ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে সরকারি বিধি বিধান মেনে, নিজের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছি। একজন ধর্মযাজক হয়ে, নিজের প্রাণ নিয়ে ভেবে ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকতে চাইনি। একজন যাজক কোনো পরিবারে গিয়ে বাড়ি আর্শীবাদ করলে ভক্ত খুশি হোন, বৃদ্ধ বা ছোটোদের আর্শীবাদ, রোগী দেখা- এগুলো পালকীয় কাজের অংশ এবং এদেশের যাজকগণ এই পালকীয় কাজগুলো আনন্দের সাথেই করে থাকেন। কিন্তু লক ডাউনের কারণে জীবন ও এই বিষয়গুলো নিয়ে পরিবার অনেক সচেতন। সচেতন সবার নিরাপত্তা নিয়ে। ধর্মকর্ম করতে গিয়ে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হোক, সেটা কারো কাম্য নয়। তাই খ্রিস্টভক্তদের ধর্মীয় অভাবটা বিবেচনা করে গত মার্চ মাস থেকে নিয়মিত অনলাইন খ্রিস্টযাগ অর্পণ করে আসছি। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি খ্রিস্টভক্ত খ্রিস্টযাগে এখনো সাথে আছেন। এই সময়ে মানুষের জীবন, নিজের হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেছি এবং এখন আমার অনুভবও হয়েছে, খ্রিস্টভক্তদের জীবন থেকে ঈশ্বর-প্রেম হারিয়ে যায় নি। অনেকে হয়তো নানা কারণে গির্জায় যেতে পারেন না, কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাসে টান পড়েনি। সাধারণ মানুষের জীবনে লক ডাউন ও সামাজিক দূরত্ব নিয়ে ভাবনা ছিলো, কিন্তু ভজনালয়ের ফটকে লক ডাউন হবে তা ছিলো কল্পনার বাইরে। মানুষ যে ঘরে এসে জীবনের প্রশান্তি খোঁজে, সেখানে না আসতে পারা বড় কষ্টের ছিলো। তাই ভক্তজন স্বভাবতই অপেক্ষায় ছিলেন চার্চের দরজা কখন খুলবে।
লক ডাউনের কারণে অগাধ সময় পেয়েছি হাতে। বই পড়ে, গান লিখে, পত্রিকায় লিখে এবং রেডিওতে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে- অবসর সময়ের কিছু সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। সেই সাথে সুযোগ নিয়েছি সময়ের লক্ষণগুলোর গভীরে প্রবেশ করার। কী হবে মহামারিকালের পরের বিশ্বে- যেমন, রাজনীতি ? অর্থনীতি ? চিকিৎসা বিজ্ঞান ? প্রযুক্তি বিজ্ঞান ? পরিবার-সমাজ এবং ধর্মীয় জীবনে ? আমার মনে হয় অনেক মানুষের মনে একটা উপলব্ধি কাজ করছে আগামী বিশ্ব নিয়ে- কেমন হবে আগামী বিশ্ব। কোভিড- ১৯ বিশ্বের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আজকের সভ্যতার কোথায় ঘাটতি এবং কোথায় পরিবর্তন অনিবার্য। প্রতিটি ঘটে যাওয়া ঘটনার নেপথ্যে একটা কারণ থাকে- এই কারণগুলোর আদি-অন্ত খুঁজতে অনেকে ইতিমধ্যে খাতা খুলে বসেছেন। রাজ্য বিলাসী, রাজনীতি বিলাসী, অর্থ বিলাসী বা স্বার্থ বিলাসীদের অনেকে উঁচু আসন থেকে নিচে নেমে এসেছেন- সংকটকে কাছ থেকে দেখার জন্য। তারা ভুলের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে দাগও টানছেন। বিশ্বের ফেলে আসা সময়ের চুলচেড়া বিশ্লেষণ হচ্ছে। প্রকৃতির সাথে মানুষের অসম সহবস্থান নিয়ে জনমত তৈরি হচ্ছে। সভ্যতার দেওয়ালে দেওয়ালে ইতিমধ্যেই ঝুলতে শুরু করেছে অতীতের ভুলগুলো।
আহত বিশ্ব বিবেক ভাবছে- ১০টা পরমানু বোমা দিয়ে যদি একটা দেশকে ধ্বংস করা যায় তবে কী হবে ২০টা বোমা তাক করে রেখে ? যার ভান্ডারে ১০টা আছে- শক্তির দিক দিয়ে সে-ও কম কোথায় ? অস্ত্র কী বেঁচে থাকার উৎস ? বোমার চেয়ে ভেন্টিলেটর কতো শক্তিশালী, ডাক্তার-নার্স কতো বড় দেশপ্রেমিক- এবার তো তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। দেশে দেশে সাধারণ জনগণ সরকারের উন্নয়ন মডেল নিয়ে আত্মতৃপ্ত হয়েছেন। অজান্তেই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন। কিন্তু মহামারির বাস্তবে দেখা গেলো- মাস না ঘুরতেই দেশে খাদ্যের অভাব- হাসপাতাল নেই, ভেন্টিলেটর নেই, ডাক্তার নেই, নার্স নেই। যে সব নার্স, ডাক্তার ও চিকিৎসা কর্মী চাকরির জন্য স্যান্ডেলের তলা খুঁইয়েছেন, অবশেষে তারাই এখন অবতার, তারাই নিজের জীবন বিপন্ন করে এখন মহামারির ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। তাহলে প্রকৃত দেশ প্রেমিক কারা ? শুধু কী, যারা যুদ্ধ করে ? যারা রাজনীতি করে ? যারা বিধায়ক ? আইসিইউতে যে নার্সটি ডিউটি করছেন- এটা কী শুধু তার পেশা, না-কী মানব প্রেমও জড়িত ? আমি মনে করি অর্থ-প্রাপ্তীর চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আবার নিজের জীবন বিপন্ন ভেবে অন্যের জীবন বাঁচানোর যে যুদ্ধ চলছে, এটার মূল্য পরিমাপ সম্ভব নয়। এটা একটা মহৎ প্রেম ছাড়া আর কী বলবেন ?
পোপ ফ্রান্সিস মহামারির শুরু থেকে বিশ্বের বিভিন্ন পেশাজীবী ও মানব কল্যাণ গোষ্ঠীর সাথে জড়িত মানুষের প্রতি তাঁর উপদেশ-বাণী দিয়েছেন। এই বাণীগুলো ক্যাথলিক চার্চের জন্য আজকের শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ দলিল। তাঁর দেওয়া বাণীগুলোতে ভবিষ্যৎ বিশ্বে, রাজনীতি, গণমাধ্যম, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, চিকিৎসা সেবা ও পরিবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। ভবিষ্যৎ বিশ্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে পোপ বলেছেন, “এই মহামারির কারণে বিশ্বের কয়েক বিলিয়ন মানুষ নতুন করে হতাশার ঝুঁকিতে পড়েছেন এবং সেই সাথে একটা নিষ্ঠুর পরিবর্তনের মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন।” এমন একটি নিষ্ঠুর পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে পোপ বলেন, “ধারণার ছেয়ে অধিক ধ্বংসাক্তক এই মহামারি রোগ থেকে ধীরগতিতে আরোগ্যলাভের যে নমুনা ও বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে, তা পিছিয়ে পড়া জনগণকে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।” তাহলে তো প্রশ্ন থেকেই গেলো- আগামী নতুন বিশ্বে নতুন করে হতাশার ঝুঁকি দেখা দিবে। তবে পোপ আশা প্রকাশ করেও বলেছেন যে, অতীতে বিশ্ব নেতাদের মনযোগ অভাবের কারণে আজকে মানুষের যে ভোগান্তী, তাদের মধ্যে এই উপলব্ধিটা সক্রিয় হলে, একটা সুন্দর বিশ্ব গড়ে উঠবে।
লক ডাউন, সামাজিক দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতা নিয়ে বড় ভাবনার কারণ হলেও, পরিবার হলো ভালোবাসার কেন্দ্রস্থল। প্রকৃত ভালোবাসার অনুশীলন হয় এই পরিবারেই। এমন একটি কঠিন সময়ে পরিবারে সৃজনশীল ভালোবাসা বিচ্ছিন্নতা কমাতে পারে। এটা গত এক শতাব্দির মধ্যে শ্রেষ্ঠ সময় যখন অনেকে পরিবারে দীর্ঘদিন অবস্থান করছেন- সন্তানদের সাথে, বয়স্কদের সাথে, অন্যদের সাথে। ঘনিষ্ঠ হওয়ার এই সময়টায় একজন আবিস্কার করতে পারেন তার সন্তানদের, পরিবারে কোন্ প্রয়োজনটা এতোদিন চোখে পড়েনি- এমন অনেক কিছু। তবে এগুলোকে অবশ্যই ইতিবাচক হিসেবে নিতে হবে। কোনোখানে কোনো অভাব বা ফাঁক থাকলে, সেটার জন্য নিজের ভুল স্বীকার করার মনোভাব থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সৃজনশীল চিন্তার ব্যক্তি না হয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ ফেলে দিলে, পরিবারে একটা মহাবিপদ নেমে আসবে।
পরিবারে সৃজনশীল ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে পোপ গৃহ নির্যাতনের কথাও উল্লেখ করেছেন। বহুদিন একসাথে থাকার কারণে একে অন্যের ভূলভ্রান্তি ধরা, অনৈক্য ও মতের অমিল ও কথা কাটাকাটি, আর্থিক সংকট, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভধারণ, বয়স্কদের নিয়ে ভাবনা, সন্তানদের অস্থিরতা, ইত্যাদির কারণে পরিবারে অশান্তি নেমে আসতে পারে। এমতাবস্থায় পরিবারে সংযম ও সহনশীলতার অভাব ঘটলে, অশান্তি গৃহ নির্যাতনে রূপ নিতে পারে। আর এই গৃহ নির্যাতনের শিকার হবেন বেশি ক্ষেত্রে নারীরা। উন্নত বিশ্বকে গৃহ নির্যাতনের বিষয়টি আরো ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলছে। কেউ মুখ খুলে করোনা ডিভোর্স নামে একটি ডেস্ক খুলে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করছেন- যেখানে শুধু ডিভোর্সের আবেদন জমা পড়বে। আর বেশি ক্ষেত্রে এই আবেদন আসবে নারীদের কাছ থেকে। তবে আমাদের দেশে এমনটি ভাবার আশংকা খুব কম।
পরিবারে সৃজনশীল ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিস আশাবাদ দেখিয়ে বলেছেন, “একদিন এই মহামারির মন্দতা থেকে আমরা মুক্ত হবো। আশা আমাদের আশাহত করে না- এটা কোনো স্বপ্ন নয়, শুধু আশা। আর আমরা আমাদের ভালোবাসা ও সংযম দিয়ে একটা সুন্দর সময় তৈরি করতে পারবো।” আমরা সেই সুন্দর দিনের আশায় আছি। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: