আমরা এখন মানব ইতিহাসের এক সংকটময় মুহূর্তে বা এক অভূতপূর্ব মানবীয় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছি। নভেল করোনা ভাইরাস বা কভিড-১৯ নামক এক ছোঁয়াছে সংক্রমনের প্রাদুর্ভাবের কারণে এই বছরের শুরুতে প্রথমে চীন দেশের উহান সিটিতে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে একটা একটা করে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষকেই সংক্রমন করেছে ও তা এখনো নির্বিচারের সংক্রমন ঘটিয়ে চলিয়েছে। আমাদের দেশও কোন ব্যতিক্রম নয়। গত মার্চ মাস থেকে আমাদের দেশের অনেক মানুষ এই মরণ ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন; অনেকে মৃত্যুবরণও করেছেন। এর যেহেতু কোন ঔষধ বা টীকা এখনো আবিষ্কার হয়নি, তাই এর জন্য সাবধানতা বা সতর্কতা অবলম্বন ছাড়া আর অন্য কোন উপায় এখনো নেই। এরই অংশ হিসেবে হাত ধোয়া, মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, আইসোলেসন, কোয়ারেন্টাইন, ইত্যাদি, অনুশীলন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পৃথিবীর সকল দেশের মত আমাদের দেশের স্বাস্থ্যবিধিতে আমূল পরিবর্তন ও নতুনত্ব এসেছে। সাবধান বা সতর্ক থাকা সত্ত্বেও করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা করতে গিয়ে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য-কর্মী, পুলিশ, প্রশাসনের মানুষ, ধর্মীয় ব্যক্তিসহ, অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে আর মৃত্যুবরণও করেছেন। এই যেন এক যুদ্ধের অবস্থা, এক অদৃশ্য শত্র”র বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আমরা ভীত, আমরা সংকিত। এই যুদ্ধ চলছে, আরও কতদিন চলবে তা আমরা কেউ জানি না। পৃথিবীর সকল দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংগে জড়িত অনেকেই গবেষণা করছে আর টীকা বা ঔষধ আবিষ্কারের চেষ্ট করছেন। ইতিমধ্যেই তারা আশা জাগিয়েছেন- হয়তো শীঘ্রই আমরা সুখবর পাব, এই সংক্রমন-ব্যধির ঔষধ বা টীকা পেয়ে যাব।
এই প্রাদুর্ভাব শুধু মানুষের দৈহিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে তা নয়- সামাজিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এই বিশে^র অনেক ক্ষতি করেছে। প্রথমত: আইসোলেসন ও লক-ডাউনের কারণে সকল স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়, সরকারি অফিস আদালত, বেসরকারি অফিস, সকল কল-কারখানা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদি, বন্ধ থাকায় অনেকেই চাকুরী ও কাজ হারিয়ছেন। বিশে^ এক অর্থনৈতিক মন্দার অশনি-সংকেত দেখা দিয়েছে। তবে এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। আমাদের দেশের গরিব মানুষদের পরিবারে নিয়মিত আহারও জুটছে না। আমাদের দেশের সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। তাতে দরিদ্রের সাময়িক উপকার হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী কোন সমাধান দেখা যাচ্ছে না। সমাজের মানুষের মধ্যে অনেক রকম সমস্যাই উদ্ভব হয়েছে এই করোনা ভাইরাসের কারণে। কোন সামাজিক অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে করা যাচ্ছে না। যদিও বা এখন আস্তে আস্তে সরকারিভাবে লক-ডাউন শিথিল করা হচ্ছে কিন্তু সব কিছু স্বাভাবিক হতে এখনো আর কতদিন লাগবে আমরা কেউ জানি না। এটা এমনই একটি মানবিক সমস্যা, যা আমাদের সকলকেই শুধু ভাবিতই করছে না, মানবিক ভালবাসা ও মানব সংহতিও দাবী করছে।
এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কি? এই সময়ের সংকটকে বিশাল বড় মনে হলেও আমাদের এর থেকে উত্তরণের পথ আমাদেরই খুঁজে পেতে হবে। আমাদের নতুনভাবে ভাবতে ও শিখতে হবে, নতুন কিছু করতে শিখতে হবে। এই মানবিক বিপর্যয়ের সময় মানব সমাজের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার মানবীয় ভালবাসা ও সংহতি। সব কিছুর জন্য অর্থ-কড়ির প্রয়োজন হলেও, মানুষে মানুষে ভালবাসা, পরস্পরের কাছে আসা- কাছে থাকা, সমাজের মধ্যে সংহতি, ইত্যাদির জন্য কোন টাকা পয়সা লাগে না। যদিও কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের কারণে আমাদের অনেক স্বাস্থ্যবিধি ও নানা নিয়ম কানুন মেনে চলতে হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হচ্ছে, তথাপি আমরা ভালবাসার ও সংহতির সমাজ গড়তে পারি। এই জন্য আমাদের সেই মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে ও প্রস্তুতি নিতে হবে । আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় পরিমন্ডলে অনেক উদ্যোগই গ্রহণ করা হচ্ছে যেন এই স্থবির ও মন্দার পরিবেশ কাটিয়ে আবার এই পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হতে পারে, সামনে এগুতে পারে। কিন্তু ভালবাসা ও সংহতির সমাধানই সবচেয়ে ভাল সমাধান এতে কোন সন্দেহ নেই। পরিবার ও সমাজের জন্য সেই সমাধানই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।
আমরা জানি যে এই অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কি হবে? শুধুই কি অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বস্তুগত অগ্রগতি, ইত্যাদি ধরণের উন্নয়ন? এই ধরণের উন্নয়ন জন্ম দেয় শুধু স্বার্থপরতা, ভোগবাদ, পরশ্রীকাতরতা, বস্তুবাদ, দুর্নীতি, ইত্যাদি। এই ধরণের উন্নয়নের ত্রুটিপূর্ণ মডেল আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, যেখানে আছে ধনী ও গরীবের বৈষম্য, শোষণ, অন্যায্যতা, বঞ্চনা, দরিদ্রদের বাইরে ফেলে রাখা বা বাদ রাখা, ইত্যাদি। আমরা এই করোনা ভাইরাসের এই সময়ে একটা সময় পেয়েছি যেন এর পরিবর্তন এনে একটি নতুন সমাজ ও নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। এই নতুন ব্যবস্থায় থাকবে না কোন শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায্যতা, বাইরে ফেলে রাখার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। এটা হবে মিলন ও ভালবাসার সমাজ, সংহতির সংস্কৃতি। আমরা যদি চাই তাহলে আমরাই এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি। করোনা ভাইরাস সাংঘাতিক একটি ছোঁয়াচে ব্যাধি, কিন্তু ভালবাসার ভাইরাস তার চেয়েও বেশি ছোঁয়াচে হতে পারে। আমরাই সেটা করতে পারি। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি করব।
দরিদ্রদের বঞ্চনার মধ্যে রেখে পৃথিবীর ধনী ও ভোগবাদী মানুষেরা যে সুখ সুবিধা ভোগ করে তা কোন মানবিকতার মধ্যে পড়ে না। ঈশ^র মানুষ হিসেবে আমাদের সকলকেই সমান করে সৃষ্টি করেছেন। তবে এই বৈষম্য কেন? আমরা সকল মানুষই পরস্পরের ভাইবোন। আমরা সকলেই একই পরিবারের সমান সদস্য। আমাদের সকলের অধিকার ও দায়িত্ব সমান। ঈশ^র আমাদের কাছে এটাই চান যেন আমরা এই পৃথিবীতে সকলেই সমান অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারি; আমরা সমান ভালবাসায় জীবন কাটাতে পারি। ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস সেই শিক্ষা দিতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের মানব সমাজকে জঙ্গল সভ্যতা ছেড়ে এখন ভালবাসার ও সাম্য-মৈত্রীর এক নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষই হবে সব উন্নয়নের ও সামাজিকতার মূল মান-দন্ড। মানুষের এই মান-দন্ড ঈশ^র নিজেই স্থির করে দিয়েছেন। ধনী বা দরিদ্র সকল মানুষের মর্যাদা ও অধিকার সমান, এই কথা যেন মানব-সমাজ সব সময় সমুন্নত রাখে।
মানুষের যত্ন যেমন করতে হবে, তেমনি যত্ন করতে হবে সৃষ্টির সব কিছুকেই। এই পৃথিবীকে ও এর সকল সৃষ্টি-কৃষ্টিকে যত্ন করতে হবে, কারণ এই পৃথিবীটা হচ্ছে আমাদের সকলের অভিন্ন আবাস-গৃহ। পোপ ফ্রান্সিস সেই কথাটিই পৃথিবীর সকল মানুষকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন তা “লাউদাতো সি” বা “তোমার প্রশংসা হোক” নামক সর্বজনীন পত্রে। এই পত্রের ৫ম বার্ষিকীতে তিনি তাঁর সেই ডাক নবায়ন করেছেন আর বছরব্যাপী তার উপর ধ্যান-প্রার্থনা ও কাজ করতে বলেছেন। এই যে বিশ^-ব্রহ্মান্ড ঈশ^র আমাদের উপহার হিসেবে দিয়েছেন, তার উপর পৃথিবীর আমরা সকল মানুষই শোষণ ও নির্যাতন এবং স্বার্থপর অপব্যবহার করে এর চরম সর্বনাশ ঘটিয়েছি। এর ফলে আমাদের এখন প্রতিফল ভোগ করতে হচ্ছে। এই করোনা ভাইরাস বা কভিড-১৯ সেই রকমই কোন প্রতিফল কি না, তা আমরা কি করে বলতে পারি? আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তন: অতিবৃষ্টি, খড়া, অতিবন্যা, ঝড়, সাইক্লোন, সুনামি, ভূমিকম্প, ইত্যাদি এখন যে আমাদের জন্য হুমকী হয়ে দাড়াচ্ছে তার কারণ তো আমাদেরই অপরিনামদর্শী আচরণ ও কাজ। এখন কভিড-১৯ লক-ডাউন আমাদের কিছুটা শিখিয়েছে যে আমাদের কোন সময় বা কোন জায়গায় থামতে হবে। সামাজিকভাবে দূরে থেকেও মানব হৃদয়ের কাছে থাকা শিখতে হবে। আমাদের পরিমিতিবোধ অর্জন করতে হবে। এই পরিমিতিবোধ হোক আমাদের নতুন সংস্কৃতির বা নতুন সভ্যতার অংশ। পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও এই মানব সমাজ আবার স্বাভাবিক হোক আর মানবিক হোক, এটাই আমাদের এখনকার আসল চাওয়া।
আমাদের মানব সমাজের সবচেয়ে বড় ভাইরাস হল ঈশ^রকে ভুলে যাওয়া, তাঁকে অস্বীকার করে দূরে চলে যাওয়া। এর ফলেই ঈশ^র-বিহীন জীবনের অনৈতিক আচরণ তার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। এই ভাইরাস ধীরে ধীরে পশ্চিম থেকে পূর্ব ও উত্তর থেকে দক্ষিন সকল দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের বাহ্যিক ও বস্তুগত বিপর্যয়ের আগে তার আধ্যাত্মিক জীবনেরই পতন হয়। বিশ^-ব্যাপী মানুষের মধ্যে ঈশ^র-বিহীনতার যে ভাইরাস বাসা বেঁধেছে তা মানব সমাজকে এখন ও ভবিষ্যতে আরও অনেক ধ্বংসের পথ দেখাবে। তাই এখনই সময় আমাদের সকলের জীবন শোধরাবার। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের সব কিছুই প্রয়োজন আছে, তবে তা যেন শুধু দৈহিক বা বৈষয়িক না হয়; সেই সঙ্গে আত্মার প্রয়োজনও আমাদের দেখতে হবে। মোট কথা আমাদের- মানুষের জন্য আসল আহ্বান কি তা তাকে আবিষ্কার করতে হবে। আমরা সুখ চাই, আনন্দ চাই, এটা তো সব মানুষের জন্যই প্রযোজ্য! কিন্তু এই জগতের ক্ষণকালের সুখ-আনন্দ তো সব নয়, কিভাবে পরকালে চিরকালের মত সুখী ও আনন্দিত হব সেটাও আমাদের ভাবতে হবে আর তার জন্য কাজও করতে হবে। ঈশ^র ছাড়া সেই জীবনের সন্ধান আমরা পাব কি করে?
যারা ঈশ^রের উপর বিশ^াস করে, তারাই একটি সুন্দর ও ভালবাসাপূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে আর অন্যদের সাথে মিলে ভালবাসা ও সংহতির এক আশা জাগানিয়া পৃথিবী গড়ার নিরন্তর চেষ্টা চালায়। এরকম মানুষ এই পৃথিবী অনেক দেখেছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা অন্যদের অর্থাৎ ঈশ^^র-বিহীন বস্তুবাদী মানুষদের তুলনায় কম। এরকম কিছু ভাল ও মহৎ মানুষ ছিল বা আছে বলেই এখনো এই পৃথিবীটা কিছুটা হলেও বাসযোগ্য হয়ে আছে। তবে এই পরিবেশটার উন্নয়ন দরকার। এই পৃথিবীকে আরও সুন্দর ও আরও ভাল করার দায়িত্ব আমাদের সকলকেই নিতে হবে। এইজন্য আমাদের নতুন অভ্যাস, আচরণ ও সংস্কৃতির অনুশীলন করতে হবে। সেই সংস্কৃতি দাবী করে- ত্যাগস্বীকার ও আত্মনিবেদন আর আহ্বান জানায় সকল মানুষের কল্যাণে কাজ করতে। এতেই সকলের মনে জেগে উঠবে একটা নতুন আশা – ভবিষ্যতের সুন্দর ও সংহতিপূর্ণ এক নতুন পৃথিবীর আশা। কভিড-১৯ পরবর্তী বিশ^ সেই সেরকমটাই হোক আমরা তা-ই চাই।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
ক্যাথলিক ডাইয়োসিস, রাজশাহী, বাংলাদেশ।
মানবীয় বিপর্যয়ে মানবীয় সংহতি ও আশা
Please follow and like us: