ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
স্নেহের ভাই ও বোনেরা,
বিশ্ব ক্যাথলিক চাচর্, গত অক্টোবর মাস যে বিশেষ ‘প্রেরণ মাস’ হিসেবে পালন করেছে তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি নিশ্চিত যে, এর ফলে অনেক সমাজের মধ্যে প্রেরণধর্মী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, যার মূল বিষয় ছিলো- “দীক্ষা এবং প্রেরণ: খ্রিস্টমন্ডলি বিশ্বে প্রেরিত।”
এই বছর কোভিড- ১৯ মহামারির কারণে যে দুর্ভোগ ও চ্যালেঞ্চ তৈরি হয়েছে, তার একটি প্রেরণধর্মী আহ্বান দেখি- যা প্রবক্তা ইসাইয়ার কাছে প্রেরিত হয়েছিলো, “এই যে আমি, আমাকে প্রেরণ করো (৬:৮)।” এটা সব সময়ের জন্যই ঈশ্বরকর্তৃক আহ্বান, “আমি কাকে প্রেরণ করবো?” ঈশ্বরের এই সদয় আহ্বান, বর্তমান সংকট ও বাস্তবতায় চার্চ এবং গোটা বিশ্বের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্চ। “এটা হলো নৌকায় শিষ্যদের মতো, যারা হটাৎ ঝড়ের কারণে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন এবং অনুধাবন করেছিলেন যে, তারা সবাই একই নৌকায়। এই সময় সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় বিষয়টি ছিলো, সবাই এক কাতারে থাকা, যা একে অন্যের সান্তনা হতে পারে। শিষ্যেরা বলেছিলেন, ‘আমরা মরে যাচ্ছি’ যা আমাদের চিন্তা করতে সাহায্য করে যে, নিজেরা একা চিন্তা করতে পারি না, কিন্তু সবাই মিলে তা করতে পারি।
যন্ত্রনা এবং মৃত্যু হলো আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবন এবং একই সাথে স্মরণ করে দেয় মন্দতা থেকে মুক্তির ইচ্ছাও। বিশ্বে প্রেরিত হওয়ার আহ্বান হলো- ঈশ্বর এবং প্রতিবেশীকে ভালোবাসার আমন্ত্রণ, যেখানে আমাদের সুযোগ করে দেয়- সহভাগীতা, সেবা ও প্রার্থনা উৎসর্গ করার জন্য। ঈশ্বর যে আমাদের প্রত্যেকের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা আবার আমাদের ভয় থেকে এমন একটা অনুভূতিকে নিয়ে যায়- যেখান থেকে আমাদের আস্থাকে নবায়ন ক’রে, অন্যের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতে পারি।
ক্রুশে আত্মনিবেদন করে খ্রিস্ট যে নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছিলেন- আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ঈশ্বরের এই ভালোবাসার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের জন্যই। ঈশ্বর তাঁর সন্তানদের প্রত্যেককেই নিজের ইচ্ছায় প্রেরিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান, কারণ সে নিজেই ভালোবাসা এবং এমন ভালোবাসা যা সব সময় ‘প্রেরিত’, যেনো আমরা নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যকে লাভ করতে পারি। ঈশ্বর আমাদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কারণেই নিজ পুত্র খ্রিস্টকে পাঠিয়েছেন। খ্রিস্ট হলেন পিতার ‘প্রেরিতজন’ যিনি পিতার ইচ্ছার প্রতি তাঁর বাধ্যতা প্রকাশ করেছেন। খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন এবং পুনরুত্থিত হয়ে তাঁর ভালোবাসার প্রেরণ কর্মে আমাদের সম্পৃক্ত করেছেন এবং সাথে তাঁর পূন্য-আত্ম্ ‘মন্ডলিকে’ অনবরত প্রাণবন্ত করে রেখেছেন। খ্রিস্ট আমাদের তাঁর শিষ্য ক’রে প্রেরণ কর্ম পরিচালনা করার জন্য, বিশ্বে মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন।
যে প্রেরণকর্মের মধ্যদিয়ে মন্ডলি পরিচালিত হচ্ছে এটা আপন মনের নিছক কোনো উদ্যোগ আয়োজন নয়। এটা হলো খ্রিস্টর ইচ্ছা, যে ইচ্ছা দিয়ে তিনি মন্ডলিকে পরিচালিত করে থাকেন। বাণী প্রচারের কাজে আমাদের ‘প্রেরণকর্ম’ হলো পবিত্র আত্মা, যিনি এ কাজে আমাদের পরিচালিত করেন ও আমাদের বহন করেন।
ঈশ্বর সব কিছুর আগে আমাদের তাঁর ভালোবাসা দেখান এবং এই ভালোবাসা একটি আহ্বান হয়ে আমাদের কাছে আসে। খ্রিস্টমন্ডলিতে আমাদের ব্যক্তিগত আহ্বান হলো- আমরা সর্বপ্রথম ঈশ্বরের সন্তান, তাঁর পরিবার, ভাই-বোন- এটাই হলো প্রকৃত ভালোবাসা, যা খ্রিস্টা আমাদের দেখিয়েছেন। সেই সাথে মানুষের মর্যাদা হলো তাঁর অন্তর থেকে উৎসারিত সন্তান হওয়ার ঐশরিক আহ্বান- যা দীক্ষার মধ্যদিয়ে আমরা লাভ করেছি। আমাদের জীবন হলো ঈশ্বরের দান এবং এই দান একটি আহ্বান- যা দীক্ষার মধ্যদিয়ে জীবনের বিভিন্ন আহ্বানের মধ্যদিয়ে তাঁর রাজ্যে পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। ঈশ্বরের ভালোবাসার দানেই মানুষের জীবনলাভ, তাতে বেড়ে উঠা এবং পরিচালিত হওয়া। খ্রিস্ট যে, নিজের জীবন উৎসর্গ ক’রে পাপ ও মৃত্যুকে জয় করেছেন- এতে করে ঈশ্বরের ভালোবাসা থেকে কেউ বঞ্চিত নয়। পুনরুত্থান রহস্য এমন একটি ঐশরিক অনুগ্রহ- যা আমাদের এই বিশ্বের আহত মানবতাকে সুস্থ করে তোলে। মন্ডলি হলো, বিশ্বে ঈশ্বরের ভালোবাসার সর্বজনীন উপহার (সাক্রামেন্ত) যা খ্রিস্টের প্রেরণ কাজের ইতিহাসের মধ্যদিয়ে আমরাও মঙ্গলসমাচার প্রচার করে সর্বত্র এবং সব সময় মানুষের হৃদয়, মন, সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রকাশিত হতে পারি।
প্রেরণ কর্ম হলো ঈশ্বরের আহ্বানের প্রতি আমাদের একটি স্বাধীন প্রতি-উত্তর। এই স্বাধীন ইচ্ছা আমরা ব্যক্ত করতে পারি- মন্ডলিতে যে খ্রিস্ট বিদ্যমান, তাঁর সাথে ব্যক্তিগত ভালোবাসার বন্ধন গড়ে তুলে। আসুন আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করি, “আমরা কী আমাদের জীবনে পবিত্র আত্মার অবস্থানকে স্বাগত জানাই? আমরা বিবাহিত, নিবেদিত প্রাণ বা অভিষিক্ত ব্যক্তি হয়ে বা দৈনন্দিন কাজে এই আহ্বান কী শুনতে পাই?” আমরা বিশ্বের যেকোনো স্থানে দয়াময় ঈশ্বর পিতার প্রতি বিশ্বাস রেখে- মন্ডলি গড়ে তোলার জন্য খ্রিস্টের মুক্তিদায় বাণী প্রচার, পবিত্র আত্মার ঐশরিক জীবন সহভাগীতা করতে পারি? আমরা কী মাতা মারীয়ার মতো হতে পারি না, যিনি ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিবেদন করেছিলেন? এটা অসম্ভব কিছু নয়, একটাই হলো মন্ডলির ইতিহাস ও জীবন, “এই যে আমি প্রভু- আমাকে প্রেরণ করো।”
এই মহামারির সময় খ্রিস্টমন্ডলিকে নিয়ে ঈশ্বরের যে অভিপ্রায় তা-ও অনুধাবন করতে হবে। আমাদের চ্যালেঞ্চগুলো হলো- অসুস্থতা, কষ্টভোগ, ভয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। মৃত্যুর কারণে দরিদ্রতা বৃদ্ধি, নিস্ব হয়ে যাওয়া, আয়-উপার্জন ও চাকুরি হারাণো, গৃহহীন ও ক্ষুদা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্চ। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বাধ্যতা ও ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকা- আমাদের সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক পুন:আবিষ্কার করার আবেদন জাগিয়ে তুলতে পারে। এই অবস্থায় আমাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস ও ভিন্নতা, অন্যের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী করে তুলতে পারে। সেই সাথে প্রার্থনা- যার মধ্যদিয়ে ঈশ্বর আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেন- তার মধ্যদিয়ে ভাই বোনদের প্রতি মর্যাদা প্রদান এবং সৃষ্টির প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারি। সেই সাথে বাধ্যবাধকতার কারণে প্রতি রবিবার খ্রিস্টযাগ অপর্ণ করাও যে সম্ভব নয় এই অভিজ্ঞতাও আমাদের স্মরণ করে দেয়। এই প্ররিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বর জ্ঞিসের করতে পারেন, “আমি কাকে প্রেরণ করবো?” এবং অপেক্ষা করেন উত্তর শোনার জন্য, “এইতো আমি, আমাকে প্রেরণ করো।” ঈশ্বর অনবরত মানুষকে খুঁজছেন, পৃথিবীতে প্রেরণ করার জন্য- খ্রিস্ট যেমন ভালোবাসার স্বাক্ষ্য বহন ক’রে পাপ ও মৃত্যু থেকে উদ্ধার করেছেন, তেমনিভাবে আমাদের ডাকেন, মানুষকে উদ্ধার করার জন্য।
বিশ্ব প্রেরণ রবিবার একটি উপযুক্ত সময় যা স্মরণ ক’রে দেয়, প্রার্থনা, অনুধ্যান এবং বস্তু সামগ্রী দান করার মতো অনেক সুযোগ রয়েছে যার মধ্যদিয়ে খ্রিস্টমন্ডলিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারি। প্রেরণ রবিবারে দান সংগ্রহ ও দানের মধ্যদিয়ে একদিকে বিশ্ব বিশ্বাস বিস্তার সংস্থাকে সহায়তা দান করতে পারি- অন্যদিকে আত্মিক প্রেরণা ও অভাবী মানুষকে সহায়তা দিতে পারে। পূন্যময়ী কুমারী মারীয়া, তাঁর পুত্রের মধ্যদিয়ে আমাদের প্রার্থনা সকল পূরণ করুন।