২০২০ সালটা শুরুই হয়েছে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে। মানবজাতির জন্যে এই বছরের মতো বছর বুঝি ইতিহাসে আর কখনো আসেনি। চীনের ইউহানে যে করোনার শুরু তা ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে সারা পৃথিবীকে। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা-সমুদ্র, খাল-বিল, মরুভূমি সব জায়গায় করোনার রাজত্ব আজ। ক্ষুদ্র একটি অনুজীবের কাছে পরাস্ত বিজ্ঞান, জ্ঞান-বুদ্ধি, গবেষণা। করোনার পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমরা সবাই অবগত। যতটা না ভেবেছিলাম করোনার গতি-প্রকৃতি বিষয়ে; করোনা তারও চেয়ে বেশী আতঙ্কগ্রস্থ হবার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। করোনার এই সময়ে আমরা কেউ ভালো নেই। ভালো না থাকাটাই স্বাভাবিক। সারা পৃথিবী যেখানে স্থবির সেখানে আমাদের ভালো থাকাও না থাকা হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও পৃথিবী করোনার ছোঁবলে নাস্তাবুদ। ব্যক্তি ও পরিবার জীবনের দিকে তাকালে ভালো না থাকার উপাখ্যানগুলো বের হয়ে আসে। করোনার এই সময়ে নেতিবাচক অনেক কিছুই বের হয়ে আসছে। একটু ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে আবার ভালো কিছুর উপাখ্যানও দেখতে পাওয়া যায়।
করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে ব্যক্তি বিশেষে সবাই পরাজিত। তবু জীবন যুদ্ধে কিন্তু কেউ থেমে নেই। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যখন লকডাউনের ধুয়ো উঠেছিলো তখনও খেঁটে খাওয়া মানুষকে রুটি রোজগারের আশায় পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। করোনার এই সময়ে অনেকেই অসৎ পন্থায় কাড়ি কাড়ি অর্থকরীর মালিকবনে যাচ্ছে। করোনার পূর্বেও যাদের তেমন কিছুই ছিলো না তারাও মানুষ ঠকানোর ব্যবসা ফেঁদে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে ঠিকই ফায়দা হাসিলে ব্যস্ত। মানুষের মধ্যে করোনাকালে মানবিক মূল্যবোধগুলো জাগ্রত হওয়ার কথা। কিন্তু অনেক সুযোগসন্ধানী করোনাকালে অভিনব প্রতারণার ফাঁদ ফেলে মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলছে। করোনার দোহাই দিয়ে সবার অজান্তে সমাজের কিছু মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার দশা। এই ধরণের প্রতারকরা মুখোশের আড়ালে মুখ পরিধান করে উপকারের নামে অপকারের নানা পসরা সাজিয়ে বসেছে প্রতিনিয়ত। দূর্নীতির যত রকমের কলা-ছলা-কৌশল রয়েছে তা প্রয়োগে পিছুপা হচ্ছে না। করোনাকালে বলা যায় তারা ভালো আছেন আর যারা দুঃসহনীয় কষ্টে তাদের দুঃখের উপাখ্যান যেন বাড়ছেই। দূর্নীতিপরায়নগ্রস্থ এই ধরণের মানুষেরা সাময়িকভাবে লাভবান হচ্ছে অঢেল; কিন্তু পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না। আর সে বাপের দেখা তারা ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন। জেকেজি ও রিজেন্ট নামক করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করার সংস্থাগুলোর খবরগুলো কয়েকদিন আগেও ছিলো টপ অফ দ্যা কান্ট্রি। সাহেদ, সাবরিনা ও আরিফদের মতো ব্যক্তিরা বিশে^ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। করোনা পরীক্ষার ভূয়া রিপোর্ট দিয়ে নিজেদের বানিয়েছে টাকার কুমিড়। আর ভুক্তভোগীকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর দারপ্রান্তে। সাহেদ নিজেকে বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও দেশের চিন্তাবিদদের কাতারে বসাবার জন্যে টাকা ঢেলে নিজের ঢোল নিজেই পিটিয়েছে। কিন্তু পেটানো এতটাই জোরে ছিলো যে, ঢোল ফাটতে সময় লাগেনি। আর সাবরিনা নিজের গ্ল্যামার দিয়ে কুপাকাত করেছে কর্তাব্যক্তিদের চক্ষু! তবে সে গ্ল্যামারে যে মেক্যাপের পরিমাণ বেশী ছিলো তা বুঝতে সময় লাগেনি। সাহেদ-সাবরিনা ও আরিফ ক্ষমতার সব রকম অপব্যবহার করেছে। প্রশ্ন থেকে যায়- কিসের ক্ষমতাবলে তারা নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মতো সাহস দেখিয়েছে! দিনে দিনে তাদের কুকর্মের বহু গল্প প্রকাশ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে ধরা পড়ে সব কথাই স্বীকার করেছে এই তিনজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যেহেতু ঘটনার পিছনে ঘটনা হারিয়ে যায় তাই মনে হচ্ছে সাহেদ, সাবরিনা ও আরিফের এই কুকর্মের ঘটনাও হারিয়ে যাবে। সবাই একদিন ভুলে যাবে তাদের মানুষ হত্যার কারসাজি। ইতোমধ্যে সবাই ভুলেও যেতে বসেছে। এই প্রতারকদের নিয়ে কিছুদিন আগেও মানুষের মধ্যে যে নাচুনে-কাঁদুনে অবস্থা হয়েছিলো তা আজ আবার স্থিমিত।
শিক্ষার্থী ও শিশুদের অবস্থা করোনাকালে বেশ সঙ্গীন। শিক্ষার্থীদের জন্যে মায়া হয়। কয়েকদিন পূর্বে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সাথে কথা হচ্ছিলো। অভিভাবক তার সন্তানের বিষয়ে জানালো যে, তার সন্তান করোনার এই পরিস্থিতিতে লেখাপড়া একদম ভুলে গিয়েছে। আর সে কারণে ঘরে প্রাইভেট টিউটর রেখে আবার লেখাপড়াগুলো চর্চা করাতে হচ্ছে। এটি শুধুমাত্র অনেকগুলো চিত্রের মধ্যে একটি চিত্র মাত্র। পিতামাতা ও অভিভাবকদের দায় এখানে অনেকখানি। করোনা ভাইরাস যেন ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে না পড়ে সে জন্যে সরকার স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখেছে। তবে বন্ধ মানে এই ছিলো না যে, পড়াশুনাও বন্ধ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়- অনেক শিক্ষার্থী করোনার এই পরিস্থিতিতে পড়াশুনা, বইপত্রের দিকে একদমই ঘেঁষে দেখেনি। বইপত্রগুলোর উপরে ধুলার আস্তরণ যে পড়েছে তা নিসন্দেহে বলা যায়। আর যদি তাই হয় তাহলে অনুশীলনের অভাবে পড়াশুনা তো আংশিক হলেও ভুলে যাবারই কথা।
করোনার বর্তমান ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে মানুষের হাতে অঢেল সময়। ঘরে বসে থেকে সময় যেন কিছুতেই কাঁটতে চায় না। তবু অনেকে মিডিয়ার বদৌলতে ভালোই সময় কাঁটিয়েছেন ফেসবুক, ইউটিউব, ম্যাসেঞ্জার, গগল ও নানা ধরণের অ্যাপসে। সবার মধ্যে কবি, সাহিত্যিক ও লেখক ভাব জেগে উঠেছে। চিন্তা ও মননশীলতার প্রকাশ পাচ্ছে লেখনিতে। আর এই ভাব যদি নিয়মিত থাকে তাহলে দেশ, জাতি ও সমাজ আশা করি অনেক কিছুই পাবে। কবি, সাহিত্যিক ও লেখকে ভরে যাবে দেশের সর্বত্র। অন্যদিকে এটা দিনের আলোর মতো সত্য করোনায় সবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ছেদ পড়েছে। একটি শুদ্ধ-সুন্দর-সুমিষ্ট ও মাধুর্যে ভরপুর সঙ্গীতে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটলে যেমন পরিবেশটাই কেমন যেন হয়ে উঠে তেমনি হয়েছে সবার জীবনের অবস্থা। শিশুদের জন্যে খারাপ লাগে! ওদের স্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেই তো বেড়ে উঠার কথা। কিন্তু শিশুদের জীবনে ছন্দপতন হয়েছে। ওরা করোনার এই পরিস্থিতিকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। শিশুদের দৌঁড়-লাফ-ঝাঁফ করেইতো বেড়ে উঠার কথা; কিন্তু ওরা আজ ঘরে বন্দি। ঘরের বাইরে বের হচ্ছে কদাচিৎ; আর বের হলেও মাস্ক নামক মুখোশের আড়ালে আসল মুখ যাচ্ছে হারিয়ে। ফলে স্থুলতা নামক রোগের ঘরে শিশুরা বড় হচ্ছে দিন দিন।
প্রকৃতিকে ধর্ষণ করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবেই। প্রকৃতির নিয়মই এটা। পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসের কথানুযায়ী, ‘ঈশ^র মানুষের পাপ ক্ষমা করেন কিন্তু প্রকৃতি ক্ষমা করে না’। করোনা ভাইরাস মানুষের প্রকৃতিকে ধর্ষণেরই ফল। আর সময় এখন প্রকৃতির প্রতিশোধ নেবার। প্রকৃতিকে মানবজাতি যেভাবে ধ্বংসের কালো হাতে গলাটিপে হত্যা করতে শুরু করেছিলো- এখন প্রকৃতি প্রতিশোধ নিয়ে তার আপন বলয়ে ঠিকই ফিরে যাচ্ছে। মানুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ হওয়ায় প্রকৃতি হয়ে উঠেছে সবুজ। বন্যপ্রাণীরা অভয়াশ্রমে বেড়ে উঠছে অবলীলায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর জন্যে এই দূর্বিষহ অবস্থা আসার দরকার ছিলো। নয়তো পৃথিবী এমন এক পরিস্থিতিতে চলে যেতো যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব হয়ে পড়তো।
করোনার বর্তমান সময়ে কেউ ভালো নেই আমরা- সবাই যেন ভালো থাকার অভিনয় করছি। আর ভালো না থাকার জন্য আমরাই দায়ী। তবু বলবো- মানুষের ভালো থাকা একান্তই প্রয়োজন। জানি না, পৃথিবীতে আর কতদিন করোনা অবস্থান করবে। যতদিনই থাকুক- আমরা যেন ভালো থাকি। ভালো থাকুক মানবজাতি। মানবজাতিকে তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধ করতে হবে করোনা ভাইরাসের সাথে। সুদিন আসবে। তবে তা কবে জানি না। যতদিন না আসে ততদিন ভালো থাকি, বেঁচে থাকি। ভালো না থাকার উপাখ্যানে ভালো থাকার উপাখ্যানই যেন যোগ হয় প্রতিদিন।

Please follow and like us: