ফাদার সুনীল রোজারিও। রেডিও জ্যোতি, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
দুই হাজার বিশ খ্রিস্টাব্দে আমাদের জন্য বড়দিনের সবচেয়ে বড় উপহার কী ? যদি বলি কোভিড- নাইনন্টিন। গত এক শতাব্দির মধ্যে এমনভাবে কোনো মহামারি মানব সভ্যতাকে নাড়া দিতে পারেনি। করোনা ভাইরাস এমনই এক রোগ, যার স্বভাবে নেই রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, স্বজন-প্রীতি, ধনী-গরিবের হিসাব, পূর্ব-পশ্চিম, সীমানা প্রাচীর, ধর্ম-বর্ণ, শিক্ষিত-মূর্খ ও কোনো করুণা। অবলীলায় সে বিচরণ করে চলেছে দেশ থেকে দেশান্তরে, মহাদেশে। বিজ্ঞানিদের সমস্ত হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়ে, পরাশক্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এখনোও বহাল তবিয়তে। গত এক বছর ধরে অজানা এই ভাইরাসটি গোটা বিশ্বের মানুষকে বন্দি করে রেখেছে মৃত্যুর আতঙ্কে। মানুষের অবাধ গতিকে সীমিত, লক ডাউন ও নিরুপায় করে করে রেখেছে। এতো উন্নত বিশ্ব, সভ্যতার শিখর, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের এতো ছড়াছড়ি, অস্ত্রের প্রতিয়োগিতা- প্রকৃতির কাছে আজ সব অসহায়। প্রকৃতি চলবে তার আপন মহিমায়- হাড়ে হাড়ে এই কঠিন বাস্তবতার কাছে মানুষ অসহায়।
বৃটিশ ধর্মীয় নেতা থোমাস রবার্ট ম্যালথাস অষ্টাদশ শতাব্দির একেবারে শেষে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,“জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক গতিতে আর খাদ্যদ্রব্য বাড়ছে গাণিতিক গতিতে।” এটুকু বলার পর তিনি থেমে থাকেননি। তিনি বলেছেন, “অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি- প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চাপ ফেলবে, পরিবেশ দুষণ বাড়বে, অধিক সংখ্যার কারণে বেকারত্ব বাড়বে।” তার পর তিনি আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, “উল্লেখিত সমস্যাগুলোর কারণে আরো বড় সমস্যা তৈরি হবে, যেমন- ক্ষুদা-অনাহার-দরিদ্রতা বৃদ্ধি, রোগ-মহামারি বৃদ্ধি, সন্ত্রাস বৃদ্ধি- এমনকী যুদ্ধও হতে পারে।” ম্যালথাস এমন সময়ে তার জনসংখ্যা তত্ব আবিষ্কার করেছিলেন যখন শিল্প বিপ্লব, সবুজ বিপ্লবের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ফলে ম্যালথাসের জনসংখ্যা মতবাদ কঠিনভাবে সমালোচিত হয়েছিলো। তবে অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তির মতে, সম্প্রতি ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ব নতুন করে ইউরোপ পেরিয়ে গোটা বিশ্বে ফিরে এসেছে। বর্তমান বিশ্বের পরিবেশ বিপর্যয়, দুষিত জলবায়ু, বনাঞ্চল ধ্বংস, বিপন্ন বন্য প্রাণিজগৎ, এইসব নানা কারণে প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। আজকে প্রকৃতির এই বৈরি স্বভাব, এই মহামারি কী মানুষের লোভ-লালসা, বিলাসীতা ও স্বার্থের কারণে সৃষ্ট? এই বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে পাঠকদের চিন্তায় ছেড়ে দিলাম। আজকের বাস্তবতা পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে ম্যালথাস তত্ব ধ্যান করার অনুরোধ রইলো।
লিখতে চেয়েছিলাম কোভিড- নাইনন্টিন ও বড়দিন- ২০২০ খ্রিস্টাব্দ নিয়ে। এবছর ইস্টার যেভাবে কেটেছে, একইভাবে কোভিড- নাইনন্টিনের মধ্যেই বড়দিন আসছে তার নিজের মতো করেই। গির্জা, বাড়িতে সাজানো হবে খ্রিস্টমাস ট্রি, মেরী খ্রিস্টমাস বাজবে ঘরের কোনে, রেডিও, টেলিভিশনে গান নাটক ঠিকই প্রচারিত হবে। কিন্তু উৎসবের আমেজ নিয়ে খ্রিস্টমাস শপিং কেমন হবে ? কেমন হবে বছর ধরে অপেক্ষার ব্যবসা? সামাজিক দূরত্বের কারণে অনলাইন শপিং ভরসা ? অনলাইন শপিং এদেশে এখনোও ততো জনপ্রিয় নয়। পাঁচ দশজন একসঙ্গে মলে গিয়ে দশটা যাচাই করে একটা বাছাই করার মজা অনলাইন শপিং করে পাওয়া যাবে না। বড়দিনের কার্ড, গিফ্ট দেওয়া নেওয়ার মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণটি মাথার মধ্যে উকি দেবে। খ্রিস্টমাস পার্টি এবার ভেস্তে গেলো। ছয়জনের অধীক সমাবেশ নিষিদ্ধ। আবার এই ছয়জনের মধ্যেও দূরত্ব মাপতে হবে। গ্লাস হাতে নেওয়ার আগে স্যানিটাইজার লাগাতে হলে, বাড়তি ঝামেলা। তারকা খচিত হোটেলগুলো অনেক আগে থেকেই লোকসান গুণতে শুরু করেছে। খ্রিস্টমাস সিজন পযর্ন্ত অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় হোটেলের বলরূমে আলোর ঝলকানি, হাই ভলিউম ডিস্কো ড্যান্স- সব বন্ধ। অগত্যা যার যার আঙিনায় যেটুকু আয়োজন করা যায়।
শিশুদের অপেক্ষার পালা নিরসভাবেই কেটে যাবে। সান্তা ক্লউজ কী এবার আসবেন ? অবশ্যই আসবেন। বড়দিন যদি আসে তবে সান্তা ক্লউজ আসবেন না কেনো? মনে হয় চিরাচরিত পোশাকে এবার দেখা যাবে না, সাধু নিকোলাসকে। মুখে থাকবে ফেস শিল্ড, কোভিড মাস্ক, ব্যাগের মধ্যে লজেঞ্চের পরিবর্তে থাকতে পারে স্যানিটাইজারের টিউব। আর কী আনবেন সাথে করে ? হয়তো দেখা যাবে সান্তা ক্লউজ এবার কম্পিউটারে বসে ‘ক্লিক এ্যন্ড কালেক্ট’ অনলাইন শপিং করে রুডল্ফ হরিণের গাড়িতে চড়ে মুক্ত আকাশে ঘুরছেন। হরিণের গাড়ি ভর্তি কোভিড মাস্ক। সান্তা ক্লউজ ‘নিউ নরমাল’ বিধি মেনে এবার এই কোভিড মাস্কই হবে শিশুদের জন্য সান্তা ক্লউজ মশাইয়ের উপহার। কিন্তু মশকিল হলো তার পৃথিবীতে নেমে আসা নিয়ে। তিনি কিন্তু জেনে গেছেন মাটিতে নেমে আসলে কী দশা হবে। সঙ্গে সঙ্গে ১৪দিনের কোয়ারিন্টাইন। তাহলে বড়দিন লাটে উঠবে। শিশুরা আঙিনায় দাঁড়িয়ে দেখবে রুডল্ফ গাড়ি। আশ্চর্য হবে দেখবে মাটিতে নামছেন না, কোনো গিফট নয়, তাদের দিকে ফেস মাস্ক ছুড়ে দিচ্ছেন। আরো হয়তো কিছু স্বাস্থ্য-বিধি টিপস নিয়ে সান্তা ক্লউজ ফিরে আসবেন। কী করে বোঝাবেন শিশুদের। তাই এবারের বড়দিন শিশুদের জন্য হবে সবচেয়ে অখুশির বড়দিন।
বড়দিন ঘিরে দেশজুড়ে যতো আয়োজনই থাকুক না কেনো, সর্ব প্রথম বড়দিন হলো- পারিবারিক উৎসব। নানা কারণে একটা লম্বা বিরতির পর অনেকে পরিবারে ফিরে আসেন। প্রিয়জন অপেক্ষায় থাকেন। তাই বড়দিন, সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দ পারিবারিক উৎসবকে আরো জমিয়ে তোলে। কিন্তু এবার অপেক্ষার পালা বিষাদে পরিণত হবে। এছাড়া শীতকালে ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার যে আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে- তাতে করে উৎসবের চিন্তাটা আরো স্তিমিত হয়ে গেছে। পশ্চিমা বিশ্বে বড়দিনের সঙ্গে নববর্ষের ছুটির রয়েছে একটা বিশেষ আবেদন। কর্মজীবী মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে পাশাপাশি এই ছুটির জন্য। ঐ দেশগুলোতে কাজ করা ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন। এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে বড়দিন ও নববর্ষ হলো একমাত্র সময়, যখন পরিবারের সবাই মিলে আউটিং করে। কিন্তু আউটিং মানে বহুলোকের ভিড়ে সামিল হওয়া। সামাজিব বিধি-নিষেধের কারণে ভ্রমন বিজর্সন দিতে হবে। মাথায় থাকবে ভাইরাস ‘কমিউনিটি টান্সমিশন’ হওয়ার ভয়।
বেকারত্ব এবারের বড়দিন ও নববর্ষের উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর বেকারত্ব কৃষিপ্রধান দেশগুলো থেকে ভিন্ন চরিত্রের এবং বেশি ভয়াবহ। বিশেষ করে হোটেল ব্যবসা, শপিং মল এবং পর্যটন খাতগুলো ভাইরাস সংক্রমণের কারণে জনশূন্য হয় আছে। উন্নত বিশ্বে বেকার জীবন পাবিারিক সমস্যার একটা কারণ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘গৃহ নির্যাতন’। বহুদিন লকডাউন থাকার কারণে একে অন্যের ভূলভ্রান্তি ধরা, অনৈক্য ও মতের অমিল ও কথা কাটাকাটি, আর্থিক সংকট, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভধারণ, বয়স্কদের নিয়ে ভাবনা, সন্তানদের অস্থিরতা, ইত্যাদির কারণে পরিবারে অশান্তি নেমে আসতে পারে। এমতাবস্থায় পরিবারে সংযম ও সহনশীলতার অভাব ঘটলে, অশান্তি গৃহ নির্যাতনে রূপ নিতে পারে। আর এই গৃহ নির্যাতনের শিকার হবেন বেশি ক্ষেত্রে নারীরা। চার্চ এবং উন্নত বিশ্বকে গৃহ নির্যাতনের বিষয়টি আরো ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলছে। কেউ মুখ খুলে ‘করোনা ডিভোর্স’ নামে আশংকা প্রকাশ করছেন- যেখানে শুধু ডিভোর্সের আবেদন জমা পড়বে। আর বেশি ক্ষেত্রে এই আবেদন আসবে নারীদের কাছ থেকে। চলতি শতাব্দির প্রথম দশকেও দেখা গেছে পশ্চিমা বিশ্বে খ্রিস্টমাস হলিডে’র পর বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদনটা বেড়ে যেতো। দ্বিতীয় দশকে এসে সামগ্রিক বিবেচনায় এই আবেদনের হার অনেকাংশে কমেছে। এখন শতাব্দির তৃতীয় দশকে এসে করোনা ডিভোর্সের হার বেড়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হচ্ছে। আর চার্চের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করছে।
উপাসনালয়ে মানুষের উপস্থিতি দিয়ে ঈশ্বরভক্তের সঠিক সংখ্যা আমলে আনা যাবে না। সাহায্য করা, সেবা করা, ভালোবাসা এগুলোও তো ধর্মের শিক্ষা, মানব ধর্ম। পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই গির্জায় যায় না বলে অভিযোগ শুনি। কিন্তু এই জনকল্যাণ কাজগুলো তারা ভালোই করে থাকেন। এবার পশ্চিমা দেশে করোনার কারণে একটা ভিন্ন চিত্রও দেখা গেছে। রাস্তায় রাস্তায় হাটু গেড়ে প্রার্থনার চিত্র, পবিত্র সাক্রামেন্ত নিয়ে শোভাযাত্রা, লক ডাউনের কারণে, গির্জাঘর বন্ধ থাকার কারণে গির্জার দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে প্রার্থনা করার দৃশ্য দেখে অনেকে অনুকরণ করেছেন। দেবালয় বন্ধ থাকলে কী হবে, ঈশ্বরের শ্রবণশক্তি তো আর বন্ধ নেই। এই মহামারিকালে জনগণের মধ্যে প্রার্থনা-ভক্তির প্রবণতা অনেক বেড়েছে। প্রার্থনা হলো ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের মাধ্যম।
শুরুতেই বলেছিলাম- দুই হাজার বিশ খ্রিস্টাব্দে আমাদের জন্য বড়দিনের সবচেয়ে বড় উপহার কী ? কোভিড নাইন্টিন। কোভিড খ্রিস্টমাস অবশ্যই এবার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নিরানন্দের কারণ। তার পরেও বড়দিন আসবে। সাধু লুক লিখেছেন, “সেই অঞ্চলে একদল রাখাল ছিলো, যারা মাঠে থেকে সারা রাত জেগে তাদের পালের পশুগুলোকে পাহারা দিতো। সেদিন হঠাৎ প্রভুর দূত তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন; প্রভুর মহিমা তখন তাদের ঘিরে উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াতে লাগলো। এক আশ্চর্য ভীতিতে ভরে উঠলো তাদের অন্তর। কিন্তু স্বর্গদূত তাদের বললেন, ‘ভয় পেয়ো না’ আমি এক মহা আনন্দের সংবাদ তোমাদের জানাতে এসেছি; এই আনন্দ জাতির সমস্ত মানুষের জন্যই সঞ্চিত হয়ে আছে। আজ দাউদ নগরীতে তোমাদের ত্রাণকর্তা জন্মেছেন- তিনি সেই খ্রিস্ট, স্বয়ং প্রভু (২:৮-১১)।” ঝড়ের পর পৃথিবী শান্ত হবেই। সুতরাং কোনো ভয় নেই। ঈশ্বর তাঁর ভক্তকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে পরীক্ষা করেন। আসুন জেগে থাকি। কারণ স্বর্গদূত খ্রিস্টের জন্মের এই মহা আনন্দ সংবাদটি দেওয়ার জন্য আমাকেও খুঁজছেন। পাঠকদের প্রতি রইলো বড়দিন ও নববর্ষের শুভেচ্ছা।
কোভিড নাইনন্টিন- বড়দিনের উপহার
Please follow and like us: