ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
অনেকে করোনা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ বা কোভিড- ১৯ থেকে সেরে উঠেছে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে রোগী তার রোগ পরবর্তী নানা উপসর্গ থেকে নিষ্কৃতিলাভ করেনি। কোভিড- ১৯ নেগেটিভ হওয়ার পর আরো যা কিছু করতে হবে বা যে সব উপসর্গ শরীরে দেখা দিতে পারে, তার কিছু তথ্য আজকের লেখায় তুলে ধরার প্রয়াস রইলো।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে প্রথমবার নেগেটিভ হওয়ার পর আরো কমপক্ষে ১৪দিন আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সম্ভব হলে ১৪দিন পরে আরো একবার কোভিড টেস্ট করে নিলে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়। কারণ পত্র-পত্রিকায় দেখা গেছে যে, একবার নেগেটিভ হওয়ার পর আবার পজেটিভ হয়েছে। সুতরাং, পর পর দুইবার নেগেটিভ হওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক মেলামেশায় আর কোনো বাধা থাকার কথা নয়।
কোভিড- ১৯ নিয়ে চিকিৎসকদের মতে, নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ রেজাল্ট আসলেও রোগীর পুরো সুস্থতা নির্ভর করছে- রোগী কতো পরিমানে সংক্রমণ ও অসুস্থ হয়েছিলো। বিভিন্ন তথ্যে দেখা গেছে, কোভিড পরবর্তী কোনো কোনো রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে, অন্যদিকে কেউ কেউ আবার লম্বা সময় ধরে স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছে। এর কারণ হতে পারে- বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক গঠন এবং শরীরে ক্রনিক রোগ আছে কীনা (ডায়াবেটিস, কিডনি, রক্তচাপ ও হার্ট, ইত্যাদি)। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোভিড নেগেটিভ হওয়ার পরে তিন ধরণের শারীরিক জটিলতা বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। প্রথমটি হলো অর্গানিক বা অঙ্গের সমস্যা। যেমন- ফুসফুস, কিডনি, যকৃত, হার্ট, মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র, হজম সমস্যা, ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো সাধারণ উপসর্গ, যেমন- শরীরে অবসাদ-ক্লান্তি, মানসিক চাপ, রুচি বা খাদ্য স্বাদ না লাগা, বুক ধড়ফড় করা, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া। যাদের শরীরে ক্রনিক কোনো রোগ নেই, কম সময়ের মধ্যে তারা এই উপসর্গগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে। সবশেষে তৃতীয়টি হলো মানসিক সমস্যা। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে হলে রোগীকে অবশ্যই আতঙ্কমুক্ত হতে হবে, গুজবে কান দিতে হবে না। এই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার উপযুক্ত পথগুলো হলো- পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ ও হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করা, টিভি দেখা, বই পড়া, ইত্যাদি। এই ব্যাপারে বাড়ির অন্যান্যদেরও সহযোগীতা করার প্রয়োজন রয়েছে।
কোভিড- ১৯ পরবর্তী কারো কারো ক্ষেত্রে ফলোআপ চিকিৎসা অবহেলা করতে নেই। যেমন যে সব ব্যক্তির হার্টের সমস্যা, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা রয়েছে- তাদের করোনা থেকে সেরে উঠার পর এই ফলোআপ বা চেকআপ চিকিৎসাবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। চিকিৎসকদের মতে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ফুসফুসে যে ক্ষত বা প্রদাহ তৈরি হয়, সেই ক্ষত বা প্রদাহ- ভাইরাস মুক্ত হওয়ার পরও থেকে যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে ফলোআপ চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ। করোনা ভাইরাস মূলতঃ শ্বাসতন্ত্রের একটি জটিল রোগ। আর এই রোগটি প্রথমেই নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ ক’রে আঘাত করে মানুষের শ্বাসযন্ত্র- ফুসফুসকে। এই আঘাতের কারণে ফুসফুসে ক্ষত বা প্রদাহ শুরু হয়। সেই ক্ষেত্রে কোভিড থেকে সেরে উঠলেও ফুসফুস সংক্রমণের কারণে- অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরানো ও বুক ধড়ফড় করার মতো উপসর্গ থাকতে পারে। সুতরাং এইসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া, কোভিড আক্রান্ত রোগী দ্রুত সেরে উঠছে মনে হলেও কিছু কিছু উপসর্গ লম্বা সময় ধরে থেকে যেতে পারে। যার মধ্যে একটি হলো কাশি। বিশেষ করে শুকনা কাশি এবং সেই সাথে শ্বাসকষ্ট থাকতে পারে। মনে রাখতে হবে- শ্বাসকষ্ট মানেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নয়। অনেকের পুরাণো অ্যালার্জি ও অ্যাজমা থাকতে পারে- যার কারণে শ্বাসকষ্ট, কাশি থাকতে পারে। তবে কোনো কোনো রোগীর তার ক্রনিক রোগ সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। যেমন ডায়াবেটিস- এটি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে- তাদের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত হাঁটাচলা এবং ওজন নিযন্ত্রণের দিকে নজর রাখতে হবে। সেই সাথে নিয়মিত ফলোআপ করতে হবে। অন্যদিকে যাদের কিডনি সমস্যা এবং হার্টের সমস্যা রয়েছে- তাদের যেমন স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, তেমনি নিয়মিতভাবে ফলোআপ করতে হবে।
ক্লান্তি-অবসাদ, কোভিড- ১৯ পরবর্তী একটা নিয়মিত সমস্যা। করোনা নেগেটিভ হওয়ার পর কম বেশি প্রায় সবার ক্ষেত্রেই এই ক্লান্তি-অবসন্নতা দেখা দিতে পারে। এই উপসর্গ হার্টের সমস্যা, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো যাদের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই। এই ক্লান্তি-অবসাদ থেকে রেহাই পেতে হলে নিয়মিত বিশ্রাম, ভিটামিনযুক্ত খাদ্য, বয়স ও শরীরের স্বাস্থ্য বিবেচনা অনুসারে চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু ব্যায়াম অপরিহার্য। এছাড়াও সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর পরবর্তী কিছুদিন গা ব্যথা, মাথা ব্যথা ও বেশি ঘাম হওয়ার উপসর্গ থাকতে পারে। এগুলো ধীরে ধীরে এবং একটা সময়ের ব্যবধানে ঠিক হয়ে যায়। তবে বেশি ঘাম দেওয়া মানেই শরীর থেকে বেশি বেশি লবণ বের হয়ে যাওয়া ফলে সোডিয়াম কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমন অবস্থায় স্যালাইন, ডাবের পানি পান করতে হবে। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে- তাদের একটু দেখে শুনে খেতে হবে।
সবশেষে, করোনা ভাইরাসের মতো এমন এক অজানা রোগ থেকে যারা সুস্থতা লাভ করেছেন, তাদের জন্য রোগ পরবর্তী উপসর্গ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা কোনো জটিল ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে সবকিছুর আগে নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। পুরণো নিয়মে ফিরে যাওয়ার আগে শরীরকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা। (উল্লেখিত বিষয়গুলো আমার নিজের চিন্তা-ভাবনা নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সরকারের স্বাস্থ্য বিধি, পত্র-পত্রিকা এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের যে সব মতামত প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)।
কোভিড- ১৯ পরবর্তী সময়ের কিছু ভাবনা
Please follow and like us: