ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
পোপ ফ্রান্সিস, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ, নির্মলা হৃদয়ের পর্বদিন থেকে, ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ খ্রিস্টাব্দের একই পর্বদিন পালন পযর্ন্ত গোটা বছর “সাধু যোসেফ বর্ষ,” হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। পোপ তাঁর প্রৈরিতিক পত্র “Patris corde” বা পিতার হৃদয়ে (With a Father’s Heart) মাধ্যমে এই ঘোষণা দেন। এখন থেকে ১৫০ বছর আগে, পোপ ৯ম পিউস, সাধু যোসেফকে, সর্বজনীন মন্ডলির প্রতিপালক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। পোপ ৯ম পিউসের সেই ঘোষণার দেড়শত বছরের মাইল ফলককে স্মরণীয় ক’রে রাখার জন্য পোপ ফ্রান্সিস এই ঘোষণা দেন।
সাধু যোসেফ ছিলেন কোমলপ্রাণ এবং বাধ্য পিতা ঃ পোপ তাঁর প্রৈরিতিক পত্রের শুরুতেই বলেন, সাধু যোসেফ ছিলেন একজন অত্যন্ত প্রিয় পিতা, একজন স্নেহময় পিতা, একজন বাধ্যতার আদর্শ পিতা, একজন পিতা যিনি গ্রহণ করতে প্রস্তুত, একজন পিতা যার মধ্যে সৃজনশীলতার সাহস রয়েছে, একজন কর্মী পিতা এবং একজন পিতার প্রতিচ্ছায়া। পোপ, করোনা ভাইরাস বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, “এই মহামারি আমাদের পরিস্কারভাবে দেখিয়ে দিলো, সাধারণ মানুষ যারা আলোচনার মধ্যে নেই, যাদের দিকে আমাদের দৃষ্টি কম, তারা কীভাবে ধৈর্য্যসহকারে মানুষের জীবনে আশার সঞ্চার করছে।” সাধু যোসেফ ছিলেন এমনই একজন, যিনি নীরবে, আড়ালে উপস্থিত থেকে মুক্তির ইতিহাসে ভূমিকা রেখে গেছেন। সাধু যোসেফ প্রকৃতপক্ষেই একজন পিতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তিনি ছিলেন বাইবেলের প্রাচীন সন্ধি এবং নব সন্ধির সীমান্ত রেখায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন ব্যক্তি, যাকে খ্রিস্ট মন্ডলি পিতা বলেই শ্রদ্ধা করবে। যিশু নিজে তাঁর পালক পিতার মধ্যে ঈশ্বরের কোমল ভালোবাসা দেখেছিলেন। তিনি দুর্বল স্বভাবকে স্বীকার ক’রে আমাদের দেখিয়েছেন- ভয়, দোষত্রুটি, দুর্বলতা থাকা সত্বেও ঈশ্বর মানুষের মধ্যদিয়েই তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে থাকেন। পোপ বলেন, একমাত্র কোমল ভালোবাসা অন্যের দেওয়া দোষ থেকে রক্ষা করতে পারে। এভাবে ঈশ্বরের সঙ্গে পুর্নমিলিত হয়ে আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি তা হলো- ঈশ্বরের মধ্যে যে সত্য বিরাজমান তা আমাদের অভিযুক্ত করেন না, বরং আমাদের স্বাগত জানান। সাধু যোসেফ বরাবর ঈশ্বরের বাধ্য ছিলেন। এই গুণ দিয়েই তিনি মারীয়াকে রক্ষা করেছিলেন এবং যিশুকে শিখিয়েছিলেন ঈশ্বরের ইচ্ছার পথে চলতে। যিশুর প্রেরণ কাজে সহায়তা দিয়ে যোসেফ হয়ে উঠেছিলেন মুক্তির ইতিহাসে একজন সত্যিকার মুক্তির পালক।
ঈশ্বরের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন ঃ কাঠমিস্ত্রি সাধু যোসেফ পিতার ইচ্ছাকে গ্রহণ ক’রে মারীয়াকে শর্তহীতভাবে গ্রহণ করেছিলেন। পোপ বলেন, আজকের বিশ্বে দেখা যায় নারীগণ মানসিকভাবে, কথা দিয়ে, কতোভাবেই না সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু একজর বধূ ও নারী হিসেবে মারীয়া ছিলেন ঈশ্ব^রের প্রতি আস্থাশীল, নিজের প্রতি কী ঘটতে যাচ্ছে তা সম্পূর্ণ না বুঝেও ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পন করেছিলেন। অন্যদিকে যোসেফের আধ্যাক্তিক জীবন ছিলো বিশেষ গুণের- যে গুণের কারণে নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে বরং নানা প্রতিকূল, অসন্তেুাষ ও আশাহত না হয়ে পবিত্র আত্মার শক্তিতে আশান্বিত হয়ে জীবনকে সেই মতে গ্রহণ করার সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। এইভাবে ঈশ্বর সাধু যোসেফের মধ্যদিয়ে আমাদের বলেন, “ভয় করো না, তুমি সুখী বা অসুখী- তোমার বিশ্বাস প্রতিটি কাজকে অর্থবহ করে তোলেন এবং আমাদের উপলদ্ধিকে জাগ্রত করেন এই মর্মে যে, ঈশ্বর পাথুরে জমিতেও ফুলের বসন্ত তৈরি করতে পারেন।” সেই কারণে যোসেফ বাস্তবতাকে ক্ষণিকের জন্য গ্রহণ না করে ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেই সাধু যোসেফ আমাদের সাহস দেন যেনো আমরা মানুষকে তাদের মতো করে গ্রহণ করি এবং দুর্বলদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি প্রদর্শন করি।
সৃজনশীলভাবেই তিনি সাহসী এবং ভালোবাসার উদাহরণ ঃ সাধু যোসেফ যেভাবে তাঁর চলার পথে সমস্যার মোকাবেলা করেছেন- তাতে করে বলা যায় তিনি ছিলেন সৃজনশীল সাহসিকতার মানুষ- যিনি ঐশরিক শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, তিনি যেভাবে সুনির্দিষ্ট পারিবারিক সমস্যার মুখোমূখী হয়েছেন, আজকের বিশ্বে অনেক পরিবার সেইভাব সমস্যার সমুক্ষীণ হচ্ছে বিশেষ করে যারা দেশান্তরিত হয়েছে। বিশ্বে আজকে বাধ্য হয়ে যারা যুদ্ধ, সহিংসতা, নির্যাতন ও দরিদ্রতার কারণে মাতৃভূমি ত্যাগ করছে, সাধু যোসেফ তাদের জন্য বিশেষ প্রতিপালক। তিনি যেমন ছিলেন মারীয়া এবং যিশুর অভিভাবক, তেমনি আজকে তিনি মন্ডলিরও অভিভাবক। পোপ বলেন, বস্তুতপক্ষে- “যারা গরিব এবং প্রান্তিক, যারা মৃত্যুপথযাত্রী এবং কষ্টভোগী, অসুস্থ, যারা আগুন্তক, যারা কারাগারে বন্দি, ‘সন্তান’ হিসেবে তিনি তাদের রক্ষা করেন।” সুতরাং পোপের ভাষায়, “আমাদের অবশ্যই শিখতে হবে কীভাবে মন্ডলিকে এবং গরিবদের ভালোবাসতে হয়।”
তিনি পিতা, যিনি শিক্ষা দেন মূল্যবোধ, মর্যাদা এবং কাজের আনন্দ ঃ নাজারেথের কাঠ মিস্ত্রি হিসেবে যোসেফ আমাদের শিক্ষা দেন, কীভাবে উপার্জন ক’রে পরিবার চালাতে হয়। তিনি মূল্যবোধ, মর্যাদা এবং পরিশ্রমের আনন্দ দিয়ে পরিবারের প্রয়োজন মিটাতেন। সাধু যোসেফের উদাহরণ দিয়ে পোপ বলতে চান, আজকের দিনেও শ্রমিকের পরিশ্রমকে প্রশংসা এবং মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নবায়ন করতে হবে। পোপ বলেন, “কাজকর্ম হলো মুক্তিদায়ী কাজে অংশগ্রহণ, ঈশ্বর-রাজ্যের আগমন মসৃন করা, আমাদের প্রতিভা এবং ক্ষমতার উন্নতিসাধন করা এবং এসব দিয়ে সমাজ সেবা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় করা।” তিনি বলেন, “যে কাজ করে, সে ঈশ্বরের সঙ্গে সহযোগিতা করে এবং কোনো না কোনোভাবে সৃষ্টিও করে।” পোপ, সবাইকে অনুপ্রাণীত করে বলেন, “সবাইকে আবিষ্কার করতে হবে কাজের গুরুত্ব যেনো প্রতিটি মানুষকে ‘নয়া স্বাভাবিক’ অবস্থা থেকে বাদ না দেয়।” তিনি মহামারির কথা উল্লেখ করে বলেন, “কাজের গুরুত্ব বিবেচনা করে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে যেনো কোনো যুবক, কোনো ব্যক্তি, কোনো পরিবার কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।”
একজন পিতা যিনি প্রতিচ্ছবি হয়ে মারীয়া ও যিশুর জীবনে প্রবেশ করেছেন ঃ পোপ ফ্রাান্সিস বলেন, পৃথিবীতে যিশুর যে পিতৃরূপ আমরা দেখি- তা হলো স্বর্গস্থঃ পিতার প্রতিচ্ছবি। পোপ বলেন, “একজন ব্যক্তি শুধু সন্তান জন্ম দেওয়্রা মধ্যদিয়েই প্রকৃত পিতা হয়ে ওঠতে পারে না- কিন্তু সন্তানের প্রতি দায়বোধ ও প্রতিপালনের মধ্যদিয়ে প্রকৃত পিতা হয়ে ওঠে।” কিন্তু দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, আজকে অনেকেই এতিম এবং পিতৃহীন, যাদের মধ্যেও রয়েছে বাস্তব জীবন। তিনি আরোও বলেন, “পিতার উচিত হবে সন্তানের ওপর কর্তৃত্ব না ক’রে তাদের মধ্যে সম্ভাবনা গড়ে তোলা, যেনো স্বাধীনভাবে তারা নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।” তাই বলছি, “সাধু যোসেফ ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি নিজের বিষয় না ভেবে গুরুত্ব দিয়েছেন মারীয়া ও যিশুর বিষয়।” পোপ বলেন, “যোসেফের মধ্যে কোনো সময় হতাশা দেখা যায়নি- বরং ছিলো শুধু বিশ্বাস।” তাই আজকের বিশ্বে একজন প্রকৃত পিতা প্রয়োজন এবং একমাত্র সাধু যোসেফ হতে পারেন সেই প্রকৃত পিতার উদাহরণ। একজন প্রকৃত পিতা তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করেন। পোপ বলেন, একজন প্রকৃত পিতার কতো সম্পদ আছে সেটা বড় বিষয় নয়, কিন্তু একজন প্রকৃত পিতা হলেন তিনি- যিনি স্বর্গীয় পিতার প্রতিরূপ।
সাধু যোসেফের নিকট নিত্যদিনের প্রার্থনা ঃ পোপ ফ্রান্সিস বলেন, তিনি তাঁর জীবনের গত চল্লিশ বছরের অধিক সময় ধরে, প্রাতঃকালীন প্রার্থনা শেষে, সাধু যোসেফের নিকট প্রার্থনা করতেন। এমনই একটি প্রার্থনা পোপ তাঁর প্রেরিতিক পত্রের শেষে যুক্ত করে দিয়েছেন। প্রার্থনাটি হলো ঃ-
“জয়তু হে মুক্তিদাতার রক্ষাকারি, হে পূণ্যময়ী মারীয়ার স্বামী।
তোমার কাছে ঈশ্বর তাঁর একমাত্র সন্তানকে স্থাপন করেছিলেন,
তোমার মধ্যে মারীয়া তাঁর আস্থা রেখেছিলেন।
তোমার মধ্যদিয়েই খ্রিস্ট মানুষ হয়েছেন।
হে যোসেফ, তুমি আমাদের কাছেও পূণ্যমন্ডিত।
তুমি একজন পিতা হিসেবে আমাদের জীবন পথে পরিচালিত করো।
আমাদের অনুগ্রহ, দয়া এবং সাহস দান করো এবং সমস্ত মন্দতা থেকে আমাদের রক্ষা করো। আমেন।
পোপ “সাধু যোসেফ বর্ষ” ঘোষণা করেছেন
Please follow and like us: