ফাদার সাগর কোড়াইয়া
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ায় খ্রিস্টবাণী আগমনের ১০০ বছরের পূর্তি আসন্নপ্রায়। তিলে তিলে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ ভিকারিয়ার বাঙ্গালী খ্রিস্টান অধ্যূষিত ধর্মপল্লীগুলো। পিমে মিশনারীদের অবদান এখানে অতুলনীয়। এছাড়াও স্থানীয় অনেকের ত্যাগ-তিতিক্ষা, শ্রম, বুদ্ধি-পরামর্শ, আর্থিক অনুদান ও বাণী প্রচারের ফলে আজকের এই বিধৌত জনপদ। এই ভিকারিয়াগুলোতে এমন কিছু খ্রিস্টবিশ্বাসী ভক্তজনগণের জন্ম হয়েছে যাদের সমাজ-ধর্মপল্লী, শিক্ষা-দীক্ষায় সর্বত্র রয়েছে অসামান্য সেবাকর্ম। বড়াল নদের তীরে পলিমাটি গায়ে মেখে গড়ে ওঠা বোর্ণী ধর্মপল্লী হচ্ছে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ার ইতিহাসের প্রথম সারির জনপদ। একটি ইতিহাস; জনপদের সূচনা। বন শব্দের সাথে নামটির মিল। বোর্ণী এলাকা এক সময় যে বনে ঘেরা ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। এখনো কিছু কিছু স্থানে এর চিত্র বিদ্যমান। আবার অনেকের মুখে এখনো প্রচলিত যে, বোর্ণী বন ছিল। বোর্ণীর ইতিহাসের শুরুর দিকে এলাকাবাসী একাকী বন্য পশুর ভয়ে রাস্তায় বের হতে ভয় পেত। আর এর প্রমাণ হচ্ছেন, পলু শিকারী। যিনি শিকারের উদ্দেশে মথুরাপুরে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ঢাকার ভাওয়াল এলাকার নাগরী, তুমিলিয়া, মঠবাড়ি ও রাঙ্গামাটিয়া থেকে আনুমানিক ১৯২০-১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বেশ কিছু পরিবার বোর্ণীর বিভিন্ন স্থানে এসে বসিত স্থাপন করেন। ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চাহিদা সেই সময়ই খ্রীষ্টভক্তগণ বেশ অনুভব করেছিলেন। আর সেই চাহিদার রূপই আজ সাধ্বী মেরীর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সাধু লুইসের উচ্চ বিদ্যালয় বোর্ণী মায়ের বুকে মহিরূহ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে চামটা গ্রামে যে গীর্জা ঘর স্থাপন করা হয়েছিলো সেখানে একই সাথে রবিবাসরীয় অনুষ্ঠান, প্রাথমিক ও ধর্মীয় শিক্ষার কাজ পরিচালনা করা হতো। বোর্ণী মায়ের বুকে (বর্তমানে যেখানে ফাদার কান্তন অডিটোরিয়াম) ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ীভাবে স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষার আলো বিতরণে বোর্ণী ধর্মপল্লীর বিদ্যালয়ে অনেকেই শিক্ষকতা করছেন। প্রত্যেকের জীবনে জ্বালিছেন শিক্ষার আলো। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা মারা গিয়েছেন। যাদের আমরা জীবনের প্রতিটি পদে স্মরণ করি। নমস্য এই শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ বিভিন্ন সময়ে বোর্ণী ধর্মপল্লীর বা অন্যান্য স্থানে শিক্ষকতার কাজ করেন। আমাদের এই শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ দেহে মারা গিয়েছেন কিন্তু তাঁদের শিক্ষার যে মাধুর্য্য ও সৌন্দর্যময়তা তা এখনো আমাদের স্মৃতির দুয়ারে আলতো করে পরশ বুলিয়ে যায়।
১৯৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে চামটা গ্রামে যে স্কুল ছিলো সেখানে প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ছাবিনা রোজারিও’র পিতা মানুয়েল রোজারিও (পাগলা মাষ্টার নামে খ্যাত) শিক্ষকতা করতেন। তিনিই বোর্ণীর ইতিহাসে প্রথম শিক্ষক। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একাই শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা করার পাশাপাশি প্রার্থনা অনুষ্ঠানও পরিচালনা করতেন। এরপর এডবিন মাষ্টারের নাম স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। এডবিন মাষ্টারের (ফাদার ইন্মানুয়েল প্রফুল্ল, ফাদার প্যাট্রিক গমেজ ও মনো স্যারের বাবা) জন্ম ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারী নাগরী ধর্মপল্লীতে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ এপ্রিল ক্যাথেরীনা রোজারিওকে বিয়ে করেন। নাগরীতে থাকাকালীন সময়েই তিনি শিক্ষকতা করতেন। পরবর্তীতে বোর্ণীতে এসেও বোর্ণী ধর্মপল্লী প্রাঙ্গণের স্কুলে এডবিন গমেজ প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় আন্তনী ক্রুশ (দিঘইর) সাবিনা দিদি (বোর্ণী) ও পলিনা রোজারিও (বড়বাড়ি) এবং বিভিন্ন সময়ে আরো অনেকে শিক্ষকতা করতেন। বোর্ণীতে তিনি প্রায় ১২/১৩ বছর শিক্ষকতা করেন। এডবিন মাষ্টার ধার্মিক ছিলেন। প্রতিদিন খ্রীষ্টযাগে যোগদান করতেন। ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই সহজ-সরল। এডবিন মাষ্টারের ৭ সন্তান। এরমধ্যে ফাদার ইন্মানুয়েল ফাদার প্যাট্রিক ও সিস্টার জাসিন্তা গমেজ সিএসসি ব্রতীয় জীবনে প্রবেশ করেছেন। এডবিন মাষ্টার বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
ফাদার কান্তন একজন কারিগর। বোর্ণী ধর্মপল্লী তথা স্কুলের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। বোর্ণী ধর্মপল্লীর অস্তিত্ব যতদিন থাকবে ফাদার কান্তনের নাম ততদিন খ্রীষ্টভক্তগণ স্মরণ করবেন। ফাদার কান্তন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ইটালীর জপ্পনা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই তিনি যাজক পদে অভিষিক্ত হন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর তিনি বোর্ণী ধর্মপল্লীতে আসেন। ফাদার কান্তন বোর্ণীতে এসে শিক্ষার অভাব হৃদয় থেকে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি আসার পরই প্রাইমারী স্কুলটিকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করেন। পরবর্তীতে ফাদার কান্তন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে স্কুলটিকে ৮ম শ্রেণীতে উন্নীত করেন। তিনি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারী থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বও পর্যন্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেন। ফাদার কান্তন ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বোর্ণী ধর্মপল্লীতে অবস্থান করে জনগণের আধ্যাত্মিক যত্ন এবং শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করেছেন। এই মহাপ্রাণ মহাপুরুষ ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই ইতালীর লেক্কোতে মৃত্যুবরণ করেন।
সৎ, বিনয়ী, নম্র ও মিষ্টভাষী সামুয়েল রায়ের জন্ম ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল বরিশাল জেলার গৌরনদী ধর্মপল্লীর কলাবাড়ি গ্রামে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল বিয়েট্রিস বিদ্যুৎলতা রায়কে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। সামুয়েল রায় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ থেকে বি.এ. বি.এড. পাশ করে সরকারী চাকুরী পান। তিনি রাজশাহী শহরে সরকারী টেলিফোন একচেঞ্জে কাজ করা কালীন সময়ে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ফাদার কান্তনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বোর্ণীতে শিক্ষকতা শুরু করেন। ইংরেজিতে তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন। ১৯৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ২৬ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে অবসর নেন। পরবর্তীতে তিনি মথুরাপুর সাধ্বী রীতা’র স্কুল ও চড়ুইকোল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে সামুয়েল স্যারের স্মৃতিশক্তি লোপ পায় এবং বছর খানেক তিনি বিছানাগত থাকার পর ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ পারবোর্ণী নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।
অপু খ্রীষ্টফার দেশাই। যিনি অপু স্যার, খ্রীষ্টফার স্যার বা দেশাই স্যার এই তিনটি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানার রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীতে স্যারের জš§। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল অপুর স্যার মথুরাপুর ধর্মপল্লীর মিটিল্ডা গমেজকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। বিয়ের পূর্বেই ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। সামুয়েল স্যারের অবসরের পর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অত্যন্ত বিশ্বস্থ্যতা ও প্রশংসার সাথে তিনি তাঁর এই গুরুদায়িত্ব পালন করে যান। যেহেতু তিনি দীর্ঘ সময় ধরে স্কুলের সাথে জড়িত ছিলেন তাই স্যারকে বিভিন্ন এলাকার অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। শিক্ষকতা ছাড়াও দেশাই স্যার ধর্মপল্লী, ক্রেডিট ইউনিয়ন ও সামাজিক বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি প্রায়ই ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের লক্ষ্য গঠনের কথা বলতেন। দেশাই স্যারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একজন সিস্টার লিপি দেশাই ব্রতীয় জীবনে রয়েছেন। স্যার বাংলা সাহিত্য ও ইংরেজীতে বেশ দক্ষ ছিলেন। দেশাই স্যার যখন ক্লাস নিতেন ছাত্ররা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনতো। তিনি প্রায়ই বাংলা সাহিত্যের বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। কত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যে তিনি সাহিত্যের রস জুগিয়ে দিয়েছেন। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন অবস্থায় ঢাকায় হৃদযন্ত্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্যারের অন্তোষ্ট্যিক্রিয়ায় বহু লোকের সমাগম হয়েছিলো। স্যারের মৃত্যুর কিছুদিন পর স্যারের অভাব সামাজিক, শিক্ষা ও মাণ্ডলিক কাজে খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়।
সুশীল জেভিয়ার গমেজ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানার নাগরী ধর্মপল্লীতে জš§গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর ক্যারোলিনা লক্ষ্মীকে (প্রাইমারী স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা) বিয়ে করেন। ফাদার ক্যান্টনের সময়ে সুশীল স্যার শিক্ষকতা করেন। ইংরেজী বিষয়ের উপর তিনি দক্ষ ছিলেন। তবে অন্যান্য বিষয়ের উপরও শিক্ষকতা করেন। বোর্ণী বোর্ডিং প্রথম মাষ্টার হিসাবে তিনি নিযুক্ত ছিলেন। অনেক সময় ধর্মপল্লীতে যাজকের অনুপস্থিতিতে সুশীল স্যার প্রার্থনা পরিচালনা করতেন এবং গান বাজনায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। এমএ পড়ার জন্য সুশীল স্যার ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় যান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বোর্ণীতে ফিরে আসেন এবং ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে আবার ঢাকায় ফিরে গেলে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের অন্তর্গত (তৎকালীন দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশ) আন্ধারকোটা ধর্মপল্লীর মিশনপাড়ায় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বার্নার্ড বিশ্বাস জš§গ্রহণ করেন। আন্ধারকোটা মিশন স্কুল থেকে তিনি ৫ম শ্রেণী পাশ করে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন এবং দিনাজপুর কস্বা মিশনের বোর্ডিং মাষ্টার হিসাবে দায়িত্ব পান। এরইমধ্যে বার্নার্ড স্যার ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পিটিআই পাশ করেন। ফাদার ক্যান্টন ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বার্নার্ড স্যারকে বোর্ণী মিশনের ম্যানেজার হিসাবে নিয়ে আসেন। সেই সময় তিনি পারবোর্ণী গ্রামের জাকি মাষ্টারের বাড়িতে থাকতেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে স্কুল যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয় তখন বার্নার্ড স্যার শিক্ষকতা শুরু করেন। সেই সাথে তিনি বোর্ডিং মাষ্টার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। জাকি মাষ্টারের বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে বার্নার্ড স্যার ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারী আগ্নেশ রোজারিওকে বিয়ে করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি জোনাইল খ্রীষ্টান এগ্রিকালচারাল কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। পরবর্তীতে ক্রেডিটের আরো বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বার্নার্ড স্যার অসুস্থতার কারণে স্কুল থেকে অবসর নেন। ২০০০ খ্রীষ্টাব্দের ৫ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মনো স্যার নামেই সবচেয়ে বেশী পরিচিত ছিলেন এন্ড্রু মনো গমেজ। মনো স্যারের জš§ ১৬ মে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ২৪ অক্টোবর বাগবাচ্চা গ্রামের মেরী রোজারিওকে বিয়ে করেন। স্কুলের মধ্যে হাস্যরসবোধ হিসাবে মনো স্যার জনপ্রিয় ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীরা মনো স্যারের সাথে একজন অভিভাবক এবং বন্ধুর মতো কথা বলতে পারতো। ইংরেজীতে দক্ষ হিসাবে মনো স্যারের প্রশংসা ছিলো বেশ। তাই বেশীর ভাগ শ্রেণীতে তিনি ইংরেজী পড়াতেন। ইংরেজী ঞবহংব তিনি যাদের একবার শিখিয়েছেন তারা আর কখনো তা ভুলে যায়নি। তাঁর শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি ছিলো খুবই সুন্দর। শিক্ষকতা ছাড়াও মনো স্যার ধর্মপল্লী, ক্রেডিট ইউনিয়ন ও সামাজিক নানাবিধ কাজে জড়িত ছিলেন। “তোমার রাজ্য আসুক প্রভু, তোমার রাজ্য আসুক” গানটি যখন তিনি গীর্জায় খ্রিস্টযাগে হারমোনিয়ামে তুলতেন তখন ভক্তিময় একটা পরিবেশের সৃষ্টি হতো। প্রভুর রাজ্য প্রতিষ্ঠাকারী ঈশ্বরের এই সেবক মনো স্যার ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
বেঞ্জামিন পালমা যিনি বেঞ্জু স্যার নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। বেঞ্জু স্যার ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ আগষ্ট রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রিয়বাগ গ্রামে ছিলেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি গণিত বিষয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ে ক্লাস নিতেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারী মাগদালেনা রোজারিওকে (প্রাইমারী স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা) বিয়ে করেন। শিক্ষক হিসাবে তিনি নিয়মের প্রতি ছিলেন কঠোর তবে ব্যক্তি হিসাবে তিনি অত্যন্ত ভালো এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সব সময় উৎসাহিত করতেন। মাঝে স্কুলের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি সিলেটে ক্যাটিখিষ্ট হিসাবে কাজ করেছেন। সিলেট থেকে ফিরে এসে আবার শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি ঢাকায় চাকুরীতে চলে যান। অবশেষে বাড়িতে ফিরে এলে তিনি প্যারালাইসড হয়ে পড়েন। বাজারে বা বাড়িতে বেঞ্জু স্যার খালি পায়ে হাঁটতেন। তিনি সব সময় মাটির স্পর্শ পেতে চাইতেন। স্যারের এক সন্তান সিস্টার মেরী তেরেজা এসসি ব্রতীয় জীবনে প্রবেশ করেছেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই বেঞ্জু স্যার মৃত্যুবরণ করেন।
জন কস্তা বা জন মাষ্টারের জন্ম ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তুমিলিয়া ধর্মপল্লীতে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাগদালেনা রিবেরুকে বিয়ে করেন। আনুমানিক ১৯৫০-৯১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি স্কুলে সব বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। জন মাষ্টার ছিলেন একজন অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষক। ক্যাটিখিষ্ট মাষ্টার হিসাবে তিনি ১৯৪২-১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার রাণীখং, বিড়ইডাকুনী, বড়দল ধর্মপল্লীতে কাজ করেছেন। পুরোহিত উপস্থিত না থাকলে তিনি রবিবাসরীয় প্রার্থনানুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। আনুমানিক ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি বাগবাচ্চা গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৬০-৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফাদার ক্যান্টনের সময়ে জন মাষ্টার মথুরাপুর ধর্মপল্লীতে ক্যাটিখিষ্ট এবং শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে বোর্ণী ধর্মপল্লীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি হাই স্কুলেও কাজ করেন। বার্ধক্যজনিত শ্বাসকষ্টে জন মাষ্টার ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ পরলোকগমন করেন।
যোসেফ পালমার জন্ম ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারী মাউসাইদ ধর্মপল্লীর হারবাইদ গ্রামে। যোসেফ মাষ্টারের পিতা পাচকল পালমা হারবাইদ থেকে বোর্ণী ধর্মপল্লীর বাগবাচ্চা গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। যোসেফ পালমা ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তেরেজা পেরেরাকে বিয়ে করেন। যোসেফ মাষ্টার প্রথমে মথুরাপুর ও বোর্ণীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে বোর্ণী স্কুলে অফিসের কাজ করেন। যোসেফ মাষ্টার ১৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দের ৫ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
অনীল তার্সিসিউস পালমা যিনি অনীল স্যার নামে পরিচিত ছিলেন। অনীল স্যারের পিতা ছিলেন যোসেফ মাষ্টার। অনীল স্যার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ আগষ্ট। তিনি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারী এলিজাবেথ রোজারিওকে বিবাহ করেন। ১৯৭৬-৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনীল স্যার ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশের ঢাকুয়া ধর্মপল্লীর ভালকি গ্রামে ক্যাটিখিষ্ট ও স্কুল মাষ্টার হিসাবে কাজে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সিলেটের শ্রীমঙ্গলের হাজারীবাগে ১৯৭৮-৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্যাটিখিষ্ট ও স্কুল মাষ্টার হিসেবে কাজ করেন। সিলেট থেকে ফিরে এসে অনীল স্যার বোর্ণীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ বছর শিক্ষকতা এবং মাঝে ৬ মাসের জন্য প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুলাই মৃত্যুবরণ অনীল স্যার।
জন রিবেরু জন মাষ্টার নামেই বেশী পরিচিত ছিলেন। জন মাষ্টার পারবোর্ণী গ্রামের জোলারপাড়ে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বরশি দিয়ে মাছ ধরার নেশা ছিল। তিনি বোর্ণী গীর্জা প্রাঙ্গণের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ফাদার ক্যান্টন বোর্ণীতে থাকাকালীন সময়ে জন মাষ্টারকে ময়মনসিংহ ধর্মপ্রদেশে বাণী প্রচারের উদ্দেশে পাঠান। তিনি ময়মনসিংহে থাকাকালীন অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। সেখান থেকে ফিরে এসে রাজশাহী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মৃত্যুবরণ করেন।
পারবোর্ণী গ্রামের নিকোলাস কস্তার ছেলে যাকোব কস্তা (জাকি মাষ্টার)। যাকোব কস্তা (জাকি মাষ্টার) গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানার নাগরী ধর্মপল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। জাকি মাষ্টার কাটেখিষ্ট ও স্কুলের মাষ্টার হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি আনুমানিক ১৯৪৫-৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। ব্যক্তি হিসাবে জাকি মাষ্টার ছিলেন একজন অত্যন্ত ধার্মিক ও দানশীল। তিনি আনন্দপ্রিয় মানুষ হওয়ায় খুব সহজেই অন্যের মন আকর্ষণ করতে পারতেন। জাকি মাষ্টার গান-বাজনায় পারদর্শী ছিলেন বিধায় বোর্ণী ধর্মপল্লীতে তাঁর নেতৃত্বে প্রথম ব্যান্ডপার্টি দল তৈরী হয়। তাঁর একজন সন্তান সিস্টার লেটিসিয়া ব্রতীয় জীবনে আছেন। জাকি মাষ্টার ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
সমাজ ও মণ্ডলীতে অবদানকারী পল রোজারিও ১৯ এপ্রিল, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে গাজীপুরের কালিগঞ্জের নাগরীর তিরিয়া গ্রামে ভক্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পল রোজারিও’র ৪/৫ বছর বয়সে ১৯৩৮/৩৯ খ্রিস্টাব্দে পিতা জোয়া পরিবার পরিজন নিয়ে ভাগ্যান্নেষণে বোর্ণী ধর্মপল্লীর কাশিপুর গ্রামে এসে বসতি গড়ে তোলেন। পল রোজারিও’র মধ্যে পড়াশুনা ও জ্ঞান আরোহনের প্রতি ছিলো প্রচণ্ড আগ্রহ। পল রোজারিও ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে নাগরী ধর্মপল্লীর সাধু নিকোলাসের উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন। মেট্রিক পাশ করার পর পল রোজারিও’র জীবনে ত্রাতা হিসাবে আসেন বোর্ণী ধর্মপল্লীর কারিগর স্বর্গীয় ফাদার আঞ্জেলো কান্তন। ফাদারের অনুপ্রেরণা ও বড়বোন রেজিনার সহায়তায় নটর ডেম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে বিএ পড়াশুনা সম্পন্ন করে মনিকা রড্রিক্সকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। সম্ভবত বিয়ের পর পরই ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। তিনিই বড়াইগ্রাম থানার প্রথম মাষ্টার ডিগ্রী অর্জনকারী। পল রোজারিও ১৯৬০/৬১ খ্রিস্টাব্দের দিকে ফাদার কান্তনের আহ্বানে বোর্ণীতে ফিরে এসে মিশন প্রাঙ্গণের স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। পল রোজারিওসহ বার্নার্ড বিশ^াস ও সুশীল গমেজ স্যার তৎকালীন মিশন প্রাঙ্গণে অবস্থিত টিচার্স কোয়াটারে থাকতেন। বোর্ণী মায়ের এ ত্রিরত্নসহ আরো অনেককে সঙ্গে নিয়ে এ সময় ফাদার কান্তন তিলে তিলে বোর্ণী ক্রেডিট ইউনিয়ন গঠনে জোর দেন। বোর্ণী মায়ের এ অক্লান্ত পরিশ্রমী যোগ্য নেতাদের হাত ধরেই আজকের এই ক্রেডিট দাঁড়িয়ে আছে। পল রোজারিও মাষ্টার বোর্ণী ক্রেডিট ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজার হিসাবে কাজ করেন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব, সৎ পরামর্শ ও শ্রম বোর্ণীবাসীর অবশ্যই স্মরণ করা দরকার। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকার পর ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে পল রোজারিও’কে সামাজিক নেতৃত্বের উপর ডিপ্লোমা কোর্সের জন্য সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ার বিশ^বিদ্যালয়, কানাডাতে পাঠানো হয়। যুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে দেশে ফিরে এলে তিনি কোর (বর্তমান কারিতাস) সংস্থার পক্ষে ফাদার কান্তনের সাথে দরিদ্রদের মাঝে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে পল রোজারিও দিনাজপুর এবং রাজশাহী কারিতাসে কাজ করেন এবং ১ নভেম্বর ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কারিতাসের আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯ মে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পল রোজারিওকে বাগানপাড়া ধর্মপল্লীর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

টোনাপাড়া গ্রামের আগষ্টিন কস্তার (ছডি মাষ্টার) জন্ম ভাদুন ধর্মপল্লীর (বর্তমান) গোয়ালগাঁও গ্রামে। যাজক হওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বান্দুরা ক্ষুদ্র পুষ্প সেমিনারীতে প্রবেশ করেছিলেন। সেমিনারী থেকে বের হয়ে তিনি হারবাইদ স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ছডি মাষ্টারের স্ত্রীর নাম জোয়ান্না কস্তা। বোর্ণী ধর্মপল্লীতে বসতি স্থাপন করার পর বোর্ণী গীর্জা প্রাঙ্গণের স্কুলে ইংরেজী শিক্ষকতা করতেন। তিনি সব সময় সাদা পাঞ্জাবী পড়ে থাকতেন বলে জানা যায়। শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পর বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়াতেন। ছডি মাষ্টার প্যারিশ কাউন্সিল ও প্রাইমারী স্কুলের ম্যানিজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ৮৬ বছর বয়সে অসুস্থ্য অবস্থায় তিনি রাজশাহী মেডিকেলে মৃত্যুবরণ করেন।
আলফ্রেড, আমব্রুজ ও আগষ্টিন পালমা; তিন ভাই শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। আলফ্রেড পালমা সিলেটের শ্রীমঙ্গলে দীর্ঘদিন যাবৎ ক্যাটিখিষ্ট মাষ্টার ও স্কুল পরিচালনার কাজ করেছেন। ছিটকীগাড়ি গ্রামে তাঁর নিবাস। ব্যক্তি হিসাবে তিনি নিয়ম-কানুনের প্রতি বেশ কঠোর ও সচেতন ছিলেন। আলফ্রেড পালমা গান-বাজনা ও যাত্রায় ছিলেন পারদর্শী। গ্রামে তিনি কষ্টের গান ও কীর্তন শিখাতেন। আমব্রুজ পালমা দিনাজপুর সাধু ফিলিপের উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ব্যক্তি হিসাবে আমব্রুজ পালমা ছিলেন একজন নম্র-ভদ্র। ফুটবল খেলা, গান-বাজনা এবং যাত্রায় তাঁর ঝোঁক ছিলো। তাঁর স্ত্রী যোয়েল একই সাথে দিনাজপুরে সাধু ফিলিপের উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ঢাকায় ওপেন হার্ট সার্জারী চিকিৎসাকালীন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আগষ্টিন পালমা শিক্ষক এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সাধু লুইসের উচ্চ বিদ্যালয়ে বিএসসি শিক্ষক ছিলেন। যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা করেন। গান-বাজনা এবং অভিনয়ে পারদর্শী হওয়ায় তিনি সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু পরিবার রাজি না হওয়ায় সেদিকে আর অগ্রসর হননি। যাত্রায় তিনি মীরজাফরের চরিত্রে অভিনয় করতেন। পরবর্তীতে ঢাকায় শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলেন এবং কারিতাস ঢাকা অঞ্চলে কাজ করেন। লিভারের সমস্যাজনিত কারণে আগষ্টিন পালমা ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
আলফ্রেড রোজারিও আলফু স্যার নামে জনপ্রিয় ছিলেন। আলফু স্যারের জন্ম ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই মার্গারেট রোজারিওকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। বিবাহের ২ বছর পরেই ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাধ্বী মেরীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেন। আলফু স্যার অধিকাংশ ক্লাসে গণিত পড়াতেন। তিনি দীর্ঘ সময় প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। স্যারের এক সন্তান সিস্টার এলিসা রুবি, এসসি ব্রতীয় জীবনে রয়েছেন। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন অবস্থায় তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। অসুস্থ্য অবস্থায় বিছানায় ৩ মাস থাকার পর ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
আন্তনী ক্রুশ স্যার বোর্ণী ধর্মপল্লীর বহু বিজ্ঞজনের শিক্ষক, গুরুজন। আন্তনী ক্রুশের জন্ম ১৯ এপ্রিল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে। বাবা শিমন জন ক্রুশ আর মা তেরেজা রোজারিও। বর্তমানে যেখানে জোনাইলের ইউনিয়ন কাউন্সিল, তার সামনে আট চালা স্কুল ঘর ছিলো। আন্তনী ক্রুশ ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে পড়াশুনা করেছেন। কিন্তু এক ছাত্রকে শিক্ষক কৃর্তক শারীরিক শাস্তি দেওয়ার কারণে সেখানকার স্কুল ভেঙ্গে ফেলা হয়। এরপর আন্তনী ক্রুশ হরিপুর দূর্গাদাস স্কুলে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। সেই সময় তাঁর সাথে ত্রি-মোহনী গ্রামের দেবেন সরকার, যাকোব রোজারিও (পান্তিগো বাড়ি) পড়াশুনা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু অন্যের জীবনকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য কাজ করেছেন। বর্তমান বোর্ণী মিশন হলরুমের পূর্ব পাশে পূর্ব-পশ্চিমে ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল ছিলো। আন্তনী ক্রুশ সেই স্কুলে একা শিক্ষকতা করেন। তিনি মিশনে শিক্ষকতাকালীন সময়ে ঝড়ে স্কুল ভেঙ্গে গেলে নিজ বাড়ি দিঘইরে স্কুল খুলেন ও প্রায় আড়াই মাস সেখানে শিক্ষা প্রদান করেন। এরপর ফাদার ভিগানো আসার পর মিশন পুকুরের পশ্চিমে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল খোলা হলে জন মাষ্টার, এডবিন মাষ্টার ও যোসেফ মাষ্টার শিক্ষকতা শুরু করেন। এরইমধ্যে তিনি ২১ বছর বয়সে বাগবাচ্চা গ্রামের মোংলা গমেজের মেয়ে এলিজাবেথ গমেজকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। ফাদার ভিগানোর সময়েই তিনি ময়মনসিংহে সরকারী স্কুলে শিক্ষকতার উদ্দেশ্যে চলে যান। সেখানে ৪ বছর শিক্ষকতা করার পর বোর্ণীতে চলে আসেন এবং ফাদার ক্যান্টনকে পাল-পুরোহিত হিসাবে পান। পরবর্তীতে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় স্ব-পরিবারে সিলেটে চা বাগানে চলে যান। তাঁর রক্তে মিশে ছিলো শিক্ষকতার আনন্দ। আর সে আনন্দ তিনি সিলেটেও ছাড়তে পারেননি। তাই মানুষ গড়ার কারিগর আন্তনী ক্রুশ সেখানেও বাঙ্গালী খ্রীষ্টান ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ৩ বছর শিক্ষকতা করেন। কিন্তু তাঁর পিতা শিমন জন ক্রুশের অনুরোধে আবার বোর্ণীতে ফিরে আসেন। আন্তনী ক্রুশ প্রায় ১৯ বছর শিক্ষকতা করার পর অব্যাহতি নেন এবং বাড়িতে আবাদি জমি চাষ করতে শুরু করেন।
আন্তনী ক্রুশের এই শিক্ষকতা জীবনে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে তিনি শিক্ষার আলো দিয়েছেন যারা আজ প্রতিষ্ঠিত ও অনেকে স্বর্গবাসী হয়েছেন। বিশেষ করে অপু দেশাই স্যার, পিটার আলমিদা, মার্গেট রোজারিও, আব্রাহাম গমেজ, হেলেনা রোজারিও, সাবিনা দিদিমনী, মনো স্যার, ইলা রোজারিও, যাকোব কস্তা, পল রোজারিও (পলু), চার্লি গমেজ, লালু রোজারিও, ফা: ইম্মানুয়েল প্রফুল গমেজ, ফা: লিও দেশাই, ফা: প্যাট্রিক গমেজ, ফা: সুনীল ডানিয়েল রোজারিও, ফা: পল রোজারিও (জয়গুরু), ফা: মাইকেল ক্রুশ আন্তনী ক্রুশের কাছে শিক্ষার আলো লাভ করেছেন। আন্তনী ক্রুশ স্যার জীবিত থাকাকালীন তাঁর সাথে কথার ফাঁকে তিনি নিজেকে একজন সার্থক ব্যক্তি বলেই মনে করেন বলছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন যে, এখনো যখন অনেকে তাঁকে স্যার বলে সন্মোধন করেন তখন তাঁর গর্বে বুকটা ভরে উঠে। তিনি সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করতেন কারো বিষয়ে সমালোচনা করা। যদি কেউ তাঁর কাছে কারো বিষয়ে কখনো সমালোচনা করে তিনি শুধু শুনেন। তিনি সবাইকে দিতে দিতে নিঃস্ব হয়েছেন কিন্তু বিনিময়ে কারো কাছে কিছুই প্রত্যাশা করেননি। তিনি বলতেন, ‘জীবনে আমার চাওয়া পাওয়া নেই। আমি আমার জন্য সুখী’। শিক্ষার বাতিঘর আন্তনী ক্রুশ ২২ নভেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
বোর্ণীর উচ্চ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও অনেকে অন্য স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক-শিক্ষিকা হিসাবে শিক্ষকতা করেছেন। তাদের নাম আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। চামটা গ্রামের আন্তনী মাষ্টার এবং আদগ্রামের শিমন রোজারিও ও চেরকু লরেন্স কস্তা আদগ্রাম সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়াও ছিটকীগাড়ী গ্রামের রাফায়েল কস্তা যিনি জি.টি. (গুরু ট্রেনিং) ছিলেন। তিনি হাইস্কুলে অফিসের কাজের সাথেও জড়িত ছিলেন। পারবোর্ণী গ্রামের হিলারী রোজারিও বোর্ণী বোর্ডিং-এ ছাত্রদের দেখাশুনা করতেন এবং সেই সাথে হাইস্কুলে কয়েক মাস শিক্ষকতা করেন। বোর্ণী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সামুয়েল রায়ের সন্তান লিন্টু জেমস রায় বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পূর্বে প্রাইমারীতে শিক্ষকতা করতেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় চাকুরী করেন। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে লিন্টু জেমস রায় মৃত্যুবরণ করেন। পারবোর্ণী গ্রামের আন্তনী গমেজ আন্তু ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৩/৪ বছর শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কারিতাসে চাকুরী করতেন। আন্তনী গমেজ আন্তু ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। বোর্ণী গ্রামের সিস্টার ফিলোমিনা (ফাদার সুব্রত কস্তার পিসিমা) বোর্ণীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর সিস্টার সম্প্রদায়ে প্রবেশ করেন। বোর্ণীর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামুয়েল রায়ের স্ত্রী বিদ্যুৎলতা বিয়েট্রিস অল্প সময়ের জন্য স্কুলে শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়।
যুগে যুগে অমর আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ। ফাদার ক্যান্টনের সময়ে বা তারও পূর্ববর্তী সময়ে শতসহস্র কষ্টের সময়েও যারা শিক্ষার আলোক মশাল বহন করেছিলেন তাঁদের প্রতি নমস্কার। তাঁরা শুধু শিক্ষার আলো বিতরণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তা নয় বরং ধর্মপল্লী ও সমাজের উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। আজকে যারা আমাদের এই দু’টি শিক্ষাঘরে বা অন্যান্য স্থানে শিক্ষার বীজ অঙ্কুরিত করছেন তাঁরাও একদিন ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হবেন। কিন্তু শিক্ষার যে সত্য, যুক্তি-খণ্ডন, ভালবাসা, মানবিকতা, গঠন, নির্যাস, তেজ, সৌন্দর্য, ভালোত্ব, আহ্বান, সাধনা, আলোক প্রজ্জ্বলন শিক্ষার্থীদের মাঝে আজ গ্রথিত ও প্রোথিত করছেন তা টিকে থাকবে ও তারা আপনাদের স্মরণীয় করবে। আমার এই লেখায় অনেক বরণীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর নাম এসেছে। অনেকের সমন্ধে বিস্তারিত লেখা সম্ভব হয়েছে। আবার অনেকের বিষয়ে জানা না থাকায় সম্ভব হয়নি। মৃত আরো অনেকেই হয়তো বোর্ণী মায়ের কোলে শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন কিন্তু তাঁদের নাম জানা না থাকায় বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য এখানে উল্লেখ্য করা গেল না বলে দুঃখিত। তবে এটা সত্য যে, নমস্য এই আলোকবর্তিকাদের শিক্ষার আলো কখনো নিভবে না। নমস্য হে অগ্রপথিক-আলোকদিশারী।

Please follow and like us: