খ্রিস্টেতে প্রিয় ভাই-বোনেরা,
আমরা সকলে জানি যে আমাদের পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস এই বছরটিকে “সাধু যোসেফ বর্ষ” হিসেবে ঘোষণা করেছেন। গত ডিসেম্বর ৮, ২০২০ তারিখে তাঁর লেখা প্রৈরিতিক পত্রে তিনি লিখেছেন : “ঈশ্বর-জননী মারীয়ার পরে, মারীয়ার স্বামী সাধু যোসেফের মত আর কোন মানুষকে পোপীয় শিক্ষায় এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পোপ নবম পিউস সাধু যোসেফকে “কাথলিক মণ্ডলির প্রতিপালক” হিসেবে ঘোষণা করেন (ডিসেম্বর ৮, ১৮৭০), পোপ দ্বাদশ পিউস তাঁকে “শ্রমিকদের প্রতিপালক” হিসেবে স্বীকৃতি দেন (মে ১, ১৯৫৫), পোপ ২য় জন পল তাঁকে “মুক্তিদাতার অভিভাবক” বলে সম্বোধন করেছেন (আগস্ট ১৫, ১৯৮৯), এবং খ্রিস্টভক্তগণ তাঁকে মনে করেন “শুভ মৃত্যুর প্রতিপালক” (কাথলিক মণ্ডলির ধর্মশিক্ষা-১০১৪)।
১৭শ শতাব্দীতে সাধু ফ্রান্সিস দ্য সেলস্’এর জীবনে ও পালকীয় কাজে সাধু যোসেফ জীবন্ত হয়ে উঠেছিলেন- সাধুর লেখার মধ্যে অনেকবার সাধু যোসেফের কথা উল্লেখ করেছেন।
বাইবেলে দুইজন যোসেফের কথা উল্লেখ আছে। মিশরের রাজা ফারাও এবং জনগণ যোসেফের কাছে নত হয়েছে। ফারাও বলেছে : “তুমিই আমার প্রধান অধ্যক্ষ হবে ; আমার সকল প্রজা তোমার বাণীর পক্ষে দাঁড়াবে ; কেবল সিংহাসনে আমি তোমার চেয়ে বড় থাকব। ফারাও যোসেফকে এই কথাও বললেন, ‘দেখ, আমি তোমাকে সমস্ত মিশর দেশের উপরে নিযুক্ত করলাম।’ ফারাও হাত থেকে নিজের আঙটি খুলে যোসেফের হাতে দিলেন। তাঁর রেশমী কাপড়ের শুভ্র পোশাক পরালেন এবং তাঁর গলায় সোনার হার দিলেন। তাঁকে তাঁর দ্বিতীয় রথে উঠতে দিলেন এবং তাঁর আগে আগে লোকে ঘোষণা করে বলতেন, ‘হাঁটু পাত’। এইভাবে তিনি সমস্ত মিশর দেশের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হলেন (আদিপুস্তক ৪১:৪০-৪৩)।
সাধু বার্নার্ডের মতে সাধু যোসেফ যে সেই প্রথম যোসেফের চেয়ে বড় ছিলেন এই ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ মাত্র নেই। প্রাচীন বিধানের যোসেফের সুবিধা ছিল এই যে তিনি রাজ দরবার ও রাজ্যের মধ্যে প্রধান অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। শুধু সিংহাসনে আসীন রাজা তাঁর উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। সকলেই তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য ছিলেন। আর নতুন নিয়মের সাধু যোসেফ হয়ে উঠেছিলেন পিতা ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও সহকারি, তাঁর পরিবারের প্রধান কর্তা ; আর তিনি শাসন ও প্রতিপালন করেছেন ঈশ্বর পুত্র যিশুকে এবং ঈশ্বর জননী মারীয়াকে। যদিও সংখ্যায় তাঁর জনগণ খুবই নগন্য ছিল, সাধু যোসেফের সমান বুদ্ধিমত্তা ও সদ্গুণ সম্পন্ন কাউকেই পাওয়া যায়নি। এটা তো স্পষ্ট যে সাধু যোসেফই পবিত্র পরিবারের অভিভাবক ছিলেন; শুধু তাঁর কাছেই ঈশ্বর দূত পাঠিয়ে যিশু ও মারীয়াকে নিয়ে মিশর দেশে পালিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন (মথি ২:১৩-১৪)। আর সাধু লুক তাঁর লেখা মঙ্গল সমাচারে উল্লেখ করেছেন যে যিশু ‘তাঁদের বাধ্য হয়ে ছিলেন’ (লুক ২:৫১)। প্রাচীন যেসেফকে ডাকা হতো “জগতের পরিত্রাতা” আর নতুন যোসেফ আমাদের কাছে হয়ে উঠেছেন “জগতের পরিত্রাতার পরিত্রাতা” ( উপদেশ, ১৯ মার্চ ১৬১২, এনেসি সংকলন ৮, ৮৬-৮৭)।
আদর্শ স্বামী ও পিতা : সাধু যোসেফ “ঈশ্বর ও মানুষের দৃষ্টিতে হয়ে উঠেছেন প্রিয়ভাজন, আর তাঁর নাম হয়েছে ধন্য (সিরাখ ৪৫:১)।” অনেক কিছুর মধ্যে ধন্য সাধু যোসেফের নামে ভক্তি হলো অনন্য (মার্চ ১৯, ১৬১৪)। তবে প্রথমেই সব চেয়ে বেশি প্রেমময়, প্রিয়ভাজন ও প্রিয়তম স্বামী ও পিতা ধন্য যোসেফের কথা আমাদের স্মরণে আনতে হবে সবচেয়ে বেশি। মঙ্গল সমাচারে সাধু যোসেফের তিনটি নাম দেওয়া হয়েছে : তাঁকে বলা হয়েছে “মারীয়ার স্বামী” – তিনি মরীয়ার দায়িত্বশীল স্বামী যিনি তাঁর স্ত্রীকে সাহচর্য্য দিয়েছেন (লুক ২:৪-৫) ; “খ্রিষ্টের পিতা” -তিনি যে যিশুর কেমন বাবা ছিলেন তা প্রকাশিত হয়েছে মারীয়ার কথায় : ‘দেখ, তোমার পিতা ও আমি কত উদ্বিগ্ন হয়েই না তোমাকে খুঁজেছি’ (লুক ২:৪৮-৪৯) ; এবং “ন্যায়বান মানুষ” – তাঁর জীবনে সকল প্রকার সদ্গুণই উপস্থিত ছিল (উপদেশ, মার্চ ১৯, ১৬১৪, এনেসি সঙ্কলন ৮, ১৩০)। স্বামী হিসেবে তিনি মারীয়ার প্রতি ও পিতা হিসেবে যিশুর প্রতি তাঁর সকল দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন ও প্রতিপালন করেছেন।
ধার্মিক বা ন্যায়বান মানুষ : “দেখ, কেমন পবিত্র ও প্রিয়তম মহৌৎসব, প্রিয় শ্রুতৃমণ্ডলি! ভক্তি করার কেমন পবিত্র মন্দির, যা উৎসর্গ করা হয়েছে পুণ্য ও প্রিয়তম পাট্রিয়ার্ক বা পিতার কাছে ! হে সাধু যোসেফ, আমি জানি না কোন স্তুতি-প্রশংসা দিয়ে আমি তোমাকে সম্মান দেখাব কারণ তুমি তোমার হাত দিয়ে ধরে আছ “সেই তাঁকেই, স্বর্গ যাকে ধারণ করতে পারে না”। এইভাবেই প্রথম খ্রিস্টমণ্ডলি এই সাধুকে স্তুতি-প্রশংসায় ভরে দিয়েছে : ‘ন্যায়বান মানুষ পাম গাছের (তাল গাছের মত গাছ) মতই বিকশিত হবে (উন্নতি করবে)…’(সাম ৯২:১৩)। (উপদেশ, মার্চ ১৯, ১৬২১ এনেসি সঙ্কলন ৮, ৩৯৭)
আদর্শ শ্রমিক : সাধু যোসেফ নম্রভাবে কঠোর পরিশ্রম করে তাঁর পরিবার চালিয়েছেন। যিশু ও মরীয়ার সকল প্রকার প্রয়োজন মিটিয়েছেন এবং সুষ্ঠুভাবে তাঁর পরিবার পরিচালনা করেছেন। তাঁর সৃজনশীলতা দ্বারা তাঁদের যত্ন করেছেন ও তাঁদের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রকাশ করেছেন।
শুভমৃত্যুর প্রতিপালক : কাথলিক মণ্ডলির ধর্মশিক্ষায় আমরা শিখেছি যে সাধু যোসেফ হলেন শুভ মৃত্যুর প্রতিপালক। ঐতিহ্যগতভাবে কাথলিক ভক্তগণ একটি ভাল মৃত্যু চেয়ে প্রার্থনা করে আসছেন (কাথলিক মণ্ডলির ধর্মশিক্ষা-১০১৪)।
খ্রিস্টেতে প্রিয়জনেরা, আমরা আমাদের রাজশাহী ধর্মপ্রদেশেও সাধু যোসেফকে উপযুক্ত সম্মান ভক্তি দিয়ে গ্রহণ করি ও তাঁর মধ্য দিয়ে প্রার্থনা করি যেন ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেককে সাধু যোসেফের গুণাবলিতে ভূষিত করেন। আমরা যেন তাঁর মত নম্র, ন্যায়বান ও ধার্মিক মানুষ হতে পারি।
সাধু যোসেফের বছর উদ্যাপন করতে আমরা আমাদের ধর্মপ্রদেশের প্রতিটি পরিবারে সন্ধ্যাবেলা রোজারীমালা প্রার্থনার সময় সাধু যোসেফের কাছে প্রার্থনা করব ; ধর্মপল্লীতে আমরা বিশেষ প্রার্থনা ও সাধু যোসেফের জীবনী নিয়ে ধ্যান করব। ধর্মপ্রদেশ পর্যায়ে আমরা তীর্থযাত্রা করার জন্য রাজশাহী উত্তম মেষপালক কাথেড্রাল গীর্জা ও রহনপুর ধর্মপল্লীর সাধু যোসেফের গীর্জা দু’টিকে এই বছর সাধু যোসেফের তীর্থস্থান হিসেবে ঘোষণা করছি। তাছাড়া নিজ নিজ ধর্মপল্লীর গীর্জায়ও পাপস্বীকার করে, খ্রিস্টযাগে যোগদান করে, খ্রিস্টপ্রসাদ গ্রহণ করে, সাধু যোসেফের কাছে বিশেষ ভক্তিপ্রদর্শন করে, উপবাস ও মানত পূরণ করে, পূর্ণদন্ডমোচন পাওয়া যাবে।
হে সাধু যোসেফ, তুমি নম্রতার ও ধার্মিকতার আদর্শ,
তোমার সদ্গুণসমূহে মুগ্ধ হয়ে
ঈশ্বর তোমাকে মা মারীয়া ও তাঁর পুত্র যিশুর দায়িত্বভার দিয়েছেন।
তুমি কঠোর পরিশ্রম করে নীরবে ও নম্রভাবে তোমার সকল দায়িত্ব পালন করেছ।
তুমি আমাদের- ন্যায় ও ধার্মিকতার পথ দেখাও,
এবং আমাদের তোমার আদর্শে ও গুণাবলীতে ভূষিত হতে অনুপ্রাণিত কর।
স্বর্গ থেকে তুমি সর্বদা আমাদের মঙ্গল প্রার্থনা কর ও ঈশ্বরের সকল আশীর্বাদ ও কৃপা নিয়ে দাও।
আমাদের জীবনের শেষে আমাদেরকে একটি ভাল ও প্রশান্তিময় মৃত্যু পেতে আমাদের সাহায্য কর।
আমেন।।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ, বাংলাদেশ।