গত ২১ মার্চ ২০২১ রোববার ভাটিকানের পোপীয় প্রাসাদ থেকে এক সাধারণ সাক্ষাৎ দেওয়ার সময় পোপ ফ্রান্সিস বর্ণ বা জাতিভেদ প্রথার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি বর্ণপ্রথাকে একটি ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যা ঘুমিয়ে আছে আর যে কোন সময় জেগে উঠে দেখিয়ে দিবে যে “আমাদের তথাকথিত সামাজিক উন্নয়ন যেমন বাস্তব বা চুড়ান্ত মনে হয়”, আসলে তা নয়। এইদিন জাতিসংঘ বিশ্ব থেকে সকল প্রকার বৈষম্যমূলক বর্ণপ্রথা বা জাতিভেদ প্রথা দূর করার মানসে ‘আন্তর্জাতিক বর্ণপ্রথা বিলোপ দিবস’ পালন করেছে।
‘যে ভাইরাস তরিৎ গুটিয়ে যায়, কিন্তু অদৃশ্য হয় না কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় লুকিয়ে থাকে’ বর্ণপ্রথা তার চেয়েও খারাপ। বর্ণপ্রথা বা জাতিভেদ প্রথা পৃথিবীতে প্রাচীনকাল থেকেই আছে, আর তা এখনও আমাদের লজ্জ্বা দেয়; কারণ আমাদের যে সামাজিক বিবর্তন ও অগ্রগতি নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে বড়াই করি, তা আসলেই অমূলক। আমাদের মনের যে উদারতা ও উন্মুক্ততা হওয়ার কথা তা থেকে আমরা অনেক দূরে রয়েছি। পোপ মহোদয় হেসটেগ দিয়ে টুইট করেছেন ##Fight Racism# Fratelli Tutti. “ফ্রাতেল্লি তুত্তি” নামক দলিলটি পোপ ফ্রান্সিস গত বছর কোভিড-১৯ বৈশিক মহামারী কালে প্রকাশ করে, পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যে সংহতি, ভ্রাতৃত্ব, আর সকল সৃষ্টি ও প্রকৃতির প্রতি যত্নের সংস্কৃতি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। পোপ কোন নির্দিষ্ট বা বিশেষ কোন প্রকার বর্ণপ্রথা বা জাতিগত বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেননি। তাঁর গোটা পোপীয় আমলে তিনি বরাবরই সকল প্রকার বৈষম্যের নিন্দা করেছেন এবং দরিদ্র বা যারা সমাজের প্রান্তসীমায় পড়ে আছে তাদের অধিকারের কথা বলেছেন। খ্রিস্টধর্মের শিক্ষায় সকল মানুষই সমান – সে সাদা বা কালো হোক, উত্তরের বা দক্ষিণের হোক, ধনী বা দরিদ্র হোক, মূল ধারার বা আদিবাসী হোক, শহরের বা গ্রামের হোক – সে যা-ই হোক না কেন! পোপ ফ্রান্সিস সেই কথাই তুলে ধরেছেন।
জাতিসংঘ এখন প্রতি বছর ২১ মার্চ বর্ণপ্রথা বিলোপ দিবস পালন করে, কারণ এই দিন ১৯৬০ খ্রি: দক্ষিণ আফ্রিকার সার্পভিল নামক স্থানে শান্তিপূর্ণ মিছিলে নিরিহ জনগণের উপর গুলি চালিয়ে ৬৯ জনকে হত্যা করেছিল। এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এরূপ ঘটনা ঘটছে অহরহ। আমরা চীনের উইঘুর জনগণের কথা ভাবতে পারি। চিনা সরকার অধিকার বঞ্চিত উইঘুর জনগণের উপর দমন পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, আর প্রতি দিন শত শত মানুষ হত্যা করে চলেছে। চিন দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ও মুসলমানদের উপর বহু বছর ধরেই দমন পীড়ণ চালিয়ে আসছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার মানুষের একটি মৌলিক অধিকার, কিন্তু শুধু মাত্র হিন্দু বা মুসলমান হওয়ার কারণে পাক-ভারত উপমহাদেশে সংখ্য লঘুরা নির্যাতিত ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে বা হচ্ছে তা আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারব না। আমাদের দেশের সরকার ও প্রশাসন সংখ্যালঘুদের বিষয় অত্যন্ত সংবেদনশীল ও তাদের সুরক্ষা দিতে তৎপর। তবে দেশের সকলেই যে সরকারের মনোভাব ধারণ করে, এমন নয়। এখনো খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, আদিবাসী, ইত্যাদি হওয়ার কারণে সরকারী চাকুরীসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেতে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। প্রায়ই ধর্মীয় সংখ্যা লঘুদের বাড়ীঘর বা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয় বা নিষ্ঠুরভাবে তাদের নির্যাতন করা হয়।
পাকিস্তানে প্রায় সংখ্যালঘু হিন্দু ও খ্রিস্টান কিশোরী বা যুবতী মেয়েদের অপহরণ করে মুসলমানরা জোর পূর্বক তাদের বিয়ে করছে। একবিংশ শতাব্দীর এই সময় এসে এমন দৃশ্য দেখতে হয় বা এমন ঘটনা ঘটে এটা সত্যিই দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যের বিষয়। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আদিবাসী বা উপজাতিদের উপর যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে বা এখনো করা হচ্ছে তা প্রনিধানযোগ্য। আদিবাসীদের ভূমি ও সম্পদ কেড়ে নিয়ে তাদের সমাজের প্রান্তসীমায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে – আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মতই আমাদের দেশের আদিবাসীদের অবস্থা হয়েছে। বাংলাদেশে অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির জনগণের ভুমির অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠা পায় নি; যদিও তারা এই দেশের আদি জনগোষ্ঠি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই দেশে এটা আশা করা যায় না। উদারমনা বঙ্গবন্ধুর কাছে সকলেই ছিল সমান। তাই তাঁর সরকার যে সংবিধান আমাদের দেশকে দিয়ে গেছেন তার মধ্যে লিপিবদ্ধ ছিল চার মৌলিক স্তম্ভ: গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। যে কোন উন্নত দেশের সমকক্ষ এই সংবিধান পরবর্তী সরকারগুলো কেটেকুটে এর মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে, বিশেষভাবে চার মূল নীতির একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে। পরবর্তীতে এর মধ্যে আবার ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ যোগ করা হয়েছে। এটা সকল্রেই বোঝা উচিত যে, রাষ্ট্রের কোন ধর্ম নাই, ধর্ম থাকে মানুষের। তবু আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুরা ভাল অবস্থায় আছে।
এই বছর আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর বা সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব পালন করছি; একই সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীও পালন করছি। এই উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানগণ শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসও এই উপলক্ষে এক ভিডিও বার্তায় আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, সরকার ও জনগণকে শুভেচ্ছা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে বাংলাদেশের লক্ষনীয় উন্নয়নযাত্রা ও বিভিন্ন ধর্মের ও সংস্কৃতির মনেুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রশংসনীয় ও অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। তিনি বলেছেন যে এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক ও স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতাপূর্ণ ভিত্তি রচনা করার কারণে। তাই আমরা বংলাদেশে কোন প্রকার বৈষম্যপূর্ণ বর্ণপ্রথা বা জাতিভেদ দেখতে চাই না। এই দেশে ভালবাসা মিলনের একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠুক। এই দেশ আমাদের সকলের।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী

Please follow and like us: