প্রিয় খ্রিস্টভক্ত ভাইবোনেরা,
দেখতে দেখতেই আমরা প্রভু যিশুর আগমনকালে উপনীত হয়েছি। বিগত প্রায় বছর জুড়েই সারা বিশ্বের আমরা সকলেই কোভিড-১৯ বা নতুন করোনা ভাইরাসের ভয়ে ভীত হয়ে দিনাতিপাত করে যাচ্ছি। কবে এই বিপদ থেকে আমরা যে রক্ষা পাব তা আমরা জানি না। তবে এই বিপদের কাল মেঘ আমাদের জীবনকে দুর্বিসহ করলেও, আমরা আশাহত হব না। “বাতাস এনেছে বয়ে এক শুভ বাণী, শোন শোন শোন, শোন তাঁর আগমনী”; বাতাস যাঁর আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে, সেই তিনি হলেন যিশু খ্রিস্ট, যিনি অতীতে এসেছিলেন, যিনি বর্তমানেও আমাদের কাছে আসছেন আবার কালের শেষে যিনি আসবেন আমাদের বিচার করতে তিনি, আমাদের অন্তরে সেই আশা জাগিয়ে রেখেছেন। পাপের পরাধীনতা ও নিরাশার তমশা থেকে যিশুই আমাদের সকলকে মুক্তির পথ, আলোর পথ দেখাতে এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। সেই পথ তিনি এখনো আমাদের দেখান – আমরা পাপের বা অন্ধকারের পথে গেলেও, ঈশ্বর আমাদের ছেড়ে যান না। যিশু খ্রিস্টকে তিনি আমাদের উদ্ধার করতে পাঠান। এখন আমরা সেই যিশুরই আগমনকাল উদ্যাপন করছি। আগমনকাল হলো প্রস্তুতির সময় বা অপেক্ষার সময়; এই অপেক্ষা হলো রাত্রি শেষে ভোরের প্রতিক্ষার মত। রাত্রির অপেক্ষা হলো বাতি জ্বেলে রাখা – অতিথিকে আলোতে বরন করে নেওয়া। তাই আগমনকালে গীর্জায় বা বাড়িতে চারটি বাতি প্রস্তুত করা হয়, যা চার সপ্তাহের প্রতীক। প্রত্যেক সপ্তাহে একটি করে বাতি বেশী জ্বেলে দেওয়া হয়; অর্থাৎ প্রথম সপ্তাহে ১ টি, দ্বিতীয় সপ্তাহে ২ টি, তৃতীয় সপ্তাহে ৩ টি এবং চতুর্থ সপ্তাহে ৪ টি বাতি জ্বালানো হয়। এইভাবে আমরা যিশুর আগমনের জন্য আমাদের অধীর আগ্রহে অপেক্ষার বিষয়টিই প্রকাশ করি।
আগমনকাল মন পরিবর্তনের সময়:
বড়দিনের জন্য বা যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনের জন্য অপেক্ষা করা বা প্রস্তুতি মানে হলো মন পরিবর্তন করা – অর্থাৎ পাপ থেকে মন ফিরানো। বড়দিনে যিশুকে বরণ করতে হলে, দীক্ষাগুরু সাধু যোহনের আহ্বান শুনে পাপ থেকে মন ফিরাতে হবে বা আমাদের মন পরিবর্তন করতে হবে। মন পরিবর্তন মানে হলো, আমাদের যাত্রা পথের দিক পরিবর্তন করতে হবে। পাপের পথ ছেড়ে পৃণ্যের পথে আসা; অন্ধকারের পথ ছেড়ে আলোর পথে আসা। আমাদের সব কিছুই তখন পরিবর্তিত হয়, এমনকি আমাদের চিন্তাধারাও। যারা দীক্ষাগুরু যোহনের কথায় মন পরিবর্তন করেছিল, তারা মন্দতা থেকে ভাল পথে, পাপের পথ থেকে ঈশ্বরের ভালবাসার পথে এসেছিল; আর তারা বাহ্যিক দৃশ্যমান চিহ্ন দেখিয়ে তাদের মন পরিবর্তন করেছিল ও অনুতাপ করেছিল। তারা দীক্ষা নিয়েছিল, কিন্তু তা অর্থপূর্ণ হতো না যদি তারা মন পরিবর্তন না করতো। পোপ ফ্রান্সিস সেই কথাই বলেছেন, জলের দীক্ষা আসলে ব্যক্তিগত অনুতাপের বা মন পরিবর্তনের কথাই প্রকাশ করে। পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে যিশুর চরণতলে নিজেকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে আমরা আমরা বড়দিনের আসল উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারি। বড়দিন মানে তো শুধু সাজগোজ, খাদ্যখাবার, আনন্দ-উৎসব বা বাহ্যিকতা নয়। জাগতিক মনোভাব, অতিরিক্ত আরাম আয়েশ সন্ধান করা, আনন্দ বিলাসী জীবন যাপন, স্বার্থপর কল্যান খোঁজ করা ও অর্থ-সম্পদের পিছনে ছোটা বড়দিনের আসল অর্থকে ম্লান করে দেয়। তাই আগমনকাল আসলে এইসব কিচু থেকে মন পরিবর্তন করে যীশুকে অন্তরে বরণ করার জন্য প্রস্তুতির সময়।
জাগতিকতা ও পাপ ত্যাগ করা:
দীক্ষাগুরু যোহনের শিক্ষা হলো যা প্রয়োজন শুধু তা-ই রাখা. অতিরিক্ত যা তা দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া। তিনি নিজে খ্রিস্টকে বরণ করার জন্য কঠোর কৃচ্ছতার পথ ধরেছেন; চটের কাপর পড়ে মরুভূমিতে ৪০ দিন ধরে উপবাস করেছেন। পোপ ফ্রান্সিসের ভাষায় এটিই মন পরিবর্তনের প্রথম ও প্রধান বিষয়; জাগতিকতা ও পাপের পথ ত্যাগ করেই আমরা মুক্তিদাতা যিশুর পথ প্রস্তুত করতে পারি। আগমনকালের অন্য দিক হলো ঈশ্বরকে ও ঐশরাজ্যের অনুসন্ধান করা। পুণ্যপিতা বলেন যে জাগতিকতা ও পাপ পরিত্যাগ আমাদের আসল লক্ষ্য নয়, আমাদের প্রধান বা আসর লক্ষ্য হলোর এই ত্যাগের মাধ্যমে এর চেয়েও বড় কিছু লাভ করা, অর্থাৎ স্বর্গরাজ্য, ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন বা বন্ধুত্ব লাভ করা।
মন পরিবর্তন হলো একটি ঐশ অনুগ্রহ:
ঈশ্বর যাদের তাঁর নিজের কাছে টেনে আনেন, তারাই মন পরিবর্তন করতে সক্ষম। ঈশ্বর এই ব্যাপারে কোন পক্ষপাতিত্ব করেন না। তিনি সকল মানুষকেই দিয়েছেন মন পরিবর্তনের ঐশ অনুগ্রহ; কারণ তিনি চান যেন সকল মানুষই মন পরিবর্তন করে, আর তাঁর কাছে ফিরে আসে। যারা বলে যে সত্যিকারভাবে মন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তারা আসলে নিম্নতর এই পাপের স্বভাবটাকে ত্যাগ করে ঈশ্বরের কাছে ফিরে আসতে চায় না, কারণ জাগতিকতা, পাপের পথ, ইত্যাদি তাৎক্ষনিক আনন্দ ও সুখ দেয় যার আকর্ষণ তারা ত্যাগ করতে পারে না। কিন্তু এটা তো প্রকৃত সুখ আর আনন্দ নয়, এই জগতের অনেক কিছুই আমাদের আনন্দ ও সুখ দেয়, কিন্তু তা ক্ষনিকের জন্য, সেই ভাল লাগা স্থায়ী নয়। আমরা কিন্তু চিরস্থায়ী ভাল লাগা, সুখ-শান্তি আর আনন্দ পেতে চাই। তাই প্রিয় ভাই বোনেরা, এই সময়টা আমাদের জন্য প্রার্থনা ও ধ্যানে জেগে থাকার সময় – আর ঈশ্বরের কাছ থেকে অনুগ্রহ লাভের সময়। আমরা তাহলেই জাগতিক মিথ্যা ও মরিচিকাময় বিষয়গুলি ত্যাগ করে যা সত্য, সুন্দর ও চিরস্থায়ী তা লাভ করতে পারি।
আমাদের মধ্যে – অর্থাৎ আমাদের সমাজে, ধর্মপল্লীতে ও ধর্মপ্রদেশে – অনেক কিছুই আছে যা মিথ্যা, অন্যায্য, পাপময়। আমরাই তার জন্য দায়ী কারণ আমরা এই পৃথিবীটাকে মিথ্যা আর পাপের অন্ধকারে ভরে ফেলেছি। এখন আমরা নিজেরাই পাপের অন্ধকার ও জাগতিকতার বেড়াজালে ভীত ও বন্দি হয়ে আছি। নিজেদের দোষে ও অপকর্মে আমরাই কষ্ট পাচ্ছি। তবু আমরা আশাহত হব না বরং নব আশায় গাইব, “ঐ দেখ প্রভু আসেন, প্রভু আসেন ত্রাতা হয়ে, ত্রাতা হয়ে ধরা তলে”। যিশুই আমাদের সকল জাগতিকতা, পাপ, মিথ্যা, অন্ধকার, দুঃখ ব্যথা, হতাশা, ইত্যাদি থেকে রক্ষা করবেন। আগমন কালে আমরা সেই যিশুরই আগমনের কথা স্মরণ করি। তাই এই সময়টা আমরা তাঁর আগমনের জন্যই অপেক্ষা করি। তাঁকেই আমাদের অন্তরে বরণ করে নিব যেন তিনি আমাদের স্বর্গের আনন্দ আর সুখ এনে দেন। যিশু, তুমি এসো, আমাদের অন্তর মাঝে এসো; মারানাথা।
আপনাদের সেবায় খ্রিস্টেতে
বিশপ জের্ভাস রোজারিও