ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
ভুমিকাঃ বিশ্ব রোমান ক্যাথলিক চার্চ, প্রতি বছর সাধারণকালের ৩৩ রবিবার বিশ্ব দরিদ্র দিবস পালন করে আসছে। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সংহতি প্রকাশ এবং তাদের প্রতি ধনী সমাজের হাত প্রসারিত করতে অনুপ্রাণীত করা। পোপ ফ্রান্সিস ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর তাঁর এক প্রৈরিতিক পত্রে- প্রতি বছর সাধারণকালের ৩৩ রবিবার বিশ্ব দরিদ্র দিবস পালনের ঘোণষা দেন। ফলে গত ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর একটা বিশেষ মূল ভাব নিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে এবং সে বছর মূলভাব ছিলো, “আসুন ভালোবাসি, শুধু কথা দিয়ে নয়, বরং কাজ দিয়ে।” ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে দিবসটি পালিত হয়েছে ১৮ নভেম্বর এবং মূলভাব ছিলো, “এই গরিব কাঁদছেন এবং প্রভু শুনছেন।” গত বছর বিশ্ব গরিব দিবস পালিত হয়েছে ১৭ নভেম্বর আর বিষয় ছিলো, “গরিবের আশা কখনো ধ্বংস হবে না।” আর এই বছর দিবসটি পালিত হবে ১৫ নভেম্বর এবং বিষয় হলো, “গরিবের প্রতি তোমার হাত প্রসারিত করো।” বাইবেলের প্রাচীন নিয়মের বেন সিরাকের রচনাবলীর ৪ অধ্যায় থেকে এই বিষয়টি বাছাই করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে বেন সিরাক, গরিবের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও ধনীর কর্তব্য সর্ম্পকে কথা বলেছেন- যার সারমর্ম দাঁড়ায়, “অভাবীকে তার প্রত্যাশিত দান থেকে বঞ্চিত করো না।” পোপ ফ্রান্সিস ভাটিকান সিটি থেকে গত ১৩ জুন, পাদুয়ার সাধু আন্তনীর মহাপর্ব দিবসে চলতি বছরের বিশ্ব গরিব দিবসের বাণী গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সম্মানীত পাঠকদের জন্য নিম্নে পোপের বাণীর চুম্বক অংশ এবং ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।
চতুর্থ বিশ্ব দরিদ্র দিবসের বাণীর শুরুতেই পোপ ফ্রান্সিস বেন সিরাকের রচনাবলী থেকে উদৃতি দিয়ে বলেন, “গরিবের প্রতি তোমার হাত প্রসারিত করো।” পোপ তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন, “গ্রন্থকার তার রচনায় মানুষের বাস্তব জীবনের সুনির্দিষ্ট দিকগুলো তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে একটি হলো দরিদ্রতা।” তিনি মনে করেন, মানুষের জীবনে যতো কঠিন সময়ই আসুক না কেনো- ঈশ্বরের প্রতি কিন্তু তার বিশ্বাস অব্যাহত রাখতে পারেন। রচনাবলীর এই পাতায় গ্রন্থকার যা বলেছেন তার উদাহরণ টেনে পোপ বলেন, “ঈশ্বরের কাছে মিনতি, গরিবদের প্রতি সংহতি এবং কষ্টভোগ একটি অবিচ্ছিন্ন বিষয়।” তিনি বলেন, “সময়ের সন্ধিক্ষণ বা প্রয়োজনে আমাদের যে প্রার্থনা- তা থেকে আমরা আমাদের প্রতিবেশীর প্রয়োজনটা বাদ দিতে পারি না।” পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “সহানুভূতি হলো দুর্বলদের প্রতি সমর্থন, দুর্ভোগীদের প্রতি শান্তনা- যা তাদের কষ্ট মোচন ক’রে সম্মান বয়ে আনতে সহায়ক হয় এবং এটাই হলো মানব জীবনের পূর্বশর্ত।” এই বিষয়ে পোপ আরো বলেন, “ঈশ্বরের অনুগ্রহের যে শক্তি আমাদের মধ্যে বিদ্যমান, তা যেনো আমাদের স্বার্থ-লোভ দিয়ে অকার্যকর করে না ফেলি।” পোপ জোর দিয়ে বলেন, “গরিবের প্রতি আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করে রাখা একটা কঠিন কাজ- তার পরেও নিজের জীবন এবং সমাজ জীবনকে পরিচালনা করার চেয়ে কাজটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
পোপ ফ্রান্সিস, বর্তমান মহাসংকট, মহামারির দিকেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাখ্যা দেন। এই প্রসঙ্গে পোপ শুরুতেই বলেন, “যখন মানব পরিবারের কোনো সদস্য পিছনে পড়ে থাকে বা অন্ধকারে থাকে, তখন আমরা নিজেরা সন্তোষজনক অবস্থায় আছি তা ভাবতে পারি না। পোপ বিলাপের সুরে বলেন- মানুষের অনীহা, উদাসীনতার করণে জীবন যখন ঘুরপাক খায় ও জীবনের চলার গতি ওলোট পালোট হয়ে যায়, আর তখন আমাদের চোখ খুলে এবং সাধু সাধ্বীদের জীবনাদর্শ অনুসরণ করি- তার আগে নয়। এটা ঠিক নয়।
পোপ ফ্রান্সিস, কভিড-১৯ মহামারির দিকে তাঁর মনোযোগ ও দৃষ্টিভঙ্গী রেখে বলেন, “সংকটময় দিনগুলোতে অনেক ডাক্তার, নার্স, প্রশাসক, ঔষুধ প্রস্তুতকারি, যাজক ও জনগণ বৈরি পরিবেশের মধ্যে প্রশংসার অপেক্ষায় না থেকে তাদের সেবার হাত প্রসারিত করেছেন- যা প্রশংসানীয়।” তিনি বলেন, “আমাদের সামনে র্দশ্যমান হয়ে ওঠা অনুমান ও ধারণাগুলো যে অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছে তাতে বুঝতে সাহায্য করছে যে, আমরা কতো দুর্বল এবং আমাদের বুদ্ধিসত্বা কতো সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে।” পোপ আক্ষেপ করে বলেন, “অনেকে পেশা হারিয়েছেন, অনেকে প্রিয়জন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন এবং দৈনন্দিন চাওয়া পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণগুলো চোখের সামনে দিগন্ত উন্মুচন ক’রে আমাদের বলে দিয়েছে যে- আমরা এমন একটা সময়ের অপেক্ষায়ই ছিলাম।” তিনি জোড়ালো ভাষায় বলেন, “এখন এটা একটা উপযুক্ত সময় এবং সবাই এখন দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আমাদের দায়িত্বগুলো একে অন্যের জন্যে এবং বিশ্বের জন্যে ভাগাভাগী করে নিতে পারি।” তিনি আরো বলেন, “যতোক্ষণ পর্যন্ত আমরা প্রতিবেশীর প্রতি, মানুষের প্রতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে আমাদের দায়িত্ব সর্ম্পকে অবগত না হই, ততোক্ষণ সংকট চলতেই থাকবে।”
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর বাণীর মূলসুর, ভালোবাসার হস্ত প্রসারিত করার দিকে ফিরে গিয়ে বলেন, “পুরুষ এবং নারী হিসেবে দায়িত্ব এবং অঙ্গীকারের মোট কথা হলো, আমরাও বিশ্ব মানব গোষ্ঠীর একটি অংশ।” মহামারি এবং বাধ্যতামূলক সামজিক দূরত্বের কারণে আমরা যতোই আলাদা অবস্থায় থাকি না কেনো- প্রভুর বাণী আমাদের অনবরত ভালোবাসার কার্যক্রমের কথাই বলে। তিনি একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষকে ইংগীত করে বলেন, “যে সব সামর্থবান মানুষ সব জেনেও অনড়, অসহযোগী এবং পকেটে হাত গুটিয়ে থাকেন তাদের জন্য “গরিবের প্রতি হস্ত প্রসারিত করুন,” বাইবেলের এই বাণী একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। অন্যদিকে, পোপ বলেন, “অনেক হস্ত অন্যের কাছে অস্ত্র বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহের জন্য বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত, এমনকী শিশুরাও বাদ নেই, যারা দরিদ্রতা ও মৃত্যু বুনে বুনে চলেছে, যারা আইন বানিয়ে নিজেরা পালন করেন না, তাদের জন্যও এই চ্যালেঞ্জ।
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর বাণীর শেষভাগে এসে পুনরায় বেন সিরাক রচনাবলীর বাণী স্মরণ করে বলেন, “আমরা যা কিছু করি না কেনো, সেটার একটা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। আর উদ্দেশ্য হলো ভালোবাসা। এটাই আমাদের যাত্রাপথের শেষ কথা এবং কোনো কিছুই যেনো এই উদ্দেশ্য থেকে আমাদের বিচ্যুত করতে না পারে।” পোপ তাঁর বাণী শেষ করতে করতে বলেন, “আমাদের একটা হাসিও গরিবদের মধ্যে ভালোবাসার চিহ্ন হতে পারে। এমনকী যারা নীরবে মানুষের মধ্যে সেবাদান করে যাচ্ছেন, তাদের প্রসারিত বাহুর সাথে একটু হাসি সেবাকে আরো জীবন্ত করে তোলে- এবং তা প্রমাণ করে- খ্রিস্টের শিষ্য হিসেবে তারা অনুপ্রাণীত।”

Please follow and like us: