-ফাদার সাগর কোড়াইয়া

জনকন্ঠ পত্রিকা যারা পড়েন; নিশ্চয়ই প্রতি বৃহস্পতিবার পাঠকদের লেখা নিয়ে ‘সমাজ ভাবনা’ নামক একটি পৃষ্ঠা দেখে থাকবেন। সেখানে একটি নির্দিষ্ট মূলভাব দেওয়া থাকে। পাঠকগণ মূলভাবের উপর তাদের চিন্তা-চেতনা লেখনীর মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে পারেন। বিগত বেশ কয়েক বছর পূর্বের এক সংখ্যায় ‘সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ রোধে সংস্কৃতি’ বিষয়ের উপর পাঠকগণ তাদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এটা বর্তমান সময়ের জন্য একটি সময়োপযোগী চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করার সুযোগ। দেশ তথা সারা পৃথিবীতে জঙ্গীবাদের যেভাবে উত্থান হচ্ছে, সেখানে সংস্কৃতি কি তা রোধে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারছে! আমরা পরিবারে জন্মগ্রহণ করি; পরিবার যেহেতু একটি বৃহত্তর সংস্কৃতির সাথে জড়িত তাই স্বাভাবিক ভাবেই বলতে পারি, একটি শিশু জন্মের পর পরই সংস্কৃতির সাথে জড়িত হয়। সংস্কৃতির আলো-বাতাস, ঐতিহ্য-কৃষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। আমাদের সমাজে বহু শিক্ষিত ব্যক্তি রয়েছেন; যারা শিক্ষা ও সংস্কৃতির নির্যাস কখনো আহরণ করতে পারেন না। তাই সব শিক্ষিত ব্যক্তি সংস্কৃতিবান নয় কিন্তু সব সংস্কৃতিবান ব্যক্তিই শিক্ষিত। এটাকে অন্যভাবে বললে, সকল শিক্ষিত ব্যক্তি সচেতন নয় আবার সকল সচেতন ব্যক্তিই শিক্ষিত। আপনি, আমি ও আমরা কোন দিকে নিজেদের চালিত করছি; সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।
ভালোই লাগে; যখন দেখি বাৎসরিক কোন ছুটিতে প্রায় প্রতিটি ধর্মপল্লীতে ‘প্রতিভার উন্মেষ’ ‘শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মেলা’ ‘পিঠা মেলা’ বা এ ধরণের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যারা ঢাকায় বা অন্য জেলা শহরে চাকুরী সুবাদে অবস্থান করেন; তাদের সুযোগ হয় এই অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করার। উদ্যোক্তাদের মধ্যে অধিকাংশই চাকুরী বা পড়াশুনার জন্য বাড়ির বাহিরে থাকেন। গ্রামে ও ধর্মপল্লীতে অবস্থানরত সবার জন্য যে তাদের চিন্তা রয়েছে; এই সব শিক্ষনীয় কার্যাবলী আয়োজন করার মধ্য দিয়ে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে বাঙ্গালী যে অধ্যুষিত ধর্মপল্লীগুলো রয়েছে সেখানকার গুটি কয়েক ধর্মপল্লীতে সংঘ, দল, প্রতিষ্ঠান বা গ্রামভিত্তিক প্রতি বছরই এ ধরণের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের খবর শুনলে ভালোই লাগে। কিন্তু চাক্ষুস দেখার সৌভাগ্য খুব কমই হয়।
ভারতীয় জি-বাংলা চ্যানেলের ডেন্স বাংলা ডেন্স অনুষ্ঠানটি আমি সুযোগ পেলেই দেখার চেষ্টা করি। ছোট কমলমতি শিশুদের নাচ দেখে অবাক না হয়ে পারিনা! অনুষ্ঠানের এতো বড় স্ট্রেজে ওরা নাচতে সাহস পায় কিভাবে? ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না কিন্তু নাচের মুদ্রা সাবলীলভাবেই ওদের শরীরে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভাবি; এই কমলমতি শিশুরা শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সংস্কৃতির যে বিশাল দুয়ারে প্রবেশ করেছে তা ওদের জন্য কত না সৌভাগ্যের! আমাদের পরিবার ও সমাজের প্রতিটি শিশুই যদি শিক্ষার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চার অভ্যাস ধরে রাখতে পারে তাহলে জীবনে জীবন মেলাবার রসদ পেয়ে যাবে নিশ্চিত। একবার আমার এক আত্মীয়া আমাকে ফোন করে বললো যে, তার মেয়ে এলাকায় আয়োজিত প্রতিভার উন্মেষে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করবে। আমি শুনে অবাক! মেয়েটির বয়সইবা কত হবে। পাঁচ বা ছয়। এই বয়সেই যদি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে পারে তাহলে বড় হলে আরো ভালো করার সম্ভাবনাই বেশী। কিন্তু চর্চাটা ধরে রাখতে হবে। আর তা করতে পারলে শিক্ষা ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান আমাদের খ্রীষ্টিয় সমাজে ও একে অপরের সাথে জীবনে জীবন মেলাবার কথা বলবে। প্রায়ই শোনা যায়; অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতিতে। অবশ্যই সব জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিবো কিন্তু তা যেন নিজের মাতৃতুল্য সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে না হয়।
সেই ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের শুরুর দিকে বা পরবর্তীতে যারা ভাওয়াল থেকে বোর্ণী, বনপাড়া, মথুরাপুরে এসেছিলেন তাঁরা খালি হাতে আসেননি। বরং সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন সেখানকার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও লোকাচার। যার মধ্যে পড়ে খাবার-দাবার থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি, ভাষার আঞ্চলিক টান; এ রকম নানাবিধ পথের অলিগলি। যা আজও বংশপরম্পরায় টিকে আছে এবং সময়ের পরিক্রমায় কিছু কিছু হারিয়েও যাচ্ছে। ভাওয়াল সংস্কৃতির মধ্যে বিশেষভাবে পরিচিত হচ্ছে, ঠাকুরের গান, নানাবিধ পালাগান বা অভিনয়, বৈঠকীগান, কীর্তন। আর এই সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে সে সময় খ্রীষ্টভক্তগণ নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসকেই লালন করতো। পরবর্তীতে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও এর চর্চা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এ চর্চা যেন ভাওয়াল জীবনের সাথে রাজশাহীর জীবন মেলাবার কথাই বলে।
সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ যে এখন একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে তা নয়। সেই সময় যারা ভাওয়াল থেকে রাজশাহীতে এসেছেন তাদের অভাব ছিলো খাদ্যের তবে মূল্যবোধের অভাব কোনভাবেই ছিলো না। নৈতিকতাবোধ ছিলো সর্বোচ্চ সীমায়। এখনো মূল্যবোধ ও নৈতিকতার আলো হারিয়ে যায়নি বলেই ভালো আছি। তবে হারাতে যে বেশী দিন আর বাকি নেই তা কে বলতে পারে? আগে বিচার-সালিশী সামাজিক বা পালকীয়ভাবে খ্রীষ্টিয় ভাবধারায় সমাধা করা হতো। এখন যদি সেই ঐতিহ্য ধরে রাখা যায় তাহলে আমরাই লাভবান হবো। কারণ কোর্ট-কাচারীর মার-প্যাঁচ আমরা খ্রীষ্টভক্তগণ কমই বুঝি।
শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চা আমাদের উচ্চতর মন-মানসিকতা গঠনে সাহায্য করে। আমাদের দেশে জঙ্গীবাদের যেভাবে উত্থান হচ্ছে তা নির্মূলে দেশের প্রতিটি স্থানে তাই গড়ে তুলতে হবে সংস্কৃতির অভয়ারণ্য ভূমি। প্রতিটি মানুষ যেন বাংলা সংস্কৃতিতে বসবাস করতে পারে; নিজে সংস্কৃতিতে স্নাত হয়ে অন্যকেও সংস্কৃতির পথে নিয়ে আসতে পারে; সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাঙ্গালীর গর্ব করার মতো একটি উদার সংস্কৃতি রয়েছে। হাজার বছরের এই লালিত সংস্কৃতি আজ প্রচণ্ড শক্তিশালী। কোন দৃশ্য-অদৃশ্য শক্তিই বাংলা সংস্কৃতির মূলে আঘাত করে ধ্বংস আনতে পারবে না। যেহেতু যুগে যুগে উপনিবেশ শক্তির অত্যাচার, শোষণ-শাসন ও দমন-উৎপীড়নে বাংলা সংস্কৃতিই প্রথম প্রতিবাদ করেছিলো; তাই এখনো আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস সুস্থ্য সংস্কৃতিচর্চা পরিবার, সমাজ, দেশ ও বৈশ্বিক সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ দমনে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসাবে কাজ করতে পারবে। সংস্কৃতিই পারবে বাঙ্গালীকে হাতে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে একটি উন্নত বিশ্বের কাতারে। আর শিক্ষা-সংস্কৃতিই পারবে জীবনে জীবন মিলাবার কথা বলতে। জয়তু হে ব-দ্বীপ এই বাংলা, জয়তু জীবনে জীবন মিলাবার উদার সংস্কৃতি। বয়ে চলুক নিরবধি খ্রীষ্টিয় সংস্কৃতি।

Please follow and like us: