বিশপ জের্ভাস রোজারিও, রাজশাহী কাথলিক ধর্মপ্রদেশ
“তোমরা বরং সব-কিছুর আগে অন্বেষণ কর ঐশ্বরাজ্য, তাঁর ন্যায়ধর্মের পথ। তাহলে ওই সবকিছুও তোমাদের দেওয়া হবে” (মথি ৬:৩৩)
আমরা যখন এই কথাটি শুনি, তখন আমাদের কাছে এটি খুব কঠিন কিছু বলে মনে হয় না; খুব স্বভাবিক একটা কথা বলেই মনে হয়। কিন্তু গভীরভাবে যদি চিন্তা ও অনুধ্যান করি তাহলে বুঝতে পারি যে এটি শুধু কোন কথার কথা নয়। সবকিছু ছেড়ে সবার আগে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া ও তাঁর সঙ্গে থাকাটাই তো আমাদের প্রথম কাজ। ঐশ জীবনের সন্ধান করাটাই তো আমাদের আসল আহ্বান বা ঈশ্বরের ডাক।
সবার আগে বা প্রথমেই স্বর্গরাজ্যের সন্ধান করার অর্থ কিছুটা বুঝতে পারব যদি মথি ৬:২৫-৩৪ অংশটি পাঠ করি। “তাই আমি তোমাদের বলছি, কি খেয়ে প্রাণ বাঁচাবে, বা কি করে শরীরটা ঢেকে রাখবে তা নিয়ে চিন্তত হয়ো না। খাবারের চেয়ে প্রাণটা কি বেশী মূল্যবান নয়! জামাকাপড়ের চেয়ে শরীরটা কি বেশী মূল্যবান নয়? আকাশের পাখীদের দিকেই একবার চেয়ে দেখ – কই, তারা তো বীজ বোনেনা, ফসলও কাটে না, গোলাবাড়ীতে ফসল জমিয়েও রাখে না; তবুও তোমাদের স্বর্গনিবাসী পিতা তাদের তো খাইয়ে থাকেন! তোমাদের মূল্য কি তাদের চেয়ে বেশী নয়? বল, তোমাদের মধ্যে কেই বা দুশ্চিন্তা ক’রে নিজের আয়ু এতটুকুও বাড়াতে পারে? …
“জামাকাপড় নিয়েই বা তোমাদের এত দুশ্চিন্তা কেন? মাঠের লিলিফুলগুলোর দিকে একবার লক্ষ্য ক’রে দেখতো! তারা কেমন বেড়ে ওঠে! কই, তারা তো কোন কাজ করে না, একগাছি সুতোও কাটে না; তবুও আমি তোমাদের বলছি, স্বয়ং সলোমনের এত ঐশ্বর্য থাকা সত্বেও তাঁর পোশাক ওই ফুলগুলোর কোনটির মতোই সুন্দর ছিল না! সুতরাং যা মাঠের ঘাসেরই মতো – আজ যা আছে, কাল যা উনুনেই ফেলে দেওয়া হবে – তাকেই যদি পরমেশ্বর এইভাবে সাজিয়ে রাখেন, তাহলে তিনি কি এই ব্যাপারে তোমাদের জন্য আরও অনেক বেশী-কিছুই করবেন না? ওহে, এতই অল্প তোমাদের ভগবদ্বিশ্বাস?…
“না, তোমরা এই সব বিষয় (প্রশ্ন) নিয়ে দুশ্চিন্তা ক’রো না যে, ‘আমরা কি খাব’ বা ‘কি পান করব?’ কিংবা ‘কি পরব?’ অধর্মী মানুষেরাই তো ওসব কিছুর পেছনে ছুটে মরে! তোমাদের যে ওসব-কিছুর প্রয়োজন আছে, তা তোমাদের স্বর্গনিবাসী পিতা তো ভাল ভাবেই জানেন। …
“তোমরা বরং সব-কিছুর আগে অন্বেষণ কর তাঁর রাজ্যের (ঐশ্বরাজ্যের) পথ, তাঁর ন্যায়ধর্মের পথ! তাহলে ওইসব কিছু তো বাড়তি হিসাবে তোমাদের দেওয়া হবে! তাই তোমরা আগামী কালের কথা ভেবে এখন দুশ্চিন্তা ক’রো না! আগামী কাল তার নিজের ভাবনা নিজেই ভাববে; প্রতিটি দিনের পক্ষে প্রতিটি দিনের বোঝাই তো যথেষ্ঠ!” (মথি ৬:২৫-৩৪)
এটা শৃধু একটা সাধারণ আদেশ নয়, তার চেয়েও অনেক বেশী কিছু। ঈশ্বরই তো এই বিশ্বব্রম্মান্ড ও এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; আর পৃথিবীর সব কিছুও তিনিই সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করে তিনি এই সব কিছুর দায়িত্বভার ও কর্তৃত্ব তাকেই দিয়েছেন। তিনি যখন সব কিছু মানুষকে অর্থাৎ আমাদের দিয়েছেন, এর চেয়ে বেশী আমাদের আর কি দরকার? তবে মানুষ তো আর একজন নয়! আমরা মানব সমাজ – আমরা অনেক মানুষ, তাই আমাদের স্বার্থপর হওয়া উচিত নয়, আমাদের হতে হবে পরার্থপর। মানুষ সৃষ্টি করে তাকে সুখী করার জন্য সব কিছুই আয়োজন করেছেন আর ঢেলে দিয়েছেন। তবে তিনি চান যেন আমরা সকলেই দায়িত্বশীল আচরণ করি। যার যার কাজ ক’রে, দায়িত্ব পালন ক’রে, আমরা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো। আর ঈশ্বর নিজেই আমাদের ভাবনা ভাববেন – তিনিই আমাদের সকল প্রয়োজন মিটাবেন, যার যতটা দরকার ততটাই। আমরা ঈশ্বরের ওপর আস্থা রাখতে পারি।
আমরা অবশ্য আমাদের জাগতিক ও মানবীয় প্রয়োজনে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য উদ্বিগ্ন বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে থাকি; আমরা আমাদের ও আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিরাপদ ও নিশ্চিত করে রাখতে চাই; আমরা আমাদের ও আমাদের সন্তানদের বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই; আর তা করতে গিয়ে যে পন্থা বা পথ বেছে নেই তার কতটুকু নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ সম্পন্ন তা আমরা বিবেচনা করি না। তাছাড়া আমরা জানি যে আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, আমাদের চিন্তা ও পরিকল্পনা অনুসারেই যে আমাদের ভবিষ্যত গড়ে উঠবে তাও তো নয়। এই জন্যই তো আমরা বাইবেলের সামসঙ্গীতে পড়ি, “ভগবান নিজেই যদি গৃহটি না নির্মান করেন, তাহলে বৃথাই হয় নির্মান কর্মীদের এত পরিশ্রম। ভগবান নিজেই যদি নগরটি রক্ষা না করেন, তাহলে বৃথাই হয় রক্ষীদের রত্রি-জাগরণ” (সাম ১২৭:১)। আসলে আমাদের ও আমাদের সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যত বিনির্মান করতে হলে সবার আগে ঈশ্বরের উপরই আমাদের নির্ভর করতে হবে। তা না হলে হয়তো আমাদের ক্ষেত্রেও সত্য হবে মঙ্গল সমাচারে যীশুর এই বাণী, “ … এদিকে যে-কেউ আমার এইসব কথা শুনেও তা মেনে চলে না, সে কিন্তু তেমন এক নির্বোধ লোকেরই মতো, যে নিজের বাড়ি গড়ে তুলেছে বালির ওপর; হঠাৎ বৃষ্টি নামল, বন্যা এল, ঝড়ো হাওয়া বইল, এবং সজোরে বাড়িটার গায়ে ঝাপটা মারতে লাগল; আর বাড়িটাও ভেঙ্গে পড়ল। উঃ, কি সাংঘাতিক সেই ভেঙ্গে পড়া” ( মথি ৭:২৬-২৭)! আমরা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য বা আমাদের সন্তানদের জন্য এমন বিপর্যয় চাইব না।
যদি আমরা আমাদের স্বচ্ছল ও নিরাপদ ভবিষ্যত প্রকৃতই শক্ত ভিতের উপর গড়ে তুলতে চাই তাহলে আমাদের প্রথমেই খুঁজতে হবে স্বর্গরাজ্যের পথ। এই কাজ আমরা কিভাবে করতে পারি? কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায়:
১। প্রার্থনা ও উপাসনা : আমরা আমাদের জীবনে যীশুকে উপস্থিত রাখতে চাইলে বা আমরা যীশুর সঙ্গে থাকতে চাইলে অবশ্যই আমাদের প্রতিদিন নিজ গৃহে ও কর্মস্থলে প্রার্থনা করতে হবে এবং রবিবার দিন বা বিশেষ বিশেষ দিনে গীর্জার উপাসনায় যোগদান করতে হবে। ঘরে একা প্রার্থনা করার মধ্য দিয়ে আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন স্থাপন করি; কিন্তু যখন আমরা গীর্জায় একত্রে মিলে উপাসনা করি তখন আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গেও মিলন ও ঐক্য স্থাপন করি। গীর্জার উপাসনায় আমরা মিলন ভোজ ও সাক্রামেন্ত গ্রহন করে আত্মাকে সঞ্জিবিত রাখি।
২। অনুতাপ ও মন পরিবর্তন করা : আমরা যদি আমাদের মন পরীক্ষা করি তাহলে আমরা দেখব যে অসংখ্যবার আমরা স¦র্গরাজ্যের পথ না খুঁজে, বরং জগতের পাপময় পথে চলেছি। সবার আগে স্বর্গরাজ্যের পথ খোঁজা মানে হল পাপের জন্য অনুতাপ করা ও মন পরিবর্তন করে ঈশ্বরের পথে আসা। এটা কিন্তু যীশুর নিজেরই আহ¦ান, “তোমরা মন ফেরাও স্বর্গরাজ্য এখন খুব কাছেই” (মথি ৪:১৭)।
৩। পবিত্র বাইবেল ও ধর্মশিক্ষা পাঠ : আমরা কি বা কেন বিশ্বাস করি, তা আমাদের ভাল করে জানা দরকার। সেই জ্ঞানের সঙ্গে আমাদের আত্মার জন্য যে খাদ্য বা রসদ দরকার তা পেতে পারি পবিত্র বাইবেল ও ধর্মশিক্ষার বই পাঠ করে। এইভাবে আমরা আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবনের শিক্ষা ও পথনির্দেশ লাভ করতে পারি।
৪। জীবনাচরণ ও জীবন সাক্ষ্য : পবিত্র বাইবেল ও ধর্মশিক্ষার বই পাঠ করলে বা এর পদগুলো মুখস্থ করলেও যদি আমরা তা অনুশীলন না করি বা সেই শিক্ষা জীবনে পালন না করি তাহলে তো কোন লাভ নেই। শুধু মুখে মুখে ধর্মের কথা বলে, কাজে যদি আমরা তা পালন না করি তাহলে তো আমরা ভন্ড। স্বর্গরাজ্যে কিন্তু ভন্ডদের কোন স্থান নেই। তাই আমরা যে শিক্ষা ধর্মগ্রন্থে পাই তা আমাদের পালনও করতে হবে।
৫। বিশ্বাস ও দয়ার কাজ : আমরা যা বিশ্বাস করি, তা আমাদের জীবনে, আচরণে ও কাজে যেন প্রকাশ পায়। ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস থাকলেও তা যথেষ্ঠ নয়; তা প্রেম ও দয়ার কাজে প্রকাশ করতে হবে। মাদার তেরেজাসহ অসংখ্য সাধু ব্যক্তিগণ সেই আদর্শ আমাদের দেখিয়েছেন। আমাদের ধর্মজ্ঞান ও বিশ্বাস হবে মৃত যদি আমরা ভাল কাজ না করি।
৬। ঈশ্বরের প্রশংসা ও তাঁকে ধন্যবাদ জানানো : ঈশ্বর আমাদের অকুন্ঠভাবে ভালবেসেছেন আর আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই দিয়েছেন। আমাদের সেই বিষয় সচেতন হয়ে, তাকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানানো দরকার; তাঁর বিচক্ষণতা ও বদান্যতার জন্য তাঁর প্রশংসা করা দরকার। যদি আমরা তা করি তাহলেই আমরা তাঁর কাছে বা স্বর্গরাজ্যে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি। আমরা অকৃতজ্ঞ হয়ে তাঁর কাছে যেতে পারি না।
৭। পৃথিবী ও প্রাকৃতিক পরিবেশের যত্ন: ঈশ্বর আমাদের দ্বায়িত্ব দিয়েছেন যেন আমরা আমাদের প্রতিবেশী মানুষ ও এই ধরিত্রী বা পৃথিবীর সকল কিছুর যত্ন করি। এই পৃথিবী হ’ল আমাদের সকলের অভিন্ন বাসগৃহ (পোপ ফ্রান্সিস)। পৃথিবী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা আমাদের সকলের নিরাপত্তার জন্যই একান্ত আবশ্যক। পৃথিবী ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে যেন আমরা ধ্বংশ না করি বরং যেন তা পরিচ্ছন্ন ও সবুজ ক’রে রাখি। এটা আমাদের আধ্যাত্মিকতারই অংশ। আমরা প্রকৃতির ক্ষতি করলে করলে, প্রকৃতি আমাদের ধ্বংশ করে ফেলবে। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত টেকসই করতে চাইলে আমাদের ঈশ্বরের দেওয়া প্রাকৃতিক বিধান অবশ্যই মানতে হবে।
ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে আমরা যেন আমাদের জীবন ও আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত গড়ার চেষ্টা না করি। আমাদের মনে রাখা উচিত আমাদের ধর্মকর্মের ও নৈতিকতার মূল লক্ষ্যই হল স্বার্গে যাওয়া। ঈশ্বর চান যেন আমরা তাঁকেই খুঁজি সবার আগে। কিন্তু আমরা তাঁকে না খুঁজে, বরং খুঁজে বেড়াই বৈষয়িক বা জাগতিক লাভ। যারা ব্যবসায়ী বা কল কারখানা চালান তারা মানুষকে কিভাবে ঠকান ও শোষণ করেন তা আমরা জানি। ক্ষমতা ও পেশীশক্তি ব্যবহার করে আমাদের অনেকেই অন্যায় কাজ করেন ও অবৈধভাবে অন্যের প্রাপ্য ছিনিয়ে নেন। যেমন আমরা অতীতে দেখেছি বিভিন্ন অভাবের সময়, কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরে, কভিড- ১৯ মহামারী, বা অন্যান্য অভাব অনটনের সময়ে মানুষের মধ্যে যে ত্রাণ বিতরণ হয়েছে, সেই সময় যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা নিজেরাই লাভবান হওয়ার জন্য ত্রাণ আত্মসাৎ করেছেন। তাঁদের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এই অন্যায় করেছেন – তাঁরা স্বর্গরাজ্য অনুসন্ধান করেন নি; তাঁরা লোভের বশবর্তী হয়ে খুঁজেছেন বৈষয়িক বা জাগতিক লাভ। কিন্তু এই লাভ তাঁদের জন্য বুমেরাং হবে, বালির ওপর গৃহ নির্মানের মতই। তাঁদের জন্য প্রভু যীশুর সতর্কবাণী প্রণিধানযোগ্য: “সমস্ত জগৎ লাভ করেও যদি তোমার আত্মাকে হারাও, তাতে তোমার লাভ কি” (মথি ১৬:২৬)?
সেইজন্য সব কিছুর আগে স্বর্গ রাজ্যের পথ খোঁজার অর্থ কি তা আমাদের বুঝে নিতে হবে যীশু খ্রিস্টের কথা থেকে, কারণ স্বর্গরাজ্যের পথ খোঁজা মানে, যীশুকেই খোঁজা। তিনি বলেছেন: “কেউ যদি আমার অনুগামী হতে চায়, তবে সে আত্মত্যাগ করুক এবং নিজে ক্রুশ তুলে নিয়ে আমার অনুসরণ করুক” (মথি ১৬:২৪)। আমরা সকলেই যে সংসার বিরাগী হতে পারব তা নয় – তা হওয়া সম্ভবও নয়। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই নিজ নিজ ক্রুশ রয়েছে, যেমন আমাদের কর্মস্থল, আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ, আমাদের মণ্ডলী, সর্বত্র আমাদের ক্রুশ রয়েছে যা আমরা যীশু খ্রিস্টের ভালবাসা ও ত্যাগস্বীকারসহ বহন করি – বা করতে পারি। তাহলেই সবার আগে আমরা খুঁজে পাব ঐশরাজ্যের পথ – পেয়ে যাব স্বর্গরাজ্য।