ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
পোপ ফ্রান্সিস গত ৩ অক্টোবর, ইটালিতে অবস্থিত আসিসীর সাধু ফ্রান্সিসের মহামন্দিরে খ্রিস্টযাগ অর্পণের পর তাঁর “সবাই ভ্রাতৃসম (Fratelli Tutti) ” নামক নতুন সর্বজনীন পত্রে স্বাক্ষরদান করেন। পোপ ফ্রান্সিস ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ মার্চ পোপ পদে নির্বাচিত হওয়ার পর এটা তাঁর তৃতীয় সর্বজনীন পত্র। (June 29, 2013, Lumen Fidei; The Light of Faith. May 24, 2015, Laudati Si; “Praise be to you, my Lord).”।
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর সর্বশেষ “সবাই ভ্রতৃসম” (Fratelli Tutti) বা সবাই ভাই-বোন, সর্বজনীন পত্রে বলার চেষ্টা করেছেন- ভ্রাতৃত্ববোধ/সৌভ্রাত্র ও সামাজিক বন্ধুত্ব ঈশ্বরের অভিন্ন অভিপ্রায়। পোপ, বর্তমান মহামারি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে বলার চেষ্টা করেছেন যে, “সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকার পরও আমরা আমাদের ভালোবাসার মধ্যদিয়ে সংহতি বজায় রাখতে পারি।” পোপ তাঁর সর্বজনীন পত্রের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন- সৌভ্রাত্রকে স্বীকৃতি এবং তা মেনে চলার জন্য। একটি বিষয় তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন যে, বিশ্বের জন্য একটা আশার কারণ হতে পারে- শান্তি এবং ঐক্যতা, যা অর্জন করতে হলে বিশ্বাসীদের মধ্যে সংলাপ ফলশালী করে তুলতে হবে। পোপ তাঁর সর্বজনীন পত্রটিতে মানুষের সামাজিক বন্ধন ও বিশ্ব মানবতাকে গুরুত্ব দিয়ে মোট ৮টি অধ্যায়ে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
১. কৃষ্ণ মেঘঢাকা বিশ্ব: পোপ প্রথমেই বর্তমান বিশ্বে মানুষকে ভাই-বোন হিসেবে গ্রহণ করার একটা ক্ষয়িষ্নু প্রবণতার যে রূপরেখা, তার কারণ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- “এর কারণ হলো ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা সজ্ঞানতা দুর্বল হয়ে যাওয়া, সংস্কৃতিকে পরিত্যাজ্য করে দূরে সরিয়ে দেওয়া, মানবাধিকার বিকশিত না হওয়া, শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ভয় এবং অপরিণত ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার আগ্রাসন- যা বিরুদ্ধ অবস্থান তৈরি করছে।” পোপ, বিশ্বের মধ্যে বিরাজমান এই সামাজিক রোগ ও সমস্যাগুলোর বিশদ তালিকা না দেখিয়ে বরং মূখ্য অংশগুলো উল্লেখ করে বলতে চান- এগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গোটা মানবতার জন্য একটা প্রতিকূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত স্বচ্ছলতা এবং বিশ্ব পরিবার সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠার মধ্যে যে ফাঁক রয়ে গেছে তা একটি পূর্ণ বিভেদ সৃস্টি করেছে। এমন অবস্থা এক সঙ্গে বসবাসে বাধ্য করা হলেও এটা সর্ম্পূণভাবে একটা ভিন্ন চিত্র- যেখানে সৌন্দর্য ও মূল্যবোধ গড়ার বিষয়টি দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
২. চলার পথে আগন্তক: প্রথম অধ্যায়ে কিছু বিষয় নিয়ে অসন্তেুাষ প্রকাশ করার পর পোপ, বাইবেলে বর্ণিত দয়ালু সামারীয়র উপমা কাহিনী ধ্যান করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা যা অভিজ্ঞতা করি, এই কাহিনী তার মধ্যে একটা উজ্জ্বল আলোকরশ্মির মতো বিরাজ করছে। এই উপমা কাহিনী আমাদের স্মরণ ক’রে দেয় যে, পরিবারে যে স্বাভাবিক ভালোবাসার অভিজ্ঞতা হয়- তা আমরা অচেনা মানুষদের প্রতিও দেখাতে পারি। ইহুদি সমাজে এরূপ ভালোবাসার শেকড় রয়েছে এবং এই ভালোবাসা আমরা ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে প্রকাশ করে পরিবারভূক্ত হয়ে উঠতে পারি।
৩. মনের মধ্যে উন্মুক্ত বিশ্বের ছবি আঁকা: পোপ ফ্রান্সিস বলেন, মানব জীবনে এই সামাজিক ভালোবাসার মাত্রা- সর্বজনীন, স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। প্রকৃত ভালোবাসা আমাকে নিজ বলয় থেকে যেমন বের হতে সাহায্য করে, তেমনি অন্যকে আমাদের ভালোবাসার আশ্রয়ে এনে দেয়। পোপ বলেন, প্রকৃত ভালোবাসা আমাদের আর্ন্তজাতিকভাবে যুক্ত হতে সাহায্য করে। ভালোবাসার স্বভাবই হলো গ্রহণ করার আবেদন তৈরি করা এবং প্রতিটা দিক সাধ্যের মধ্যে এনে বৃহত্তর পরিসরে পরস্পরের মধ্যে অঙ্গীভূত হওয়া। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, প্রকৃত ভ্রাতৃত্ববোধ হলো, অন্যের জাতিগতসুত্রে পাওয়া সংস্কৃতিকে সম্মান করা- সে যতোই গরিব হোক বা কষ্টের মধ্যে থাকুক না কেনো। তিনি বলেন, অর্থনীতির কথা বলতে গেলে বলতে হয়, মানুষের মর্যাদার সাথে তার আর্থিক অধিকার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রকৃতির দান দ্রব্যের উপর সমান অধিকার বিষয়ে পোপ বলেন, “একজন মানুষ প্রয়োজনীয় মর্যাদা যদি ভোগ করতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে অন্যে সেটার বাঁধার কারণ হয়ে আছে।” প্রকৃতির দান ‘সৃষ্টির’ উপর অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির। পোপ বলেন, আজকের দিনে অনেকে আর এইভাবে চিন্তা করেন না, কিন্তু যদি আমরা এই নীতি বিশ্বাস করি যে, জন্মের অধিকার মানুষের মর্যাদা দূরে সরিয়ে দেয় না, তাহলে নতুন ও উন্নত ভবিষ্যত, মানবতাবাদ গঠন করার একটা ছবি আঁকতে পারি।
৪. বিশ্বের প্রতি প্রসারিত হৃদয়: পূণ্য পিতা পোপ, শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “অভিবাসন আমাদের জন্য একটা সুযোগ করে দিয়েছে- ভাই-বোনদের যত্ন নেওয়ার জন্য।” পোপ বলেন, এই দেশান্তরী হওয়া অবশ্যই আর্ন্তজাতিক গুরুত্ব বহন করে- তাই আর্ন্তজাতিকভাবেই এর মোকাবেলা করতে হবে। পোপ বলেন, মাইগ্রেশন বা দেশান্তরীকে একটা ভয় হিসেবে না দেখে, এটাকে মানব সেবার সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী- বিশ্ব মানব গোষ্ঠীর অংশ এবং সৌন্দর্য। একজন ব্যক্তির আদি উৎস যেখানেই থাকুক না কেনো, সে বৃহত্তর বিশ্ব পরিবারের সদস্য এবং তাকে বাদ দিলে বিশ্ব পরিবারের পুরো অর্থ ফুটে ওঠে না।
৫. সুস্থ রাজনীতি: সুস্থ রাজনীতির প্রয়োজন সম্পর্কে বলতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, বিশ্বটা যে সব মানুষের জন্য, এর পিছনে দু’টি বিষয় বাঁধা সৃষ্টি করে রেখেছে। একটি হলো, (Populism) বা লোকসাধারণের আবেগ-অনুভুতি বা ভয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি এবং দ্বিতীয়টি হলো, (Liberalism) বা মুক্ত-উদারবাদ। পোপ বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, Populism, মানুষ সম্পর্কে যে মূল ধারণা তা সংক্ষীপ্ত করে ফেলেছে। অন্যদিকে Liberalism দিয়ে বুঝানো হচ্ছে, বাজার অর্থনীতি, অর্থাৎ মুক্ত বাজার অর্থনীতি মানুষের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দিবে। তাঁর ভাষায়, সুস্থ রাজনীতি হলো- সবার আগে সামাজিক ভালোবাসা; অর্থনীতি নয়। রাজনীতির আশ্রয়ে, রাজনীতির ভালোবাসা হলো, যারা বিশেষ অভাবী- তাদের জন্য ত্যাগস্বীকার করা। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদের শিখতে হবে যে, সব কাজে সব সময় আশাতীত ফল লাভ করা যায় না- কিন্তু আমাদের বিশ্বাস অক্ষুন্ন রাখতে হবে, “জমিতে বুনে দেওয়া বীজের গোপন শক্তির উপরে।” পোপ বলেন, আজকের দিনে রাজনীতিকে মানুষের জন্য কল্যাণ যেনো বৃহত্তর এবং দীর্ঘকাল ধরে বিরাজমান রাখে, এমন কল্যাণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
৬. সমাজের মধ্যে সংলাপ এবং বন্ধুত্ব: এই অধ্যায়ে এসে পোপ ফ্রান্সিস শুরুতেই বলেন, “সংলাপই তার পূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে- সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য।” তিনি বলেন, সংলাপ হলো স্বার্থপরতা-ঔদাসীন্য ও হিংস্র-বিক্ষোভের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া সড়ক। যে সমাজটি প্রকৃত সংলাপের মধ্যে থাকে, সে সমাজ অন্যের দৃষ্টিভঙ্গীর পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে থাকে। যার অর্থ হলো, মানুষের মর্যাদাকে সম্মান দেওয়া এবং সম্মান নিয়ে বসবাস করা। বহুতল বিশিষ্ট বস্তুর বিভিন্ন দিক্ বিভিন্ন আকারের হলেও যখন এটাকে একটা বুহৎ পূর্ণ বস্তু হিসেবে দেখা হয়, তখন সেটা হয়ে ওঠে একটা তলা বা একটা অংশ থেকে বিশাল বড় এবং পূর্ণ সৃষ্টি। আমাদের পবিত্র আত্মার কাছে মিনতি জানাতে হবে যেনো তিনি আমাদের এই কাজে সহায়তা দান করেন।
৭. উদ্যোগকৃত পথের নবায়ন: ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির কারণে সংঘাতরত দলগুলোর মধ্যে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপনের জন্য নিরাময় উদ্যোগ প্রয়োজন। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, স্থায়ী ও প্রকৃত শান্তি নির্ভর করে সত্য এবং সেই সাথে ন্যায্যতা ও দয়ার মধ্যে। তিনি আরো বলেন, তখনই ঐক্য স্থাপিত হয়- যখন সবার মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলো একত্রে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়া দুর্বল ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য হতে হবে একটা সার্বক্ষণিক চলমান প্রচেষ্টা। বিবাদ বাড়তেই পারে তবে তার সমাধান রয়েছে সুষ্ঠ সংলাপ ও সত্যিকার আলাপের মধ্যে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, গোটা সমাজের প্রত্যেকে পুর্নমিলিত হবে বা অতীতের পাপ ভুলে যাবে। “পুর্নমিলন হলো একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ।”
পারমানবিক বোমার মতো ঘটনা মানুষের মন্দতার কতো গভীরে বিদ্যমান, তা মন্দতার প্রতীক হিসেবে মনে রাখতে হবে। পোপ বলেন, যুদ্ধ এবং মৃত্যুদন্ড- দু’টি ভ্রান্ত সমাধান মাত্র। এই দু’টি পদক্ষেপ আরো চরম অবস্থার সৃষ্টি করে- সেই সাথে স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে নতুন করে ধ্বংসের আলামত যোগ করে। পোপ, প্রাচীন মন্ডলির শিক্ষার আলোকে যুদ্ধ এবং মৃত্যুদন্ডের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সেই সময় সত্যের অছিলায় এই দু’টি নিয়ম প্রচলিত ছিলো। কিন্তু আজকে আমাদের সময়ে, আজকের পরিবর্তিত বাস্তবতায় এইসব পদেক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য।
৮. আজকের বিশ্বে ভ্রাতৃত্ববোধ হবে ধর্মের সেবা: পোপ ফ্রান্সিস তাঁর সর্বজনীন পত্রের শেষভাগে এসে শুরুতেই বলেন, “বিশ্বের ধর্মগুলোর প্রয়োজনীয় ভুমিকা হলো- আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা।” ধর্ম বর্তমান ও চলমান সত্যের মধ্যদিয়ে মানবতাকে স্মরণ করে দেয় যে, এ সবই মানব মর্যাদার উৎস।” সেই সাথে ধর্মীয় শিক্ষা বিরাজমান থাকলে- একাত্ববাদ ও বস্তুবাদ, যা শুধু বিভাজন তৈরি করে- তার বিরুদ্ধে মানব সত্বাকে জাগ্রত করতে পারে। ক্যাথলিকদের সর্বোচ্ছ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস, ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে, “সবার জন্য মঙ্গল এবং দরিদ্রদের উন্নয়ন সাধনের” আহ্বান জানান। সবশেষে পোপ, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে আবু ধাবী সফরের সময় আল্ আয্হার প্রতিষ্ঠানের গ্র্যান্ড ইমামের সাথে স্বাক্ষরিত- “বিশ্ব শান্তি, সহ-বাস ও মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ” দলিল থেকে উদৃতি দিয়ে বলেন, “ঈশ্বরের নামে, শান্তি ও সংলাপের পথ- বৃহৎ মানবতার- ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন।”
“সবাই ভ্রাতৃসম” (Fratelli Tutti) সর্বজনীন পত্রের সারকথা।
Please follow and like us: