গত বছর অর্থাৎ ২০২০ খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকে অদ্যাবধি মানব জাতির এক মহাশত্রু কভিড ১৯ বা করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী সকল দেশের সকল মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছে। এই ভাইরাসের কোন ঔষধ না থাকায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দেশগুলিতে এরই মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুকোলে ঠাই নিয়েছে ও এখনো মৃত্যুর মিছিল বাড়াচ্ছে। তবে আশার বিষয় হলো এই যে এখন মৃত্যুর সংখ্যা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় আমাদের বাংলাদেশে অনেকটাই কমে এসেছে। আরো একটি বড় খবর হলো যে এরই মধেই আমাদের এই অদৃশ্য শত্রু করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে আর তা প্রয়োগও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বিচক্ষণতা ও দক্ষতার কারণে বাংলাদেশেও সীমিত আকারে এই করোনা টিকা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে লাখের উপরে এই টিকার ডোজ দেওয়া হচ্ছে। ভারতের সেরাম কম্পানি উৎপাদিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আবিষ্কৃত আস্ত্রা জেনেকার টিকা কিছু অনুদান হিসাবে পাওয়া আর বাকিটা কিনে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা এই টিকার আমদানিকারক। এখনো আরো অনেক টিকার ডোজ আমদানি করতে হবে বাংলাদেশকে। ভবিষ্যতে হয়তো অন্য কম্পানির টিকাও আমদানী করতে হবে। আস্ত্রা জেনেকা ছাড়াও ফাইজার, জনসন, ইত্যাদি কম্পানিগুলিও নিজস্ব টিকা তৈরী করেছে। তাছাড়া চিন দেশও তাদের করোনা টিকা আবিষ্কার করেছে। ভারত বাংলাদেশসহ অন্যান্য অনেক দেশই নিজস্ব করোনা টিকা আবিষ্কার করার চেষ্টায় আছে।
তবে ইতিমধ্যেই যে টিকা বের হয়েছে, আর যা আনা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় এখনো যে পর্যাপ্ত নয় তা বলাই বাহুল্য। এখন কারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই টিকা পেতে পারে সরকারিভাবে তার একটি নীতিমালা তৈরী করা হয়েছে। যারা স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, সরকারী কর্মকর্তা, ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ আগে এই টিকা পেতে পারেন। তবে বাংলাদেশ সরকার অতি বিচক্ষণতার সাথে ৪০ বছরের উপরে সকল নাগরিককেই প্রাথমিকভাবে এই টিকার আওতায় এনেছে। তবে অন-লাইনে নিবন্ধন করতে হয় বলে, এই টিকার আওতা থেকে অতি-দরিদ্র ও স্বল্প-শিক্ষিত জনগণ বাদ পড়ে যাচ্ছে। এই টিকা পাওয়ার অধিকার সকলেরই রয়েছে। সকলকেই যদি এই টিকার আওতায় আনা না হয় তাহলে সমাজে ও দেশে এই টিকার কার্যকারিতা থাকবে না। আর তাতে করণাও নির্মূল হবে না। এই করোনা টিকা পাওয়ার অধিকার ও আওতা থেকে কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না। এই টিকা পাওয়ার নৈতিক অধিকার সকলেরই আছে, সে গরীব বা ধনী যা-ই হোক।
তবে করোনা টিকা তৈরীর নৈতিকতাও বিচার্য্য বিষয়। কি দিয়ে বা কিভাবে এই টিকাগুলি আবিষ্কার বা তৈরী হচ্ছে তা আমাদের জানা দরকার। যারা এই টিকাগুলি আবিষ্কার করছে তারা খুলে বলছে না কিভাবে বা কি দিয়ে এই টিকা তৈরী হচ্ছে। তবে জানা গিয়েছে জনসনের টিকা তৈরী করা হয়েছে মানব ভ্রুণের সেল থেকে। ভ্রুণ হলেও সে পূর্ণ মানব মর্যাদা সম্পন্ন এক মানব ব্যক্তি। তবে জনসন ব্যবহৃত সেই ভ্রুণ অনেক পুরাতন এবং ক্লোন করা। তা হলেও যদি তা ইনডিউজ্ড বা স্বেচ্ছাকৃত গর্ভপাত করা হয়ে থাকে, তাহলে এই ভ্রুণের ক্লোন থেকে তৈরী করা করোনা টিকার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে একটি নৈতিক প্রশ্ন উঠতে পারে। আর প্রশ্ন হতে পারে এর তৈরী প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না হলে, আমাদের তা গ্রহণ করা উচিত হবে কি না!
একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে অন্য আর একজন মানুষ তাঁর জীবন উৎসর্গ করতে পারে – আর তা করা কোন অনৈতিক কাজ নয়, বরং নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। তাই করণা টিকা যদি মানব ভ্রুণ থেকেও তৈরী হয়, তাহলেও তা জীবন রক্ষার জন্য বলে তা গ্রহণ করা যায়। মানব ভ্রুণের ক্লোন করা সেল একজন মানব ব্যক্তি এই ক্ষেত্রে অন্য মানুষের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করছে। তবে আমাদের মনোভাব যদি হয় কার্নিভরাস (মাংসাশী), আর এই করোনা টিকা তৈরীর জন্য গর্ভপাত ঘটানো হয়, তাহলে তা নৈতিকভাবে কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই ক্ষেত্রে ইচ্ছা করে গর্ভপাত গ্রহণ করে বা জোরপূর্বক তার গর্ভপাত ঘটানো হয়, তাহলে তা মানুষ হত্যা করার শামিল হবে। ভ্রুণ হত্যা করা মানে মানুষ হত্যা করা। মানুষ হত্যা করে মানুষ বাঁচানো বা অন্য মানুষের জীবন রক্ষা করা গ্রহণযোগ্য নয়।
তবে নৈতিক বিচার করতে গেলে তা এক তরফা একমুখী করা যাবে না। নৈতিক বিচার হতে হবে সামগ্রিক বা এর সঙ্গে জড়িত সকল বিষয় বিবেচনা করে। এই টিকা মানব ভ্রুণের ক্লোন থেকে তৈরী হলেও, তা তো স্বয়ংক্রিয়ভাবে গর্ভপাত হওয়া ভ্রুণ থেকেও হতে পারে। আর তা ক্লোন করে বহুগুণ বৃদ্ধি করে অসংখ্য টিকা তৈরী করা সম্ভব। আর তাছাড়া এর সঙ্গে জড়িত আছে জীবনে প্রশ্ন। জীবন বাঁচানোর জন্য বা রক্ষার জন্য এই টিকা আবিষ্কার হয়েছে। তাই জীবন রক্ষাকারী এই টিকার নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং তা স্বার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। এই টিকা পাওয়ার অধিকার সকলের থাকলেও, তা গ্রহণ করতে কোন ব্যক্তিকে জোর জবরদস্তি করা যাবে না। টিকা নেয়ার বা না নেওয়ার অধিকারও সকলের আছে। তবে টিকা যদি জীবন রক্ষাকারী হয়, তাহলে জীবন রক্ষার জন্য সকলকেই এই টিকা গ্রহণ করতে হবে। নিজের জন্য না হলেও, পরিবারের ও সমাজের সকলের মঙ্গলের জন্য, সকল ব্যক্তিকেই তা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় এই জীবন নাশী ভাইরাস থেকে পৃথিবী মুক্ত হতে পারবে না।
তাই করণার যে কোন টিকাই গ্রহণযোগ্য হতে পারে যদি তা সকল নৈতিক মান দন্ড ও মানবিকতা ঠিক রাখা হয়। এখানে ভেক্সিন বা টিকা দেওয়া বা গ্রহণের ব্যাপারে কোন বৈষম্য করা যাবে না। জীবন রক্ষার অধিকার ও দাবী সকলেরই সমান। যারা এই টিকার মূল্য দিতে পারবে অথবা যারা প্রভাবশালী এবং যারা সরকারি কর্মকর্তা শুধু যদি তাঁরাই এই করোণা টিকা গ্রহণ করে তা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের সরকারের দায়িত্ব হলো এই বিষয়টি নিশ্চিত করা যেন দেশের ধনী গরীব সকলেই এই টিকা পায়। তাহলেই মাত্র আমরা আশা করতে পারব যে আমাদের দেশ করোনামুক্ত হবে।
করোনা ভাইরাসের একটি বিশেষ দিক হলো যে যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ও মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের মধ্যে শিশু ও তরুণদের সংখ্যা নগন্য; বরং নাই বললেই চলে। আর তাই করোনা ভাইরাসের প্রবল প্রতাপের সময় বা লক ডাউনের সময়ও শিশু ও যুবক-যুবতীরা মোটামুটি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা ও মেলামেশা কম বেশী চালিয়ে গেছে অথচ আক্রান্ত হয়েছে কম। আর দেখা গেছে বয়স্করা আক্রান্ত হয়েছে ও মৃত্যুবরণ করেছে বেশী। এখন সেই বয়স্করাই অফিস আদালত ও ব্যবসা বানিজ্য করে যাচ্ছে প্রায় স্বাভাবিকভাবে। এখন শিশু ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সরকার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছে। আগামী ৩০ মার্চ ২০২১ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি সরকারের বিশেষ নিয়ম ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু হতে যাচ্ছে। এই প্রস্তুতির জন্য প্রথমেই সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের করোনা টিকা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। খুব শীঘ্রই হয়তো যুবক-যুবতী ছাত্র-ছাত্রীরাও এই করোনা টিকার আওতায় এসে পরবে। শিশুদের জন্য তাদের উপযুক্ত টিকা তৈরীর প্রচেষ্টা চলছে; তাও হয়তো এসে যাবে। ধীরে ধীরে আমরা যেমন গ্রহণ করে নিচ্ছি আমাদের মধ্যে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব ও অবস্থান, তেমনি আমরা করোনা টিকা গ্রহণ করে আমাদের দেহে এর এন্টিবডি বা এন্টিজেন তৈরী করে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তুলছি। ভবিষ্যতে হয়তো করোনা ভাইরাস হবে একটি স্বাভাবিক বিষয় যার মোকাবেলা করার ক্ষমতা ও দক্ষতা আমরা অর্জন করব স্বাভাবিকভাবেই।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী