ফাদার দিলীপ এস. কস্তা
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ফাদার পৌল ডি’রোজারিও (জয়গুরু, ১৯৫১-২০২০) গত ১৩ জুলাই ২০২০ তারিখে রাত ৮:৫০ মিনিটে শারিরিক অসুস্থ্যতা জনিত কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজশাহী বিশপ হাউজে পরলোকগমন করেন। ১৫ জুলাই ২০২০ তারিখে বোর্ণী ধর্মপল্লীতে তার অন্ত্যেস্টিক্রিয়া শেষে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর ৮ মাস ১০ দিন। ঈশ্বর তাঁর আত্মাকে চিরশান্তি দান করুন! সাধু পৌলের ভাষায়: “আসলে আমরা কেউ নিজের জন্য বেঁচেও থাকি না, কেউ নিজের জন্যে মরেও যাই না। যদি বাঁচি, তবে প্রভুর জন্যেই বাঁচি; আর যদি মরি, তাহলে প্রভুর জন্যেই মরি। সুতরাং বাঁচি বা মরি, যে-ভাবেই থাকি না কেন, আমরা প্রভুরই” (রামীয় ১৪:৭-৮)। মহাপ্রয়ানে শায়িত ফাদার পৌল ডি’রোজারিও (জয়গুরু)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য উপস্থাপন করছি।
ফাদার জয়গুরুর জন্ম ৩ নভেম্বর ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দ মঠবাড়ী ধর্মপল্লীর বাশবাড়ি গ্রামে তালটিহির বড় বাড়ি নামক এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তিনি ৫ বছর বয়সে পিতা-মাতার সাথে বোর্ণী ধর্মপল্লীর প্রিয়বাগ গ্রামে আগমন করেন। তার পরিবার সেখানেই স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। তার লেখাপড়ার হতেখড়ি বোর্ণী ধর্মপল্লীর সেন্ট মেরীস্ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ৭ম শ্রেণীতে উঠে তিনি দিনাজপুর সেন্ট যোসেফস্ মাইনর সেমিনারীতে প্রবেশ করেন এবং ১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দে দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস্ হাইস্কুলের বিজ্ঞান শাখা থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দে নটর ডেম কলেজ, ঢাকা থেকে আইএসসি পাশ করেন। ঢাকা কলেজ থেকে তিনি বিএসসি পাশ করেন ১৯৭৫ খ্রীষ্টাব্দে।
মেজর সেমিনারীয়ান হিসেবে তিনি প্রথম এক বছর ম্যাথিস হাউজে অবস্থান করেন এবং এরপরে বনানী ন্যাশনাল মেজর সেমিনারীতে যাজকীয় অধ্যয়ন শেষে ৩ জানুয়ারি ১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দে নিজ ধর্মপল্লী বোর্ণীতে যাজক পদে অভিষিক্ত হন। যাজকীয় অভিষেকের পর তার পালকীয় সেবাকাজের যাত্রা শুরু হয় বনপাড়া ধর্মপল্লীতে সহকারী পাল-পুরোহিত হিসেবে। এছাড়া তিনি মারীয়ামপুর ও বেনীদুয়ার (২ বার) ধর্মপল্লীতে সহকারী পাল-পুরোহিত হিসেবে সেবাকাজ করেন। পাল-পুরোহিত হিসেবে তিনি পালকীয় সেবাকাজ করেন আন্ধারকোঠা, মথুরাপুর ও রহনপুর ধর্মপল্লীতে। তিনি বনপাড়া সাধু পোপ ৬ষ্ঠ পল সেমিনারীতে আধ্যাত্মিক পরিচালক হিসেবে ২ বছর সেবাদায়িত্ব পালন করেন।
ফিলিপাইনের আতেনেও দি ম্যানিলা ইউনিভার্সিটিতে তিনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পড়াশোন করে পালকীয় ঐশতত্ত্বে ম্যাজিষ্ট্রাতুম আর্তিউম মাস্টারস্ ডিগ্রি লাভ করেন। ফাদার জয়গুরু যাজকীয় জীবনের রজত জয়ন্তী (১৯৮২-২০০৭) উদ্যাপন করেন ৩ জানুয়ারি ২০০৭ খ্রীষ্টাব্দে।
ধর্মপল্লীতে পালকীয় সেবাকাজের পাশাপাশি তিনি কাটেখিস্ট ডিরেক্টর, যুব পরিচালক, আরডিপিএফ পরিচালক, বিশপ মহোদয়ের কাউন্সেলর, ২০০০ খ্রীষ্টাব্দের জুবিলী সমন্বয়কারী, এসভিপি’র আধ্যাত্মিক পরিচালক, ক্ষুদ্র খ্রীষ্টীয় সমাজ ফেসিলিটেটর এবং ধর্মপ্রদেশীয় পালকীয় টিমের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বভাবের দিক থেকে ফাদার জয়গুরু ছিলেন উদার চিন্তার মানুষ। মানুষ, বিশ্ব-প্রকৃতি, ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করতেন এবং সাপ্তাহিক প্রতিবেশীসহ বিবিধ পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। বন্ধুবৎসল ও আমোদপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন সকলের বন্ধু ও প্রিয়জন। ‘জয়গুরু’ যীশুর নাম সাধনা ছিল তার ধ্যানে ও জ্ঞানে।
জীবন সাধনায় জনপদের পথিক, গুরুপ্রেমী ও উদার আনন্দের গুরু সাধক ফাদার পৌল ডি’রোজারিও ওরফে জয়গুরু ব্যক্তি জীবনে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হলেও তার ব্যক্তি সত্তা সাহিত্য রসে ভরপুর। কবিতা, কথা, গান, গল্প, প্রবন্ধ, কলামসহ সাহিত্যের নানা শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। তার রচিত ও প্রকাশিত বইগুলো হলো: মৌলিক খ্রীষ্টীয় সমাজ (১৯৯৯), জয়গুরু (১৫ আগষ্ট ২০০৩), ধর্মপ্রদেশীয় যাজক (১৮ ডিসেম্বর ২০০৩), স্পন্দিত হৃদয়ের বন্দিত কাহিনী (৩ জানুয়ারি ২০০৭), ছন্দে পদে জীবন চেতনা (৭ অক্টোবর ২০১০), উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্র খ্রিষ্টীয় সমাজের (আসিপা) ইতিবৃত্ত (৭ অক্টোবর ২০১০), মৃন্ময় পাত্র – বিবর্ণ কাহিনী (৩ জুন ২০১৬) এবং গুরু সাধনা: সুরে গানে (১৯ মার্চ ২০২০)।
৩৮ বছরের যাজকীয় জীবনের বেশীরভাগ সময়ই তিনি কাজ করেছেন ধর্মপল্লীর পালক ও সহকারী পালকরূপে। বলা যায় যে, তিনি একজন সফল পালক। তার মেধা, মনন, বোধ, বিশ্বাসে ও খ্রীষ্ট চেতনায় জয়গুরু বার বার উঁকি মেরেছে তার জীবন সাধনায় তথা তার চলনে-বলনে।
জীবনের পড়ন্ত বিকেলে নানাবিধ শারিরিক অনুবিধাকে ডিঙিয়ে ফাদার জয়গুরু সঙ্গীত সাধনায় গভীরভাবে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তারই রচিত ‘গুরু সাধনা: সুরে গানে’ নামক সঙ্গীত সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয়েছে এই তো তার মৃত্যুর মাত্র ২০/২৫ দিন আগে। বইটি হাতে পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।
ফাদার জয়গুরুর সঙ্গীত সাধনার শুরু হয় যখন তিনি মেজর সেমিনারীর ছাত্র তখন থেকেই। সময়ের প্রয়োজনে ও নাান উৎসব-উপলক্ষ্যকে ঘিরে তার রচিত বেশ কয়েকটি গান গোটা বাংলাদেশে বহুল প্রচলিত ও পরিচিত। তার রচিত কয়েকটি বিখ্যাত গান হল: ১. জীবন যদি দিলে প্রভু শক্তি দাও গো তবে …; ২. তব আশিস দানে ধন্য করো …; ৩. নতুন সাজে মোরে দাও সাজিয়ে …; ৪. ক্রুশ কাঁধে জীবন পথে আমিও প্রভু যাবো সাথে …; ৫. প্রভুর অন্তিম ভোজের স্মরণে, নতুন নিয়মের সন্ধি ক্ষণে …; ৬. পূজার বেদীতে দাও গো তুলে …; ৭. আমি নিজেকে উজার করে তাঁকে ভালোবাসবো …; ৮. এই জীবন তো সহভাগিতার …; ৯. এসো এসো হে রাজা রাজাধিরাজ …; ১০. কত স্বাদ তোমার প্রসাদ ….; ১১. চোখের তারা প্রভু …; ১২. জীবন সুন্দর প্রভু তব …; মধুর এই জয়ন্তী, প্রেমের এই জয়ন্তী …
ফাদার জয়গুরুর রচিত গান ও লেখাগুলো আমাদের আধ্যাত্মিক ও মনোজগতের তৃষ্ণা মেটায়। তার সমগ্র জীবন সত্তা চারণ বাউল ও কবির মতো। তার অফুরান্ত ভাবসম্ভার থেকে আমাদের জন্য তিনি অনেক কিছুই রেখে গিয়েছেন। খ্রীষ্টভক্তদের হৃদয়ে তিনি একজন জনদরদী পালক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আর ভাই পুরোহিতদের কাছে তিনি একজন সদা হাস্যরসিক, সহজ, সরল, বিনম্র ও আদর্শ বন্ধু হিসেবে সবার আদর্শ হয়ে থাকবেন।
অসুস্থ্যতা ও চিকিৎসা
গত মার্চ (২০২০) মাসের মাঝামাঝি হতে তাঁর শরীর দূর্বল হতে থাকে এবং পরপর দু’বার স্ট্রোক করেন।
গত মার্চ (২০২০) মাসের ২০ তারিখে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয় এবং গুলশানের কিওর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তার মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়ে এবং পরবর্তীতে তা ক্যান্সারে রূপ নেয়। এছাড়া তার হার্টে ব্লক পাওয়া যায় এবং তার ডাইবেটিসও ছিল অনেক বেশী মাত্রায়।
তার মস্তিষ্কের টিউমার অপারেশন করা হয় ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে এবং ক্যান্সারের রেডিও থেরাপি দেয়া হয় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে।
সর্বপ্রকার চিকিৎসা করা হলেও তার অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপের দিকেই যেতে থাকে।
ঢাকায় চিকিৎসা শেষ হলে ডাক্তারগণের পরামর্শে গত ২৬ জুন (২০২০) তাকে রাজশাহী ফিরিয়ে আনা হয় এবং রাজশাহী ম্যাডিক্যালে রেখে চিকিৎসা চলতে থাকে।
গত ০৯ জুলাই (২০২০) রাজশাহী ম্যাডিক্যাল থেকে তাকে রাজশাহী বিশপ হাউজে এনে সেবাযত্ন করা হয়।
পরিশেষে গত ১৩ জুলাই (২০২০) রাত ৮:৫০ মিনিটে তিনি আমাদের সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে পরলোকে স্বর্গীয় পিতার শান্তির রাজ্যে গমন করেন। উল্লেখ্য যে, তার অসুস্থ্যতাকালীন সময়ে সার্বক্ষণিক তার পাশে থেকে তাকে বিশেষ সেবা যত্ন করেন সুরশুনিপাড়া ধর্মপল্লীর সন্তান পরিমল হেম্ব্রম।
পরম করুণাময় পিতা ঈশ্বর তাঁর বিশ্বস্ত সেবক ফাদার জয়গুরুকে অনন্ত বিশ্রাম দান করুন। পরিশেষে, ঋষি যাবের উক্তিই হোক আমাদের পরম সান্ত¦না: “আমি তো নগ্ন হয়েই মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, আবার নগ্ন হয়েই ফিরে যাব আমি। ভগবান নিজেই দিয়েছিলেন, ভগবান নিজেই ফিরিয়ে নিয়েছেন। ধন্য ধন্য ভগবানের নাম!” (যোব ১:২১)। হে প্রভু, তাঁহাকে অনন্ত বিশ্রাম প্রদান করো!