ফাদার সুনীল রোজারিও। খ্রিস্টজ্যোতি পালকীয় কেন্দ্র, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
পোপ ফ্রান্সিসের- ইরাক সফর ছিলো আধুনিককালের ধর্মীয় সংলাপ ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা। তিনি তাঁর যাত্রাপথে বিমানে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের বলেন, এই সফর হলো “শান্তির তীর্থ” এবং তিনি যে বাণী বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন তা হলো “তোমরা সবাই ভাই (মথি ২৩:৮)।” রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এবং ভাটিকান রাষ্ট্রের প্রধান পোপ ফ্রান্সিস গত ৫ মার্চ শুক্রবার থেকে চারদিনের ইরাক সফরের শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত সফরের উদ্দেশ্য থেকে এক পা সরে যান নি। তাঁর এই সফর ছিলো মূলতঃ যুদ্ধ বিধ্যস্থ প্রাচীন সভ্যতার দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে একটি সংলাপের সফর। সেই সঙ্গে ইরাকী নেতাগণও পোপের এই সফরকে তাদের দেশে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে একটি সংলাপ শুরুর আলচ্যসূচি হিসেবে দেখেছেন। সফরের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী মোস্তাফা আল-কাধিমী পোপকে বাগদাদ বিমান বন্দরে স্বাগত জানিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বলতে চেয়েছেন, পোপ ইরাকে এসেছেন শান্তির পায়রা হয়ে।
প্রধানমন্ত্রী কাধিমী, পোপের ইরাক সফরকে ভালোবাসা এবং সহনশীলতার বার্তা হিসেবে উল্লেখ করে ইরাকী জনগণকে জাতীয়ভাবে সংলাপের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইরাকে বিরোধী রজনৈতিক নেতাদের মধ্যেকার মতপার্থক্য নিরসন করার জন্য সংলাপের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং তাদের অনুধ্যান করতে হবে- পোপের ইরাক সফরের মূল উদ্দেশ্য, “ভালোবাসা এবং সহনশীলতা।” প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, “একমাত্র সংলাপই দেশের মধ্যেকার বিভাজনকে নির্মূল করতে পারে।”
পোপ তাঁর আন্তঃধর্মীয় সংলাপ শুরু করেন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পৌঁছেই। ইরাকী প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ্ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পোপকে বিশ্ব শান্তির প্রবক্তা হিসেবে স্বাগত জানান। প্রেসিডেন্ট ভবনে পোপ তাঁর ভাষণে বলেন, “আমি প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইরাকে আসতে পেরে খুবই আনন্দিত।” তিনি বলেন, “অস্ত্রের এই সংঘর্ষ নীরব হোক, যতো প্রকার অনিয়ম, সংঘাত, চরমপন্থা, দলীয় সংঘর্ষ ও অসহযোগ কর্মকান্ড নির্মূল হোক।” পোপ ফ্রান্সিস খ্রিস্টান জনগণের ব্যাপারে বলেন, “বহু শতাব্দি ধরে খ্রিস্টানগণ এই ভূ-খন্ডে বসবাস করে আসছেন এবং জাতিকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধশালী করছেন এবং এখনো তারা তা করে যাওয়ার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।” তিনি বলেন, “ইরাকে বহু ধর্ম এবং বহু জাতির বসবাস- যা উন্নয়নের অন্তরায় নয় বরং সহায়ক।” ইরাকে বহুকাল ধরে আঞ্চলিক ও দলীয় সংঘাৎ ও মৌলবাদের উত্থান, শান্তির বিরুদ্ধে একটা হুমকি হয়ে আছে। পোপ বলেন, “ইরাকী খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে সুযোগ দেওয়া উচিত- যেনো তারা তাদের অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন এবং সেইসাথে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে।”
প্রেসিডেন্ট বারহাম সালিহ্ ইরাকী জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে পোপকে প্রাচীন মেসোপটামিয় সভ্যতার- উর, মসুল, নাযাফ, আরবিল, নিনেভে ও কারাকাস শহর সফরে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “এই ভূমি হলো ভাববাদী ও স্বর্গীয় ধর্মের উৎসভূমি।” তিনি বলেন, “এই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন প্রবক্তাদের প্রবক্তা আদি পিতা আব্রাহাম এবং এই পবিত্র ভূমি বিশ্ববাসীর কাছে আরাধ্য।” প্রেসিডেন্ট সালিহ্ পোপকে আশ্বাস দেন- তিনি একটি স্থায়ী সংলাপ সম্মেলন কেন্দ্র গড়ে তুলবেন, যেখোনে দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠীর নেতা এবং ভাটিকান প্রতিনিধি সংলাপে উপস্থিত থাকবেন। সবশেষে প্রেসিডেন্ট পোপকে বলেন, “আমরা আমাদের ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করছি আর আপনার এই আগমন হলো ক্ষতের উপর সুস্থতার প্রলেপ।” প্রেসিডেন্ট পোপের এই সফরকে- নিরাপত্তা, সুস্থির, শান্তি ও মানবতার সফর হিসেবে উল্লেখ করে তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রেসিডেন্ট ভবনে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পোপ বাগদাদে অবস্থিত সাইরো ক্যাথলিক চার্চ, আওয়ার লেডী অব সালভেশন ক্যাথিড্রালে যান এবং সেখানে বিশপ, ফাদার, খ্রিস্টধর্মের নেতৃবৃন্দ, সেমিনারিয়ান ও ক্যাটেখিস্টদের সাথে এক সংলাপ বৈঠকে মিলিত হোন।
খ্রিস্টধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আওয়ার লেডী অব সালভেশন ক্যাথিড্রালে (খ্রিস্টধর্মের) সংলাপ সভার শুরুতেই পোপ বলেন, বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে নিরাপদ থাকার জন্য লকডাউন প্রয়োজন হলেও- যতো বাধা বিপত্তি থাকুক না কেনো, প্রৈরিতিক কাজের কোনো লকডাউন নেই। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, “আমাদের কাছে রয়েছে ঈশ্বরের দেওয়া সবচেয়ে বড় এবং কার্যকর ভ্যাকসিন, আর হা হলো- আশা নিয়ে প্রার্থনা এবং প্রৈরিতিক কাজের প্রতি বিশ্বস্থতা।” তিনি ঈশ্বরের দেওয়া দান- শক্তিশালী ভ্যাকসিন সম্পর্কে বলেন, “এর দ্বারা আমাদের শক্তিকে নবায়ন করতে পারি, যেনো মিশনারি শিষ্য হিসেবে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারি এবং ঈশ্বরের রাজ্যে পবিত্রতার, ন্যায্যতার এবং শান্তির দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারি।” পোপ খ্রিস্টধর্মের নেতাদের উদ্দেশ্যে আরো বলেন- “পুর্নমিলন এবং ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের জন্য বীজ বপন করতে হবে- যেনো সবাইকে আশায় পুর্নজন্ম হওয়ার দিকে চালিত করতে পারে।” তিনি বলেন, “খ্রিস্টের ভালোবাসা আমাদের শিক্ষা দেয়- ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা ও প্রতিযোগিতা দূরে ফেলে একটা সর্বজনীন ঐক্য স্থাপন করা- যাতে করে ভাই-বোনের বন্ধন গড়ে তুলতে পারি- যারা একে অন্যকে গ্রহণ করেন।” সবশেষে পোপ বলেন, “চিড়ধরা ও বিভাজিত বিশ্বে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের মধ্যদিয়ে স্বাক্ষ্যদান কতোই না জরুরি- তাই আমাদের প্রতিটি চেষ্টাই হতে হবে- ভক্তসমাজ, ধর্মপল্লী, ধর্মপ্রদেশ এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্যদিয়ে প্রাবক্তিক ভূমিকা গ্রহণ করা- যাতে করে ইরাকী চার্চ যিশুর সেই আহ্বানের উত্তর দিতে পারে, ‘প্রার্থনা করো যেনো সবাই এক হয়ে উঠে’।”
পোপের ইরাক সফরসূচিতে ছিলো ইরাকের প্রাচীন উর শহরে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। উর হলো আদি পিতা আব্রাহামের জন্মস্থান এবং আব্রাহামকে, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানগণ তাদের নবী হিসেবে জ্ঞান করে থাকে। উর সফরকালে পোপ উপস্থিত ইসলাম এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতাদের “শান্তির জন্য ঐক্য” ও ধর্মীয় সহনশীলতার বাণী উচ্চারণ করেন। পোপ তাঁর বাণীর শুরুতেই বলেন, “ঈশ্বরের আরাধনা এবং প্রতিবেশীকে ভালোবাসা হলো ধর্মের সারকথা, সত্যতা।” তিনি ইরাকী মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বৈরীতা ভুলে গিয়ে শান্তি ও ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
পোপ ফ্রান্সিস, ইরাকে ধর্মীয় বিভেদ ও কয়েক দশক ধরে চলে আসা সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরে তাঁর শান্তি. ভ্রাতৃপ্রেম ও ঐক্যের বাণী উপস্থাপনের জন্য- আদি পিতা আব্রাহামের জন্মস্থান এবং প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া পবিত্র উর শহর বেছে নেন। উর শহরে পোপ ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “এটা আমাদের মূলে, ঈশ্বরের কর্মের উৎসে- আমাদের ধর্মের জন্মস্থানে ফিরে যাওয়া।” তিনি বলেন, “এখানে আমরা আব্রাহামের সন্তান হিসেবে একত্রে প্রার্থনা করতে পারি।” পোপ তাঁর ভাষণে বলেন, “আমাদের পিতা আব্রাহামের এই জন্মস্থান থেকে বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, অতএব সত্যিকারভাবেই গ্রহণ করি যে, ঈশ্বর হলেন দয়াশীল। আর যদি আমরা আমাদের ভাই-বোনদের ঘৃণা করি তাহলে সেটা হবে ঈশ্বর নিন্দা।” তিনি এই প্রসঙ্গে আরো বলেন, “বৈরী স্বভাব, চরমপন্থা এবং বিবাদ ধর্মের অনুসারির আত্মায় জন্ম নিতে পারে না- সেটা হলে হবে বিশ্বাস ঘাতকতা করা।” তাঁর মতে, ইরাকে কখনো শান্তি ফিরে আসবে না- যদি এক ধর্মের মানুষ ভিন্নধর্মের মানুষকে ‘অন্য’ হিসেবে দেখে। তিনি বলেন, “কারা হারলো আর কারা জিতলো, এটা শান্তির দাবী নয়- কিন্তু আসল সত্য হলো সবাই ভাই-বোন এবং সমস্ত ভুলবোঝাবুঝি ভুলে, অতীতের ব্যাথা ভুলে, সংঘর্ষের পথ থেকে ঐক্যের দিকে যাত্রা।” আব্রাহাম মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের কাছে আদি পিতা হিসেবে গণ্য হলেও উর শহরের আন্তঃধর্মীয় সভায় কোনো ইহুদি উপস্থিত ছিলেন না। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইহুদি রাষ্ট্র জন্মের এক বছর আগেও ইরাকে দেড়লাখ ইহুদি বাস করতেন।
কুর্দিস্তানে পোপের সফরের প্রধান কারণ ছিলো, জনগণের প্রতি সহানুভূতি দেখানো। কুর্দি জনগণ বহু বছর ধরে রাজ্যহীন ছিলেন। বর্তমানে কুর্দিস্তান হলো স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। ৭ মার্চ সকালে পোপ কুর্দিস্তানের রাজধানী আরবিল শহরে পৌছালে তাঁকে স্বাগত জানাত কুর্দি প্রেসিডেন্ট নেচিরভান বারজানী এবং প্রধানমন্ত্রী মাসরুর বারজানী। আরবিল শহর থেকে পোপ পবিত্র বাইবেলে উল্লেখিত নিনেভে অঞ্চলের সমতলভূমি কারাকুস সফর করেন। কারাকুস শহরে অবস্থিত ইম্মাকুলেট কনসেপশন চার্চে এক সংক্ষীপ্ত প্রার্থনা সভায়ও তিনি যোগ দেন। বিকালে পোপ ফ্রান্সিস আরবিল শহরে ফিরে গিয়ে ফ্রান্সো হারিরি ফুটবল স্টেডিয়ামে পবিত্র খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ করেন। আরবিল হলো বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন শহর। এই দিনে পোপের প্রতিটি শহর সফরের সময় তিনি জনগণকে সংলাপের কথা উল্লেখ করেছেন। পোপ বার বার জোর দিয়ে বলেছেন- অস্ত্র নয়, যুদ্ধ নয়, বিদ্বেষ নয়, বিভেদ নয়, “সংলাপই হলো সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।”
পোপের ইরাক সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ বৈঠকটি ছিলো- আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিস্তানী শিয়া ধর্মীয় নেতার সঙ্গে। ৯০ বছর বয়স্ক শিয়া ধর্মীয় নেতা পবিত্র নাযাফ শহরে অবসর জীবন যাপন করছেন। বহু বছর ধরে তিনি জনসমাবেশে আসেন না। ৮৪ বছর বয়স্ক পোপ ফ্রান্সিস এই শিয়া ধর্মীয় নেতার সঙ্গে একান্ত পরিবেশে ৫০ মিনিট সময় ধরে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে উভয় নেতাই ইরাকে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের সৌহার্দ ও শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের উপর তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। শিয়া নেতা সিস্তানী বলেন, “ধর্মীয় নেতাদের একটি দায়িত্ব হলো ইরাকী খ্রিস্টানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা- যেনো তারা পূর্ণ অধিকার নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারেন।” উভয় ধর্মীয় নেতাই একমত প্রকাশ করে বলেন যে, এটা ইরাকী খ্রিস্টান এবং একই সঙ্গে মুসলমানদের জন্য উত্তম যদি দেশের ধর্মীয় নেতাগণ একসাথে সহবস্থানের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন। আল-সিস্তানী ইরাক সফরের জন্য পোপ ফ্রান্সিসকে ধন্যবাদ জানান এবং তাঁর দিক থেকে ইরাকী খ্রিস্টানদের নিরাপত্তা ও পূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিস্তানীর সঙ্গে ক্যাথলিক ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিসের এই আন্তঃধর্মীয় বৈঠক ছিলো আধুনিককালের ধর্মীয় ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা।
পোপের ইরাক সফর- আন্তঃধর্মীয় সংলাপের বিরল ইতিহাস
Please follow and like us: