সম্প্রতি (সেপ্টেম্বর ২৬-২৮, ২০২০) রাজশাহী জেলার তানোর থানায় অবস্থিত মুন্ডুমালা কাথলিক চার্চে বা ধর্মপল্লীতে ফা: প্রদীপ গ্রেগরীকে (বর্তমানে তাঁর যাজকত্ব স্থগিত) ও একটি অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক কিশোরী মেয়েকে নিয়ে যে অপ্রীতিকর ও কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছে তা পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকলেই জানতে পেরেছে। প্রদীপের অপরিনামদর্শী আচরণ ও অনৈতিক কর্মকান্ড খ্রিস্ট বিশ্বাস ও মঙ্গল সমাচারের শিক্ষার পরিপন্থী। তাই খ্রিস্টান হিসাবে আমরা কেউই তা গ্রহন বা সমর্থন করতে পারি না। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ হিসাবে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ও অভিযুক্ত প্রদীপের এহেন আচরণকে কখনোই সমর্থন করি না; বরং ঘৃণা ও নিন্দা জানাই। এই ঘটনায় আমি ব্যক্তিগতভাবে অতিশয় দুঃখিত, হতবাক ও মর্মাহত হয়েছি। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য অভিযোগকারী কিশোরী মেয়েটি ও তার পরিবারের প্রতি এবং এই ঘটনায় যারা বিঘ্ন ও কষ্ট পেয়েছে তাদের সকলের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

উল্লেখ্য যে গত ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ঘটনার সূত্রপাত। ২৭ সেপ্টেম্বর মেয়ের ভাই তানোর থানায় সাধারণ ডাইরী করেন এই মর্মে যে তার বোনকে আগের দিন ঘাস কাটতে যাওয়ার পর থেকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, অর্থাৎ তার বোন নিখোঁজ হয়েছে। জানা যায় যে ২৬ তারিখ সকালে প্রদীপ সেই মেয়েকে কিছু বিষয় সংশোধন করার জন্য তার অফিসে ডেকে নেয় এবং আলাপের পর তাকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন। এর পর ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে খ্রিস্টযাগ উৎসর্গের পর ফিরে গিয়ে মেয়েকে তার শোয়ার ঘরে দেখতে পায়। কখন মেয়ে তার ঘরে প্রবেশ করেছে এই ব্যাপারে প্রদীপ কিছু জানত না বলে জানিয়েছে। প্রদীপের মতে অভিযোগকারিণী কোথায় ছিল এবং কোন সুযোগে তার ঘরে প্রবেশ করেছে সেই বিষয়েও সে অবগত ছিল না। এই ভাষ্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করা কঠিন। সেই ধর্মপল্লীর সহকারী পাল-পুরেহিত ফা: প্যাট্রিক গমেজ বিশেষ কাজে অন্যত্র থাকায় এই সময় ধর্মপল্লীতে উপস্থিত ছিলেন না।

এই ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গেই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ তরিৎ পদক্ষেপ গ্রহন করেছে এবং ২৮ তারিখ সকালে কয়েকজন পুরোহিতকে (ফাদার পল গমেজ, ফাদার উইলিয়াম মুর্মু ও ফাদার ইম্মানুয়েল রোজারিও) সঠিক ঘটনা জানতে ও সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলাপ আলোচনা করতে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। তারা অভিযোগকারিণী মেয়ের সাথে ও প্রদীপের সাথে একান্তে আলাপ করেছে। পরে তারা মেয়ের পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ধর্মপল্লীর কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিসহ বেশ কিছু সংখ্যক খ্রিস্টভক্তের সাথে ঘটনাটি নিয়ে আলোচনা করে। (ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছে বা যারা অবগত ছিল তাদের সাথে আলাপ করেছে, এবং সত্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছে।) সেই সময় সেখানকার সহকারী পুরোহিত ফা: প্যাট্রিক গমেজ এবং তানোর থানার দুই জন পুলিশও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

একান্ত আলাপে বা সামাজিক আলোচনার সময় অভিযোগকারিণী বা তার পরিবার (পিতামাতা, বড় ভাই) কেউই ধর্ষণ বা কোন প্রকার দৈহিক সম্পর্ক হয়েছে বলে প্রকাশ করেনি। তা সত্বেও এই তথ্য জানার পরে আমি প্রদীপ গ্রেগরীর যাজকপদ ও তাঁর সকল প্রকার পালকীয় সেবা দায়িত্ব স্থগিত বা রহিত করি। ২৮ তারিখে সামাজিকভাবে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলাপ অলোচনাকালে রাজশাহীর ফাদারগণ ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিয়ে কি করা যায় এই ব্যাপারে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মতামত জানতে চান। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পর মেয়ের অভিবাভকগণ কি চান জানতে চাইলে প্রথমে বিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘন করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের বিয়ের চিন্তা করা যায় না। তাছাড়াও ক্যাথলিক মণ্ডলীর আইন অনুসারে বিবাহের একটি প্রক্রিয়া আছে তা অনুসরণ না করে বিবাহ দেওয়া যায় না। এই কথা বলা হলে মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে মেয়ের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা হয়। মেয়েটির ভবিষ্যৎ, মান সম্মান, মর্যাদার কথা বিবেচনা করে একটি সুন্দর পরিবেশে রেখে পড়ালেখা করা ও মানবিক গঠনলাভের সুযোগদানের প্রস্তাব করা হলে উপস্থিত সকলেই ভাল প্রস্তাব হিসাবে তাতে সম্মতি প্রকাশ করে। তবে প্রথমে দুই তিন দিন পিতামাতার সাথে নিজ বাড়ীতে থাকার কথা বলা হয় যাতে মেয়েটি বুঝতে পারে যে সে পিতামাতার কাছে গৃহিত হয়েছে। এতে সে স্বাভাভিক হবে, মনে শান্তি পাবে এবং পরবর্তীতে যেখানেই রাখা হোক না কেন সে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে পড়ালেখা করতে পারবে এবং সুন্দর মন মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারবে। এই প্রস্তাব মেয়েটি গ্রহণ করেছে বটে তবে পিতামাতার সাথে নিজ বাড়ীতে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে উপস্থিত সকলে আলাপ আলোচনা করে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য মেয়েটিকে সিস্টারদের কনভেন্টে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই মেয়েকে পিতামাতার হাতে না দেওয়া এবং জোর করে আটকে রাখার দাবী অযৌক্তি ও ভিত্তিহীন।

অন্যদিকে, মেয়েটিকে প্রদীপের ঘরে পাওয়া, তার অপরিনামদর্শী আচরণ ও অনৈতিক কর্মকান্ড সামাজিক কলঙ্কের সৃষ্টি করেছে। ফলে মাণ্ডলিক আইন মোতাবেক সেও শাস্তি পাবে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তাই মন্ডলির কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাতের জন্য উপস্থিত সকলের সম্মতিতে ও সামনেই সে ফাদারদের সাথে রাজশাহীতে আসে। পরবর্তীতে প্রদীপের সাথে ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘ সময় আলাপ করি এবং তার অপরিণমদশী আচরণ ও অনৈতিক কাজের জন্য আমি প্রদীপ গ্রেগরীর যাজকপদ ও তাঁর সকল প্রকার পালকীয় সেবা দায়িত্ব স্থগিত বা রহিত করি।

সামাজিক আলোচনায় ঐক্যমতে আসার পরেও শোনা যায় ২৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগকারিণী ও তার ভাই প্রদীপের বিরুদ্ধে তানোর থানায় অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা করে। সেই রাত্রেই র‌্যাব প্রদীপকে রাজশাহী বিশপ ভবন থেকে ধরে নিয়ে যায়। প্রদীপ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ। তাই তার ব্যক্তিগত অপকর্মের দায় তাঁর নিজস্ব। তার অপকর্মের জন্য কোনভাবেই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ এই দায়ী নয়। দোষী প্রমাণিত হলে রাষ্ট্রের আইন মোতাবেক প্রদীপ শাস্তি পাবে। এই ক্ষেত্রে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

এখন এটি পুলিশ ও আদালতের বিষয়। আমরা এই ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করিনি বা ভবিষ্যতেও করব না। আমি এবং রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের আমরা সকলেই চাই পুলিশের নিরপেক্ষ তদন্তে আসল সত্য বেড়িয়ে আসুক এবং ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠা হোক। প্রদীপ যদি দোষী বা অপরাধী প্রমানিত হয় তাহলে তাঁর উপযুক্ত শাস্তি হোক এটা আমরা সকলেই চাই। এই ব্যপারে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পক্ষ থেকে অভিযুক্তকে সুরক্ষা দেওয়া বা তার পক্ষ সমর্থন করার কোন প্রশ্ন্ই ওঠে না বা তার কোন সুযোগ নেই। তথাপি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনেকেই সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ তথা গোটা কাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে বিশো˜্গাার করছেন এবং মনগড়া তথ্য প্রচার করছেন আর কুৎসা রটনা করে চলেছেন। এই কারণে আমরা রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ, ফাদারগণ ও বিশ্বাসী ভক্তসমাজ খুবই বিব্রতবোধ করছি ও কষ্ট পাচ্ছি।

প্রদীপের ২০১০ খ্রিস্টাব্দের একই প্রকার একটি ঘটনাও এখানে টেনে আনা হচ্ছে, আর বলা হচ্ছে যে সে সময় তাঁকে কোন শাস্তি দেওয়া হয়নি বলে আজ তারই পুণরাবৃত্তি ঘটলো, যা অনভিপ্রেত। সেই সময় নওগা জেলার ধামইরহাট থানায় অবস্থিত বেনীদুয়ার ধর্মপল্লীর বোর্ডিং এর একটি অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক কিশোরী মেয়েকে জড়িয়ে একটি কেলেঙ্কারী হয়েছিল। প্রদীপকে তখন ঐ মেয়ের সাথে বগুড়া শহরে পাওয়া গিয়েছিল। সেই সময়ও তাঁর যাজক পদ রহিত বা স্থগিত করা হয়েছিল। সামাজিকভাবে সেই সময় সেখানে একটা মিমাংসা করা হয়েছিল। পরে এই নিয়ে আর কোন কথা শোনা যায় নি। পরবর্তীতে প্রদীপ অনুতপ্ত হয়ে যাজক পদে পুণপ্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে তাঁকে তখন চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশের প্রয়াত মহামান্য বিশপ (পরবর্তীতে আর্চবিশপ) মজেস কস্তার কাছে পাঠানো হয়। এর লক্ষ্য ছিল যীশুর ক্ষমা লাভ, জীবনের সংশোধন ও মন পরিবর্তনের সুযোগ দান করা। প্রায় দুই বছর আধ্যাত্মিক যাত্রা করার পর বিশপ মজেস কস্তা প্রদীপকে আবার যাজকীয় ও পালকীয় কাজ করার অনুমোদন দেন। এরপর প্রদীপ চট্টগ্রাম মহাধর্মপ্রদেশেই ভালভাবে কাজ করছিল। মাত্র দেড় বছর আগে পুণরায় তাঁকে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশে ফিরিয়ে আনা হয় আর মুন্ডুমালাতে পালপুরোহিত হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যেই দুর্ভাগ্যজনকভাকে তাঁকে জড়িয়ে আর একটি কলঙ্কময় কেলেঙ্কারীর ঘটনা ঘটল। এর জন্য আমরা লজ্জ্বিত ও দুঃখিত। তবে কাথলিক মণ্ডলির আইন ও বিধান অনুসারে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ সকল পদক্ষেপই গ্রহণ করেছে। তা হয়তো জনসম্মুখে প্রকাশিত হয় নি। তবে ধর্মপ্রদেশ যে কিছ্ইু করেনি তা ঠিক নয়। আমি আশা করব যে এই ব্যখ্যার পরে প্রদীপের অপরিনামদর্শী আচরণ ও অনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য ব্যক্তি হিসাবে শুধু তাঁকেই অভিযুক্ত করা হবে, গোটা রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ বা মণ্ডলিকে নয়।

আমাদের ফাদারগণ ঈশ্বরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ও অভিষিক্ত হয়ে ঈশ্বর ও তাঁর জণগণের সেবা করার জন্য প্রেরিত হন। বাড়ীঘর ছেড়ে তাঁরা যীশুর শিষ্য হন এবং নিজে পবিত্র থেকে ঐশ জনগণকে পবিত্র করার চেষ্টা করেন আন্তরিকভাবে। তাঁরা মণ্ডলির সেবা করেন বিনা পারিশ্রমিকে, নি:স্বার্থ ও নিরলসভাবে। খ্রিস্টভক্তদের সুরক্ষা দিতে ও তাদের মঙ্গল করতে প্রচুর ত্যাগস্বীকার করে থাকেন। দরিদ্র পীড়িতদের প্রতি দয়া করেন ও নির্যাতিতদের পাশে দাড়ান জীবনের ঝুঁকি নিয়েও। পালকীয় সেবাকাজ করতে গিয়ে অনেকবার তাঁদের ঈর্ষা, নিন্দা ও অপবাদেরও শিকার হতে হয়। যাজকগণ যে ভাল কাজ করেন এই কথা জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বেশেষে সকলেই তা জানে ও স্বীকার করে থাকে। তার পরেও তারা অন্যান্য সকলের মতই মানুষ। তাঁদেরও মানবীয় দুর্বলতা রয়েছে। তাই মানবীয় দুর্বলতার কারণে কেউ কেউ স্খলিত হতে পারে। তার সেই স্খলণ ও কৃত অপরাধের জন্য ব্যক্তিগতভাবে সে নিজেই দায়ী। তাই এই দায়ভার থেকে মুক্তি পেতে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবেই চেষ্টা করতে হয়। আমি আশা করব খ্রিষ্টভক্তগণ যেন এই অবস্থায় আমাদের যাজকদের ভুল না বুঝে বরং পরামর্শ ও প্রার্থনা দ্বারা তাঁদের সাহায্য করবে।

বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ
৬ অক্টোবর ২০২০

Please follow and like us: