবেশ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশকে হাস্যকর বলে থাকেন। অনেকে আবার এই বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন; তাই অভ্যাস পরিবর্তন করার প্রশ্নে তাদের মধ্যে অনীহা দেখা যায় এবং এভাবে তাদের কথা ও কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং তাদের সকলেরই মধ্যে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে মনপরিবর্তন’ অপরিহার্য, যাতে যিশু খ্রিস্টের সাথে তাদের সাক্ষাতের ফলশ্রুতিতে চতুর্দিকের জগতের সাথে তাদের সম্পর্ক সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্মের যত্ন নেওয়া ও তা লালন ক’রে সৎ ও ধার্মিক জীবন যাপন করাই হচ্ছে আমাদের আহ্বানের মূল বিষয়; এটি আমাদের খ্রিস্টীয় জীবনের কোন ঐচ্ছিক বা আনুষঙ্গিক বিষয় নয় (তোমার প্রশংসা হোক – ২১৭)
১ম অধ্যায় : আমাদের অভিন্ন বাসগৃহের অবস্থা
এই পৃথিবী বা ধরিত্রী হলো এমন একটি জায়গা যেখানে আমরা সকলে বসবাস করি। এটা যেন আমাদের সকলের বাসগৃহ- আমাদের অভিন্ন বসত-বাটী। এখানে আমরা সকলেই বসবাস করি- এর সব কিছুই আমাদের সকলের। আমরা যেহেতু এর সব কিছুই ভোগ করি, সেহেতু এই পৃথিবী বা ধরিত্রীকে যত্ন করার দায়িত্বও আমাদের সকলের। বর্তমান পরিস্থিতির উপর ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক অনুধ্যানগুলো ক্লান্তিকর ও অস্পষ্ট মনে হবে যদি না সেগুলো আমাদের বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে নতুন করে বিশ্লেষণ করে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, কারণ যা বর্তমানে ঘটছে তা অনেকাংশেই অভূতপূর্ব । আমরা নিজেরাই এই পৃথিবীটার অংশ বিশেষ। অথচ আমাদের চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি এখানে কেমন দ্রুত সব কিছুই বদলে যাচ্ছে (তো.প্র.হো. – ১৭)।
কিন্তু আমাদের জগতটির “বাস্তবচিত্রের দিকে সংযত দৃষ্টি দিলেই বুঝা যায় যে, প্রায়শ:ই ব্যবসায়িক স্বার্থে ও ভোগবাদের কারণে মানুষের হস্তক্ষেপের মাত্রা পৃথিবীটাকে প্রকৃতপক্ষে আরও কম সম্পদশালী ও অধিকতর অসুন্দর, ক্রমাগত ও অধিকভাবে সীমিত ও ধূসর করে তুলছে, যদিওবা একই সাথে প্রযুক্তিক অগ্রগতি ও ভোগ্যপণের পরিমান সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি হচ্ছে। এভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে, অপ্রতিস্থাপনযোগ্য ও অপুনরুদ্ধারযোগ্য সৌন্দর্যকে আমরা নিজেরা যা-কিছু সৃষ্টি করেছি তা দিয়ে পূরণ করে দেওয়া সম্ভব” ( তো.প্র.হো. -৩৪)।
অথচ আমরা জানি যে, যা ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন, তা আমরা সৃষ্টি করতে পারি না। সুতরাং আমরা যা ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছি, তা একটি অমূল্য উপহার। এই অমূল্য উপহারের যত্ন করা আমাদের সকলেরই একটি পবিত্র দায়িত্ব। এই দান ঈশ্বর দিয়েছেন, আমাদের নিজেদের ও আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কল্যাণের জন্য। আমরা নিজেরা সব ভোগ করে নি:শেষ করে ফেললে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বা আমাদের ভবিষ্যত বংশধরেরা কি পাবে? তারা যখন জানবে যে পৃথিবীর সকল প্রাচুর্য্য ও কল্যাণ আমরা সবই ভোগ করেছি বা ধ্বংস করেছি তখন তারা আমাদের বিষয়ে কি বলবে? আমরা তাদের কাছে কি জবাব দিব?
২য় অধ্যায় : সৃষ্টির মঙ্গলবার্তা
কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বলে থাকেন যে ‘ঈশ্বর’ বলে কিছু নেই। তাদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিত যেমন আছে, তেমনি আছে অশিক্ষিত। তারা বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করে আর মনে করে, মানুষই তার নিজের ‘ঈশ্বর’। ঈশ্বর প্রদত্ত বিজ্ঞান ও জ্ঞান-বুদ্ধির উপর নির্ভর করে, তারা ঈশ্বরকেই অস্বীকার করে থাকে। তাই পোপ ফ্রান্সিস তাঁর পত্রে খ্রিস্টবিশ্বাসীসহ সকল বিশ্বাসীদের এই বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন যে, বিজ্ঞান ও ধর্ম, যেহেতু নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বস্তবতা অনুধাবন করতে পারে, সেহেতু পরস্পরের সঙ্গে একটি গভীর সংলাপে অবতীর্ণ হতে পারে (তো.প্র.হো. – ৬২)।
আমরা তো কেউ ঈশ্বর নই। আমাদের সৃষ্ট হওয়ার আগে থেকেই পৃথিবীর অস্তিত্ব ছিল, যা আমাদের দান বা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। আমাদের খ্রিস্টবিশ্বাসীদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা আছে যে, যেহেতু মানুষকে ঈশ্বর তাঁর নিজের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু মানুষের সব কিছু যথেচ্ছভাবে কর্তৃত্ব ও ভোগ করার অধিকার আছে। এই ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক নয়; বরং কর্তৃত্ব ও অধিকারের সাথে তার দায়িত্ব ও জবাবদিহীতাও আছে; বাইবেলের ভাষায় যাকে বলা যায় ‘চাষ করে ফল ভোগ কর আর বাগানের দেখাশোনা ও যত্ন কর’ (তুলনীয় আদি ২:১৫)। “এখানে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে পারস্পরিক দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্কের ইঙ্গিত নিহিত আছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু যেকোন মানব-গোষ্ঠী বিশ্বের প্রাচুর্য থেকে সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু তার সাথে তার দায়িত্ব হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীটিকে যত্ন ও সংরক্ষণ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এর ফলপ্রসূতা নিশ্চিত করা” ( তো.প্র.হো. ৬৭)।
৩য় অধ্যায় : মানুষই পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারণ
এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানুষই প্রতিবেশ বা পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারণ। বনাঞ্চল কেটে উজার করে, নদ-নদী দখল ও প্রবাহ বন্ধ করে, নির্বিচারে খনিজ পদার্থ উত্তোলন করে, তেল-গ্যাস উত্তোলন ও জ¦ালানী হিসেবে ব্যবহার করে, নানাভাবে অপরিচ্ছন্ন করে, পৃথিবীর স্বাভাবিক কার্বন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে, গ্রীনহাউজ ও ওজোন স্তরের ক্ষতিসাধন করে, ইত্যাদি; নানাভাবে মানব-সমাজ ক্রমেই এই পৃথিবী বা ধরিত্রীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। তাই পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন যে, মানুষের জীবন-যাত্রা ও তার কাজকর্ম অনেক জটিল কুটিল হয়ে পড়েছে তাই আমাদের পারিপার্শ্বিক জগতের বহুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে ও হচ্ছে। সেই জন্যই আমাদের একটু থেমে মানুষের প্রকৌশলগত জ্ঞান, কর্ম দক্ষতা, উৎপাদন ও আয় এবং সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা, ইত্যাদির সম্পর্ক ও উদ্দেশ্য নিয়ে চিন্তা করে দেখা উচিত। আমাদের দেখা উচিত এই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব ও তার কাজের স্থান কোথায় ( তো.প্র.হো. – ১০১)।
এই কারণেই দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বের অনেক সমস্যাই সৃষ্টি হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত অনুসন্ধিৎসা, ঝোঁক বা আকর্ষণ থেকে। পরিণাম কি হবে তা চিন্তা না করেই বা সচেতন না হয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণা বা তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে হিতে বিপরিত হয়ে যাচ্ছে। তাই এই ধরণের কাজের জন্য একটি দিকনির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ মানুষের সকল কাজেরই আবশ্যকীয় বিষয় হলো মানবীয় নৈতিকতা ও মানব কল্যাণ। পোপের বক্তব্য হলো, “আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য ভাল-মন্দ বিচারের ঊর্ধ্বে নয়, কেননা তারা এমন একটি কাঠামো তৈরি করে, যেখানে কতিপয় ক্ষমতাধর দলের স্বার্থ রক্ষার জন্যই জীবনমান নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবহৃত হয়। আপাতদৃষ্টিতে সিদ্ধান্তগুলো সম্পূর্ণরূপে যন্ত্রপাতি বিষয়ক বলে মনে হলেও আসলে তা হচ্ছে- আমরা কি ধরণের সমাজ বিনির্মান করতে চাই সে সম্পর্কিত” (তো.প্র.হো. – ১০৭)। সুতরাং আমরা যে কাজ করি বা যেভাবে তা করি, তার উদ্দেশ্য কিন্তু ভবিষ্যতের সমাজ ও প্রজন্মের কল্যাণ সাধন করা- শুধু বর্তমানের প্রয়োজন মেটানো বা ফলভোগ করাই নয়; আর তা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের জন্যও নয়, তা হতে হবে সর্বসাধারণের কল্যাণের জন্য।
৪র্থ অধ্যায় : সমন্বিত প্রতিবেশ বা পরিবেশ
প্রতিবেশ বা প্রাকৃতিক পরিবেশ শুধু একটি বিচ্ছন্ন বিষয় নয়, এর মধ্যে অনেক কিছুই জড়িত আছে। এর মধ্যে আছে প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক বিষয়। এখানে শুধু মানুষের সুবিধার কথা চিন্তা করলে হবে না; বরং ভাবতে হবে বনের জীব-জন্তু, আকাশের পাখী-পঙ্গপাল, বাতাসে উড়ে বেড়ানো মশা-মাছির মত প্রাণীকুল, ভূমির পোকা-মাকড় ও সরিসৃপ, নদী ও জলাভূমির মাছ, সমুদ্রের সকল জীব, ইত্যাদির কল্যাণের কথাও। ঈশ্বর তো এদেরও সৃষ্টি করেছেন, প্রকৃতিতে এদেরও একটি করে ভুমিকা দেওয়া আছে। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে মানুষের কারণেই অনেক প্রাণী ও জীব-জন্তু পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
সেইজন্য পোপ ফ্রান্সিস তাঁর পত্রে লিখেছেন, “সবকিছুই যেহেতু পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্রে আবদ্ধ এবং যেহেতু বর্তমান যুগে সমস্যাগুলো এমন একটি দৃষ্টিবোধের দাবি জানায়- যা বৈশ্বিক সংকটের সকল দিক বিবেচনার মধ্যে আনতে সক্ষম, সেহেতু আমি সমন্বিত পরিবেশ সংরক্ষণের কিছু উপাদান নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব করছি, যার মধ্যে এর মানবিক ও সামাজিক দিকসমূহ স্পষ্টত:ই বিশেষ গুরুত্ব পায়” (তো.প্র.হো. – ১৩৭)। “জীবজগৎ ও মানব সমাজ টিকে থাকার জন্য কী কী থাকা প্রয়োজন সেই বিষয় অনুধ্যান ও বিতর্ক থাকাটা অপরিহার্য। তাছাড়া উন্নয়ন, উৎপাদন ও খাদনের কোন কোন মডেল বা আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন করার জন্য সততার থাকার প্রয়োজন। কারণ, সবকিছুই যে পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ তা বলা নিষ্প্রয়োজন” (তো.প্র.হো. – ১৩৮)।
আমাদের এই বিশ্বে এমন একটি মানবিকতার প্রয়োজন যা অর্থনৈতিক জ্ঞানসহ সকল ধরণের জ্ঞানকে একত্রে সন্নিবেশিত করতে পারবে এবং শুধু মানুষের নয় বরং সকল সৃষ্টির সেবা নিশ্চিত করতে পারবে। তাই “জরুরি ভিত্তিতে আমাদের এমন এক মানবতাবাদের প্রয়োজন যা অধিকতর সমন্বিত ও সমন্বয় সাধনকারি অর্থনীতিসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র একযোগে কাজ করতে পারে। বর্তমানকালে মানবসত্তা, পরিবার, কর্মসংশ্লিষ্ট ও শহুরে বাস্তবতা বিশ্লেষণ করা থেকে, এমনকি ব্যক্তি-মানুষে কিভাবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয় যার ফলশ্রুতিতে তারা অপরের সাথে বা পরিবেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে তা থেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়” (তো.প্র.হো. – ১৪১)।
৫ম অধ্যায় : কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচীর ধারা
মানুষের অপরিনামদর্শী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও কর্মকান্ডের ফলে পৃথিবীর পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করা সহজ হবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও আমাদের যেটুকু সময় আছে সেই সময়ের মধ্যেই আমাদের একটা কিছু করতে হবে- যেন এই পৃথিবী বা ধরিত্রীকে বাঁচাতে পারি। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, “এ পর্যন্ত আমি বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি, আর সেই সাথে যে-গ্রহটিতে আমরা বসবাস করছি সেখানে যে ফাটল ধরেছে তা দেখিয়ে দেয়ার এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের একান্ত মানবিক কারণগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। এই বাস্তবতা ধ্যান করার মধ্য দিয়েই আমরা যদিও ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় লক্ষ্য পরিবর্তনের অন্যান্য কর্মসূচী গ্রহণের দিকনির্দেশনা পেয়ে গেছি, তথাপি বর্তমানে আমরা যে আত্মঘাতী ঘুর্ণাবর্তে পড়ে আছি, সংলাপের মাধ্যমে তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রধান প্রধান নক্শা-চিত্র তৈরি করতে চেষ্টা করব” (তো.প্র.হো. – ১৬৩)।
পৃথিবী-গ্রহটি যদি আমাদের সকলের অভিন্ন বাসগৃহ হয় তাহলে এই আসন্ন বিপর্যয় থেকে এই গ্রহটিকে বাচাঁতে আমাদের সকলকেই সমানভাবে উদ্যোগী ও দায়িত্বশীল হতে হবে। এখানে আমাদের সকলের মধ্যে সংলাপ ও সংহতি গড়ে তুলতে হবে, উদ্দেশ্য একটাই আর তা হলো, আমাদের অভিন্ন এই বাসগৃহকে রক্ষা করা। “আত্মনির্ভরশীলতা আমাদেরকে অভিন্ন পরিকল্পনাসহ একটিমাত্র বিশ্ব হিসেবে চিন্তা করতে বাধ্য করে। তথাপি যে সৃজনশীল চিন্তা প্রযুক্তিতে বিপুল অগ্রগতি এনে দিয়েছে সেই একই চিন্তা-চেতনাই আবার জগৎব্যাপী গুরুতর পরিবেশ-সংক্রান্ত ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ফলপ্রসূ উপায় আবিষ্কারে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। একতরফাভাবে কোন একটি দেশের পক্ষে যে এই প্রকট সমস্যাটির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, সেখানে একটি বৈশ্বিক মতানৈক্য পৌঁছানো অপরিহার্য” (তো.প্র.হো.- ১৬৪)। তাই আমাদের প্রত্যাশা হলো যেন সকল দেশের সকল মানুষ একযোগে ও সমন্বিতভাবে আমাদের সকলের এই অভিন্ন আবাসস্থল পৃথিবীটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে। না হলে প্রকৃতি যখন আঘাত হানবে, পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত হবে, তখন কোন দেশের বা কোন জাতির মানুষই তা থেকে রেহাই পাবে না।
৬ষ্ঠ অধ্যায় : প্রতিবেশ বা পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা
পৃথিবীর এই বিপর্যয় বা অশনিসংকেতপূর্ণ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কি হবে তা সকলকেই ভেবে দেখতে হবে। আমাদের আর সময় নেই, এখনই উদ্ধার কাজে নামতে হবে। এর জন্য যথাযথ কর্মপন্থা ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এমনও হতে পারে যে আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায়ও কিছু বা আমূল পরিবর্তন আনতে হবে; আমাদের জীবন যাপন পদ্ধতিতে অভিযোজন আনতে হবে। সেই জন্য পোপ মহোদয় বলেছেন, “অনেক কিছুরই গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন হওয়ার প্রয়োজন আছে, কিন্তু সর্বোপরি আমাদেরই অর্থাৎ মানবকুলেই পরিবর্তন হওয়াটা জরুরি। কেননা আমাদের অভিন্ন উৎপত্তি সম্বন্ধে, আমাদের পরস্পরিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে এবং ভবিতব্য সবার সাথে সহভাগিতা করার দায়িত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান ও সচেতনতার অভাব আছে। এই মৌলিক সচেতনতা উপস্থিত থাকলে জীবন সম্পর্কে নতুন প্রত্যয়, মনোভাব ও অবস্থার অগ্রগতি সম্ভব হতো। কেননা আমাদের সামনে সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও শিক্ষা বিষয়ক যেসব চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান- তা আমাদের কাছে নবায়নের সুদীর্ঘ পথ নির্দেশ করবে” (তো.প্র.হো. – ২০২)। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের জীবনযাত্রা ও সমাজ ব্যবস্থায় পবির্তন না আনলে পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে আবহাওয়ার ব্যপক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে- পৃথিবীর অনেক জায়গা এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়ে গিয়েছে, নদ-নদী বন্ধ হয়েছে বা গতি হারিয়েছে, আবহাওয়াতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ প্রচন্ড ঘুর্ণিঝর, ভূমিকম্প, সুনামি, ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে- আর মানুষের জীবন ও সম্পদ ধ্বংসের মুখে পরছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একটি গভীর সম্পর্ক আছে, তাই মানুষের যে কোন কাজ ও আচরণ প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলে। মানুষ প্রকৃতিকে ভালবাসলে বা যত্ন করলে, প্রকৃতিও মানুষকে ভালবেসে রক্ষা করে; আবার যখন মানুষ প্রকৃতিকে আঘাত করে তখন প্রকৃতিও মানুষের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে প্রচন্ড আঘাত করে। “যে কোন প্রসঙ্গে আসিসির সাধু ফ্রান্সিস-এর কথা মনে হলেই আমরা বুঝতে পারি যে, সৃষ্টির সাথে সুন্দর ও সুষম সম্পর্ক থাকাটাই সার্বিক ব্যক্তিগত মনপরিবর্তনের একটি দিক আছে যেখানে থাকে আমাদের ভুলভ্রান্তি, পাপ, অপরাধ ও ব্যর্থতা স্বীকার করা এবং সেখানে থাকে অকৃত্রিম অনুতাপ ও মনপরিবর্তনের সদিচ্ছা” (তো.প্র.হো. – ২১৮)।
এখন তাহলে আমরা কি করব? প্রকৃতিতে নেতিবাচক পরিবর্তন, আবহাওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া, প্রতিবেশ বা পরিবেশে বিপর্যয়, ইত্যাদি দেখে আমরা ভীত হব, আক্ষেপ করব, আর নিশ্চুপ বসে ধ্বংসের অপেক্ষা করব? নাকি সচেতন হব, প্রকৃতির এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বা আবহাওয়ার অস্বাভাবিক নেতিবাচক পরিবর্তনের জন্য নিজেদের দায় স্বীকার করে তা সংশোধন করার প্রয়াস নিব? সিদ্ধান্ত এখন আমাদেরই নিতে হবে এবং তা এখনই।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিস, বাংলাদেশ।
তোমার প্রশংসা হোক: প্রকৃতি ও পরিবেশ: আমাদের করণীয়
Please follow and like us: