পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস ১লা জানুয়ারি ২০২১ খ্রিস্টাব্দ বিশ্বশান্তি দিবসে তাঁর বাণীতে যথার্তই বলেছেন, “যত্নের সংস্কৃতিই শান্তির পথ”। এই কথার অর্থ হলো ভালবাসা দিয়েই আমরা শান্তি অর্জন করতে পারি। ভালবাসা ছাড়া যত্ন সম্ভব নয়! আমরা সকল মানুষেরা যদি পরস্পরকে অকৃত্রিমভাবে ভালবাসি তাহলে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন অসম্ভব নয়। সেই অকৃত্রিম ভালবাসাই আমরা চাই; সকলেই আমরা চাই যেন অন্যরা আমাদের সেইরকম ভালবাসায়ই ভালবাসে। আর আমরা তা কিভাবে পেতে পারি? সেই ভালবাসা আমরা পেতে পারি যদি মঙ্গল সমাচারে যিশুর শিক্ষা অনুসারে আমরা অন্যদের অকৃত্রিম ও বৈষম্যহীনভাবে ভালবাসি। তাহলে আর দেরী কেন, অন্যদের জন্য অপেক্ষা কেন? আমিই কেন শুরু করছি না? সেটিই খাঁটি কথা, আমি আর তুমি চল অকৃত্রিম ভালবাসায় অন্যদের প্রথম ভালবাসতে আরম্ভ করি!
যত্নের সংস্কৃতি আসলে ভালবাসারই সংস্কৃতি – আর তা কোন বস্তু বা জিনিষ নয়, এটা অনুশীলনের বিষয়। তার মানে এই কথাটি বলা যত সহজ অনুশীলন করা তত সহজ নয়। ভালবাসা ভাল লাগে, কিন্তু ভাল লাগা ভালবাসা নয়। কাউকে ভালবাসলে আমরা তাকে যত্ন করি – তাকে অনুভব করি ও তাকে অন্তরে বহন করি। তার যত্ন করতে গিয়ে আমরা কষ্ট করি, ত্যাগস্বীকার করি। মা যেমন তাঁর সন্তানকে ভালবাসে বলে তার জন্য কষ্ট করে, ত্যাগস্বীকার করে। সেই ভালবাসা আসে ঈশ্বরের কাছ থেকে; ঈশ্বরই সকল ভালবাসা ও যত্নের উৎস ও আদর্শ। তিনিই বিশ্বব্রম্মান্ডের সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। আমরা যদি ঈশ্বরকে ভালবাসি তবেই ঈশ্বরের ভালবাসা ও যত্নের আদর্শ আমরা গ্রহন করব। আমাদের জীবনে ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে আমরা ভালবাসার কথা ভাবতেও পারি না।
আমরা খ্রিস্টানরা যিশু খ্রিস্টের উপর বিশ্বাসী, আর তাঁর আদর্শ অনুসরণ করি। যিশু তাঁর মর্ত্য-জীবনে ভালবেসেছেন সকলকে আর যত্ন করেছেন সব কিছুকে। তিনি বিশেষভাবে ভালবেসেছেন দরিদ্রদের, অসহায় বিধবা ও শিশুদের, অসুস্থ-পীড়িতদের ও কুষ্ঠরোগীদের, অপদূতগ্রস্থদের ও অপ্রকৃতিস্থদের, সমাজের যারা নিম্ন শ্রেনীর মানুষ তাদেরকে, যারা পড়ে আছে সমাজের প্রান্তসীমায় তাদেরকে, আর অন্য সকলকে। তিনি ক্ষুধার্তদের খাবার দিয়েছেন, অসুস্থদের সুস্থ করেছেন, কুষ্ঠরোগীদের ও অপদূতগ্রস্তদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিয়েছেন, মৃত মানুষকেও পুনর্জীবন দিয়েছেন, মানুষদের যার যা নাই তিনি তা-ই দিয়ে তার অভাব মোচন করেছেন। প্রকৃতির উপরও তার কর্তৃত্ব ছিল – তিনি সাগরের ঝড় ও ঢেউ থামিয়েছেন এবং সাগরে মাছ ধরতে তিনি শিষ্যদের সহায়তা করেছেন। এইসব কিছু তাঁর ভালবাসা ও যত্নেরই বহিঃপ্রকাশ। যিশু জগতের মানুষকে পাপ ও অন্ধকার থেকে মুক্ত করে পরিত্রান দিতে নিজের জীবন ক্রুশের উপর বিষর্জন দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
যিশুর শিষ্যরা ও তাঁর উপর বিশ্বাসীরা যিশুকে অনুসরণ করে যিশুর মতই ঈশ্বরের সকল সৃষ্টি প্রকৃতি ও সকল মানুষকে ভালবেসেছেন। আর এই জন্য তারা তাদের জীবন বিষর্জন পর্যন্ত দিয়েছেন। আর তাতে এটাই প্রমানিত হয় যে ত্যাগস্বীকার ও কষ্টস্বীকার ছাড়া ভালবাসা হয় না। সেই জন্যই মণ্ডলীর সামাজিক শিক্ষায় ঈশ্বর ও মানুষের সেবার জন্য আমাদের আহ্বান করা হয়েছে। শুধু মানুষকে নয়, ঈশ্বরের সকল সৃষ্টিকেই ভালবাসা ও যত্ন করাই হলো যত্নের সংস্কৃতি। মানুষের সঙ্গে জীব-জন্তু আর প্রকৃতি ও পরিবেশকেও ভালবাসতে হবে, কারণ ঈশ্বর সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন সকল যুগের, সকল স্থানের ও সকল মানুষের জন্য। ঈশ্বরই সব আমাদের দিয়েছেন আর যত্নও করছেন। কিন্তু আমরা যদি তা যত্ন না করে ধ্বংস করি তাহলে তার বিরূপ প্রতিফলও আমাদেরই ভোগ করতে হবে।
যত্ন করা মানে সকল মানুষের মর্যাদা ও অধিকার তুলে ধরা। এটাই মঙ্গল সমাচার ও খ্রিস্টমণ্ডলীর শিক্ষা। তাই যত্ন করতে গিয়ে আমরা যেন মানুষের কোন অসম্মান বা অমর্যাদা না হয়। যত্ন করা মানে ভালবাসা, আর ভালবাসা না থাকলে যত্ন করা কখনোই সম্ভব নয়। মানুষকে ভাল না বাসলে অন্য কোন কিছুকেই সত্যিকারভাবে ভালবাসা সম্ভব নয়। মানব ব্যক্তি সকলেই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর তাই যীশুর শিক্ষা হলো আমরা যেন সকলকেই ভালবাসি ও যত্ন করি। এইভাবেই আসবে পরস্পরের সাথে মিলন ও শান্তি, যা হবে সামাজিক শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের শান্তি। বিশ্বশান্তি গড়ার এর চেয়ে বড় বিকল্প আর কি হতে পারে? তা হলে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বশান্তি গড়ার জন্য আমাদের যত্ন করতে হবে সকল মানুষকে আর ঈশ্বরের সকল সৃষ্টিকে।
ভালবাসাপূর্ণ যত্নই শান্তি স্থাপনের শক্তিশালী ও টেকসই পথ। স্বার্থপরতা ও অহঙ্কার নিয়ে আমরা প্রকৃতভাবে ভালবাসতে পারি না। ভালবাসতে আর যত্ন করতে হলে ত্যাগস্বীকার করতে হয়, স্বার্থত্যাগ করতে হয়। আমরা সকলেই যদি আমরা সেই স্বার্থত্যাগ ও ত্যাগস্বীকারের পথ ধরে পরার্থপর ভালবাসায় সকলকে যত্ন করতে পারি তাহলে পরস্পরের মধ্যে শান্তিপূর্ণ মিলন ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে পারব। তাই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত যত্নের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস ঠিকই বলেছেন, “যত্নের সংস্কৃতি ছাড়া শান্তি স্থাপন সম্ভব নয়”।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী