ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।

রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিসে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের পালকীয় কর্মশালার মূলসুর ছিলো, “আমরা হলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক”। এই কর্মশালার মধ্যদিয়ে আমরা পরিবার, সমাজ ও মণ্ডলিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক (Stewardship) হওয়ার ক্ষেত্রে যিশু ও মণ্ডলির শিক্ষায় আলোকিত হয়েছি। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের করণীয়: দায়িত্বশীল আচরণ, দায়বদ্ধতা, ঐশ অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা, সৃষ্টির যত্ন ও পরিবেশ রক্ষা, ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেছি। সেবার ঐশ্বতাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক তাৎপর্য উপলব্ধি করে দায়িত্বশীল সেবক হিসেবে সময় (Time), সামর্থ্য (Talent) ও সম্পদ (Treasure) এর যথাযথ ব্যবহারে আমাদের বুদ্ধিমত্তা (Intelligence), সেবাকাজ ও প্রেম-ভালোবাসাকে (Heart) সম্পৃক্ত ও একাত্ম করার মাধ্যমে সেবাকাজে সফলতা আনয়ন সম্পর্কে সচেতন হয়েছি। কর্মশালার দলীয় আলোচনার প্রতিবেদন উপস্থাপনার ভিত্তিতে মোট সাতটি দর্শন (Vision), প্রেরণ (Mission) এবং অগ্রাধিকারসমূহ (Priorities) নির্ধারণ করা হয়েছে, যার দ্বিতীয়টি হলো ঃ- ধর্ম-কর্মে, সম্পর্কে, কথায় ও কাজে, জীবনসাক্ষ্যদানে দায়িত্বশীল ও বিশ্বস্ত থাকা।

ধর্ম-কর্ম করা কোনো খন্ডকালীন দায়িত্ব বা বিষয় নয়। ধর্মের একটা মাত্র অনুশাসন ধ’রে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকার বিষয়ও ধর্ম নয়। রবিবারদিন নিয়মিত গির্জায় যোগদান করলেই ধর্ম পালনের দায়িত্ব শেষ হলো- তা-ও কিন্তু নয়। মানুষের জীবনের স্তরে স্তরে ঈশ্বর ভক্তি ও মানব কল্যাণ বিদ্যমান থাকার নামই ধর্ম। ধর্মে-কর্মে, কর্মে-ধর্মে একজন ভক্তকে অনবরত প্রমাণ করতে হয় সে খ্রিস্টের শিষ্য। জীবনে প্রতিকূল বা অনুকূল- প্রতিটি অবস্থায় খ্রিস্টের সাক্ষ্যদান একজন প্রকৃত ভক্তের জীবন। কিন্তু যদি সে যা বলে ও করে- তার মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকে, তাহলে সেটা কেমন সাক্ষ্যদান হলো? এটা তো তাহলে ফরিসিদের মতোই হয়ে গেলো। যিশু বলেছেন, “কিন্তু তারা নিজেরা যা করেন, তোমরা তা করতে যেয়ো না, কারণ তারা বলেন একরকম, করেন আর একরকম। … তারা যা কিছু করেন, সমস্তই লোক দেখানো (মথি ২৩:৩-৫)।” ধর্মের নামে ভন্ডামী আগেও ছিলো, এখনোও আছে। তারা কথায় পটু, মানুষের মন গলাতে পারে। আসলে কিন্তু কথায় ও কাজে মিল নেই। একজন প্রকৃত ভক্তই মাত্র তার কথা ও কাজের মধ্যদিয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেন।

ঈশ্বর প্রতিটি মানুষকে যথেষ্ট মাপে সামর্থ-দান দিয়েছেন। ঈশ্বর বিভিন্ন প্রকারের সামর্থ-দান দিয়েছেন যেনো মানুষের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ খ্রিস্টের সাক্ষ্যদান দিতে পারে। মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, সুন্দর সম্পর্ক, আদান প্রদানের মধ্যদিয়ে সামাজিক জীবন উত্তরণ/উন্নত করার জন্য ঈশ্বরের এই দান। “ঐশ আত্মাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা প্রত্যেককে দেওয়া হয় সকলেরই মঙ্গলের জন্য। একজনকে পবিত্র আত্মা দান করেন প্রজ্ঞার ভাষা, আর একজনকে সেই পবিত্র আত্মাই দান করেন ধর্মজ্ঞানের ভাষা। অন্য একজনকে সেই আত্মাই আবার দান করেন পরম বিশ্বাস। কাউকে আবার সেই একই আত্মা দান করেন রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা, অন্য কাউকে নানা অলৌকিক কাজ করার ক্ষমতা, অন্য কাউকে প্রাবক্তিক বাণী ঘোষণা করার ক্ষমতা, অন্য কাউকে নানা আত্মিক শক্তির সরূপ বিচার করার ক্ষমতা, অন্য কাউকে নানা অজ্ঞাত ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা, অন্য কাউকে আবার সেই সব ভাষা বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা (১করি ১২:৭-১০) ।”

সাক্ষ্যদানের জন্য যে যেটুক বহন করতে পারে, ঈশ্বর তাকে সেটুকু দিয়েছেন। আর সেটুকুই তার জন্য ষোল আনা, পূর্ণ মাপে দেওয়া। মালিক, “প্রত্যেকের কর্মক্ষমতা বিবেচনা করে সে তাদের একজনকে দিল পাঁচশো মোহর, একজনকে দু’শো মোহর এবং একজনকে একশো মোহর (মথি ২৫:১৫)।” এই কাহিনীতে প্রথম দুইজন ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তারের কাজে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী প্রমাণ রেখেছেন। ঈশ্বরের রাজ্যে তাদের সাক্ষ্যদান রেখেছেন। কিন্তু সামর্থ-অনুসারে যে একশো মোহর পেয়েছিলো, সে কাদের প্রতিনিধিত্ব করে? কেউ কেউ আবার নিজের দায়িত্ েঅবহেলার কারণে ঈশ্বরের রাজ্যে কোনো অবদান রাখতে পারে না। বাইবেলের এই কাহিনী কী আমাদের জীবনের সাথে মিল রয়েছে? অবশ্য মিলে যায়। বাইবেলের মতে, মালিক তাঁর তিন কর্মচারীকেই দায়িত্বশীল মনে করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে কেউ কেউ দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও কার্যত: আহ্বানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেই যে দায়িত্ববান হবে, তাও কিন্তু নয়। ভাবতে হবে- আমি কীভাবে আমার দায়িত্ব পালন করছি। যে মনিবের কাছ থেকে একশো মোহর- আমি কী তার মতো ?

ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক রচনা করতে হলে আগে মানুষের সাথে রচনা করতে হবে। ঈশ্বর তো এমন নয় যে তাঁর প্রয়োজন আছে, তাঁকে চেয়ে নিতে হবে। ঈশ্বরকে লাভ করার পালকীয় ভুমি হলো মানুষ। মানুষের সাথে মানুষের গড়তে হয় আত্মার সম্পর্ক। দেখতে হয় মানুষকে হৃদয় দিয়ে, হেেত হয় দরদী। যুক্ততর্ক, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি দিয়ে মানুষকে একটা সময়ের জন্য বশ করা যায়, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করা যায় না- সম্পর্ক বানানো যায় না। ক্যাথলিক শিক্ষা মতে আমাদের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে হয়। যিশু বলেছেন, “তোমরা যদি শুধু নিজেদের ভাইদের সঙ্গেই কুশল আলাপ করো, তবে কীই বা এমন কিছু করলে? বিধর্মীরা কী ঠিক তাই করে না (মথি ৫:৪৭)?” আমাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্বে আমরা লবনের মতো। পচনশীল সমাজ, জাতিকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা আবার আলোর মতো…। আমাদের জীবন দেখে মানুষ যেনো আকৃষ্ট হয়। সাধু পৌল বলেন, “স্বয়ং খ্রিস্টই তো আমাদের মধ্যে শান্তির বন্ধন, ইহুদী অনিহুদী এই দুইকে তিনিই তো এক করে তুলেছেন। যে শত্রুতার প্রাচীর তাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলো, তিনি আপন দেহ উৎসর্গ করেই তা ভেঙ্গে দিয়েছেন। … তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো এ-ই; ইহুদী অনিহুদী এই দুইকে নিয়ে তিনি এক ও অভিন্ন একটি মানবজাতিকে গড়ে তুলবেন নিজেরই আশ্রয়ে, আর এই ভাবেই তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন (এফেসীয় ২:১৪-১৫)।” ঈশ্বরকর্তৃক আমরা প্রত্যেকে আহুত হয়েছি- যেনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ- নির্বিশেষে, মানব জাতির মধ্যে যে অবিশ্বাস, অন্যায়, অনৈক্য ও অনাস্থা রয়েছে- তা দূর করে একজন বিশ্বস্ত ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে ওঠতে। একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবকের মিশন হলো- মানব জাতীর জন্য একটা ভ্রাতৃসমাজ বিশ্ব গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করা। ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেককে এই কাজ করার শক্তি দান করুন। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: