ফাদার সাগর কোড়াইয়া
সব নদ-নদীই ইতিহাস সৃষ্টি করে। আর সে নদ-নদীর ইতিহাস জানতে আমরা আগ্রহী হয়ে উঠি। যদি সে নদ-নদী আমাদের আপন হয়। জোনাইল এলাকার বাসিন্দাদের সাথে বড়াল নামটি এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, বড়াল নামটি শোনার সাথে সাথে ছোটবেলার বহু স্মৃতি অজান্তে এসে ভীড় করে। বর্ষার পানি আসার সাথে সাথে নদীতে দিনভর লাফালাফি, মাছ ধরা, নৌকা চালানো, চাষীদের পাট জাগ দেওয়া। এরকম আরো বহু ঘটনা প্রত্যেককেই আলোড়িত করে। অনেকেই স্মরণ করতে পারবে স্কুলে পড়ার সময়গুলোর কথা। স্কুলে টিফিনের সময় নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নৌকা দেখা আবার মাঝে মাঝে নৌকার পাটাতনে উঠে পড়া। মাঝিদের সাথে ভাব জমানো। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঢেউ গোনা। কখনো বা নৌকার সাথে সাথে দৌঁড় লাগানো। নৌকা ভর্তি নানা রকম ফল দেখে লোভ করা। আর যাদের বাড়ি নদীর তীরে তাদের স্মৃতি তো আরো মধুর। যারা এখন প্রায় সত্তোর বছরের কাছাকাছি বা তারও উপরে তারা বড়াল সমন্ধে আরো বহু কিছু বলতে পারবে। কারণ সেই সময়ে বড়ালের যৌবন ছিলো। যত সৌন্দর্য বড়াল অর্জন করেছিলো তা সেই সময় উজাড় করে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বড়ালের আগের অবস্থা আজ আর নেই। দেখলে মনে হয় মানুষের মতো বড়ালও আজ মরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কবে হয়তো ঘুম ভেঙ্গে দেখবে বড়াল মরে গেছে। তখন বাঁচাবার চেষ্টা বিফলে যাবে। প্রাকৃতিকভাবে অনেক নদী মরে যায়। এটাই নদীর স্বাভাবিকতা। কিন্তু যদি নদীকে জোর করে মারা হয় তাহলে তা হত্যা করা ছাড়া আর কি বলা যায়। বিশ একুশ বছর আগে যেখানে নদীতে বড় বড় নৌকা চলতো, দল বেঁধে ভ্রমণে যাওয়া হতো সেখানে আজ আর বড়ালে পানি নেই। বৃষ্টির পানি যতটুকু দেখা যায় সেটাই যেন বর্ষার পানি হয়ে রাজত্ব করে। কয়েক বছর আগে পত্রপত্রিকায় “বড়াল বাঁচাও” নামে আন্দোলন হচ্ছে দেখতে দেখতে পেলাম। এছাড়াও বড়ালকে নিয়ে একুশে বইমেলায় বইও প্রকাশিত হয়েছে। বেশ ভালো লেগেছিলো এই ভেবে যে, অত্যন্ত বড়াল বাঁচবে। কিন্তু যখন চাক্ষুস বড়ালের অসহায় অবস্থা দেখি তখন ভাবি বড়ালের বাঁচার আশা নেই। বড়ালের দু পাশ ভরাট হতে হতে নালায় পরিণত হওয়ার প্রতিক্ষায় আছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম শুধু বড়ালের গল্প শুনে আর স্বপ্ন দেখে দিন রাত কাঁটাবে।
বড়ালের এই অসহায় অবস্থা কৃষক আর জেলেরা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে। কারণ বড়াল যেখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তার আশেপাশে রয়েছে বড় বড় বিল। আর বড়ালের পানি বিলগুলোতে প্রবেশ করে বিলের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনে। ফলে ধান চাষ থেকে শুরু করে, মাছের চাহিদা পূরণ সবই সম্ভব হয়। কিন্তু আজ আর বড়ালে পানি আসে না আর বিলেও পানি প্রবেশ করে না। এখন আর আগের মতো পাট চাষও করা হয় না। কারণ কৃষকদের আগে ভাবতে হয় পাট কোথায় জাগ দেওয়া হবে। যেহেতু বড়ালে পানি নেই তাই বিলেও পানি নেই, সেহেতু সম্ভব নয়।
বড়ালের প্রাচীন নাম বড়হর। স্থানীয় নাম বড়াল। বড়হর অর্থে বোঝানো হচ্ছে বড় হাওর বা পদ্মার বড় নদী। আমরা বড়ালকে নদী হিসাবে জেনে অভ্যস্ত। কিন্তু বড়াল হচ্ছে একটি নদ। আর নদ বা নদী পৃথকীকরণের জন্য কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। এতদিন আমরা স্ত্রী নামে যে প্রবাহগুলো দেখেছি সেগুলোকে নদী হিসাবে আখ্যায়িত করেছি। আবার পুরুষ নামে যে প্রবাহ সেগুলোকে নদ হিসাবে ডাকা হতো। কিন্তু উভয়ের কোনটাই সঠিক পদ্ধতি নয়। আসল পদ্ধতিটি হচ্ছে যদি কোন প্রবাহের নামের শেষে আকার, একার, ওকার এবং ঔকার থাকে তাহলে সে প্রবাহগুলো নদী নামে পরিচিত হবে। যেমন- যমুনা, মেঘনা, পদ্মা। আর যদি কোন প্রবাহের নামের শেষে আকার, একার, ওকার, এবং ঔকার না থাকে কিন্তু হ্রস্ব-উ-কার থাকে বা হ্রস্ব-উ-কার নাও থাকে তাহলে তা অবশ্যই নদ হবে। যেমন- সিন্ধু নদ, নীল নদ, কপোতাক্ষ নদ। সুতরাং আমাদের চিরচেনা এই বড়ালটিও নিঃসন্দেহে একটি নদ হিসাবে পরিচিত হওয়ার কথা। কিন্তু যেহেতু নদী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে তাই বড়াল নদী হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত। যদি পদ্মাকে বলি রাজশাহীর হৃৎপিণ্ড তাহলে বড়াল হচ্ছে হৃদস্পন্দন। পদ্মার যে স্থান থেকে বড়ালের উৎপত্তি সে স্থানটি রাজশাহীর গোপালপুর নামক গ্রাম। তাই বড়াল পশ্চিম থেকে উৎপত্তি হয়ে পূর্বগামী। পদ্মা সেখানে প্রায় দুই কিলোমিটার প্রশস্থ। বড়াল বৃটিশ ভারতের অন্যতম প্রধান এবং প্রাচীন পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র “সারদাহ” নামক স্থানের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর বড়াল সাপের ন্যায় বিভিন্ন দিকে ধাপিত হয়ে চলছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন জনপদ। এছাড়াও বড়ালের বিভিন্ন শাখা নদ-নদী ও খালের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- মুসাখাঁন নদ, নন্দকুজা নদী প্রবাহমান কিন্তু অপর দুটি গাইনগড় ও পচা বড়াল মৃত। বড়াল পূর্বদিকে বাঁক নিয়ে বড়াইগ্রাম (বড়াইগ্রামের আদিনাম বুড়িগাঁও) থানা দপ্তর অতিক্রম করে লক্ষ্মীকোল বাজারের উত্তর পূর্ব পার্শে প্রবেশ করেছে। এরপর বড়াল পূর্বমুখী হয়ে রয়না অতিক্রম করে বিভিন্ন পথে জোনাইলের দিকে ধাপিত হয়েছে। আজ এ স্থানটি মৃতপ্রায়। জানা যায়, গত ২০ বছর পূর্বেও নাকি রয়নার মোড় থেকে নৌ পথে চাটমোহর পর্যন্ত নৌকা চলাচল করতো।
বাগডোব ব্রিজ পেরিয়ে বড়াল পূর্বদিকে ধাপিত হয়েছে। এর উত্তরদিকে আদগ্রাম এবং দক্ষিণ দিকে পিঙ্গইল, কুমারখালি। বড়ালের দু’পাশে পানের বরজ এবং অন্যান্য ফসলের ক্ষেত ও ফলের বাগান এলাকাটিকে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। বড়ালের উভয় পাশ দেখলে মনে হয় কোন এক সময় এদিকে প্রচুর জঙ্গল ছিলো। যার ছোঁয়া আজও কিছুটা রয়ে গেছে। উত্তরপাড়ে আদগ্রামে রয়েছে একটি শ্মশানঘাট। এরপর এখান থেকে আরও দুই কিলোমিটার অতিক্রম করার পর জোনাইল বাজার এবং দক্ষিণ পাশে পারবোর্নী গ্রাম। জোনাইল নাটোর জেলার অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন একটি জনপদ। জোনাইল বাজারটি বৃহত্তর রাজশাহী জেলার মধ্যে অন্যতম একটি প্রধান নৌবন্দর ছিল। অনেক ব্যবসায়ী মানুষ জোনাইল বাজারে বসবাস করতো। জোনাইলের নৌবন্দরটির নাম ছিল নাগরকান্দি। জোনাইলের নৌবন্দরটির অবস্থান ছিল ব্রীজের নিকটে। বড়ালের উত্তরপাড়ের অংশটি নাগরকান্দি নৌবন্দর নামে পরিচিত ছিল। বৃটিশ আমলে বড়ালের উত্তরপাড়ে জোনাইল বাজারে একটি পতিতা পল্লী ছিল। পাকিস্থান আমলের শেষের দিকে পল্লীটি উঠে গেছে। বর্তমানে জোনাইল বাজার অত্র এলাকায় বেশ বড় একটি ব্যবসা কেন্দ্র ও বাজার হিসাবে পরিচিত। প্রতিনিয়ত জোনাইল বাজার তার অবস্থার পরিবর্তন করে আরো ভালো অবস্থানে রূপান্তরিত হচ্ছে। জোনাইল বাজার অতিক্রম করে বড়াল সোজা পূর্বদিকে বেশ প্রশস্ত আকার নিয়ে ধাপিত হয়ে সোন্দভা তারপর হরিপুরে গিয়ে পৌচ্ছেছে।
বড়ালের মরণের সাথে সাথে জোনাইল অধিবাসীদের বড়ালকে নিয়ে রচিত স্বপ্নগুলোও মরে যাচ্ছে। কয়েক বছর পূর্বে যেখানে বড়ালের পানি কমে গেলে মাছ ধরার ধুম পড়ে যেতো সেখানে আজ আর তেমনটি চোখে পড়ে না। অনন্ত মাঝির সেই ডিঙ্গি নৌকা আর নেই। বড়ালের দু’পাশের গাছগুলোতে রসালো ফলও আর ধরে না। যেখানে অন্যদেশে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য সবাই মিলে একসাথে কাজ করে সেখানে আমাদের দেশে তার বিপরীত চিত্র লক্ষনীয়। আজ বরং বড়ালের দুপাশ মাটিতে ভরে যাচ্ছে। কে কতটুকু জায়গা বাড়াতে পারে সে প্রতিযোগীতায় মত্ত। বড়ালকে বাঁচাতে কে এগিয়ে আসবে? আবার কে ফিরিয়ে আনবে বড়ালের হারানো যৌবন? হৃদয় গভীরে কেউ কি বড়ালের কান্না শুনতে পায় না? আজ বড়াল অতি ক্ষীণ কন্ঠে বলছে, আমি বাঁচতে চাই, আমি বাঁচতে চাই, আমাকে বাঁচাও। বড়ালকে নিয়ে বহু কবিতা, গল্প, সাহিত্য লেখা হয়েছে। আরো লেখা হয়তো হবে। তবে তখনই এর সার্থকতা যখন বড়াল আবার পুনরুত্থিত হবে।
বড়ালকে নিয়ে একটি কবিতা-
বড়াল শত গ্রাম আর জনপদের জন্মদাতা।
নীরবে নাকি রুদ্রমূর্তি নিয়ে এসেছিলো
তা কেউ জানে না। জানে শুধু অযত্নে বেড়ে উঠা বৃদ্ধ বটগাছটি
আর জীর্ণ পাখাভাঙ্গা চিল-শকুনীর দল।
যে জেলেটা রাত্রি শেষে মাছ ধরে বড়ালের পাশে ঘুমায়
ও যে সব সময়ে স্বপ্ন দেখে
বড়ালের যৌবন হারিয়ে যাবার স্বপ্ন।
উলঙ্গ ছেলের দল ছেঁড়া জালে তুলে আনে
বড়ালের পুরানো পান্ডুলিপি যা ছিলো
বহুদিন মাছের দলের সাথে ঘুমিয়ে।
চোখের পটে ভীড় করে বাসা বাঁধে
বড়ালের নিঃশব্দে ঘুমিয়ে পড়ার ছবি
ক্ষয়ে যাওয়া চোয়ালের শক্ত আবরণ।
গানে গানে ঘুমিয়ে পড়ে সে
নিঃশব্দে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে
নিজের জলতরঙ্গ মাঝে।
শুনা যায় বড়ালের কান্না মিহিসুরে
রাতের তারার আকাশে
আর জেলের ছেঁড়া জালের ফাঁকে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
সিদ্দিকী, মাহবুব: বড়াল নদের ইতিকথা, শ্রাবণ প্রকাশনী, শাহবাগ, ২০১৩ খ্রীষ্টাব্দ।