ফা. সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, “বিশ্বে গড়তে হবে ভালোবাসার সভ্যতা।” তিনি বলেছেন, “আসুন ভালোবাসি, শুধু কথা দিয়ে নয়, বরং কাজ দিয়ে।” তিনি আরো বলেছেন, “গরিবের প্রতি তোমার হাত প্রসারিত করো।” তিনি গরিবের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও ধনীর কর্তব্য সর্ম্পকে কথা বলেছেন- যার সারমর্ম দাঁড়ায়, “অভাবীকে তার প্রত্যাশিত দান থেকে বঞ্চিত করো না।” সম্প্রতি পোপ, কোভিড- ১৯ মহামারির কারণে বিশ্বে স্বাস্থ্য সংকটের প্রভাব কেমন হতে পারে, এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, “বিশ্বে গড়তে হবে ভালোবাসার সভ্যতা।” এই ভালোবাসা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে ভালোবাসার উর্ধ্বে। এই ভালোবাসা সর্বজনীন- ধনী গরিব, জাতি গোষ্ঠীর উর্ধ্বে।
বছরটির শুরু থেকে এই করোনা ভাইরাস এমন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে- যেটা কোনো বাঁধা চিনে না, কোনো সীমানা চিনে না, কোনো সংস্কৃতি বোঝে না এমনকী কোনো রাজনৈতিক মত পার্থক্যও বোঝে না। আর এটাকে মোকাবেলা করতে হলে ভালোবাসার প্রয়োজন- যে ভালোবাসা বাঁধা, সীমানা, বৈরীতা, সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক মত পার্থক্যের উর্ধ্বে। কারণ মানুষ নিয়ে কথা, আর মানুষ সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং তারাই মাত্র সর্বোচ্চভাবে ভালোবাসার মূল্য প্রকাশ করতে পারে। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণে যে সম্পর্ক গড়ে উঠে তার গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। এগুলো ভালোবাসা, মানব উন্নয়ন ও সংকট মোবাবেলায় অবশ্যই প্রয়োজন তবে এখানে ভালোবাসার সভ্যতার উপস্থিত নাও থাকতে পারে। প্রকৃত ভালোবাসা প্রতিযোগিতায় নয় বরং তা হলো ভাগ করে নেওয়ার উৎসাহ ও আনন্দের মধ্যে বিদ্যমান। পোপ এখানে প্রকৃত মানব প্রেমের কথাই বলতে চান। তাঁর ভাষায়, প্রকৃত মানব প্রেম সব জাতি গোষ্ঠিকে শ্রদ্ধার সাথে দেখে- কাকেও খাটো করে দেখার সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করে না। প্রকৃত ভালোবাসা হলো সৃজনশীল ও ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বাসী উদ্যোগ- যার মধ্যদিয়ে সর্বজনীন মঙ্গল কামনার আবেদন থাকে, উদ্যোগ থাকে। প্রকৃত ভালোবাসার এই আবেদন গন্ডীবদ্ধ নয়- বরং ছোটো সমাজ, বৃহৎ সমাজ এবং আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে বিস্তৃত। যা কিছু করা হয় পরিবারে, প্রতিবেশী পর্যায়ে, গ্রাম, ছোটো-বড় শহর এমনকী আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে- সব খানেই একই ভালোবাসার বীজ থেকে এসব বেড়ে উঠে। আঞ্চলিক তিক্ততা অনেক সময় যুদ্ধের কারণ হয়ে উঠে আবার আঞ্চলিক পর্যায়ের ভালোবাসা সবার আদর্শ হিসেবে রূপ নিতে পারে। অন্যদিকে সামাজিক ভালোবাসার অভাব হলো মনের সংকীর্ণতা এবং সুন্দর একটা সংস্কৃতিকে দূরে তাড়িয়ে দেওয়ার কাজ। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, এই মহামারি থেকে বিশ্ব মানবতা একটা উত্তম অধ্যায়ে প্রবেশ করতে পারে- যদি সবাই একসাথে সুন্দরের অনুসন্ধান করে। অন্যদিকে দলীয় মনোভাব তৈরি হলে বিশ্ব মানবতা সংকট থেকে মহাসংকটে নিমজ্জিত হবে। কোভিড- ১৯ মহামারি বিষয়ে বলতে গিয়ে পোপ বলেন, কিছু লোক শুধু এই সংকট থেকে মুক্তির জন্য নিজেদের নিয়ে চিন্তা করছে। কোনো গোষ্ঠী আবার ভ্যাকসিন তৈরি করছে হয়তো ব্যবসা করার জন্য। কোনো দেশ আবার ভ্যাকসিনের সুযোগটা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা খুঁজছে। পোপের ভাষায়, নিজের ভালো, নিজের চিন্তা, গোষ্ঠীর ভাবনা, রাজনৈতিক সুবিধা না খুঁজে অন্যের সাথে ভাগ করে নিয়ে মানুষকে মহৎ এবং দয়ালু হতে হয়- এটাই মানবতার বাণী। একজনের স্বাস্থ্য-সেবা দেওয়া মানে সমাজের জন্য সেবা দেওয়া। একটি সুস্থ সমাজ সবার স্বাস্থ্যের দিকেই নজর দেয়। বিশ্ব হয়তো একদিন বর্তমান স্বাস্থ্য সংকট থেকে নিস্কৃতি লাভ করবে, কিন্তু ভালোবাসার অভাব থাকলে সামাজিক সংকট এবং বিশ্ব মানবতা সংকটের মধ্যেই থাকবে। তাঁর ভাষায় একটি সুস্থ সমাজ, একটি শান্তিময় সমাজ গড়ে উঠে তখনই যখন সেখানে সবার মঙ্গল সাধিত হয়, সবার মঙ্গল নিশ্চিত থাকে। তাই এই মহামারির সময়টা ভালোবাসার চর্চা এবং ভালোবাসার সংস্কৃতি গড়ে তোলার একটা সুযোগ হিসেবে নিতে হবে। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ভালোবাসা শর্তহীন, তাইতো বাইবেলে বলা হয়েছে, তোমার শত্রুকে ভালোবাসো। পোপ বলেন, মনে রাখতে হবে, ভালোবাসা একটি শিল্প এবং শত্রুকে, অপছন্দের মানুষকে ভালোবাসার মধ্যদিয়ে এই শিল্প আরো সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারে। যে ভালোবাসা মানুষকে মুক্ত ও ফলশালী করে তোলে সে ভালোবাসা অবশ্যই মূল্যবান কারণ এটা করতে গিয়ে একজনকে ত্যাগস্বীকার করতে হয় তর্কের, নিজের মত ও গন্ডী থেকে বের হয়ে অন্যকে ক্ষমা করতে হয়, নিজের অবস্থানকে রক্ষা থেকে বিরত থাকতে হয়। সুতরাং পোপ জোর দিয়ে বলেন, তাহলে আমাদের কোন্টা গ্রহণ করতে হবে, ভালোবাসার সভ্যতা নাকী হিংসার সভ্যতা। আর ভয় পেয়ে ভালোবাসার সভ্যতা গড়া থেকে পিছিয়ে যেতে হবে না। পোপ বলেন, মহামারি এবং সামাজিক দূরত্বের কারণে আমরা যতোই আলাদা অবস্থায় থাকি না কেনো- প্রভুর বাণী আমাদের অনবরত ভালোবাসার কায়ক্রমের কথাই বলে।” সুতরাং বিশ্বে ভালোবাসার সভ্যতা গড়ে তোলা সবার কাম্য এবং বাঞ্চনীয়।

Please follow and like us: