ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিসে ২০২০ বছরের পালকীয় কর্মশালার মূলসুর ছিলো, “আমরা হলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক”। এই কর্মশালার মধ্যদিয়ে আমরা পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলীতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক (Stewardship) হওয়ার ক্ষেত্রে যীশু ও মণ্ডলির শিক্ষায় আলোকিত হয়েছি। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়: দায়িত্বশীল আচরণ, দায়বদ্ধতা, ঐশ অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা, সৃষ্টির যত্ন ও পরিবেশ রক্ষা, ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেছি। সেবার ঐশ্বতাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক তাৎপর্য উপলব্ধি করে দায়িত্বশীল সেবক হিসেবে সময় (Time), সামর্থ্য (Talent) ও সম্পদ (Treasure) এর যথাযথ ব্যবহারে আমাদের বুদ্ধিমত্তা (Intelligence), সেবাকাজ ও প্রেম-ভালোবাসাকে (Heart) সম্পৃক্ত ও একাত্ম করার মাধ্যমে সেবাকাজে সফলতা আনয়ন সম্পর্কে সচেতন হয়েছি। কর্মশালার দলীয় আলোচনার প্রতিবেদন উপস্থাপনার ভিত্তিতে মোট সাতটি দর্শন (Vision), প্রেরণ (Mission) এবং অগ্রাধিকারসমূহ (Priorities) নির্ধারণ করা হয়েছে, যার প্রথমটি হলো ঃ- ব্যক্তি ও খ্রিস্টিয় পরিবার পর্যায়ে বিশ্বস্ততা, দায়িত্বশীলতা এবং দায়বদ্ধতা সম্পর্কে শিক্ষা ও ধারণা দান করা।
ভূমিকা ঃ- পিতামাতাদের মনে রাখতে হবে- আজকে সন্তানগণ তাদের অধীনে, কিন্তু একদিন সন্তানদের অধীনে যেতে হবে পিতামাতাকে। তাই আজকের পিতামাতা সন্তানদের প্রতি যেরূপ করছেন- একসময় সন্তানগণ পিতামাতার প্রতি তাই করবে। একটি পাত্রে বালি ভরে মাটিতে ১৮ বছর পুঁতে রাখেন। ১৮ বছর পর সেই পাত্র থেকে বালিই বের হবে- সোনা নয়। একই কথা- এখন সন্তানদের যা দিচ্ছি, যা খাওয়াচ্ছি- সন্তান বড় হলে তার থেকে অধীক বের হয়ে আসবে না।
পরিবার হলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। ঈশ্বর নিজে আদম ও হবাকে সৃষ্টি ও আর্শীবাদ করে পরিবার স্থাপন করেছিলেন। সেই থেকে আজোও পরিবারের সংজ্ঞা বদল হয়নি। তবে সময় বদলের সাথে সাথে পরিবারের চেহারা পাল্টেছে। পাল্টে যাচ্ছে পরিবারের আদর্শ, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য। পরিবার হলো আদর্শ ও শান্তি স্থাপনের প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কারখানা। পরিবারেই সন্তানের জীবন শুরু হয়- তাদের শিক্ষার ভিত্তিটা এখানেই শুরু হয়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি যেখানে পরিবারেই শান্তির অভাব। ছেলেকে তো কাছে পাওয়াই যায় না। মেয়ের সাথে তো কথা বলাই যায় না। লেখা পড়ার প্রতি আগ্রহ নেই। সংসারের প্রতি বউয়ের মনোযোগ নেই। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া, দুই বউয়ের মধ্যে ঝগড়া। বাড়ির কর্তা সারাদিন বাইরে থাকে। কোনোদিন একসাথে খাওয়া দাওয়া করে না। একসাথে ধর্মকর্ম করে না। এটা আজকের পরিবারের একটা বাস্তব চিত্র। যে পরিবারে একদিনও সন্ধ্যায় প্রার্থনা ছাড়া কেউ ঘুমাতে যেতো না, আজকে সেই পরিবার থেকে প্রার্থনা ওঠে গেছে। কপালে হাত ওঠে না। একসাথে খাওয়া দাওয়া ওঠে গেছে। সন্তানের উপর পিতামাতার নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গেছে। সন্তানরা বাবা মায়ের কাছে মন খুলে কথা বলে না, সমস্যার কথা বলে না। নিজের সমস্যা সহভাগিতা করে তার মতো আর একজন সমস্যাগ্রস্থের কাছে গিয়ে।
এই যে পরিবারের দৃশ্য এর জন্য দায়ী কে? বাড়ির কর্তা হিসেবে আমিই সবার আগে দায়ী। শুরু থেকে উপযুক্ত শিক্ষা না দিয়ে ভুল হয়ে গেছে, আর এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দায়িত্বশীল পিতামাতা কোনোভাবেই সন্তানদের প্রতি তাদের দায় বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে পারেন না। মনে রাখতে হবে- পারিবারিক অশান্তি হলো সবচেয়ে বড় অশান্তি।
খ্রিস্টান পরিবারের অনেকেই আজকাল শহরে বা অন্য জায়গায় পেশাজীবীর কাজ করছেন। তাদের সন্তানদের দেখার সময় নেই। মার হাতে প্রচুর টাকা- সন্তানরা যখন যা চাইছে মা তখনই তা দিয়ে দিচ্ছেন। এই টাকা এবং মোবাইলের যাচ্ছে-তাই ব্যবহারের কারণে অনেক সন্তান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চার্চ পরিচালিত স্কুলগুলোতে খ্রিস্টান ছেলে মেয়েদের রেজাল্ট হতাশাজনক। পড়াশুনায় আমাদের সন্তানরা দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। কেনো পিছিয়ে যাচ্ছে? কেউ কী ভেবে দেখবেন না?
আজকে পরিবারের অশান্তির জন্য সামাজিক পরিবেশও অনেকাংশে দায়ী। এদেশে খ্রিস্ট সমাজ খুবই ছোটো। আমাদের সন্তানদের দিনের একটা বড় অংশ অতিবাহিত করতে হয় বৃহৎ সমাজের সাথে। বৃহৎ সমাজের আদর্শ দ্বারা আমাদের সন্তানরা প্রভাবিত হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার পরও যতোদূর সম্ভব সন্তানদের মধ্যে খ্রিস্টিয় ঐতিহ্য গড়ে তোলার সময় বের করতে হবে। খ্রিস্টানরা সংখ্যায় কম হলেও আর্থিক দিক দিয়ে বেশ ভালো। পূজা-পার্বণে অর্থের প্রচুর অপব্যবহার হতে দেখা যায়। বিশ্বায়নের প্রভাব পরিবারকে ওলট পালট করে দিচ্ছে। যুব সমাজের কাছে প্রবনতা বেড়ে চলেছে অন্য দেশে পাড়ি জমানোর জন্য। ইন্টারনেটে অবাধ বিচরণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে নৈতিক অধঃপতনের কারণ হয়ে উঠে।
উপসংহার ঃ – ব্যক্তি ও খ্রিস্টিয় পরিবারে বিশ^স্ততা, দায়িত্বশীলতা এবং দায়বদ্ধতা সম্পর্কে শিক্ষা ও ধারণা দান করার দায়িত্ব শুধু পিতামাতার নয়- সমাজেরও। এই ক্ষেত্রে খ্রিস্টিয় পরিবার ও সমাজকে অবশ্যই চার্চের দিকনির্দেশনা মেনে চলতে হবে। প্রতিটি ধর্মপল্লীতে চার্চের বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে- যেগুলোর দায় দায়িত্ব রয়েছে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে মানুষকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া। চার্চ পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোও তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। চার্চের বিদ্যালয়গুলো গড়ে তোলার পিছনে মূল লক্ষ্য ছিলো ছেলেমেয়েদের আদর্শবান হিসেবে গড়ে তোলা। বিদ্যালয় এই কাজটি কতোটুকু করছে তা মূল্যায়ন করে দেখা দরকার। সব মিলিয়ে একটা যৌথ প্রচেষ্টা থাকতে হবে- যাতে সন্তানগণ খ্রিস্টিয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে উঠতে পারে। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।