পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস গত ৪ অক্টোবর তার সর্বশেষ সার্বজনীন পত্র “ফ্রাতেল্লী তুত্তি” (ভাইবোন সকল) প্রকাশ করেছেন। এই পত্রে তিনি বিশ্বের সকল জাতির, সকল ধর্মের ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মিলনের ডাক দিয়েছেন। “ফ্রাতেল্লী তুত্তি” পাঠ করলে বুঝা যায় পৃথিবীতে কেন এত অন্যায়, বৈষম্য, শোষণ ও সামাজিক বিভেদ। পোপ ফ্রান্সিস ঠিকই লিখেছেন যে এই সব অন্যায় অবিচার আর বৈষম্য শোষণ ধর্মবিশ্বাস ও ভালবাসা দিয়েই দূর করা সম্ভব। আমি এখানে এই সার্বজনীন পত্রের সারমর্ম করছি না; বরং এর মধ্য দিয়ে পোপ ফ্রান্সিস যে সাহস করে ক্ষমতাবানদের কাছে যে সত্য তুলে ধরেছেন তা প্রশংসা করছি। এই সার্বজনীন পত্রে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে তা তুলে ধরছি।
এই সার্বজনীন পত্রে প্রথম যে চ্যালেঞ্জটি এই সার্বজনীন পত্রে তুলে ধরা হয়েছে তা হ’ল “দরিদ্র মানুষ” এবং তাদের প্রতি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব। দরিদ্রদের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজ যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব পোষণ করে এবং রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যে বৈষম্য ও শোষণ রয়েছে তা দূর করা জরুরী। এই সার্বজনীন পত্রে তুলে ধরা হয়েছে এই ভগ্ন পৃথিবীটা দুর্দশার কথা। পৃথিবীর এই ভগ্ন দশার বেশ কিছু কারণ রয়েছে: এর মধ্যে রয়েছে স্বার্থপর মনোবৃত্তির বিশ্বায়ন, বস্তুগত চাকচিক্য ও ভোগবাদের বিশ্বায়ন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, ইত্যাদি। এইভাবে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিটিই ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর পরিস্থিতি যখন সবার জন্যই ভগ্ন দশার অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তখন দরিদ্রদের দুঃখ-কষ্টই বেড়েছে সবচেয়ে বেশী। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে, ক্ষমতাবানরা হচ্ছে আরও ক্ষমতাবান, এবং দরিদ্ররা হচ্ছে আরও দরিদ্র আর তাদের যে সামান্য ক্ষমতাটুকু ছিল তা-ও তারা হারিয়ে ফেলছে। অর্থ-সম্পদ ও ক্ষমতার ব্যাপারে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য রয়েছে এবং দরিদ্রদের দুর্দশাপূর্ণ অবস্থার ব্যাপারে এই বিশ্ব যেন দিনে দিনে আরও বেশী উদাসীন হয়ে পড়ছে। সকলেই সামাজিক ধনী-গরীবের মধ্যে এই অসাম্য ও বৈষম্য গ্রহন করছে স্বাভাবিক বলেই – এমন কি ঈশ্বর ও ধর্মের নাম ব্যবহার করেও ধনী – দরিদ্রের এই অন্যায্য পার্থক্যকে জায়েজ বা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ঈশ্বর কিন্তু এই বৈষম্য সৃষ্টি করেন নি, কিন্তু তাঁর নামেই এই বৈষম্য জিয়িয়ে রাখা হচ্ছে। এখন দরিদ্ররা যেন নিষ্পত্তিযোগ্য বা ফেলে দেওয়ার মত বস্তুতে পরিণত হয়েছে: “মানব জাতির কোন একটি অংশের কারণে বা তাদের স্বার্থে অন্য একটি অংশকে খুব সহজেই বলিদান করা হচ্ছে। পৃথিবীর সম্পদ বেড়েছে ঠিকই, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষে মানুষে অসাম্য ও বৈষম্য।” অসাম্যে কথা বলতে গিয়ে এই সার্বজনীন পত্র অন্তত দুইবার উল্লেখ করেছে যে বিশ্বব্যাপী নারীদের ক্ষেত্রে এই কথাটি দ্রুব সত্য। শুধু মাত্র নারী হওয়ার কারণে যে কেউ কম অধিকার ভোগ করবেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
মঙ্গল সমাচারের দয়ালু সামারীয়ের উপমা কাহিনীটিকেই এই সার্বজনীন পত্রের রূপক ভিত্তি করা হয়েছে। এই গল্পে বর্ণিত যাজক ও মন্দিরের সেবক যারা ডাকাতদের হাতে পড়া লোকটাকে সাহায্য না করে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল, তারা যেন আজ এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে আমরাই; কারণ আমরা ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে দরিদ্র, আঘাতপ্রাপ্ত, রক্তাক্ত এবং অসহায় অভাবীদের পাশ কাটিয়ে যাই। আমাদের উদাসীনতা ও ধর্মীয় ব্যর্থতা হল সেই মন্দিরের পুরোহিত ও সেবকেরই মত যাদের ব্যক্তিগত নৈতিক অন্ধত্বের মনোভাব বা দৃষ্টিভঙ্গী সমাজের সেই নীতি ও ধর্মীয় গোড়ামীর মধ্যেই স্থিতমূল হয়েছে যা এই অন্ধত্বের জন্ম দেয়।
এই অন্ধত্বের কারণেই আজ মানুষের যে মৌলিক মর্যাদা তা আজ ভূলুন্ঠিত হয়েছে। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর পত্রে মানুষের মর্যাদা, সকল মানুষের মর্যাদা, সকল কিছুর কেন্দ্রে পুণঃস্থাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন। মানুষ, সে গরীব বা ধনী হোক, সকলের মর্যাদাই ঈশ্বর প্রদত্ত ও পবিত্র; আর তা সকলেরই সমান। কেউ তা ক্ষুন্ন করতে পারে না, কোন যুক্তিতেই মানুষের মর্যাদা অবনমিত করে তথাকথিত উন্নয়ন সাধন করা যাবে না। সকল প্রকার বস্তুগত ও পার্থিব উন্নয়নের আগে উন্নয়ন হতে হবে মানুষের – সকল উন্নয়ন ও অগ্রগতির কেন্দ্র ও লক্ষ্য হল মানুষ।
“ফ্রাতেল্লী তুত্তি” সার্বজনীন পত্র আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছে যে এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের অতিমাত্রায় জাতীয়তাবাদী ও গোষ্ঠীগত মনোভাব প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ এই এরূপ মনোভাব নিজেদের স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছু সহ্য করে না আর নিজেদের বাইরের সব কিছুকেই অমঙ্গলজনক মনে করে। বলা হয়ে থাকে যে তিক্ততা, ঘৃণা, ও শত্রুতার সময় আমাদের কোমল ও দয়ালু হতে হবে; সব সময় ভালবাসা থেকেই কথা বলতে হবে, ঘৃণা থেকে নয়: “দয়া চর্চা করতে হয়; এটা কায়েমী স্বার্থবাদী কোন ভাসা ভাসা গুণ নয়”। এই পত্রে পোপ ফ্রান্সিস স্বীকার করেছেন যে বর্তমানে এটা এমন একটা “বিপরিত-সংস্কৃতি” হয়ে উঠেছে, যে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। আমাদের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, আরাম আয়েশ, সামাজিক মুক্তি ও মর্যাদা, কিছুই আমরা সহজে ত্যাগ করতে পারব না। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস আমাদের তা-ই করতে আহ্বান করেছেন: “আমি সেই মানব সংহতির কথা উল্লেখ করতে চাই, যা নাকি একটি নৈতিক গুণ আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি যা আসে ব্যক্তিগত মন পরিবর্তন থেকে”। এই পত্রে পোপ ফ্রান্সিস আমাদের মন পবির্তনের আহ্বান জানিয়েছেন, বিশেষভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে, অভিবাসী ও মানব পাচারের শিকার অসহায় মানুষদের ক্ষেত্রে, শিশুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে, প্রবীনদের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে, সমাজের প্রান্ত সীমায় পড়ে আছে যে সকল অসহায় দরিদ্র মানুষ তাদের সমাজে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে, ইত্যাদি।
এই পত্রে পোপ ফ্রান্সিস একটি সুদূর-প্রসারী চ্যালেঞ্জের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন – বিচারে মৃত্যুদন্ড ও যুদ্ধ। তিনি আমাদের কাথলিক মণ্ডলির ধর্মশিক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন – মানুষ কোন কারণেই অন্য মানুষের জীবন নিতে পারে না। সহিংসতা ও যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশে হাজার হাজর মানুষ মৃত্যুবরণ করছে আর বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশান্তরী হচ্ছে। খ্রিস্টান হিসাবে মানব জীবনের এই অমর্যাদা ও জীবন বিনাশী দুষ্ট পন্থা আমাদের প্রতিহত করতে হবে। মানব জীবনের আরও একটি হুমকি হল গর্ভপাত বা ভ্রুন হত্যা। স্বার্থপর ও ভোগবাদী মনোবৃত্তি ও আচরণের কারণে মানুষ আজ এই জীবন বিরুদ্ধ কাজ করে যাচ্ছে।
কাথলিক মণ্ডলি যে কোন ধরণের জীবন বিরুদ্ধ মনোভাব ও কাজ বা মানব জীবনের মর্যাদা হানি হয় এমন কাজের বিরোধিতা করে। তাই কাথলিক মণ্ডলির ধর্মবিশ্বাস ও যীশুর শিক্ষার আলোকে পোপ ফ্রান্সিস জোর দিয়ে বলেছেন কাথলিকদের উচিত বিশ্বব্যাপী জীবন বিরুদ্ধ বা জীবন ধ্বংশকারী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। নৈতিকভাবে দেখতে গেলে বিচারে মৃত্যুদন্ডের কোন প্রয়োজন নেই, আর এতে কোন ন্যায্যতাও প্রতিষ্ঠিত হয় না। সাধু পোপ জনপলের মতে মৃত্যুদন্ড ছাড়াও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব; আর যাবজ্জীবন কারাদন্ড তার একটি বিকল্প হতে পারে। তবে যদি প্রশাসন বা অন্য কারও দুর্নীতির কারণে তা সম্ভব না, তাহলে তার দায় অভিযুক্ত বা দোষী ব্যক্তির উপর চাপানো উচিত নয়। যুদ্ধ বিগ্রহ ও সন্ত্রাস সব সময়ই খারাপ। যুদ্ধ ও সহিংসতা কোন সমস্যার সমাধান দিতে পারে না বরং তা বৃদ্ধি পায়। এর জন্য সংলাপ ও সমঝোতার চেয়ে ভাল কোন উপায় আর নেই। যুদ্ধের দ্বারা লাভের চেয়ে ক্ষতিই হয় বেশী। আগে যে “ন্যায় যুদ্ধের” কথা বলা হত তা কাথলিক শিক্ষায় আর ধোপে টিকে না।
“ফ্রাতেল্লী তুত্তি” নামক এই দলিলটি শুধু মাত্র কাথলিকদের জন্যই নয়, বরং এই দলিল পৃথিবীর সকল জাতির সকল, সকল ধর্মের মানুষের কাছেই প্রাবক্তিক আবেদন রেখেছে। বিশেষ করে পোপ ফ্রান্সিসের গত বছর আরব এমিরাত ভ্রমনের সময় কায়রোর আল আয্হার মসজিদের গ্রান্ড মুফতির সঙ্গে সম্পাদিত বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের যে দলিল প্রকাশ করেছিলেন, তাতেই পোপের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছাসম্পন্ন আবেদন সবার কাছে প্রকাশিত হয়েছে। এই মূল্যবান দলিলের দ্বারা পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের সকল মানুষের মধ্যে ভালবাসা ও ন্যায্যতাপূর্ণ ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু মানুষের মধ্যেই নয়, ঈশ্বরের সকল সৃষ্টির সঙ্গে, বিশেষভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গেও এই ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী
ফ্রাতেল্লী তুত্তি (ভাইবোন সকল)
Please follow and like us: