ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
(প্রতি বছর ক্যাথলিক চার্চ ১ জানুয়ারি, ঈশ্বর জননী ধন্যা কুমারী মারীয়ার মহাপর্বদিনে বিশ্ব শান্তি দিবস পালন করে থাকে। পোপ ৬ষ্ঠ পল ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি এই বিশ্ব শান্তি দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণানুসারে ১ জানুয়ারি, ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর বিশ্ব শান্তি দিবস পালিত হয়ে আসছে এবং প্রতি বছর পোপ, এই বিশ্ব শান্তি দিবস উপলক্ষে বিশেষ বাণী দিয়ে থাকেন)।
১. ভূমিকা ঃ যত্ন নেওয়ার সংস্কৃতি হলো শান্তির পথ (A Culture of Care as a Path of Peace) বা শান্তির পথ হিসেবে যত্ন নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। পোপ ফ্রান্সিস ৫৪তম বিশ্ব শান্তি দিবস উপলক্ষে তাঁর বাণী এভাবেই শুরু করেছেন। পোপ বলেন, “নয়া বছরের সূচনালগ্নে আমি শুভেচ্ছা জানাতে চাই বিশ্বের সরকার, আর্ন্তজাতিক সংস্থার নেতা, ধর্মীয় নেতা ও তাদের অনুসারি ও সদিচ্ছাপূর্ণ নারী পুরুষদের। আমি সবাইকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে বলতে চাই যে, নতুন বছর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে, মানবতা, ব্যক্তি ও সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও জাতির মধ্যে ন্যায় ও শান্তির সক্ষমতা এগিয়ে যাবে।” তিনি বলেন, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ করোনা ভাইরাস মহামারি বিশ্বের সকল প্রান্ত-সীমা অতিক্রম ক’রে পরিবেশ, খাদ্যসামগ্রী, অর্থনীতি ও অভিবাসন নীতির মধ্যে আন্ত:সর্ম্পকিত ও অসহনীয় কষ্টের- বিশেষ করে যারা পরিবারের সদস্য ও স্বজন এবং কর্মক্ষেত্র হারানোর কারণ হয়েছে। পোপ বলেন, তাদের বিষয়ও চিন্তা করি, যারা চিকিৎসক, নার্স, ঔষধ প্রস্তুতকারি, গবেষক, স্বেচ্চাসেবক এবং যারা হাসপাতল ও স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িত। তারা অনেক করেছেন এবং এখনোও ত্যাগস্বীকার করে যাচ্ছেন- রোগীসেবা এবং তাদের কষ্ট লাঘব ও জীবন রক্ষার জন্য এবং অনেকে এই সেবা দিতে গিয়ে প্রাণও দিয়েছেন। আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের পুর্নবার বলতে চাই যে, এই মহামারির টিকা যেনো প্রযুক্তিগতভাবেই যারা অসুস্থ, যারা গরিব এবং যারা প্রান্তিক তাদের জন্য যেনো নিশ্চিত করা হয়। অনেকে এই ক্ষেত্রে তাদের ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববন্ধনের সাক্ষ্য বহন করার পরেও এটা দুঃখজনক যে, অব্যাহত থাকা নানা রকম জাতীয় স্বার্থ, বর্ণবাদ, যুদ্ধ-সংঘর্ষ শুধু মৃত্যু ও ধ্বংসই ডেকে আনবে। চলতি বছরের নানা মানবিক ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, একে অন্যের যত্ন ও সৃষ্টির যত্ন নেওয়ার মধ্যদিয়ে একটি ভ্রাতৃ-সমাজ গড়া আরোও কতো গুরুত্বপূর্ণ। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “এই কারণে আমি বেছে নিয়েছি- যত্নের সংস্কৃতি হলো শান্তির পথ।”
২. সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর হলেন আমাদের মানব সেবার উৎস ঃ বিশ্বের বহু ধর্মই- মানুষের উৎস, সৃষ্টিকর্তা ও প্রকৃতির সঙ্গে তাদে এবং তাদের সহ-সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনার মধ্যে রাখে। তিনি বলেন, বাইবেলের আদিপুস্তকের প্রথম পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘যত্ন এবং সুরক্ষা,’ মানবতার জন্য ঈশ্বরের পরিকল্পনা। এই সম্পর্কের উজ্জ্বল দিকটা হলো, মানুষ ও বিশ্ব সম্পর্ক এবং আমরা সবাই ভাই-বোনসরূপ। “ঈশ্বর প্রভু এ্যাডেনে এক উদ্যান তৈরি করলেন এবং সেই উদ্যানে নিজের নির্মিত মানুষকে রাখলেন (আদি ২:৮)।” তারপর, “সদাপ্রভু আদমকে লয়ে এ্যাডেন উদ্যানে কৃষিকাজ ও রক্ষার্থে সেখানে রাখলেন (আদি ২:১৫)।” আদি পুস্তকে এই বাণীর অর্থ হলো, পৃথিবীকে ফলবান করো এবং রক্ষা করো। আদি পুস্তকে বর্ণিত কেইন ও আবেল হলেন, বিশ্বের ভাই-বোনদের ইতিহাসের শুরু। যদিও কেইন তার ভাইকে রক্ষা না করে ভুল করেছিলো। কেইন তার ভাইকে হত্যার পর ঈশ্বরের ডাকে উত্তর দিয়েছিলো, “পরে সদাপ্রভু কেইনকে বললেন, তোমার ভাই আবেল কোথায় ? কেইন উত্তর দিলো, আমি জানি না, আমি কি আমার ভাইয়ের রক্ষক (আদি ৪:৯) ?” কেইনকে কিন্তু তার ভাই আবেলের রক্ষক হওয়ারই কথা ছিলো। কিন্ত ঈশ্বর চান আমরা সবাই ভাইয়ের রক্ষক হই। বাইবেলের এই কাহিনী আমাদের শিক্ষা দেয়, যেমন- আমাদের জীবনকে সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া, অন্যের প্রতি ন্যায্যতা ও বিশ্বাস যা একই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন।
৩. সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর হলেন সেবা/যত্নের আদর্শ ঃ পবিত্র বাইবেল ঈশ্বরকে শুধু সৃষ্টিকর্তা হিসেবেই উল্লেখ করেনি, কিন্তু তিনি এমন এক ঈশ্বর যিনি সৃষ্টিরও যত্ন নেন। ঈশ্বর মানুষকে অমর্যাদাপূর্ণ না রেখে তিনি তাঁর প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন এই পরিকল্পনা নিয়ে- মানুষ যেনো সৃষ্টির মধ্যে ভারসাম্য ও সৃষ্টিকে রক্ষা করতে পারে। পোপ বলেন, “শান্তি এবং সহিংসতা একসঙ্গে থাকতে পারে না।” ঈশ্বর যে বিশ্রামকালের কথা বলছেন, সেখানে ঈশ্বরের সেবা করতে হবে এবং সেইসঙ্গে সৃষ্টির মধ্যেও ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি বলা হয়েছে। “কিন্তু সপ্তম বছরে ভূমির বিশ্রামের জন্য বিশ্রামকাল, সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে বিশ্রামকাল হবে। তুমি নিজের ভূমিতে বীজ বপন করবে না এবং নিজের দ্রাক্ষালতাও ঝুড়িও না (লেবীয় ২৫:৪)।” তার অর্থ হলো, প্রতি সপ্তম বছরে ভূমির জন্য, দাসদাসী এবং যাদের কাছে আমরা ঋণী তাদের জন্য এই বিশ্রামকাল হবে অবসরের কাল। এই দয়ার বছরে যত্ন নেওয়া এবং জীবনকে সুন্দর হয়ে ওঠার জন্য সুযোগ দেওয়া যেনো মানুষের মধ্যে কেউ দরিদ্র না থাকে (দ্বিতীয় ১৫:৪)। প্রাচীনকালের প্রবক্তাগণ, সমাজের দরিদ্রদের প্রতি অন্যায্যতার ব্যবস্থা সৃষ্টি না করে ন্যায় স্থাপনের কথা বলে গেছেন। “কারণ তারা রুপোর বিনিময়ে ধার্মিককে, ও একজোড়া পাদুকার বিনিময়ে দরিদ্রকে বিক্রি করে দিয়েছে; তারা দুর্বলের মাথা ধুলায় মাড়িয়ে দেয় ও বিনম্রদের পথ বক্র করে (আমোস ২:৬-৭)।”
৪. যিশুর পালকীয় কাজে যত্ন ঃ যিশু তাঁর প্রৈরিতিক কাজের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করেছেন- মানব সমাজের প্রতি ঈশ্বরের ভালোবাসাকে। সমাজগৃহে যিশু নিজেকে প্রকাশ করেছেন একজন অভিষিক্ত হিসেবে এবং এব্যাপারে সাধু লুক তাঁর মঙ্গলসমাচারে লিখেছেন, “প্রভুর আত্মিক প্রেরণা আমার ওপর নিত্য অধিষ্ঠিত, কারণ প্রভু আমাকে অভিষিক্ত করেছেন। তিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন দীনদরিদ্রের কাছে মঙ্গলবার্তা প্রচার করতে, বন্দীর কাছে মুক্তি আর অন্ধের কাছে নবদৃষ্টি-লাভের কথা ঘোষণা করতে, পদদলিত মানুষকে মুক্ত করে দিতে এবং প্রভুর অনুগ্রহদানের বর্ষকাল ঘোষণা করতে (৪:১৮-১৯)।” এতে প্রমাণিত হয়- পিতা ঈশ্বরের কাছ থেকে তিনি এই প্রৈরিতিক কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি তাঁর করুণাগুণে রোগাক্রান্তকে কাছে টেনে সুস্থ করেছেন, পাপীকে পাপমুক্ত করে নতুন জীবন দিয়েছেন। কারণ যিশু ছিলেন উত্তম মেষপালক যিনি তাঁর মেষদের যত্ন নিতেন। “আমি প্রকৃত মেষপালক। আমি আমার মেষগুলোকে জানি আর আমার মেষগুলোও আমাকে জানে (যোহন ১০:১৪)।” পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “যিশু নিজে ছিলেন একজন উত্তম সামারীয় পথিক, যিনি চলার পথে আহতদের সাহায্য করেন এবং তাদের ক্ষত বেঁধে দিয়ে যত্ন নেন।” যিশু তাঁর জীবন বিসর্জন দিয়ে চূড়ান্তভাবে আমাদের জন্য ভালোবাসার পথ উন্মুক্ত করেছেন এবং আমাদের বলেছেন, “আমাকে অনুসরণ করো এবং সেইমতো কাজ করো।”
৫. যিশুর অনুসারিদের মধ্যে সেবা/যত্নের সংস্কৃতি ঃ প্রাচীনকাল থেকেই খ্রিস্ট মন্ডলি অনুশীলন করে আসছিলো আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক দয়া কাজের সংস্কৃতি। আদি খ্রিস্ট মন্ডলিতে খ্রিস্টের অনুসারিগণ এই দয়ার কাজটি ভালোভাবেই করতো (শিষ্য ৪:৩৪-৩৫)। তারা তাদের খ্রিস্টসমাজকে একটি স্বাগতম আবাস হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তারা সব সময়ের জন্য মানবিক প্রয়োজন এবং যারা প্রকৃতপক্ষে অভাবী তাদের পাশে দাঁড়াতেন। এটা তাদের জন্য একটা প্রচলিত নিয়মই হয়ে উঠেছিলো- দরিদ্রদের প্রয়োজন মেটানো, মৃতদের সংস্কার, এতিম ও প্রবীণদের এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে দাঁড়ানো। পরবর্তীকালে মানুষের মধ্যে আদিসমাজের এই উদ্যোগটি হারিয়ে গেলে মন্ডলির পিতৃগণ ঘোষণা দেন এই বলে যে, “বিষয়-সম্পত্তি হলো সব মানুষের মঙ্গলের জন্য।” এই প্রসঙ্গে সাধু আমব্রুজ বলেন, “প্রকৃতির মধ্যে সবকিছু স্থাপন করা হয়েছে সবার ব্যবহারের জন্য এবং তাতে রয়েছে সবার সম-অধিকার। কিন্তু লোভ-লালসা এই অধিকারকে অল্প কিছু মানুষের অধিকার করে তুলেছে।” প্রথম শতাব্দির দিকে নারকীয় হত্যার পর মন্ডলি নতুন করে সমাজ ও সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিতে শুরু করে। সেটা ছিলো সময়ের প্রয়োজনে খ্রিস্ট মন্ডলির দান ও সেবা কাজ। সেই সময় থেকেই হাসপাতাল, এতিমখানা, গরিবদের আবাস নির্মাণ ও মানুষের প্রয়োজনে মন্ডলিতে নানা সাহায্য সংস্থা গড়ে উঠে।
৬. মন্ডলির সামাজিক নীতির মূল ভিত্তি হলো যত্নের সংস্কৃতি ঃ মন্ডলির সামাজিক নীতি শতাব্দিকাল ধরে পিতৃগণের ধ্যান-ধারণায় পরিপুষ্টতা লাভ ক’রে সক্রিয়ভাবে দানশীল কাজের মধ্যদিয়ে বিশ্বাসের সাক্ষ্য বহন করে আসছে। এই আদর্শিক বিষয়গুলো শুভ-বুদ্ধির মানুষের কাছে মূল্যবান পৈত্রিক নীতি, যেগুলো সেবার ব্যকরণ হিসেবে বিরাজ করছে, যেমন- প্রতিটি মানুষের মধ্যে মর্যাদা বৃদ্ধির দায়িত্ব, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের প্রতি সহানুভূতি, সবার জন্য সমান মঙ্গল সাধন এবং প্রকৃতিকে রক্ষার চেতনা, ইত্যাদি।
= যত্ন হলো প্রতিটি মানুষের মর্যাদা ও অধিকার বৃদ্ধি ঃ খ্রিস্টধর্ম মানুষ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তা হলো, পরিপূর্ণভাবে মানুষ হয়ে উঠার জন্য সন্ধান করা। মানুষ সব সময় অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত- ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, পরিপূর্ণ- অপরিপূর্ণ নয়, সে অনন্য এবং তার মধ্যে রয়েছে অলঙ্ঘনীয় মর্যাদা- কোনো শোষণ নয়। প্রতিটি নারী পুরুষের মধ্যে যে উদ্দেশ্য বিদ্যমান- তা শুধু নিজের প্রয়োজন ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে- পরিবার, সম্প্রদায় ও সমাজের সঙ্গে বসবাস করার জন্য, যেখানে সবার মর্যাদা সমান। এই মর্যাদাদান থেকেই মানুষ তার অধিকার লাভ করে। তাই পোপ বলেন, “মানুষের কর্তব্য হলো, গরিব, অসুস্থ, কাছের-দূরের, সময়ের দূরত্বে, বিদেশী- সবাইকে প্রতিবেশী হিসেবে অভিনন্দন জানানো।”
= সর্বে-মঙ্গলের জন্য যত্ন ঃ সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক জীবন তার পূর্ণরূপ ধারণ করে, যখন তা সর্বসাধারণের মঙ্গল ও সেবার জন্য গ্রহণ করা হয়। অন্য কথায়, এইসব সামাজিক ব্যবস্থাপনার কারণে মঙ্গল সাধন দলগত হতে পারে বা ব্যক্তিগত হতে পারে। পোপ বলেন, “আমাদের সব নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে গোটা মানব জাতির জন্য এবং সেই সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ফলাফল চিন্তা করে।” এই প্রসঙ্গে পোপ কোভিড- ১৯ মহামারির বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, “আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি যে আমরা একই নৌকায়- ভয়ার্ত ও দিক নির্দেশনাহীন। কিন্তু একই সময়ে এটাও গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় যে, এটা আমাদের এক সারিতে এনে দাঁড় করিয়েছে।” সুতরাং বলা যায়, “কেউ নিজে শুধু সমাধান লাভ করতে পারে না” এবং কোনো রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন থেকে নিজের জনগণের মঙ্গল নিশ্চিত করতে পারে না।
= সংহতির/সহমর্মিতার মধ্যদিয়ে যত্ন ঃ সংহতি বা সহমর্মিতা হলো অন্যের জন্য আমাদের ভালোবাসা। “এই ভালোবাসা অসার বা ভাবাবেগ নয় কিন্তু প্রত্যেকের এবং সবার জন্য মঙ্গল সাধন, কারণ আমরা এই কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।” সহমর্মিতা আমাদের অন্যকে বুঝতে সাহায্য করে- যা ব্যক্তি ও জাতির উর্ধ্বে বা কোনো গণনায় পরিমাপযোগ্য নয় বা এমনও নয় যে, একবার ব্যবহার করে বাতিল করলাম। কিন্তু বাস্তবে সবাইকে আমাদের প্রতিবেশী গণ্য করে সবার সঙ্গে যাত্রা আর এই যাত্রা হলো ভোজসভায় অংশগ্রহণের যাত্রা যেখানে মিলিত হবার জন্য ঈশ্বর আমাদের সবাইকে সমানভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
= যত্ন এবং সৃষ্টিকে রক্ষা ঃ ‘তোমার প্রশংসা হোক’ সর্বজনীন পত্র উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, সৃষ্টির সবকিছু একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই সর্বজনীন পত্র আমাদের বিশেষভাবে বলে, যেনো আমরা গরিবদের কান্না এবং সৃষ্টির কান্নাও শুনতে পাই। আমাদের বিরামহীন চেষ্টা ও মনোযোগ দিতে হবে পৃথিবীর যত্ন, আমাদের সবার ধরিত্রী এবং ভাই-বোনদের প্রয়োজনের বিষয়টির প্রতি। বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি আমাদের উপলব্ধি যথেষ্ঠ নয়- যদি আমাদের হৃদয় মন ভাই-বোনদের প্রতি অনুরাগ, সদয় না থাকে। শান্তি, ন্যায় এবং প্রকৃতির যত্ন- একটি চলে আসা পরস্পরযুক্ত প্রশ্ন, যা আলাদা করা সম্ভব নয়।
৭. একটি দিক নির্ণয়কারি যন্ত্র যা পথ নির্দেশ করে ঃ কর্তৃত্বকারি এই সময়ের প্রভাবে সংস্কৃতির অপচয় এবং মানুষ ও জাতির মধ্যে অসমতা তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়ে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “আমি রাষ্ট্র ও আর্ন্তজাতিক সংস্থার প্রধানগণ, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানি, গণমাধ্যম কর্মী ও শিক্ষাবিদদের আহ্বান জানাচ্ছি এই বিশ্বায়নের যুগে একটি সর্বজনীন গ্রহণীয় দিক নির্দেশনা গ্রহণ ক’রে একটি সুন্দর মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে।” এই দিক নির্দেশনা হাতে নিলে মানুষের মর্যাদা রক্ষা, সবার মঙ্গলের জন্য ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন, দারিদ্র বিমোচন, রোগব্যাধী, দাসত্ব নির্মূল, অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর হবে। পোপ বলেন, “আমি সবার কাছে আবেদন করছি, আপনারা এই দিক নির্ণয়কারি যন্ত্রটি হাতে নিয়ে প্রাবক্তিক ভুমিকা গ্রহণ করুন, যাতে সামাজিক বিভাজন দূর ক’রে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়।” তিনি বলেন, “সমাজ-নীতির এই দিক নির্দেশনা অনুসরণ করলে- সংস্কৃতির যত্ন বৃদ্ধি, সমাজ ও জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আর্ন্তজাতিক বিধান পর্যবেক্ষণকে অনুপ্রাণীত করবে।” তিনি আরোও বলেন, মানবতার যে বিধান রয়েছে, আমাদের সেগুলো মান্য করতে হবে- যাতে চলমান নানা সংঘর্ষ বন্ধ করা সম্ভব হয়। পরিতাপের বিষয় হলো, অনেক সম্প্রদায় ও অঞ্চলের মানুষ ভুলে গেছে কখন তাদের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা বিরাজ করছিলো। গোলা বারুদ, অস্ত্রের শাসন অনেক অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রার ছন্দ ব্যাহত করছে। সন্তানরা পড়ালেখা করতে পারছে না, নারী-পুরুষ তাদের পরিবার ভরণ পোষণ করতে পারছে না, খরা-দুর্ভীক্ষ যেসব অঞ্চলের মানুষ দেখেনি, সেখানে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ তাদের পিছনে- বাড়ি-ঘর, পারিবারিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির শিকড় ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। পোপ তাঁর ভাষায় বলেন, মানুষের জীবনে অনেক অগ্রাধিকার রয়েছে, যেমন- নিরাপত্তা, শান্তি স্থাপন, মানব উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন ও স্বাস্থ্যসেবা- কিন্তু এগুলোর গুরুত্ব না দিয়ে অযথা অস্ত্র কারখানা, আনবিক বোমার পিছনে কতো সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, “একটা সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে, মরণাস্ত্র তৈরি বন্ধ করে সেই অর্থ দিয়ে একটা তহবিল গঠন করতে হবে যাতে বিশ্ব থেকে ক্ষুধা দূরীকরণ ও পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে সাহায্য করে উন্নত করা সম্ভব হয়।”
৮. সংস্কৃতি যত্নের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম ঃ যত্নের এই সংস্কৃতি বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা কার্যক্রম অপরিহার্য। এই প্রসঙ্গে পোপ ফ্রান্সিস এখানে কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরেছেন ঃ-
– যত্নের সংস্কৃতি শুরু করতে হবে পরিবারে। এই পরিবারেই শুরু হতে পারে কীভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে সবাই বসবাস করতে পারে। পরিবারকে অবশ্যই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি দেখভাল করতে হবে।
– পরিবার ছাড়াও স্কুল-কলেজে অনুশীলন করতে হবে। এই ব্যাপারে গণমাধ্যমকেও দায়িত্ব পালন করতে হবে- যেনো, প্রতিটি মানুষের মর্যাদা, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মৌলিক অধিকার স্বীকৃতিলাভ করতে পারে। ন্যায় ও ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা হলো একটি স্তম্ভ্য।
– ধর্ম এবং ধর্মীয় নেতাগণ ও তাদের অনুসারিরা বৃহত্তর পরিসরে মূল্যবোধ, সমাজের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা থাকা সত্বেও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং অভাবী ভাই-বোনদের প্রতি সহানুভূতি থাকা।
– সরকারের সেবা প্রতিষ্ঠান, সরকার ও আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যারা যেখানে কর্মরত রয়েছেন, তারা বিভিন্ন উপায়ে এব্যাপারে জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে পারেন।
৯. সেবা/যত্বের সংস্কৃতি ছাড়া শান্তি সম্ভব নয় ঃ যত্নের এই সর্বজনীন সংস্কৃতির অনুশীলন ক’রে মানুষের মর্যাদা ও কল্যাণ বৃদ্ধি, শ্রদ্ধা-সহানুভুতির মাধ্যমে সমাজে পুর্নমিলন ও গ্রহণযোগ্যতা স্থাপন করা যায়। পোপ বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য- দরকার শান্তির পথ।” সেই সঙ্গে শুভ চেতনার নর নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে- শান্তি স্থাপনের জন্য। মানবতা যে বর্তমান সংকট ও কষ্টের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে হাল ধরা এবং দিক নির্ণয় গ্রহণ করা, যাতে সামজিক মর্যাদা ও মৌলিক সামাজিক নীতি স্থাপন করা সম্ভব হয়। খ্রিস্টান হিসেবে আমাদের অবশ্যই অনুকরণ করতে হবে মা মারীয়াকে- যিনি হলেন ‘সাগরের ধ্রুবতারা এবং আশার জননী।’ পোপ সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন আমরা ভালোবাসা ও শান্তি, ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন, পারস্পরিক সমর্থন এবং গ্রহণযোগ্যতার নতুন দিগন্ত গড়ার জন্য একসঙ্গে এগিয়ে যাই। আমরা অন্যের বিরুদ্ধে প্রলোভন এবং অমর্যাদার বীজ বপন না ক’রে যেনো “একে অন্যের প্রতি যত্নশীল হ’য়ে- একটি গ্রহণযোগ্য ভাই-বোনের সমাজ গঠন করি।”
পোপ ফ্রান্সিস, ৮ ডিসেম্বর- ২০২০, ভাটিকান সিটি।
৫৪তম বিশ্ব শান্তি দিবস উপলক্ষে পোপের বাণী
Please follow and like us: