‘তোমার প্রশংসা হোক’ সপ্তাহ ( মে ১৬-২২, ২০২০)
যখন ঈশ্ব র বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, তিনি দেখলেন সব কিছুই সুন্দর হয়েছে এবং মানুষকে এই সব কিছু দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিল। সেই দায়িত্ব আমরা কিভাবে পালন করেছি? আমরা সেই দেখাশোনার কাজ কীভাবে করেছি বা তা আরও কীভাবে ভাল করতে পারি? আসলে আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি যে সেই দায়িত্ব ভালমত বা সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। এর প্রমান হল যে পৃথিবীসহ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের পরিবেশের বা প্রতিবেশের অরিজিনালিটি বা শুরুর অবস্থাটা ও আদিরূপ অনেকাংশেই বদলে গেছে। এই আদিরূপটা যে বদলে গেছে, তা তো নিজে নিজে বদলে যায়নি। এর জন্য কে দায়ী ? নিরপেক্ষভাবে এর উত্তর দিতে গেলে মানুষ হিসেবে আমরা আমাদের দায় কি এড়াতে পারি? শুধু তাই নয়, পৃথিবীর পরিবেশের মধ্যে এখন অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে- সারা বিশে^র মানুষেরই সমস্যা হচ্ছে। পৃথিবী পৃষ্ঠের যে উষ্ণতা বাড়ছে, তার ফলে যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে তার জন্য আসলে আমরাই দায়ী। আমাদের তো এখনই নিজেদের দায় সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হতে হবে।
পোপ ফ্রান্সিসের সর্বজনীন পত্র “তোমার প্রশংসা হোক” রচনায় আহ্বান জানান যেন আমরা যেখানে বসবাস করি, সকলের সেই বসতবাড়ি, এই পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হই। এর মূল শিক্ষা হলো পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ, তবে সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণের কারণসমূহ ও এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আমাদের বর্তমান সমস্যাগুলোও এখানে উঠে এসেছে; তাছাড়া বর্তমান বিশে^ যে অর্থনৈতিক কাঠামোগুলো গড়ে উঠেছে সেইগুলোর ভুলভ্রান্তি ও হঠকারী দিকগুলোও সুন্দরভাবে আলোচনা করা হয়েছে, কারণ এই কাঠামোগুলো দরিদ্রদের আরও দরিদ্র করেছে আর ধনীদের করেছে আরও ধনী। বর্তমানের তথাকথিত সভ্য জগতে যে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা হঠকারী ও শোষণমূলক। এই গ্রহটি হলো সকল মানব পরিবারের বা সকল জাতিগোষ্ঠির বসতবাড়ি। এই বাড়িতে সকল দেশের সকল জাতিগোষ্ঠীর সকলেই সমান, আর সমান অধিকার রাখে। তবে আমাদের এই মানব পরিবারের বর্তমান অবস্থা কি তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আহারের সময় পরিবারের বা বাড়ির সকলেই কি সমান খাবার পাচ্ছে? এই ক্ষেত্রে আমরা কি উন্নতি করতে পারি?
এই পৃথিবীর যেসব বিষয় আমাদের এক করে তোলে, আমাদের সকলের মঙ্গল বয়ে আনে, আমাদের সকলকে যত্ন করে ও রক্ষা করে- সেইসব বিষয়গুলি আমাদের সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবী নামক গ্রহটি আমাদের সেই সব কিছুই দেয়- কোন বৈষম্য না করেই, সেই জন্যই এই গ্রহটি আমাদের সকলের প্রিয় আবাস গৃহ। এই গৃহটিকে আমাদের সকলেরই যে ভালবাসা ও যত্ন করা উচিত সেই কথাটিই পোপ ফ্রান্সিস আমাদের সকলকে এই পত্রের মাধ্যমে স্মরণ ক’রে দিয়েছেন। এই অতি মূল্যবান দলিলটি আবহাওয়া পরিবর্তন সম্পর্কিত সকল বিষয় বুঝতে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের যত্ন করার তাগিদ অনুভব করতে পারি; তাছাড়া পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার পরিকল্পনা করতে ও প্রস্তুতি নিতে আমাদের সাহায্য করবে।
আমাদের পৃথিবীর বর্তমান অপরিচ্ছন্ন, ভঙ্গুর ও ধূসর অবস্থার জন্য আমাদের অবশ্যই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হতে হবে। পৃথিবীর পরিচ্ছন্ন ও সবুজ অবস্থাটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি, যা একদিন বিশ^ময় আমাদের সকলকে কত আনন্দ দিত। এখন আমাদের সেই নষ্টালজিয়া বা সেই সুন্দর ও নিরাপদ অতীতে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা জাগে। এখন যে অতিরিক্ত উষ্ণতার কারণে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, পর্বতের এবং উত্তর মেরুতে জমে থাকা বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, প্রায়ই ঘনঘন প্রচন্ড বেগে ঘুর্ণিঝড় হয়ে সব কিছু দুমড়ে মুচড়ে ফেলে, খরা ও অকাল বন্যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আসে, নদীভাঙ্গনে ফসলের জমি ও বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ভূমিকম্প ও সুনামি হয়ে শহর বন্দর ধ্বংস করে মানুষকে নিঃশ্ব করে ফেলে, গাছপালা ও বনাঞ্চল নিঃশেষ হয়ে পৃথিবীর মরুময় হচ্ছে, নদীনালা ও জলাভূমি ভরাট হয়ে সকল জলপ্রবাহ বন্ধ ও নোংরা অপরিচ্ছন্ন হয়ে পরছে, এইভাবে পৃথিবী তার আদিরূপ হারিয়ে ফেলেছে। এখন আমাদের আর ভাল লাগে না।
আমাদের ভাবতে হবে কেন এমন হল – পরিবেশ দূষণ ও আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ কি? পোপ ফ্রান্সিস স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, পরিবেশ দূষণ বা আবহাওয়া পরিবর্তনের বড় কারণ মানুষ নিজেই। মানুষ অপরিনামদর্শী ও স্বার্থপরের মত পৃথিবীর সকল প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগ করে উজার করেছে, এখন তার প্রতিফল ভোগ করছে। দেশে দেশে মানুষ গাছপালা ও বনভূমি কেটে উজার করেছে, বনের জীবজন্তু ও পশু-পাখি সব মেরে উজার করেছে, ভূ-পৃষ্ঠের ও ভূগর্ভস্থ সকল সম্পদ উজার করেছে, সকল প্রকার খনিজ পদার্থ উত্তোলন করে চলেছে, ফসিল তৈলের জ্বালানি পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে, কলকারখানার ধোঁয়া আকাশে বাতাসে কার্বন বাড়িয়ে ওজোন স্তর ধ্বংস করে উষ্ণতা বাড়িয়েছে আর সেখানকার বর্জ্য নদী ও জলাভূমি নোংরা করে সকল মাছসহ সকল জীব মেরে ফেলছে, মানুষ বিষ দিয়ে জমি থেকে সকল পোকামাকড় বিনা কারণে মেরে সাবার করে দিচ্ছে, বস্তুবাদী ও ভোগবাদী মানুষের ভোগের নেশা মিটাতে গিয়ে যা প্রয়োজন আর যা প্রয়োজন নাই বাছবিচারহীনভাবে সকল কিছুই হজম করে যাচ্ছে, আরও কত কিছু! এমনকি নিজেদের ভবিতব্য- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও কোন কিছু জমা না রেখে সব কিছুই ভোগ ও উপভোগ করে চলেছে। এখন সময় এসেছে এর প্রতিফল ভোগ করার।
এখনও মানুষের বা মানব জাতির কোন হুস হচ্ছে না। পোপ ফ্রান্সিস আমাদের হৃদয়ের একটি গভীর আকাঙ্খার কথা তুলে ধরেছেন তার পত্রে – আমরা আবার সুন্দর পৃথিবী চাই যেখানে আমরা নিরাপদে, নির্ভয়ে, আনন্দে ও স্বাচ্ছন্দে হেসে খেলে বেড়াব। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমরা যদি আমাদের এই গ্রহের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাল করতে চাই, আর যদি জলবায়ু বা আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রোধ করতে চাই সেটা তত সহজ হবে না। কিন্তু আমাদের বসে থাকলে চলবে না। আমাদের কিছু করতেই হবে। তবে এর জন্য প্রথমেই চাই আমাদের অন্তর মনের পরিবর্তন। আমাদের ভোগবাদী, স্বার্থপর ও অপরিনামদর্শী আচরণ ত্যাগ করার মনোভাব তৈরি করতে হবে। তা না হলে আমাদের বাহ্যিক কোন পরিবর্তন বা কার্যক্রম কোন ফল দিবে না। তারপর আমরা এই কাজ একা করতে পারব না বা একা করা সম্ভবও নয়। সকলে মিলে পরিকল্পনা করতে হবে ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। ধনী-গরীব, সমাজের উচু-নীচু শ্রেণি, জাত-পাতের কোন বিভেদ মানা যাবে না। পৃথিবী যেহেতু সবার, সবাইকেই জড়িত হতে ও চেষ্টা করতে হবে পৃথিবীকে বাঁচাতে। পৃথিবী বাঁচলে সকলেই বাঁচবে, আর পৃথিবী ধ্বংস হলে কেউ বাঁচতে পারবে না বা রক্ষা পাবে না। পৃথিবীর বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কাউকে ক্ষমা করবে না – ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই দিবে না।
আমরা ইতিমধ্যেই পৃথিবীকে এই ভয়াবহ ভঙ্গুর ও দূরাবস্থার মধ্যে পতিত হওয়ার অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। সেইসঙ্গে দূরাবস্থায় ফেলে দিচ্ছে পৃথিবীর মানুষকেও। তবে এতে দরিদ্র ও অসহায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই বেশি ভুক্তভোগী হয়। বর্তমান জগতের মনোভাব হলো সহজে, আরাম আয়েসে, কম কাজ করে বেশি উৎপাদন ও লাভ করা, পুরাতনটা ফেলে দিয়ে নতুন নতুন জিনিস ব্যবহার করা, আরও যত বেশি ভোগ্যপণ্য বা বিলাসী দ্রব্য আয়ত্ব করা যায় সেই চেষ্টা করা। এই সবকিছু বা অন্য কারণে যত বেশি বা যত তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া যায় সেই চেষ্ট করা, ইত্যাদি। বস্তুবাদ ও ভোগবাদ মানব সমাজে এইভাবেই মাথা চাড়া দেয় বা স্থায়ী হয়ে যায়। এর ফলে মানুষের মধ্যে আসে লোভ, অশুভ প্রতিযোগিতা, প্রতারণা, শোষণ, ইত্যাদি। তাই মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সমসাথী-সমব্যথী, সহযোগী-সহভাগী, ভ্রাতৃত্ব ও মিলনের বন্ধু না হয়ে, হিংসা-বিদ্বেষের শত্রুতে পরিণত হয়। তাই দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের আগে মানুষের স্বভাবগত ও আচরণগত বিপর্যয় হয়েছ। মানুষই পরিবেশ ও আবহাওয়া বিপর্যয়ের আসল কারণ। পরিবেশ ঠিক করতে হলে, আগে মানুষকেই ঠিক হতে হবে- তার নৈতিকতা ঠিক করতে হবে। কি তারা করতে পারবে আর কি তারা করতে পারবে না, সেই নৈতিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে- বিবেকের বাণী শুনে চলতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের সুবিধার জন্য- সকল যুগের ও সকল দেশের, সকল মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনার জন্য। কোনক্রমেই তা ধ্বংস ও বিপর্যয়ের পথে চলার জন্য নয়্।
তাই আমাদের সকলকে বুঝতে হবে যে, পৃথিবীর সবকিছু মানুষের জন্য হলেও তার দায়িত্বজ্ঞানহীন হওয়ার কোন কারণ নেই। ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি ক’রে মানুষকেই তার দেখাশোনা করার দায়িত্ব দিয়েছেন ও ভোগ-উপভোগ করতে বলেছেন, তা তিনি দায়িত্বশীলতার সঙ্গেই করতে বলেছেন। ঈশ্বর পৃথিবী ও এর সবকিছু সকল দেশের, সকল জাতির, সকল কালের, সকল শ্রেনির, মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন। মানুষ পৃথিবীর সম্পদ যেভাবে ভোগ-উপভোগ করছে, সেই সম্পদ নি:শ্বেষ হয়ে যাচ্ছে- আনাগত ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য কোন কিছুই সঞ্চিত থাকবে বলে মনে হয় না। আর যদি তা-ই হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না- ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন না। তাই আমাদের দায়িত্ববান হতে হবে, দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। আমরা সকলে যেমন আমাদের নিজেদের উন্নয়ন চাই, আমাদের বাড়িঘর সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে সাজাতে চাই, তেমনি এই ধরিত্রীকেও একইভাবে উন্নত করতে হবে, সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে সাজাতে হবে, কারণ এই সুন্দর ধরণী- সবুজ পৃথিবী- আমাদের সকলের বাসগৃহ বা বসতবাটী। সুতরাং আমাদের গৃহ বা বসতবাটীকে আমরা রাখব পরিচ্ছন্ন আর সাজাবো সবুজ সাজে।
আমরা এর জন্য কি কার্যক্রম হাতে নিব- তা একত্রে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সকলেই আমরা একই কাজ করব না, একেকজন আমরা একেক কাজ করব। কিন্তু তার নেতৃত্ব কে দিবে? এই নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক নেতৃবর্গ। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের সচেতন ও নিষ্ঠাবান নেতার দরকার, যে হতে পারে সত্যিকারের আদর্শ। আমাদের মুখের নেতৃত্বের দরকার নেই; আমাদের দরকার আদর্শ। আমাদের সেইরূপ নেতা তৈরি করতে হবে। যদি আমরা মনে করি আমাদের পৃথিবীকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করতে হবে তাহলে আমাদেরই হতে হবে সেই নেতা, কারো জন্যে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের পিতামাতাদের হতে হবে তাদের সন্তানদের আদর্শ। পৃথিবীকে ভালবাসুন বাবা-মায়ের মত ও যত্ন করুন সন্তানের মত। অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে রচনা করুন এক শক্ত সেতুবন্ধন আর টেকসই ও ছন্দময় পরম্পরা। আমাদের সন্তানেরা আমাদের কাছ থেকেই শিখবে এক ভালবাসার সভ্যতা ও স্নেহ-যত্নের সংস্কৃতি যা অনাগত দিনের পথ ধরে চলবে। তারাই হয়ে উঠবে এমন সমাজ নেতা যারা সেবা করবে মানুষকে, সমাজকে, দেশকে আর বেশি করে ভালবাসবে পৃথিবী- প্রকৃতিকে; আর রক্ষা করবে সবুজে ভরা এই সুন্দর পৃথিবীকে। আর সেই সঙ্গে তারা প্রশংসা গান গাইবে সৃষ্টিকর্তা ঈশ^রের- যিনি উপহার হিসেবে দিয়েছেন আমাদের এই ধরিত্রী মাতাকে।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিস, বাংলাদেশ।

Please follow and like us: