ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
প্রাচীন রোম নগরী ও গ্রীস দেশে মা ও মাতৃত্ব দিবস পালন করার রীতি প্রচলিত ছিল। একটি বিশেষ দিনে তারা দেবীদের দেবীমাতা রেহেয়া ও সাইবেল দেবীর পূজা করতেন। রোমীয়রা আবার আলাদাভাবে হিলারিয়া দেবী মাতার পূজা করতেন। তবে এমন নজিরও আছে যে, আধুনিক দিনের শুরুতে খ্রিস্টানরা মা দিবস পালন করতেন- যাকে বলা হত ‘মায়ের গির্জা রবিবার।’ অর্থাৎ, কোন অঞ্চলের প্রথম এবং প্রধান গির্জার স্মরণে পলিত হত মা গির্জা রবিবার। এক সময় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে তপস্যাকালের ৪র্থ রোববার মা গির্জা দিবস পালিত হত। সেদিন খ্রিস্টভক্তরা মাতৃমন্ডলিতে গিয়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন।
জুলিয়া ওয়ার্ড হোয়ে নামে একজন নারী ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ‘মা দিবসের ঘোষণা’ ধারণা নিয়ে- বিশ্বে শান্তি স্থাপনের জন্য নারীদের আহ্বান জানান। পরে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে হোয়ে প্রচারনা চালান- প্রতিবছর দুই জুন দিবসটি পালন করার জন্য। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মিসিগান অঙ্গরাজ্যের জুলিয়েট ক্যালহোন ব্ল্যাকলি নামে একজন নারীবাদী স্থানীয়ভাবে মা দিবস পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরে তার সাথে আরও কয়েকজন যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
উনবিংশ শতাব্দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের ঠিক পূর্বে, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার এ্যান রেভেস জার্ভিস নামে এক ভদ্রমহিলা ‘মা দিবস কর্ম সমিতি’ নামে একটি সংঘ গঠন করেন। মূল লক্ষ্য ছিল- নারীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, নিজ নিজ পরিবারে কীভাবে সন্তানদের প্রতিপালন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের সময় নানা বর্ণের মানুষের মধ্যে মতভেদ থাকা সত্বেও মা কর্ম সমিতির প্রতি তাদের আস্থা ছিল। বিষয়টি লক্ষ্য করে, পাশাপাশি, ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে এ্যান জার্ভিস ‘মা বন্ধু দিবস’ সংঘ স্থাপন করেন- যেখানে গৃহযুদ্ধরত উভয় পক্ষের মায়েরা সমবেত হতেন পুর্নমিলন স্থাপনের প্রচেষ্টা নিয়ে।
এ্যান রেভেস জার্ভিস ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করার পর তার মেয়ে আন্না জার্ভিস ব্যাপকভাবে মা দিবস পালনের দায়িত্ব হাতে নেন। তার চেষ্টায় আজকের যে মা দিবসের কার্যক্রম সেটা শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে। সে বছর আন্না জার্ভিস তার মা এ্যান জার্ভিসের আত্মার স্মরণে মে মাসে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার সেন্ট এন্ডু ম্যাথডিস্ট চার্চে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেই স্মরণ দিবস আয়োজনের মধ্যদিয়ে তিনি মা-দের দায়িত্ব সর্ম্পকে সজাক করে তোলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে এই চার্চেই নির্মাণ করা হয়েছে আর্ন্তজাতিক মা দিবসের স্মৃতিস্তম্ভ। মায়ের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য আন্না জার্ভিস তার উদ্যোগ চালিয়ে যান এবং সেই সাথে দিনটির স্বীকৃতি এবং সরকারি ছুটির দাবি জানান। তার প্রচারণার মূল বিষয় ছিল, “মা এমন ব্যক্তি, যে তোমার জন্য যা করেছে, আর কেউ তা করেনি।” মার্কিন কংগ্রেস ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তাদের সভায়, মা দিবসে সরকারি ছুটির আবেদন বাতিল করে তামাশার সুরে বলে, যদি মা দিবস পালন করতে হয়- তবে শাশুরি দিবসও পালন করতে হবে। তারপর সময় বেশি গড়ায়নি, আন্না জার্ভিসের চেষ্টায় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে মা দিবস পালন শুরু হয় এবং ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এই দিবসে স্থানীয়ভাবে ছুটিও ঘোষণা করা হয়। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আমেরিকার প্রায় সব রাজ্যে, শহরে এবং চার্চে মা দিবস বাৎসরিক ছুটি হিসেবে পালন শুরু হয়। পরে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন তার এক ঘোষণায় প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার সরকারি ছুটি হিসেবে মা দিবস পালনের বিলে সাক্ষরদান করেন।
এ্যান জার্ভিসের মেয়ে আন্না জার্ভিস তার মায়ের মা দিবস পালনের আন্দোলন নিয়ে সফলতা লাভ করলেও, মা দিবসের বাণিজ্যকরণ নিয়ে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন এবং মা দিবস বয়কট করেন। তাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল- পরিবারে, সমাজে ও গৃহযুদ্ধে মা-দের অবদানের জন্য ঘরে ঘরে মাকে তাদের সম্মান জানান। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল হলমার্কের মত বড় বড় কিছু কোম্পানি মা দিবস উদ্যাপনের জন্য বাজার খুলে বসেছে। কোম্পানিগুলো মা-দের সম্মানীত করার জন্য চমকপ্রদ সব গিফ্ট আইটেম দোকানে সাজিয়ে রাখল। এইসব কান্ড দেখে আন্না জার্ভিস মা দিবস প্রত্যাখান ক’রে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার হুমকি দেন। মিস আন্না জার্ভিস আজীবন অবিবাহিতা ছিলেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মা দিবস বাণিজ্যকরণের কারণে মা দিবস পালন প্রত্যাখান করে মার্কিন যুক্তাষ্ট্রের ছুটির পঞ্জিকা থেকে দিন তারিখটা বাতিল করার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। কিন্তু বাস্তবে পশ্চিমা বিশ্ব শুধু নয়, আজকের দিনে গোটা পৃথিবীতেই দিনটি ঘিরে চলছে বড় ধরণের বাণিজ্যকরণ। পারতপক্ষে, সবাই আজকাল বাজার থেকে গিফ্ট কার্ড, গিফ্ট বক্স, চকোলেট বা অন্যকিছু উপহার এনে মাকে খুশি করে। তাতে করে মা-দের প্রতি সন্তানদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অবদান কতটুকু তা পরিমাপ সম্ভব নয়। আমার মনে হয়, সন্তানের হাতে আঁকা একটা উপহার কার্ড মায়ের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসার প্রমাণ।
বিশ্বের কিছু দেশে নিজেদের সুবিধা মত দিনে মা দিবস পালিত হলেও অধিকাংশ দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। উদ্দেশ্য হলো- পরিবারে মা-দের ভূমিকার স্বীকৃতিদান। মা শুধু পরিবারে একজন ব্যক্তি নন, পরিবারে ২৪ ঘন্টাব্যাপী একজন দ্বাররক্ষক। মা পরিবারে অনেক সময়, অনেক কিছু না দেখার ভান করলেও, আসলে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে কোন কিছু আসে না এবং যায়ও না। সন্তানদের প্রথম দাবি/ আবদার মায়ের কাছে। সেই হিসেবে মা পরিবারে মধ্যমণি। তিনি সন্তানের দাবিগুলো যথাস্থানে উত্থাপন করেন। আধুনিক দিনের মায়েরা যেমন একদিকে বাইর জগতটা সমালান, তেমনি ভিতরটাও।
বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন কোন না কোন দিবস পালিত হচ্ছে। যেগুলোর মধ্যে অনেক আছে অর্থহীন দিবস, যেগুলোর কোন কল্যাণ চোখে পড়ে না। যেগুলোর ব্যাখ্যা অনেকের জানা নেই। আর ৩৫৬ দিনের মধ্যে একটি দিন বরাদ্দ মা-দের জন্য- যিনি ২৪ ঘন্টা শুধু নয় ৩৫৬ দিনেরই পরিবারে দ্বাররক্ষক। তাদের কাজের কোন সীমা নেই, কোন গন্ডি নেই। আজকের এই করোনা ভাইরাস সংকটকালে মায়েরা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত তাদের সন্তানদের নিয়ে। আর করোনা যোদ্ধা হিসেবে যারা ফ্রন্টলাইনে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন- তাদের বেশিরভাগ হলেন নারী। আসুন আমরা মা মারীয়ার মধ্যস্থতায় বিশ্ব মা-দের জন্য প্রার্থনা করি, তাদের অবদানের কথা স্বীকার করি এবং তাদের ভালোবাসতে শিখি। ঈশ্বর মা-দের আর্শীবাদ করুন। পাঠকদের প্রতি রইল শুভেচ্ছা।
১০ মে আর্ন্তজাতিক মা দিবস ও পূর্ব ইতিহাস
Please follow and like us: