ফা. সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
ভূমিকাঃ প্রতি বছরের মতো এবারও রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিসে অনুষ্ঠিত হলো ১৮তম বাৎসরিক পালকীয় কর্মশালা-২০২০। তবে কোভিড- ১৯ মহামারির কারণে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিবিধান এবং সরকারের স্বাস্থ্যবিধি আমলে এনে পালকীয় কর্মশালার ধরণটা বদলে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বছরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ডাইয়োসিসের প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রিয়ভাবে একটা কর্মশালার আয়োজন করা হতো। কিন্তু এবার তা না করে তিনটি ভিকারিয়াতে আলাদাভাবে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। (মধ্য ভিকারিয়া, স্থান:- আন্ধ্যারকোটা- ২১ আগস্ট)। উত্তর ভিকারিয়া, স্থান:- বেনেদুয়ার- আগস্ট ২৮ এবং দক্ষিণ ভিকারিয়া, স্থান: বোর্ণী- সেপ্টেম্বর ৪)। তিনটি ভিকারিয়াতে পর্যায়ক্রমে পালকীয় কর্মশালার আয়োজন সমাপ্ত হওয়ার পর সেপ্টেম্বরের ১১-১২ তারিখে খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্রে যৌথভাবে পালকীয় সম্মেলনের মধ্যদিয়ে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের পালকীয় কর্মশালার যবনিকা টানা হয়। এবছরের পালকীয় কর্মশালার মূল বিষয় ছিলো ঃ আমরা হলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক।
পূর্ব কথা: ১৮তম বাৎসরিক পালকীয় কর্মশালা সামনে রেখে ডাইয়োসিসের বিশপ জের্ভাস রোজারিও একটি পালকীয় পত্র প্রকাশ করেন। শুরুতেই তিনি করোনা ভাইরাসের কোভিড- ১৯ মহামারির কথা উল্লেখ করে বলেন, “জগত সৃষ্টির সময় তো এই ভাইরাস ছিলো না ! তাহলে কীভাবে এখন এলো ? মানুষের বা মানব জাতির কোনো দায় এতে নেই তো ?” ঈশ্বর সবকিছু মুখের কথায় সৃষ্টি করলেও, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন নিজের হাত দিয়ে এবং নিজের প্রতিমূর্তিতে। পরে ঈশ্বর “এর সব দায়িত্ব মানুষকে দিয়েছেন, যত্ন ও রক্ষণা-বেক্ষণ করতে, আর আমরা তা মানিনি। আমরা পৃথিবীকে সবুজ ও পরিস্কার রাখিনি।” পোপ ফ্রান্সিসের ‘তোমার প্রশংসা হোক’ সর্বজনীন পত্রের বরাত দিয়ে বিশপ বলেন, “এই পৃথিবীর সম্পদ সবই দিয়েছেন ঈশ্বর, আর তা তিনি দিয়েছেন সকল যুগের, সকল দেশের সকল জাতি-গোষ্ঠী মানুষের জন্য। আমরা পৃথিবীর সম্পদ স্বার্থপরের মতো শুধু আমরাই ভোগ করেছি- আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সঞ্চয়, রক্ষণা-বেক্ষণ বা বাড়িয়ে তোলার মনোভাব বা আগ্রহ দেখাইনি।” তিনি বলেন, পরিবেশ বাঁচাও-পৃথিবী বাঁচাও- আন্দোলনের সন্মুখভাগেই রয়েছে বিশ্ব ক্যাথলিক চার্চ। পোপের নেতৃত্বে “আমাদের অভিন্ন বসত-বাটী” এই ধরিত্রী মাতার যত্নের আবেদন জানানো হলেও মানুষের স্বার্থ, লোভ ও দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতার কারণে বিশ্ব পরিবেশ আজ বিপর্যয় ও হুমকীর মধ্যে। ফলে বিশ্বের উপর নেমে আসছে বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি।
গত ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের বাৎসরিক পালকীয় কর্মশালার মূল বিষয় ছিলো, “সৃষ্টি ও কৃষ্টির মধ্যদিয়ে মঙ্গলবাণী ঘোষণা।” সৃষ্টির মধ্যে কৃষ্টিকে লালন পালন করে মানুষের মাঝে মঙ্গলবাণী ঘোষণা। কৃষ্টি হলো ঈশ্বরের প্রশংসা-গৌরব করার একটি মাধ্যম। কৃষ্টির মাধ্যমে সৃষ্টির মধ্যে মানুষের উৎসব-যজ্ঞগুলো আয়োজন করতে গিয়ে প্রকৃতি ধ্বংস ঈশ্বরের অভিপ্রায় নয়। কিন্তু মানুষ বাস্তবে প্রকৃতিকে ধ্বংসই করেছে। “সৃষ্টি ও কৃষ্টির মধ্যদিয়ে মঙ্গলবাণী ঘোষণা” বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি এগুনো সম্ভব হয়নি। তার আগেই কোভিড- ১৯ মহামারি মানুষের স্বাভাবিক জীবনের গতি থামিয়ে দিয়েছে। এতে করে গণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে নানা দুর্ভোগ। কর্ম, জীবন-জীবিকা ও পেশা হারিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। অর্থনীতির চাকা থেমে গেছে। তাতে করে, ভবিষ্যতে মানব সভ্যতাকে আরো নানা সংকটের সমুক্ষীণ হতে হবে। সবশেষে বিশপ তাঁর পালকীয় পত্রে বলেন, “আমি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে সেইসব মানুষদের স্মরণ করি- যারা বিশ্বব্যাপী মানুষের বিপর্যয়ের সময় অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। যারা খ্রিস্টকে অনুসরণ করে- তারাই এমনটি করতে পারে। যিশু নিজেই বলেছেন, “আমি যেমন তোমাদের ভালোবেসেছি, তোমরাও তেমনি পরস্পরকে ভালোবাসো।”
আলোচ্য বিষয়বস্তু- ১ঃ যিশু ও মন্ডলির শিক্ষায় আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক- বিষয়ের উপর আলোচনা উপস্থাপন করেন, রাজশাহী সিটি’র কলিমনগর অবস্থিত, হলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চের ফাদার ইন চার্জ ইম্মানুয়ের কে. রোজারিও। তিনি বলেন, “ঐশতাত্ত্বিক ও মন্ডলির এতিহ্য অনুসারে সেবক হয়ে উঠা” প্রতিটি ভক্তের প্রথম কাজ। একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবককে যেমন গৌরব করতে হবে ঈশ্বরের, তেমনি লালন-পালন করতে হবে তাঁর সৃষ্টিকে। ফা. রোজারিও বলেন, “এই পৃথিবীর সম্পদ সবই দিয়েছেন ঈশ্বর, আর তা দিয়েছেন সকল যুগের, সকল দেশের, সকল জাতিগোষ্ঠী মানুষের জন্য। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর “তোমার প্রশংসা হোক” সর্বজনীন পত্রের মধ্যদিয়ে বিশ্বের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন, “আমাদের অভিন্ন বসত-বাটী” এই ধরিত্রী মাতার যত্ন করার জন্য। তাহলে এটা স্পষ্ট যে, এই সর্বজনীন পত্রটি বিশ্বসৃষ্টি ও ঈশ্বরের অন্যান্য দানের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করে। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমরা কেমন পৃথিবী রেখে যেতে চাই ? কঠোরভাবে মানব সমাজকে ঝাকুনি দেওয়া প্রশ্নটি মানুষের দায়িত্বের কথাই বলে আর এই দায়িত্ব প্রকাশ পায় মানুষের সেবায়। আবার এই দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হচ্ছে একজন ‘ব্যবস্থাপক’, যাকে অন্যের গৃহ এবং বিষয়-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যারা বিশ্বাস করে ঈশ্বর বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন, তারাই বিশ্বাসী এবং তারাই সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। ঈশ্বর চান, তাঁর দেওয়া বিভিন্ন দান- মানুষ তার প্রতিভা, প্রজ্ঞা, সামর্থ্য-শক্তি দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাক, বিশ্বকে বসবাসের আরো যোগ্য করে তুলুক, আর এইভাবে হয়ে উঠুক ঈশ্বরের কাজের সহযোগী, ঈশ্বরের সহকর্মী। আর এইভাবে, এই অর্থেই সমগ্র সৃষ্টির উপর আইনসম্মত অধিকার ঈশ্বর মানুষের উপর ন্যাস্ত করেছেন। আর এইভাবেই মানুষ লাভ করে- ঈশ্বরে সেবা, সৃষ্টির সেবা এবং মানুষের সেবা করার দায়িত্ব।
দায়িত্বশীলতার মধ্যদিয়ে মানুষ প্রভুর প্রকৃত সেবক হয়ে উঠতে পারে। মানুষ দাযিত্বপ্রাপ্ত, তাই তার কাছে ঈশ্বরের প্রত্যাশা, পৃথিবীতে তিনি মানুষের হাতে যা কিছু ন্যস্ত করেছেন- মানুষ যেনো তা নিয়ে “উৎপাদনশীল, দায়িত্বশীল, দায়বদ্ধ ও বিশ্বস্থ হয়ে উঠে।” কলসীয়দের কাছে সাধু পল লিখেছেন, “তোমাদের যা-কিছু করার থাকুক না কেনো, মনপ্রাণ দিয়েই তা করো, কেনো না তোমরা যা করছো তা মানুষের জন্যে তো নয়- প্রভুরই জন্যে। জেনে রাখো, ঈশ্বর সন্তানদের জন্যে সঞ্চিত রাখা সেই যে সম্পদ, তোমরা একদিন পুরষ্কার হিসেবে প্রভুর কাছ থেকে পাবেই” (৩:২৩-২৪)। একজন বিশ্বস্থ সেবক মনিবের সম্পদ নিয়ে যখন মনিবের ইচ্ছা পালন করে, তখন তার জন্য পুরষ্কার সঞ্চিত হয়ে থাকে। তখন এই দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকের হাতে মনিব পুরষ্কার হিসেবে তুলে দেন আরো অনেক কিছুর দায়িত্বভার।
দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক যেমন সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল তেমনি শ্রদ্ধাশীল প্রতিবেশী ভাইবোনদের ভালোবাসায়। যিশু বলেছেন, প্রধান দু’টি আজ্ঞা হলো, ‘তোমরা প্রভু ঈশ্বরকে ভালোবাসো আর তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাসো। ঈশ্বর শুধু আমাদের হোম্ বা যজ্ঞবলীতে সন্তুষ্ট নন- সন্তুষ্ট মানুষকে ভালোবাসায়। মানুষ যদি মানুষকে ভালোবাসে, তবে সেই ভালোবাসা মানুষের মধ্যদিয়ে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে। কারণ, মানুষ হলো মানুষের প্রকৃত রক্ষক ও পরস্পরের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা।
আলোচ্য বিষয়বস্তু- ২ ঃ রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বাস্তবতা ও দায়িত্বশীল সেবাক হিসেবে আমাদের করণীয়ঃ- বিষয়ের উপর আলোচনা উপস্থাপন করেন, কারিতাস রাজশাহী অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক, মি. সুক্লেশ জর্জ কস্তা। মি. কস্তা তার আলোচনার শুরুতেই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে সংক্ষীপ্ত এবং বাস্তব পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তারপর তিনি কোভিড- ১৯ মহামারির কারণে ধর্মপ্রদেশের জনগণের অর্থনীতির খাতগুলোতে ব্যাপক এবং বিরূপ যে প্রভাব পড়েছে সে বিষয়ে তথ্যচিত্র তুলে ধরেন। আজকের বাস্ততবতায় ও সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একজন দায়িত্বশীল সেবক কোন্ বিষয়গুলো বা ক্ষেত্রসমূহ নিয়ে কাজ করতে পারেন- তা তিনি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন। আর বিষয়গুলো হলো :- ১. পরিবার- পরিবার হলো মন্ডলির কোষ। একজন শিশু পরিবার থেকে যা শিক্ষা গ্রহণ করে তা সে কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করে থাকে। ২. মন্ডলি- খ্রিস্টেতে দীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা মন্ডলির সদস্যপদ লাভ করি। … প্রকৃত অর্থে প্রতিটি খ্রিস্টিয় পরিবার এক একটি গৃহ মন্ডলি। তাই মন্ডলির একজন সভ্য হিসেবে এর প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে সেবাকর্ম করা আমাদের দায়িত্ব। ৩. সমাজ- মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বসবাস ক’রে আমরা সামাজীকরণ শিখি ও সামাজিক হয়ে উঠি। সমাজ অথর্- অনেকে একসাথে, সকলের তরে সকলে, পরস্পরের তরে পরস্পরে। ৪. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি- আমাদের দেশের শতকরা ১০% মানুষ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। অসচেনতা, পুষ্টিহীনতা, ঘন বসতী, বিভিন্ন ধরণের দুর্ঘটনা, চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়া, ইত্যাদি কারণে একজন স্বাভাবিক ও সুস্থ মানুষ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষে পরিণত হয়। ৫. প্রবীণ ব্যক্তি- আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজকের এই প্রবীণগণ জ্ঞান ভান্ডার ও সামাজের সম্পদ। তাদের যত্ন নেওয়া ও ভালোবাসা আমাদের দায়িত্ব। ৬. অসুস্থ ব্যক্তি- সুস্থ মানুষ অশেষ শক্তিধর ও ক্ষমতাশালী। কিন্তু মানুষ অসুস্থ হলে উপলব্ধি করে তার অসহাত্ব এবং প্রত্যাশা করে অন্যের সহায়তা। বর্তমানে এই করোনাকালীন সময়ে আমরা প্রতিনিয়ত তা উপলব্ধি করছি। কেউ অসুস্থ হলে তার কাছে কেউ যেতে চায় না; সঠিক চিকিৎসা পায় না। এমনকী কেউ মারা গেলেও তার কাছে যেতে চায় না। তাই অসুস্থ ব্যক্তিদের সুস্থ করা সেবা দেওয়ার জন্য দায়িত্বশীল সেবকের খুবই প্রয়োজন। ৭. চাকুরিজীবী- ধর্মপ্রদেশর অধিকাংশ খ্রিস্টভক্ত নানা অনানুষ্ঠানিক কাজের সাথে যুক্ত। ফলে তাদের চাকুরির নিশ্চয়তা কম থাকে এবং চাকুরিকালীন সময়ে কাজের ব্যস্ততা ও ছুটি-ছাঁটা সীমাবদ্ধতার কারণে মন্ডলির কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ কম থাকে। এমনকী চাকুরি শেষে তাদের অনেকে অসহায়ের মতো জীবন যাপন করে। ৮. দরিদ্র ও অভাবী মানুষ- বর্তমানে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র ও অভাবের পাশাপাশি মানসিক দরিদ্রতায়ও ভুগছে। তাই মানুষের মধ্যে হতাশা, অতিমাত্রায় লোভ, সংকীর্ণতা কাজ করছে। ৯. শিক্ষা কার্যক্রম- গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রতিটি খ্রিস্টান পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব। এ শিক্ষা শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত নয় বরং নানাবিধ অ-প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক এবং মান্ডলিক শিক্ষার সাথে যুক্ত। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতিটি বিষয়ের বাস্তবতা উপলব্ধি করে আলোচক বিষয়ের ইতিবাচক, নেতিবাচক এবং করণীয়সমূহ উল্লেখ করেছেন। ১০. পরিবেশ ও প্রতিবেশ- সবশেষে মি. কস্তা এই বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে বিশপের পালকীয় পত্র, পোপের সর্বজনীন পত্র, ‘তোমার প্রশংসা হোক’- থেকে উদৃতি দিয়ে আমাদের ধরিত্রী ও তার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন। উপসংহারে আলোচক বলেন যে, দায়িত্বশীল সেবক হিসেবে আমরা যা দান করতে পারি তা হলো – সময়, মেধা-বৃদ্ধি এবং সম্পদ। তাই আমরা যদি সেবাকাজে মাথা, হাত ও হৃদয় সম্পৃক্ত করতে পারি তাহলে সেবাকাজে আমাদের সফলতা আসবেই।
ভিকারিয়া পর্যায়ে উল্লেখিত বিষয় দুটি উপস্থাপনার পর দলীয় আলোচনার জন্য বলা হয়েছিলো- কিভাবে আমরা যিশু ও মন্ডলির শিক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে উঠতে পারি? যিশু ও মন্ডলির শিক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে উঠার জন্য আমাদের কী কী করণীয় ? উত্তরে বলা হয়েছে- সাক্রামেন্তের আলোকে জীবন যাপন ও পরিবার গড়ে তোলা। ঈশ্বর মানুষকে যে দান দিয়েছেন সে সম্পর্কে সচেতন হয়ে সেই দানের মধ্যদিয়ে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে উঠা। ঈশ্বরের সৃষ্টিকে রক্ষা ও লালন পালন করা। সৃষ্টি ও কৃষ্টির মধ্যদিয়ে ঈশ্বরের প্রশংসা করা। কিছু কিছু বদ্অভ্যাস বর্জন করে মন্ডলি ও সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করা, সমাজে মিলে মিশে বসবাস করা এবং ধর্ম ও ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ করা, ইত্যাদি।
যৌথ/কেন্দ্রিয় কর্মশালা ঃ সেপ্টেম্বরের ১১/১২ তারিখে খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্রে তিনটি ভিকারিয়া যৌথভাবে পালকীয় কর্মশালার সমাপ্তি টানে। শুরুতেই পালকীয় টিমের আহ্বায়ক ফা. উইলিয়াম মুরমু তিন ভিকারিয়ার থেকে প্রতিনিধিদের স্বাগত জানান। পরে ফাদার মুরমু তিন ভিকারিয়ায় অনুষ্ঠিত পালকীয় সম্মেলনের উপর কিছুক্ষণ আলোকপাত করেন। পরে তিনি যৌথ কর্মশালার কাঠামো তুলে ধরেন এবং সবার সহযোগীতা কামনা করেন। যৌথ কর্মশালায় তিনটি ভিকারিয়ায় উল্লেখিত বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনার ফলাফল/বিবরণ উপস্থাপন করা হয়। মুক্ত আলোচনায় অনেকে তাদের মতামত তুলে ধরেন। অনেকেই মনে করেন- ধর্মকে জীবনে উপযুক্তভাবে ধারণ করতে হলে তাকে শুরুতেই একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হতে হবে। তার দায়িত্ব নিজের জীবন থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ ও মন্ডলির মধ্যে বিস্তৃত। সবাই যদি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন তাহলেই হবে সুন্দর গৃহ মন্ডলি/পরিবার, সংগঠিত সমাজ এবং অংশগ্রহণমুলক মন্ডলি। অনেকে বলেন, আজকের দিন শেষে যেনো কর্মশালা শেষ হয়ে না যায়। আগামী দিনগুলোতে কর্মশালার সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন নিয়ে যেনো কর্মকান্ড চলমান থাকে। সবশেষে দীর্ঘ আলোচনার পর প্রেরণ বিবৃতি তৈরি করা হয়।
প্রেরণ বিবৃতি ঃ বিগত বছরের পালকীয় কর্মশালার মূলসুরের উপর ভিত্তি করে গৃহিত অগ্রাধিকারসমূহের আলোকে এই বছরের পালকীয় কর্মশালার মূলসুর নেওয়া হয় “আমরা হলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক”। ১১-১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় সেবাকেন্দ্রে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ, ৩৯ জন যাজক, ২৪ জন সিস্টার, ১ জন ব্রাদার, ১ জন ডিকন ও ৬০ জন খ্রিস্টভক্তসহ সর্বমোট ১২৬ জন অংশগ্রহণকারি নিয়ে ১৮তম ধর্মপ্রদেশীয় পালকীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মশালার মধ্যদিয়ে আমরা পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলীতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক (ঝঃবধিৎফংযরঢ়) হওয়ার ক্ষেত্রে যীশু ও মণ্ডলির শিক্ষায় আলোকিত হয়েছি। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়: দায়িত্বশীল আচরণ, দায়বদ্ধতা, ঐশ অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা, সৃষ্টির যত্ন ও পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেছি। সেবার ঐশ্বতাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক তাৎপর্য উপলব্ধি করে দায়িত্বশীল সেবক হিসেবে সময় (Time), সামর্থ্য (Talent) ও সম্পদ (Treasure) এর যথাযথ ব্যবহারে আমাদের বুদ্ধিমত্তা (Intelligence), সেবাকাজ ও প্রেম-ভালোবাসাকে (Heart) সম্পৃক্ত ও একাত্ম করার মাধ্যমে সেবাকাজে সফলতা আনয়ন সম্পর্কে সচেতন হয়েছি।
ভিকারিয়া পর্যায়ে অনুষ্ঠিত তিনটি কর্মশালার সারসংক্ষেপ প্রতিবেদন এবং ধর্মপ্রদেশীয় পর্যায়ে কর্মশালার দলীয় আলোচনার প্রতিবেদন উপস্থাপনার ভিত্তিতে আমাদের দর্শন (Vision), প্রেরণ (Mission) এবং অগ্রাধিকারসমূহ (Priorities) নির্ধারণ করা হয়, যা নিম্নে উল্লেখ করা হল।
দর্শন (Vision) মণ্ডলিতে দায়িত্বশীল ও বিশ্বাসযোগ্য সেবক হওয়া।
প্রেরণ (Mission) দায়িত্বশীল ও বিশ্বাসযোগ্য সেবক হয়ে ওঠার জন্য খ্রিস্টিয় গঠন এবং ঈশ্বর, বিশ্ব প্রকৃতি ও মানুষের সেবার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
অগ্রাধিকারসমূহ (চৎরড়ৎরঃরবং)
১্ । ব্যক্তি ও খ্রিস্টিয় পরিবার পর্যায়ে বিশ^স্ততা, দায়িত্বশীলতা এবং দায়বদ্ধতা সম্পর্কে শিক্ষা ও ধারণা দান করা।
২। ধর্ম-কর্মে, সম্পর্কে, কথায় ও কাজে, জীবনসাক্ষ্যদানে দায়িত্বশীল ও বিশ্বস্ত থাকা।
৩। মণ্ডলি ও সমাজের কল্যাণে সবার অংশগ্রহণে সমন্বিত পালকীয় যত্ন নেওয়া।
৪। বিশ্বপ্রকৃতি ও পরিবেশের যত্ন, রক্ষা ও সংরক্ষণে ব্যক্তি, পরিবার ও মণ্ডলি পর্যায়ে সচেতনতা দান ও উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৫। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ও উপকরণের সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সম্পর্কে দায়িত্বশীল হওয়ার শিক্ষা দান করা।
৬। দয়ার কাজ এবং স্থানীয় মণ্ডলিকে স্বাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
৭। যুবক-যুবতীদের অংশগ্রহণ ও দায়িত্বশীল সেবক হয়ে ওঠার জন্য পর্যায়ক্রমে গঠন, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দান করা।
সবশেষে বিশপ জের্ভাস রোজারিও, পালকীয় কর্মশালায় সক্রীয় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সেইসাথে কর্মশালায় গৃহীত অগ্রাধিকারসমূহ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, ধর্মপল্লী ও ধর্মপ্রদেশ পর্যায়ে ফলপ্রসূভাবে বাস্তবায়ন করতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান। বিশপ প্রার্থনা ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, “তাঁর আশা, এই কাজে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরও আমাদের অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ দান করবেন।”