গত ১২ নভেম্বর গণভবনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর প্রতিনিধিবৃন্দ সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশের কাথলিক বিশপ সম্মিলনী (সিবিসিবি)’র পক্ষ থেকে কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও (ঢাকার অবসরপ্রাপ্ত আর্চবিশপ), ঢাকার নব-নিযুক্ত আর্চবিশপ বিজয় এন ক্রুজ, ও.এম.আই, ঢাকার সহকারী বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ এবং ভাটিকানের রাষ্ট্রদূত পরম শ্রদ্ধেয় আর্চবিশপ জর্জ কোচেরী। সাক্ষাৎকালে কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর প্রতিনিধিগণ বাংলাদেশে কাথলিক মণ্ডলির বিভিন্ন কার্য্যক্রম, ও মজিব বর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী ও শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নরে জন্য রাষ্ট্রের সাথে কিভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তা তুলে ধরেন।
কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি’ রোজারিও- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, কাথলিক মণ্ডলির সহমর্মিতা ও উদারতার চিহ্নস্বরূপ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর পক্ষে অর্ধকোটি টাকার একটি চেক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে প্রদান করেন।
পোপের প্রতিনিধি আর্চবিশপ জর্জ কোচেরী, পোপ মহোদয়ের সর্বশেষ বিশ্বজনীন পত্র, “ফ্রাতেল্লি তুত্তি”, “ভাইবোন সকল”-এর একটি কপি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। কার্ডিনাল মহোদয় বলেন, এই পত্রে- বর্তমানকালে কোন্্ ধরনের বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে তার দর্শন, কর্মকাণ্ডের নীতি এবং কার্যক্রমের নির্দেশনা রয়েছে। এই পুস্তিকাটিতে আপনারও অনেক সামাজিক দর্শন ও চিন্তাধারা স্থান পেয়েছে এবং আরও অনেক বিষয়ে আপনি নতুন চিন্তাভাবনা লাভ করে অনুপ্রাণিত হতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেককে তিনটি করে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বই এবং স্মৃতিস্মারক হিসেবে প্রত্যেককে একটি মেটাল নৌকা প্রদান করেন।
প্রতিনিধিগণ প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি জাতির যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা; জাতির পিতার অনুসরণে জাতির যোগ্য মাতা; পিতার অসমাপ্ত কাজসকল সবই পূরণ করে যাচ্ছেন। জাতির পিতার স্বপ্ন আপনার জীবন ও কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছেন প্রতিদিন। মানুষের প্রতি, বিশেষভাবে দীন-দরিদ্র, ক্ষুদ্র-দুর্বল নারী-পুরুষের প্রতি আপনার ভালবাসা কতো গভীর! এই ভালবাসা আপনাকে প্রতিক্ষণ অনুপ্রাণিত করছে মানুষের কাছে আসতে, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে, নির্ভয়ে নিজের জীবন নিবেদন করতে।
কার্ডিনাল প্যাট্রিক জানান যে, এ বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা এবং পরিবারের সকলের প্রতি আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করেছি এবং বিদেহী আত্মার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি। সেই সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে উদ্্যাপিত মুজিববর্ষে কাথলিক খ্রিস্টান সমাজ অনেক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে- তার মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে কাথলিকদের দ্বারা সাত লক্ষ ফলজ বৃক্ষ রোপন করা। এই উদ্যোগ বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে আমাদের বিশেষ উপহার। কার্ডিনাল মহোদয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আরো জানান যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্র্ষিকী উপলক্ষে আমরা ৮ জন কাথলিক বিশপ টুঙ্গিপাড়া তাঁর মাজার (৭ নভেম্বর) এবং মুজিব নগর (৯ নভেম্বর) পরিদর্শন করে আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি, মৃতজনদের জন্য চিরশান্তি কামনা করেছি, জাতির জন্য এবং আপনার ও আপনার সরকারের জন্য প্রার্থনা করেছি।
টুঙ্গিপাড়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, উক্ত এলাকায় অনেক উদার মন নিয়ে সর্বধর্মের মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে সবাই গড়ে উঠেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান- আমার বাবাও মিশন স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। কার্ডিনাল মহোদয় বলেন, মুজিবনগরের কথা স্মরণ করলেই মনে পরে ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে যখন মুজিব-নগরে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠনের কথা। ভবেরপাড়া প্যারিশের সেদিন একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। ফাদার ফ্রান্সিস গমেজ (পরবর্তীতে ময়মনসিংহের বিশপ) এবং সিস্টার ক্যাথেরিন, এসসি. প্যারিশ থেকে সভার জন্য চেয়ার টেবিল সরবরাহ করেন এবং উক্ত অনুষ্ঠানে বাইবেল পাঠ করেন।
কারিতাস বাংলাদেশ, কাথলিক চার্চের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি দেশীয় এন.জি.ও.। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে, কাথলিক নীতি ও আদর্শ অনুসরণ ক’রে, বাংলাদেশ এনজিও এফায়ার্স ব্যুরোর অনুমোদনক্রমে, কাথলিক চার্চের পক্ষ হয়ে দেশে আপামর জনগণের জন্য ত্রাণ ও উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে কারিতাস বাংলাদেশ ৪৯টি জেলায় ২০ লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে কাজ করছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২৭৮ কোটি টাকা ।
পোপ ফ্রান্সিস ও আপনার মধ্যে একটি সুন্দর, ঘনিষ্ঠ ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে গ্রহণ ক’রে যে ভালবাসা আপনি প্রকাশ করেছেন তা তাঁর কাছে বড়ই আদর্শনীয় এবং তার জন্য তিনি আপনার প্রশংসা করে থাকেন। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁর ভালবাসার কারণে তিনি অন্যের মধ্যদিয়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন- ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে। বাংলাদেশ কারিতাসের মাধ্যমে, ২০১৯ জানুয়ারি থেকে ২০২০ অক্টোবর পর্যন্ত ৯৩ কোটি টাকা রোহিঙ্গাদের মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। এখানেও পোপ ফ্রান্সিসের অবদান অতুলনীয়।
সিবিসিবির প্রতিনিধি দল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স¦াস্থ্য খাতের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, খ্যাতিসম্পন্ন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালটি ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারের নিকট হস্তান্তরের পর, গত বছর ১১ নভেম্বর, ঢাকা কাথলিক আর্চডাইয়োসিস কর্তৃক, “সেন্ট জন ভিয়ানী” নামে একটি হাসপাতাল, ফার্মগেট এলাকায় শুরু করা হয়। এলাকার সাংসদ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা উদ্বোধন করেন। করোনা ভাইরাস মহামারিকালে হাসপাতালটি উক্ত এলাকায় জরুরী চিকিৎসা প্রদান করে বিশেষ অবদান রেখেছে। হাসপাতালের চূড়ান্ত রেজিষ্ট্রেশন ও উন্নয়নের জন্য সরকারের সহযোগিতা একান্ত কামনা করি।
কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি যে, সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপুমনির নির্দেশনায় ও শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় চার্চ পরিচালিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারকর্তৃক নীতিমালার চূড়ান্ত একটি খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে প্রায় একবছর আগে। তবে এখনও সেটি গেজেটরূপে প্রকাশিত হয়নি। হয়তো আপনার নির্দেশনায় অতি শীঘ্র নীতিমালাটি আমরা হাতে পাব।
আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, টি. এ. গাঙ্গুলী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং নটর ডেম ইউনিভার্সিটি শুরু করার জন্য আমি আপনাদের অনেকবার অনুপ্রাণিত করেছি।
প্রতিনিধিগণ বলেন, আপনার সহৃদয়তা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের খ্রিস্টান সমাজ থেকে দু’জনকে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে স্থান দিয়েছেন। এটা আপনার উদারতা ও ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সমাজের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ; এর জন্য আমরা সর্বদাই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
আমরা আপনার মধ্যে দেখেছি দীন-দূঃখী, বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি অনেক দরদ ও মমতাবোধ। এ ক্ষেত্রে আমরাও আপনার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। যারা দুর্বল ও নির্যাতিত, বিশেষ করে, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সরকারের সদয় দৃষ্টি রাখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে ওরা যেহেতু দুর্বল, সবলদের নির্যাতন প্রায়ই ভোগ করতে হয়। অতএব সরকারকে দুর্বলদের পক্ষ নেওয়া একান্ত জরুরী।
পরিশেষে, এই সাক্ষাতের সুযোগ দানের জন্য, আমাদের কথা ধৈর্য্য সহকারে শোনার জন্য এবং দেশের ক্ষুদ্র খ্রিস্টানসমাজের প্রতি আপনার অতীতের সকল মহানুভবতার জন্য, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। আপনাকে ও আপনার সরকারকে সর্বদাই প্রার্থনায় স্মরণ রাখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।
তথ্য : বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর পক্ষে
ঢাকার অবসরপ্রাপ্ত আর্চবিশপ।
-ফাদার বাবলু কোড়াইয়া