বিশপ জের্ভাস রোজারিও, রাজশাহী

কভিড ১৯ বা নতুন করোনা ভাইরাস যে মহাসংকট এই পৃথিবীর বুকে নামিয়ে এনেছে, তা ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব বিরল ঘটনা। পৃথিবীতে হয়তো এর পূর্বে অনেক মাহামারিই হয়েছে, অনেক দেশে অনেক স্থানে অনেক মানুষও মসহামারিতে মরেছে; কিন্তু এইবারের নতুন করোনা ভাইরাসের মত সারা বিশে^র উপর এমন ছাপ আর কোনটিই রাখেনি। চীন দেশ থেকে শুরু করে একটি একটি করে পৃথিবীতে যত দেশ আছে তার সব ক’টিই এই মারাত্মক ছোঁয়চে ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে আর ইতোমধ্যে বহু মানুষও মরেছে আর এখনো মরছে। শুধু কি তাই? এই মরণ ভাইরাস গোটা বিশ^টাকেই অচল করে ফেলেছে – বদলে দিয়েছে মানুষের বহুদিনের গড়ে তোলা সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নিয়ম নীতি ও ব্যবস্থা, মানব সম্পর্ক, মানুষের আচার আচরণ, সংস্কৃতি, ইত্যাদি। এর ফলে বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল-কলেজ, অফিস আদালত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠান, কল কারখানা, কৃষি খামার, আর গরীব মানুষের জীবিকার পথ। এই ভাইরাস ধনী গরীব দেশ বা ধনী গরীব মানুষ কোন পার্থক্য করেনি। সকল দেশের সকল প্রকার মানুষকেই এই ভাইরাস আক্রমন করেছে। কিন্তু এই ভাইরাসের উৎপত্তি কিভাবে হলো? এখনও কেউ স্পষ্ট করে তা বলতে পারে নি। এই রোগ বণ্য পশু-পাখী থেকে নাকি চীনা কারখানা থেকে বেরুলো সেটা সকলেই জানতে চেয়েছে, কিন্তু রহস্যের অতলে তলিয়ে গেছে সকল চেষ্টাই।
এই ভাইরাসের ভয়ঙ্কর থাবায় ধর্মীয় স্থান ও প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ হয়ে আছে – মসজিত, মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জা, কিছুই এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। আমাদের জীবনে এসেছে নতুন কিছু আচার আচরণ, অভ্যাস, অনুশীলনী যা আগে আমরা কখনও পালন করিনি। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আমাদের একটি নতুন সংস্কৃতির অংশ হতে হয়েছে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা সেনিটাইজার দিয়ে জীবানুমুক্ত করা, বাইরে গেলে সর্বদা মাস্ক দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখা, পিপিই পরা, হাত মোজা পরা, সামাজিক দূরত্ব বজিয়ে রাখা বা জনসমাগম এড়িয়ে চলা, ভাইরাসের সংক্রমন ঝুঁকি রয়েছে এমন জায়গা থেকে ফিরে কোয়ারেন্টাইন ও আসোলেশন বা আলাদা থাকা, গরম পানি খাওয়া, গরম পানির ভাপ নেওয়া, লেবুর রসে গরম সর্বত পান করা, ইত্যাদি এই সবই হলো সেই নতুন অনুশীলনী বা নতুন রীতি-সংস্কৃতির অংশ। সাবান দিয়ে স্নান করে পরিষ্কার হয়ে রক্ষাকারী মুখোস পড়ে পরিবারের অন্যদের সাথে কথা বলা বা কাছে আসা। এরূপ অনুশীলনী বা সংস্কৃতি একেবারেই স্বাভাবিক নয় – তা আমাদের মানব সমাজের স্বাভাবিকতার পরিপন্থী। কিন্তু তার পরও জীবনের ও সমাজের নিরাপত্তার কারণে আমাদের তো তা বাধ্য হয়েই মানতে হচ্ছে। আমরা যত তাড়াতাড়ি এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে মুক্তি পাই ততই মঙ্গল।
এই কভিডের কারণে পৃথিবী ব্যাপি যেন এক মহাযুদ্ধের অবস্থা হয়ে আছে। শুধু কোন একটি দেশ নয়, পৃথিবীর সকল দেশ একযোগে লক-ডাউনের মধ্যে পরেছে, সকল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, বাস, রেল, বিমানসহ সকল পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু দেশের সাথে দেশের যোগাযোগ নয়, মানুষে মানুষে সকল সম্পর্ক সন্দিহান ও ধোয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বা জাতীয় সকল সেমিনার সভা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের দেশের মধ্যেও তো আমরা দেখেছি লকডাউন আর সরকারী স্বাস্থ্যবিধি ইত্যাদির কারণে সকল সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় অনেক কল কারখানা বন্ধ হয়েছে, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বন্ধ হয়েছে বা সংকোচিত হয়েছে। বেতন ও আয় বন্ধ হয়ে গেছে অনেকেরই আর ঘরে বসে খেতে গিয়ে পরিবারের খাদ্য রসদ ফুরিয়ে যেতে সময় লাগেনি। দরিদ্রদের অবস্থা হয়ে গেছে আরও সঙ্গীন ও শোচনীয়। এই অবস্থায় সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে ত্রানের খাদ্য পেয়ে তাদের সমস্যা কিছুটা হালকা হলেও, দরিদ্রদের পথে বসার অবস্থাই হয়েছে। শহরে চাকুরী বা কাজ হারিয়ে ও ঘর ভাড়া দিতে না পেরে অনেক পরিবার গ্রামে চলে গিয়েছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত মাথায় করে।
করোনায় আক্রান্ত হলে কেউ তাকে সেবা করতে চায় না, চিকিৎসা দিতে চায় না, এমনকি আপন পরিবারের সদস্যরাও তাকে পরিত্যাগ করে। আরও একটি দুর্ভাবনার বিষয় হলো যে করোনা ভাইরাসে মৃত্যু হলে সৎকার করার কোন মানুষ পাওয়া যায় না। ভয়ে আপন আত্মীয়রাও কাছে আসে না। এমন ঘটনা শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ^ব্যপী প্রায় সকল দেশেই দেখা গিয়েছে। এই অমানবিক পরিসিস্থতি সামাল দিতে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এখন অবশ্য কিছু স্বেচ্ছাসেবী ধর্মীয় – সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংঘ এই দায়িত্ব নিচ্ছে। কিন্তু এখনও অনেক স্থানে মৃতদের সৎকারের জন্য স্বেচ্ছাসেবী মানুষ পাওয়া ভার হয়ে দাড়িয়েছে।
তার উপর মানুষের এই দুর্দশাকে আরও তীব্র করার জন্য কিছু মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে। কিছু বাড়ী ওয়ালা বাড়ী ভাড়া বাড়িয়েছে বা তার জন্য নমনীয় না হয়ে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কঠোর বা নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, এমনকি ভাড়া সঠিক সময়ে দিতে না পারায় বাড়ী থেকে ভাড়াটিয়া পরিবারকে বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে। কল কারখানার কিছু মালিক শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী না দিয়ে চাকুরীচ্যুত করেছে। বাজারে অসাধু দোকানীরা ভোজ্যপন্নের দ্রব্যমূল্য যেমন খুশী বাড়িয়েছে – গরীব ক্রেতারা পরিবারের সদস্যদের, বিশেষভাবে শিশুদের মুখে অন্ন তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার কষ্ট করে গ্রামের চাষীরা যে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করছে, তারা তার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না মধ্যস্বত্ব ভোগী ও ফরিয়া ব্যবসায়ীদের কারণে। আর সবচাইতে দুঃখের বিষয় হল যে কিছু ব্যবসায়ী করোনা ভাইরাসের এই সংক্রমনকালে মানুষকে সাহায্য না করে বরং মানুষকেই ব্যবসার পণ্য করে তুলেছে। হাসপাতালেও মানুষের চিকিৎসা নিয়ে চলছে প্রহসন – করোনা রোগীদের চিকিৎসা নিয়েও চলছে নানা ছলচাতুরী, প্রহসন আর মিথ্যাচার। করোনা বা কভিডের এই দুঃসময়ে পৃথিবীর অনেক দেশের মত আমাদের দেশেরও অনেক ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রশাসনের অনেক মানুষ, ইত্যাদি অনেকেই করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা করতে গিয়ে আত্মহুতি দিয়েছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি একশ্রেনীর মানুষ মানুষকে পূজি করে অসাধু উপায়ে বড় লোক হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে – কিছু লোভী মানুষ হাসপাতাল খুলে ও ভূয়া করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রি করে কোটি কেটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে শুধু মানুষের ক্ষতিই করেনি, সেই সঙ্গে দেশের দুর্নামও বয়ে এনেছে। আরও অনেক সুবিধাবাদী মানুষ এই করোনা কালে তাদের লাভ ও সুযোগ সুবিধা লুটে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে – মানুষের লাভ ক্ষতি ভাবার সময় তাদের নেই। মানবিকতার এমন বিপর্যয়ে আমাদের সমাজ ও দেশ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
এই করোনা ভাইরাসের সংক্রমনকালে সকল দেশই বিপদ ভঞ্জনের জন্য ও নিরাপদ থাকার জন্য লক ডাউন ঘোষণা করেছে। আমাদের দেশেও তাই হয়েছে। এর ফলে বিমান, রেল, বাস, নৌযান, ইত্যাদি পরিবহন ব্যবস্থা সবই সবই বন্ধ হয়েছে। এতে দেশে দেশে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, মানুষে মানুষেও দূরত্ব বেড়েছে – আর সকলেরই অবর্ণনীয় অসুবিধা ও কষ্টের মধ্যে পরতে হয়েছে। সভা সেমিনারের বাস্তব উপস্থিতি বন্ধ হয়ে ভার্চুয়াল বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে পৃথিবীর একটা উপকারও হয়েছে – আর তা হল বেশ কয়েক মাস ধরে পেট্রোল ডিজেল তেল কম পুড়েছে – তাই পৃথিবীর সম্পদ সঞ্চিত থেকেছে আর পরিবেশের দোষণও কম হয়েছে। বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে ও সমুদ্রের সৈকতে মানুষের বিচরণ ছিল না বলে প্রকৃতি তার স্বরূপ কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছে। গাছ পালা কাটা, বনাঞ্চল উজার করা, পাহাড় কাটা, খনিজদ্রব্য উত্তোলন, ইত্যাদি বন্ধ থাকায় প্রকৃতি কিছুটা হলেও স্বস্থি পেয়েছে। বন্য প্রাণী ও জলের জীব জন্তু যেন তাদের অধিকারের বিচরণ এলাকা ফিরে পেয়েছে। আকাশে বাতাসে কার্বন কমেছে, আর প্রাণ বাচানো অক্সিজেন বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে এই মরণ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মানুষকে কিছু ভাল শিক্ষাও দিয়েছে। এই যে যুদ্ধের অবস্থা, এই যে সরকারী, বেসরকারী সকল কর্মকান্ড বন্ধ বা সীমিত হয়ে আছে, বিবাহ অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সামাজিক অনুষ্ঠান, পারিবারিক বেড়ানো, আনন্দ ভ্রমন, ইত্যাদিসহ সব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে ও মানব সম্পর্ক বন্ধ বা সীমিত হয়ে আছে। এর মধ্যেও কিন্তু আমাদের কিছু ভাল কিছুর অনুশীলনও হয়েছে। আমরা অনেকেই ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা শিখেছি, কম বেশী নিয়ম মেনে চলতে শিখেছি আর পরিবার পরিজনকে সময় দিতে পেরেছি। পরিবারের সকলে এক সঙ্গে থাকতে পেরেছি ও একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেছি যা অনেক দিন হয়ে উঠেনি। আমরা অনেকে সীমাবদ্ধতা, মন্দা ও ভবিষ্যতের অনিশ্চিয়তার কারণে হলেও পরিমিত ও সাধারন খাবার খেয়েছি। বিবাহ অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অপচয় বন্ধ করেছি। করোনাকালের এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা অন্য দরিদ্র অসহায় পরিবারের পাশে দাড়িয়েছি; তাদের সহমর্মী হয়েছি। গাছপালা না কেটে বরং লাগিয়েছি। আমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশের যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের কিছু ভাল অভ্যাস ও আচরণ গড়ে উঠেছে। নিজেদের বাড়ীঘর, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, সহকর্মী, কর্মস্থল, ধর্মকর্ম, ইত্যাদি সম্পর্কে ভেবেছি ও অনুভব করেছি। এদের বা এগুলোর মূল্য ও অভাব সম্পর্কে সচেতন হয়েছি।
এই ভাইরাসের কোন ঔষধ কারও জানা ছিল না। এখনও তার ঔষধ বের হয়নি। তবে পৃথিবীর বহু দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণই গবেষণা করছেন, আর শোনা যাচ্ছে যে খুব শীঘ্রই হয়তো এই ভাইরাসের ভেক্সিন বা টীকা পাওয়া যাবে। আমাদের দেশও আক্রান্ত হয়েছে এবং অনেক মানুষ মরেছে। আশার কথা হলো আমাদের দেশের গবেষকগণও টীকা আবিষ্কার করতে অনেকদূর এগিয়েছে। আমরা একটি ভাল সমাধান হয়তো খুব শীঘ্র পাব। আমাদের এই আশা ফলপ্রসূ হবে এটাই আশা করি। তবে আমরা যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাস, আচার আচরণ, জীবনের রীতি, সব কিছু কভিডের কারণে বদল হয়ে গেল। যা-ই হোক না কেন কভিডকে বা করোনা ভাইরাসকে ভয় পেলে চলবে না, জীবন তো আর থেমে থাকতে পারে না। তাই সচেতন হয়ে জীবনকে সাবধানে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। পৃথিবীকে আবার স্বাভাবিক হতে হবে, আবার সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
করোনাকালে আমরা বিশ^জুড়ে আমরা সবাই যুদ্ধের অবস্থার মত ঘরবন্দী হয়ে থেকেছি – অনেক কষ্ট ও চ্যালেঞ্জ বয়েছি। মরণ রোগ কভিড ও মৃত্যুর মিছিল মোকাবেলা করে মানব জাতি ভয়ে ও সঙ্কায় দিন কাটিয়েছে আর অগনিত প্রিয়জনকে শবযাত্রায় পাঠিয়েছে একা নিসঙ্গ। কিন্তু এখন তো অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। সব রাত্রির শেষে ভোর আসে, ভয়েরও শেষ আছে। মানব জাতি আজ চায় এক নতুন ভোর – নতুন আশার ও নির্ভয়ের একটি দীপ্ত দিবস। মানব সভ্যতা সামনে এগিয়ে যাবে নতুন করে। তবে করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে সহসাই বিদায় নিচ্ছে না। আগামী দু’এক বছর তো এই ছোঁয়চে মরণ ভাইরাস মানব জাতির সঙ্গেই থাকছে। তাহলে আমরা এখন কি করব? ভেক্সিন বা টীকা এলেও এই করোনা বা কভিড থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই ভয় নয়, বরং সচেতন হয়ে সাবধানে পথ চলা, মরণ ভাইরাসকে এড়িয়ে চলা, জীবন বাঁচিয়ে চলা, এটাই হবে মানব জাতির বা আমাদের জীবন পথ। এটাই হবে মরণ ভাইরাসের সঙ্গে বসবাসের পথ।

Please follow and like us: