বিশপ জের্ভাস রোজারিও, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ
যাজকদের সেবাকাজ সম্পর্কিত পোপীয় পরিষদ (ভাটিকান) ২৭ জুন ২০২০ একটি নির্দেশনা প্রকাশ করেছে, যার নাম হ’ল “ধর্মপল্লী সমাজকে খ্রিস্টমণ্ডলির বাণীপ্রচার সেবাকাজে পালকীয় রূপান্তর”। এর আলোকে আমরা একটা বিশ্লেষণ করতে পারি। “মরুভূমিতে যাত্রাকালে ইস্রায়েল জাতির লোকেরা যেমন ঈশ^রের মণ্ডলি বলে আখ্যায়িত হয়েছিল, ঠিক তেমনি ভবিষ্যত ও নিত্যস্থায়ী আবাস-সন্ধানী বর্তমান যুগের ’নতুন ইস্রায়েল জাতি’কে খ্রিস্টের মণ্ডলি বলা হয়” (খ্রিস্টমণ্ডলি ৯, ২য় ভাটিকান)। সে এমনই এক জনমণ্ডলি যা ঈশ^র নিজেই গঠন করেছেন, “যারা যীশুকে বিশ^াস সহকারে ত্রাণদাতা রূপে এবং একতা ও শান্তির উৎস হিসাবে গ্রহণ করেছে, ঈশ^র তাদেরকে একত্রে সম্মিলিত ক’রে মণ্ডলি রূপে গঠন করেছেন যেন প্রত্যেকের এবং সকলের জন্য সে পরিত্রাণদায়ী মিলনের নিদর্শন হয়ে উঠতে পারে” (উপরোক্ত)। ইতিহাস ও সময়ে বসবাস করে সে খ্রিস্টের কাছ থেকে প্রাপ্ত পরিত্রাণের সেবা কাজে অংশগ্রহণ করে যায়। এই ঐশজনমণ্ডলির সদস্যরা প্রত্যেকে ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যার যার মত খ্রিস্টমণ্ডলির বিভিন্ন কল্যানমূলক সেবা কাজে অংশ গ্রহণ করে ও দায়িত্ব পালন করে থাকে।
তাই ঐশজনগণই বাণী প্রচার কাজ করে থাকে, আর তা তারা করে যার যার ঐশ আহ্বান, জীবন অবস্থান, পরিপার্শিক অবস্থা অনুসারেই। মণ্ডলির আইন শাস্ত্রে (৫১৫ § ১) “ধর্মপল্লী”র একটি ধর্মতাত্ত্বিক সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এইভাবে – ধর্মপল্লী হ’ল “খ্রিস্টবিশ^াসীদের একটি সমাজ” যাদের রয়েছে বিভিন্ন প্রকার ঐশ আহ্বান, যেমন যাজক, ডিকন (পরিসেবক), নিবেদিত জীবনের ব্যক্তিগণ, খ্রিস্টভক্ত জনগণ, বিভিন্ন সংঘ ও পরিবার, যাদের সকলেই কোন না কোনভাবে ধর্মপল্লীর পালকীয় কাজে অংশ নিয়ে থাকে। এই সকল কাজের দায়িত্ব পালক পুরোহিতের উপর ন্যস্ত, কিন্তু তিনি তা সম্পন্ন করেন উল্লেখিত সকলের সহযোগিতায় ও অংশ গ্রহণে। “নিগূঢ় খ্রিস্টমণ্ডলি” নামক নির্দেশনায় (১৫ অগষ্ট ১৯৯৭) পাল-পুরোহিতের পালকীয় দায়িত্ব পালনে খ্রিস্টমণ্ডলির সকল সদস্যের অংশ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে; আর যাজকদের সেবাকাজ সম্পর্কিত পোপীয় পরিষদ “ধর্মপল্লী সমাজের যাজক, পালক ও নেতা” দলিলে একই নির্দেশনা দিয়েছে (৪ আগষ্ট ২০০২)। উভয় নির্দেশনাতেই খ্রিস্টমণ্ডলির একই বাণীপ্রচার সেবা কাজের বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ধরণের কথা বলা হয়েছে যা আজ একটি বাস্তবতা। বর্তমান দলিলে ধর্মপল্লী সমাজকে রূপান্তরের যে রূপরেখা বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে খ্রিস্টমণ্ডলিতে সকলের স্থান রয়েছে, আর সকলেই সেখানে স্থান পেতে পারে। তবে মণ্ডলির কিছু অতিরঞ্জিত মনোভাব, যেমন খ্রিস্টভক্তদের যাজক মনোভাবাপন্ন হওয়া, যাজকদের সংসারী মনোভাবাপন্ন হওয়া, বা ডিকনদের আধাযাজক বা সুপার খ্রিস্টভক্ত মনে করার মত বিষয়গুলির কোন অবকাশ এখানে নেই। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে এই নতুন দলিলে নতুনত্ব কিছু নেই। নির্দেশনাগুলি সেই পূর্ববর্তী দলিলগুলিতেই প্রকাশিত হয়েছে।
এই নির্দেশনার উদ্দেশ্য হ’ল কিছু পালকীয় পদ্ধতি যার অনেক কিছু ইতিমধ্যেই ধর্মপল্লীর পালকগণ বাস্তবায়ন করেছেন। ধর্মপল্লীর খ্রিস্টভক্তগণ ইতিমধ্যেই নতুন পালকীয় পদ্ধতি সাদরে গ্রহণ করেছে, এবং সেই অনুসারে তাদের অবদান রেখে চলেছে। তবে এইসব নতুন পালকীয় পদ্ধতি কতটা ঠিক বা ঠিক নয় তা অবশ্যই বিবেচনা করে দেখতে হবে; আর যদি ঠিক না হয় প্রয়োজনে তা সংশোধন করতে হবে – এই নতুন নির্দেশনা সেই কথাই বলে। তাছাড়া ভবিষ্যতের পালকীয় পদ্ধতি কি হবে তার ভিত্তিও রচনা করতে হবে। খ্রিস্ট নিজে মণ্ডলিকে দায়িত্ব দিয়েছেন মিশনারী হতে, বাণী প্রচার করতে আর বাহ্যিকভাবে সাক্ষ্যদান করতে; আর তাই এর কাঠামোতে অব্যাহত নবায়ন ও পুনর্গঠন আনা দরকার যেন সে বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ সমূহ মোকাবেলা করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই তাই দেখতে হবে যে পালকীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে পালকীয় যত্ন দেওয়া হয়, তাতে খ্রিস্টে দীক্ষিত সকল ভক্তের সমান অংশ গ্রহণ আছে কিনা। ২য় ভাটিকান মহাসভা থেকে শুরু করে বর্তমানে পোপ ফ্রান্সিস পর্যন্ত মণ্ডলির সকল শিক্ষা মালায় ধর্মপল্লী সমাজ ও পালকীয় সেবার যে দর্শন প্রকাশিত হয়েছে তা শুধু একটি মতামত নয়, বরং তা আমাদের বাস্তব জীবনে অনুসরণ করার জন্যও বটে। আমরা দু’টি চরমাবস্থার কথা চিন্তা করতে পারি: এক দিকে রয়েছে এমন সব ধর্মপল্লী যেখানে পাল-পুরোহিত ও অন্যান্য পুরোহিতগণ সকল সিদ্ধান্ত ও পালকীয় সেবার ব্যবস্থা করেন – সেখানে অন্যান্য দীক্ষিত বিশ্বাসী ভক্তগণ শুধু পুরোহিতগণের আদেশ নির্দেশ পালন করে। আবার অন্যদিকে রয়েছে তারা যারা পোষণ করে গণতান্ত্রিক মনোভাব – যার ফলে তারা মনে করে ধর্মপল্লীতে কোন কর্তৃত্বপূর্ণ পালক পুরোহিতের দরকার নেই, তিনি হবেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি অন্যদের মতই – যাজক বা খ্রিস্টবিশ্বাসী ভক্ত – শুধু তাঁর নিজের উপর অর্পিত কাজটুকুই করবেন। তাদের মতে ধর্মপল্লীর সকল দায় দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব হ’ল যৌথ বিষয়। তাছাড়া তারা ধর্মপল্লীকে মনে করে একটি নির্দ্দিষ্ট ভূমি বা একলাকার বিষয় মাত্র, প্রতিবেশী অন্য কোন সমাজের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
বর্তমান নির্দেশনায় কিন্তু মাণ্ডলিক আইন অনুসরণ করে ধর্মপল্লীর স্থানীয় ও প্রতিবেশী অন্যান্য ধর্মপল্লী ও পালকীয় সমাজগুলির সঙ্গে বিশেষ নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা ও উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য নির্দ্দিষ্ট এলাকায় অবস্থিত ধর্মপল্লীগুলির দলীয় সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে – তা হতে পারে পালকীয় একক (Pastoral Units) বা ভিকারিয়েট (Vicariate)। আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে যে তিনটি ভিকারিয়া রয়েছে তা এই নির্দেশনারই বাস্তবায়ন। এই সব পালকীয় এককের কাজ হ’ল “স্থানীয় প্রতিবেশী ধর্মপল্লীগুলির মধ্যে সমন্বিত সহযোগিতা বৃদ্ধি করা” (Apostolorum Successores, arts. 215b; 217)। ধর্মপ্রদেশের কেন্দ্রের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মপল্লীগুলির সংযোগকে সুদৃঢ় করাই এর উদ্দেশ্য। নতুন নির্দেশনায় বড় বড় ধর্মপ্রদেশের জন্য এপিস্কপাল ভিকার (Episcopal Vicar) এর কথা বলা হয়েছে – যিনি ধর্মপ্রদেশীয় বিশপের সঙ্গে যুক্ত থেকে ও তাঁর নির্দেশনায় পালকীয় কার্য সম্পাদন করে থাকেন। বাংলাদেশের ধর্মপ্রদেশগুলিতে এখনও এই নজির নেই, বা এর আপাতত: প্রয়োজনও নেই। ধর্মপ্রদেশকে বিভিন্ন পালকীয় এককে ভাগ করে ধর্মপল্লীগুলি ও ধর্মপ্রদেশের মধ্যে প্রশাসনিক ও পালকীয় সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন রয়েছে। এর আসল লক্ষ্য হ’ল খ্রিস্টমণ্ডলীর সার্বিক কল্যান। তবে যা-ই করা হোক না কেন, ধর্মপ্রদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিভিন্ন কৃষ্টির মানুষের বসবাস, ইত্যাদি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণের সহযোগি ও অংশ হওয়া মানে হ’ল একটি অভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির মধ্যে প্রবেশ করা। অর্থাৎ এইভাবে আমরা খ্রিস্টমণ্ডলীর সদস্য হিসাবে যাজক, নিবেদিত ব্যক্তিবর্গ ও ভক্তবিশ্বসীগণ সকলে মিলে একটি সমন্বিত ও অংশগ্রহণকারী মণ্ডলি বা যীশুর দৃশ্যমান দেহ গড়ে তুলতে পারি। উপর থেকে ঐশ জনগণের বা খ্রিস্টবিশ্বাসী ভক্তদের উপর কোন পরিকল্পনা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তাই এর জন্য ধর্মপ্রদেশ ও ধর্মপল্লীকে একটি পালকীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে যাজক, ধর্মব্রতী ব্যক্তিগণ ও খ্রিস্টভক্তগণ সকলে মিলে একটি পালকীয় পরিকল্পনা তৈরী করবে, যা অনুসরণ করে ঐশরাজ্য বিস্তারের জন্য স্থানীয় ধর্মপ্রদেশের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে এরূপ প্রক্রিয়া সক্রিয় রয়েছে – ভিকারিয়া ও ধর্মপ্রদেশ পর্যায়ে যে পালকীয় আলোচনা সভাগুলি অনুষ্ঠিত হয়, তা এই লক্ষ্য পূরণের জন্যই। তাছাড়া রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের রয়েছে বাৎসরিক পালকীয় কর্মশালা যার মাধ্যমে প্রতি বছর এখানে বিশেষ মূলভাব নিয়ে আলাপ আলোচনা করে ধর্মপ্রদেশ ও ধর্মপল্লীগুলির জন্য কর্ম-পরিকল্পনা করা হয়। এই পরিকল্পনা প্রনোয়নে যেমন ঘাস-মূলের অংশগ্রহণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও তার অংশগ্রহণ। এই প্রক্রিয়ায় পবিত্র আত্মাই হচ্ছেন পথ প্রদর্শক ও চালিকা শক্তি। যাজকদের জীবন ও সেবাকাজ সম্পর্কিত পোপীয় পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত এই নতুন নির্দেশনা অনুসারে এইভাবে সকল ধর্মপ্রদেশ ও ধর্মপল্লীগুলি যেন পুণর্গঠিত হয় বা রূপান্তিরিত হয় ও নতুন কাঠামো নিয়ে নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করে ঐশজনগণ হয়ে উঠতে পারে – সেটাই নতুন এই নির্দেশনার লক্ষ্য।