ভূমিকা
শিক্ষাদান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কাথলিক মণ্ডলি বিশ্বব্যাপী সুবিখ্যাত। তবে কাথলিক মণ্ডলি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষ নিয়ম নীতি অনুসরণ করে থাকে। এই কাজ করে কাথলিক মণ্ডলি মানুষকে – মানব সমাজকে – আরও বেশী মানবীয় করতে চায়। কারণ কাথলিক মণ্ডলি মঙ্গলসমাচারে মানুষের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে সেই অনুসারে মানুষকে গড়ে তুলতে চায়। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করে তার মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার গুণাবলী ও প্রতিভা দিয়ে দিয়েছেন। সেই গুণাবলী ও প্রতিভাগুলোকে আবিষ্কার করতেই কাথলিক শিক্ষা কার্যক্রম সহায়তা করে, যেন কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা নিজের সকল প্রতিভা ও গুণাবলী আবিষ্কার করে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত ২য় মহাসভার দলিল “খ্রিস্টিয় শিক্ষা বিষয়ক ঘোষণাপত্র” (Gravissimum Educationis) এর শিক্ষা অনুসারে খ্রিস্টমণ্ডলি হলো খ্রিস্টের উপস্থিতির চিহ্ন। কাথলিক মণ্ডলি সেই খ্রিস্টকেই মানুষের কাছে উপস্থাপন করে তার সকল সেবা কাজের মধ্য দিয়ে। কাথলিক মণ্ডলির শিক্ষাদান কার্যক্রমও তার কোন ব্যতিক্রম নয়।
কাথলিক শিক্ষাদান কার্যক্রম একটি মাণ্ডলিক সেবাকাজ
২য় ভাটিকান মহাসভার “খ্রিস্টমণ্ডলি বিষয়ক সংবিধান” (লুমেন জেন্সিউম) শুরুতেই বলেছে যে “খ্রিস্টেতে মণ্ডলি হ’ল সংস্কার বা সাক্রামেন্ত স্বরূপ, অর্থাৎ পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলন ও সকল মানুষের মধ্যে একতার চিহ্ন ও উপায় স্বরূপ” (খ্রিস্টমণ্ডিল বিষয়ক সংবিধান – ১)। তাই প্রত্যেক কাথলিক স্কুলের আসল উদ্দেশ্য হল খ্রিস্টমণ্ডলির সংস্কারীয় স্বরূপে অংশগ্রহণ করা এবং ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রাকৃতিক (পার্থিব) ও অতিপ্রাকৃতিক (অপার্থিব) সদগুণাবলীগুলি (virtues) অর্জন করতে আর এই দুইয়ের মিলনের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে আবিষ্কার করতে সাহায্য করা। কাথলিক স্কুলের শিক্ষকগণ ছাত্রছাত্রীদের এই কাজে সহযোগিতা করে থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের কাথলিক স্কুলগুলিতেও অনেক অকাথলিক শিক্ষক শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী কাজ করে। কাথলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে তারাও এই কাথলিক শিক্ষাদান কার্যক্রমের সহযোগী। তারাও কাথলিক শিক্ষাদর্শে বিশ্বাস করবে এটাই কাথলিক চার্চের বা মণ্ডলির আশা। কাথলিক চার্চ বা মণ্ডলি বিশ্বব্যাপী শিক্ষা বিস্তার কাজে সুবিখ্যাত; তবে এই কাজ কাথলিক মণ্ডলি কখনোই ব্যবসা বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে করে না। কারণ কাথলিক চার্চের কিছু স্কুল দৈবাৎক্রমে লাভজনক হলেও এর অধিকাংশ স্কুল চলে ভর্তুকীতে। এমন স্কুলও আছে যা চলে সম্পূর্ণ কাথলিক চার্চের নিজ খরচে। এর কারণ হলো যে কাথলিক মণ্ডলি বিশ্বাস করে যে সকল মানুষেরই শিক্ষা লাভের অধিকার আছে, সে দরিদ্র হলেও। কাথলিক মণ্ডলির শিক্ষাদান কার্যক্রমের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো একজন মানুষকে পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত মানুষ তৈরী করা, শুধু বইয়ের জ্ঞান দান করা নয়। কাথলিক স্কুলের শিক্ষাদান কাজের সঙ্গে যারাই জড়িত হোক না কেন তাদেরকে সকলকেই এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে হবে; সে যে ধর্মেরই হোক না কেন!
কাথলিক শিক্ষা কার্যক্রমের লক্ষ্য
কাথলিক মণ্ডলি বা চার্চ মানুষকে নিষ্কলুষ, নির্ভেজাল, সুন্দর ও সকল মানবীয় গুনে গুনান্বিত করে গড়ে তুলতে চায় কারণ কাথলিক চার্চ তার সংস্কারীয় বিশ্বাস অনুসারে পৃথিবীর সকল মানুষকেই খ্রিস্টের মত একেকজন পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে আহূত ও প্রেরিত। কাথলিক মণ্ডলি বিশ্বাস করে খ্রিস্টই হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত মানুষের আসল ব্লু-প্রিন্ট বা নীল-নক্সা, যেটি স্বয়ং ঈশ্বরের তৈরী। কাথলিক মণ্ডলি বিশ্বাস করে মানুষ ঈশ্বরেরই প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট। বাইবেলে লেখা আছে, “পরমেশ্বর তাঁর নিজের প্রতিমূর্তিতে মানুষকে সৃষ্টি করলেন; পরমেশ্বরেরই প্রতিমূর্তিতে তাকে সৃষ্টি করলেন: পুরুষ ও নারী করে তাদের সৃষ্টি করলেন” (আদি ১: ২৭)। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে যে মানুষের জীবনের চুড়ান্ত লক্ষ্য হলো ঈশ্বরের মত হওয়া – অর্থাৎ পবিত্র, সুন্দর, পরিপূর্ণ ও অনিন্দনীয় হওয়া। আমরা জানি মানুষ কখনোই ঈশ্বরের মত হতে পারবে না; কিন্তু স্বর্গের বাসিন্দা হতে হলে আমাদের সেই রকম হতেই চেষ্টা চালাতে হবে। মানুষকে হতে হবে ঈশ্বরের মনের মত মানুষ।
মোট কথা কাথলিক মণ্ডলির শিক্ষা কার্যক্রমের আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে প্রকৃতভাবে মানুষই বানানো, তাকে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিকশিত, বিদ্যার ডিগ্রীধারি বা কারিগরি জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ নয়। কাথলিক মণ্ডলি চায় যেন কাথলিক স্কুলে পড়া একজন মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে বা শুধু নিজের লাভের কথা না ভেবে বরং সে যেন সব কিছুর আগে একজন মানবীয় গুনাবলী সম্পন্ন ও নিরহঙ্কারী মানুষ হয় এবং নিজের সঙ্গে অন্যদের কথাও ভাবে। কিন্তু আজকাল কাথলিক স্কুলে পড়া সকল মানুষই কি সেই রকম? তা মনে হয় নয়! খুব জোর হতে পারে যে তারা কাথলিক স্কুলে পড়েছে বলে তারা গর্ব করে, ভাল চাকুরী পায়, এবং নিজের সফলতা নিয়ে অহঙ্কার করে। আর পরে নিজের সন্তানকে কাথলিক স্কুলে ভর্তি করাতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালায়। আজ পর্যন্ত কাথলিক স্কুলগুলি যে ছাত্রছাত্রী পড়িয়েছে, তার সংখ্যাও তো কম নয়! কিন্তু একথা কি বলা যাবে যে কাথলিক স্কুলে পড়া অধিকাংশ মানুষ তার স্কুলের মূল্যবোধগুলি আবিষ্কার করতে পেরেছে, অনুধাবন করতে পেরেছে, আর গ্রহন করেছে? সকলে না হোক, তাদের অধিকাংশ যদি তা করতো তাহলে তো সমাজে তার ইতিবাচক প্রতিফলন দেখা যেতো! কিন্তু এই বিষয়ে আমাদের যথেষ্ঠই হতাশ হতে হচ্ছে।
কাথলিক শিক্ষার আদর্শ
আমরা তাহলে সঠিকভাবে কাথলিক মতাদর্শ অনুসরণ করে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছি কিনা তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। এখন তো দেখা যাচ্ছে অনেক ব্যবসায়ীও কাথলিক স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করে সুন্দর সুন্দর স্কুল বানাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য অনেক সুবিধা দিচ্ছে আর এমনকি স্কুলের নামও কাথলিক স্কুলের মতই দিচ্ছে বা রাখছে। তারা এসব করছে শুধু ব্যবসা করার জন্য। এখানেই আমাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালাতে অবশ্যই টাকার প্রয়োজন আছে – কাথলিক স্কুলগুলো অতীতে বিনে বেতনে বা ফি না নিয়ে, অর্থাৎ অবৈতনিকভাবে ছাত্রছাত্রী পড়িয়েছে, কারণ তখন স্থানীয় পিতামাতা ও অভিভাবকদের ছাত্রবেতন দেওয়ার সার্মথ্য ছিলনা বা তাদের শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা ছিল না। ধীরে ধীরে বিশেষভাবে শহরাঞ্চলের কাথলিক স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীরা বেতন দিয়ে পড়তে পাড়ায় স্কুলগুলোর পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। এইসব স্কুরগুলোর শিক্ষাদানের ও মানবীয় গঠনের সুনাম বৃদ্ধি পাওয়ায়, ছাত্রছাত্রী ভর্তির প্রতিযোগিতা দেখা যায় এখন। এখন শহরের কাথলিক স্কুলগুলোর অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও জৌলুষ বেড়েছে। তবে গ্রামের কাথলিক স্কুলগুলোর চিত্র ভিন্ন। এখানে ছাত্রছাত্রীরা যে বেতন বা ফি দেয় তা দিয়ে স্কুল চালানো দুস্কর। তাই অল্প কিছু হাই স্কুলের কয়েকজন করে শিক্ষক শিক্ষিকা সরকারী মাসিক বেতন পায়, তবে তা স্কুলের মোট শিক্ষকের একতৃতীয়াংশও নয়। বাকী টাকা স্কুলের কর্তৃপক্ষকেই কোনভাবে জোগার করতে হয়। তাছাড়া এইসব স্কুলের অবকাঠামো ও অন্যান্য খরচ তো আছেই। শহরের বা গ্রামের সকল কাথলিক স্কুলের লক্ষ্য কিন্তু এক। তাহলে কাথলিক মণ্ডলি পরিচালিত শহর ও গ্রামের স্কুলগুলো কিভাবে এই লক্ষ্য পূরণের জন্য একযোগে কাজ করতে পারে?
কাথলিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে ২য় ভাটিকান মহাসভা ঘোষণা করেছে: “জাতি, সামাজিক অবস্থান বা বয়স যা-ই হোক না কেন, ব্যক্তি হিসাবে প্রত্যেকটি মানুষের যে মর্যাদা আছে, সেই মর্যাদার সাথে তার শিক্ষালাভের অধিকার জড়িত, আর এই অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। এই শিক্ষা প্রতিটি মানুষের জীবন-লক্ষ্য, ও তার যোগ্যতা অনুসারে উপযোগী হওয়া উচিত – সে নারীই হোক বা পুরুষই হোক। সে শিক্ষা হওয়া উচিত তার জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপযোগী। উপরন্তু সেই শিক্ষার লক্ষ্য যেন বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, যার ফলে সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে প্রকৃত একতা ও শান্তির বন্ধন সুদৃঢ় হয়ে গড়ে উঠবে। প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হ’ল জীবনের চরম লক্ষ্যে পৌছার জন্য মানুষের গোটা ব্যক্তিত্বকে গঠন করা, যে সমাজে সে বাস করে তার কল্যান সাধন করা, এবং পরিণত বয়সে সমাজে তার যে দায়িত্ব-কর্তব্য আছে তা পালনের জন্য তাকে প্রস্তুত করে তোলা” (২য় ভাটিকান মহাসভা, খ্রিস্টিয় শিক্ষা বিষয়ক ঘোষণাপত্র – ১)। শিক্ষার উদ্দেশ্য তাই শুধু নিজের জন্য নিজেকে গড়া নয়, বরং বিশ্বের সকলের কল্যাণের জন্য গড়ে উঠা।
এখন কথা হল কাথলিক স্কুলের সেই অভিন্ন লক্ষ্য কি, যা অন্য স্কুলগুলোর মধ্যে দেখা যায় না? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় – মানুষ সম্পর্কে ঈশ্বরের যে পরিকল্পনা তার বাস্তবায়নের জন্যই স্কুলের শিক্ষা ও গঠন। কাথলিক স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা ও গঠন দিয়ে তাদেরকে মানুষের মত মানুুষ তৈরী করার চেষ্টা করে। শুধু বইয়ের শিক্ষা বা দক্ষতা, তাত্ত্বিক জ্ঞান, নৈতিকতাবিহীন গবেষণা কৌশল ও ফলাফল, যন্ত্রকৌশল ও উৎপাদন, ইত্যাদি কাথলিক স্কুলের প্রধান লক্ষ্য নয়, যদিও তা কাথলিক স্কুলে সহজেই অর্জন করা যায়। কাথলিক স্কুলের আদর্শ কোন ব্যবসাসফল স্কুলের মত নয়, হওয়া উচিত নয়। কাথলিক স্কুলগুলো যেন কাথলিক আদর্শ থেকে কখনোই বিচ্যুত না হয় সেই লক্ষ্য রাখতে হবে। কাথলিক স্কুলের শিকক্ষকদের মধ্যে যদি অকাথলিক শিক্ষক শিক্ষকাও থাকে তাহলেও কাথলিক আদর্শ সকলকেই উন্নত রাখতে হবে, কোন ক্রমেই তার ব্যতিক্রম করা যাবে না বা বিসর্জন দেওয়া যাবে না। অন্যথায় তা আর নিজেকে কাথলিক স্কুল বলে দাবী করতে পারবে না।
কাথলিক শিক্ষায় ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ
কাথলিক স্কুলে পড়াশুনা করে একজন মানুষ নৈতিক বিবেক সম্পন্ন এবং ভালবাসা ও ন্যায্যতার আদর্শ লাভ করবে এটাই আশা করা হয়। কাথলিক স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রী যে সকলেই কাথলিক হবে, এমন নয়। বর্তমানের এই বহু ধর্মের সহাবস্থান ও বহু সাংস্কৃতিক যুগে এটা আরও অসম্ভব। তাই সকল ছাত্রছাত্রী নিজ নিজ সংস্কৃতি ও ধর্মের আলোকে সৃষ্টিকর্তাকে জানবে ও ভালবাসবে এই শিক্ষা দিতে কাথলিক স্কুলসমূহ অঙ্গীকারাবদ্ধ। সৃষ্টিকর্তাকে জানার অধিকার শিশুদের ও যুবকদের রয়েছে; তাদের প্রতি সৃষ্টিকর্তার আহ্বান সম্পর্কেও তাদের জানার অধিকার রয়েছে (যোহন ৪: ২৩)। তাদের সেই অধিকার খর্ব করা যাবে না। আর তাই কাথলিক স্কুল সমূহ শুধু ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ করা নয়, বরং ছাত্রছাত্রীদের জীবনে সেই ধর্মীয় শিক্ষার নৈতিক প্রয়োগ ও প্রতিফলন দেখতে চায়। আর তা সম্ভব হয় যখন যারা এই শিক্ষা দান করেন তাদের জীবনাচরণে যদি সেই শিক্ষাদর্শ ফুটে উঠে। কাথলিক শিক্ষার মূল বিষয়ই হ’ল খ্রিস্টকে অন্যদের কাছে উপস্থিত করা – যার অর্থ হ’ল বাণী ঘোষণা করা বা খ্রিস্টকে বা তাঁর শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানুষের কাছে তুলে ধরা।
কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা পড়াশুনা করে তারা যেন মানব জীবনের আসল “সত্য” কি তা আবিষ্কার করতে পারে, সেটাই কাথলিক শিক্ষার আসল সফলতা। তাই কাথলিক শিক্ষার মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক কাথলিক স্কুলে বিভিন্ন ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের নিজ নিজ ধর্ম পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় কিন্তু কাথলিক শিক্ষা কার্যক্রমের আদর্শ অনুসরণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয় বরাবর। নিজ নিজ ধর্মের শিক্ষা অনুসরণ করলেও তারা যেন নতুন মানুষ হয়ে উঠতে পারে – সেটাই কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেটাই চায়। সাধু পলও শিক্ষা দিয়েছেন যে আসল শিক্ষা হ’ল নতুন মানুষ হওয়া (এফে ৪: ২২-২৪) ও খ্রিস্টের মত একজন পূর্ণ মানুষ হওয়া (এফে ৪: ১৩)। ধর্ম ও নৈতিকতা শুধু জানার জন্য নয়, বরং তা পালন করার জন্য। তবে কাথলিক স্কুলের কোন ছাত্রছাত্রী যদি কোনভাবে ধর্মান্ধ বা ভন্ড প্রকৃতির হয় তাহলে তা-ও কাথলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক রকম ব্যর্থতা। মোট কথা কাথলিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ভাল ও সমন্বিত মানুষ হতে হবে। তাই কাথলিক স্কুলের কর্তৃপক্ষকে সেই লক্ষ্যই রাখতে হবে।
পরিবার ও সমাজ কাথলিক শিক্ষার আতুরঘর
খ্রিস্টিয় শিক্ষা বিষয়ক ঘোষণাপত্র নামক দলিলের শিক্ষা অনুসারে, কাথলিক শিক্ষার শুরু হয় পরিবারে ও পিতামাতাদের মধ্য দিয়েই। অকাথলিক পরিবারেও শিশুরা তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকেই তাদের প্রাথমিক শিক্ষা ও গঠন লাভ করে থাকে। সুতরাং পিতামাতা, পরিবার ও সমাজের সমর্থন ছাড়া সুষম শিক্ষা ব্যবস্থা চালানো সম্ভব নয়। তাই ভাল শিক্ষা ও গঠন দান করার জন্য বিশেষভাবে পিতামাতাদের অবশ্যই জড়িত থাকতে হবে বা জড়িত রাখতে হবে (খ্রিস্টিয় শিক্ষা বিষয়ক ঘোষণাপত্র – ৬)। তবে এটা শুধু পিতামাতা নয় সমাজের সকল নাগরিকদেরই দায়িত্ব। কারণ সমাজে মানুষ কেউ একা থাকতে পারে না; একা চলতে পারে না। প্রত্যেকটি মানুষই হ’ল একটি সমাজের প্রতিচ্ছবি। একেকজন মানুষ ভাল হলে সমাজ ভাল হবে; আবার একেকজন মানুষ খারাপ হলে সমাজও খারাপ হবে। প্রত্যেকটি মানুষই সমাজে ভাল বা মন্দ প্রভাব ফেলে। মাত্র কয়েকজন মানুষ ভাল শিক্ষা লাভ করলে চলবে না, সেই শিক্ষা সকলের জন্যই। কাথলিক মণ্ডলি বিশ্বাস করে যে সমাজের সকলকেই ভাল, উন্নত ও নৈতিক মানুষ হতে হবে; তাহলেই সমাজ ভাল ও সুন্দর হবে। কাথলিক স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আহ্বান ও অঙ্গীকার তা-ই।
কাথলিক স্কুলের দায়িত্বশীলতা
কাথলিক স্কুলের অনেক বড় সামাজিক দায়িত্ব আছে। কাথলিক স্কুলের মতাদর্শ হ’ল, “শিক্ষার জন্য এসো, সেবার জন্য যাও”। আজকাল অবশ্য অনেক স্কুলেই এই কথাগুলো গেইটের উপর বা দেওয়ালে লেখা থাকে। লেখা থাকলেই যে সেটা সেই স্কুলের প্রকৃত আদর্শ তা কিন্তু নয়। কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনে রাখতে হবে, শিক্ষাদানের লক্ষ্য শুধু ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে দেওয়া নয়, বরং তাদেরকে নিজ পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য ও দেশের জন্য উপযুক্তভাবে গড়ে তোলা। কাথলিক স্কুলের এই ছাত্রছাত্রীরা যেন মহান সৃষ্টিকর্তার কল্যান আহ্বান ও প্রেমের সুসংবাদ সকল মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারে। তারা যেন নিজেরা নতুন মানুষ হয়ে সমাজের ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে পারে – তারা যেন এমন সমাজ গড়তে পারে যেখানে থাকবে নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ মিলন, ন্যায্যতা ও শান্তি, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহভাগীতার মনোভাব, যেটি হবে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যহীন ও শোষণহীন একটি সমাজ। এই কাজটি একটি চ্যালেঞ্জই বটে। শিক্ষা যেহেতু একটি প্রেরণ কাজ, তা সহজ হবে না তাই স্বাভাবিক। ঈশ্বর কাথিলিক মণ্ডলি বা চার্চকে সেই কঠিন কাজই করতে আহ্বান করেছেন। যেসকল মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তাদের মনোভাবও যেন এমন হয়। শিক্ষা কোন ব্যবসার বিষয় নয়, কাথলিক চার্চ সেটা মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে।
বর্তমানে আমাদের দেশের সরকার শিক্ষাবিস্তারের জন্য অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছে যার আপাতঃ লক্ষ্য কাথলিক শিক্ষাদর্শেরই মত। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সরকারের সেই সদিচ্ছা অনেক সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না তা আমরা জানি। সেইজন্য কাথলিক স্কুলের একটা দায়িত্ব আছে আশেপাশের সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা ও সহভাগীতার মাধ্যমে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিস্তারের কাজ করা। বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে প্রতিবেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঙ্গী করে বা জড়িত করে সেখানে বৃহত্তর সেবাদান করতে পারে। কয়েক বছর পূর্বে কারিতাস বাংলাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর কাথলিক শিক্ষাবোর্ড এই কাজটি করে যাচ্ছিল। বর্তমানে ফন্ড সংকটের কারণে এই ভাল কার্যক্রমটি স্তিমিত হয়ে গেছে। তবে এটা শুধু কাথলিক শিক্ষাবোর্ডের কাজ নয়, বরং এটা প্রত্যেকটি কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ। কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষকে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উপসংহার
কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা জীবন শেষে ছাত্রছাত্রীরা কি নিয়ে গর্ব করে বা তারা তাদের মাতৃ প্রতিষ্ঠানকে কেন স্মরণ করে? তারা তাদের ভাল রেজাল্ট বা ফলাফলের জন্য গর্ব করতে পারে, তাদের প্রতিষ্ঠানের নিয়ম শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে গর্ব করতে পারে, তারা কয়েকজন শিক্ষক বা শিক্ষিকার আদর ভালবাসার কথা স্মরণ করে এখানে মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু তারা কয়জন কাথলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আদর্শ ধারণ করে; আর তা করলেও তা কি শুধু মুখেই? কাথলিক মণ্ডলি যে আদর্শের জন্য স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, তাদের কয়জন সেই আদর্শ ধারণ করে বা অনুশীলন করে? এখন তো দেখা যায় যে কাথলিক স্কুল থেকে পাশ করা ভাল ছাত্রছাত্রীদের প্রায় কেউই সেই স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা হতে আসে না। কাথলিক ছাত্রছাত্রীদের যারা এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আসে, তারা কি অন্য চাকুরী জোগার করতে পারেনি বলেই এখানে আসে? এই মন্তব্য করা খুবই অপমানজনক, কিন্তু বর্তমানে এমন কথা তো প্রায়ই শোনা যায়। আর যারা নিজেদের যোগ্যতায় নয়, বরং কাথলিক স্কুল কর্র্তৃপক্ষের অনুকম্পায় শিক্ষকতার কাজ করার সুযোগ পায় তারা কি নিজেদের দুর্বলতার কথা ভাবে, নাকি নানা দায় দাবী করে কর্তৃপক্ষকে বিব্রত করে? কাথলিক শিক্ষা শুধু যাজক ও ধর্মব্রতীদের দায়িত্ব নয়। এই কাজের দায়িত্ব সকল বিশ্বাসীদেরই নিতে হবে; তবে যে যেভাবে পারবে, সেইভাবেই। কাথলিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষের উচিত কাথলিক ছাত্রছাত্রী বা অকাথলিক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যাদের প্রতিভা ও আগ্রহ রয়েছে তাদেরকে শিক্ষাদান কার্যে তাদেরকে জড়িত ও প্রস্তুত করা যেন তারা এই কাজকে নিজের আহ্বান ও পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। তবেই কাথলিক শিক্ষার উদ্দেশ্য, অর্থাৎ সমাজের সমন্বিত উন্নয়ন, নবায়ন ও রূপান্তর সম্ভব। আশা করব আমাদের দেশে কাথলিক শিক্ষাকার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে খ্রীষ্টিয় লক্ষ্য পূরণ করে পরিচালিত হবে।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী