ফাদার সুনীল রোজারিও। রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
আবারো করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়েছে। চলতি বছরের দ্বিতীয় মাসে এসেও মৃতের সংখ্যা পাঁচের কাছাকাছি চলে এসেছিলো। পশ্চিমা বিশ্বেও কিছুটা কমেছিলো। দ্বিতীয় ঢেউ, তৃতীয় ঢেউয়ের কথা শুনলেও কার্যতঃ আমরা সেদিকটাতে গুরুত্ব দেইনি। সব সময় ভেবেছি আমাদের প্রতি ঈশ্বরের বিশেষ আর্শীবাদ আছে। ঈশ্বর যে আমাদের দৃষ্টি থেকে সরে গেছেন তা কিন্তু নয়। ঈশ্বর কী আমাদের হাত ধূয়ে দিতে আসবেন নাকী মাক্স পড়িয়ে দিবেন? আমাদের দিক থেকে যেটুকু করণীয়, সেটুকু তো আমাদের করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে সেই সাথে ঈশ্বরের কাজে আমাদের সহযোগীতার হাত বাড়াতে হবে।
করোনাভাইরাস তার রূপ-গুণ অনবরত বদল করছে। মানুষ বুঝে উঠার আগেই ওরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। আর আমরা তো আগের ধারণার মধ্যেই রয়ে গেছি- মাস্ক পড়তে হবে, হাত ধুতে হবে, দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, ইত্যাদি। তড়িঘড়ি করে দেশে দেশে ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু করোনার রূপ-গুণ বদলের পাশাপাশি ভ্যাকসিনের সংস্করণ কিন্তু বদলাচ্ছে না। এই ভ্যাকসিন নিয়েও এখন নানা কথা মোড়ে মোড়ে আলোচনার শীর্ষে। কোনো দেশের বিজ্ঞানিরা বলছেন, অক্সফোর্ড কারখানার অ্যাস্টাজেনেকা ভ্যাকসিন মানুষের শরীরের রক্ত জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছে। তাই দেশে এই ভ্যাকসিন চলবে না। আবার কয়েকদিন বাদেই প্রমাণ করে বিবৃতি দেওয়া হলো, এই ভ্যাকসিন রক্ত জমাট করে না। ইস্রায়েল দেশে নাকী ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণে অনেকের মুখের নকসা বদলে গেছে। আমাদের দেশের অনেক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বা মৃতুবরণ করেছেন। এখানে ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। কথা হলো- কারো শরীরে যদি ক্রনিক ডিজিস থাকে তাহলে এই ভ্যাকসিন কতোটুকু কার্যকর? অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি বলছে, এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ২০/২৫ দিনের মধ্যে তার কার্যকারিতা শুরু হয়। আর মৃত্যু মানেই শুধু করোনাভাইরাস নয়। তাই মৃত্যুর সাথে এই ব্যতিক্রমগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশে গত বছর ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের খবর পাওয়া গিয়েছিলো এবং ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিলো। এরপর দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ২৩ মার্চ সরকার প্রথমবার সাধারণ ছুটির ঘোষণা দিয়েছিলেন। ছুটি ঘোষণার শুরুতে এই মেয়াদ ছিলো ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পযর্ন্ত। সেই সাথে ছুটি চলার সময় গোটা দেশকে লাল, সবুজ ও হলুদ জোন চিহ্নিত করে পরিস্থিতি বিবেচনা করে লকডাউন আরোপের পরিকল্পনা হয়েছিলো। চলতি বছর সংক্রমণের উর্ধ্বগতি দেখে সরকার ২৯ মার্চ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে। এর পরের ঘোষণায় করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ০৫ এপ্রিল ২০২১ ভোর ৬.০০টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২.০০টা পযর্ন্ত মেয়াদে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ১৪ তারিখ থেকে আরো কঠোর নির্দেশনা আসতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে কমপক্ষে ১৪দিন সময় লাগে দেহে লক্ষণগুলো ফুটে উঠতে। সেই হিসাবে, ৭ দিনের এই লক্ডাউন কতোটুকু ফলপ্রসু হবে তা দেখতে সময় লাগবে আরো ৭ দিন অর্থাৎ এপ্রিলের ১৮/১৯ তারিখের আগে বোঝা যাবে না- এই লক্ডাউন কতোটুকু কাজে লেগেছে। অন্যদিকে বিমান, বাস ও ট্রেনে যে পরিমাণ যাত্রী চলাফেরা করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বাজারগুলোতে চলাফেরা করেন। লকডাউনের ৭ম দফায় বলা হয়েছে- “কাঁচা বাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পযর্ন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে।” মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের কারণে এই কাঁচা বাজার বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। এই বাজার খোলা রাখার সময়সীমা যতোই সংক্ষিপ্ত হোক না কেনো রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি এখানে থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা দোকান খোলা রাখার জন্য বিক্ষোভ করছে। তাদেরও অনেক যুক্তি আছে। বই মেলায় যারা স্টল দিয়েছেন তারাও ব্যবসায়ী।
বাস যাত্রীরা যখন জবাব দেন, আমার রোগ হবে তো আপনার কী? তখন বুঝতে হবে আমাদের মধ্যে সচেতনতার কতো বড় অভাব রয়েছে। সরকারি বিধান মেনে চলার পাশাপাশি নিজে যদি সংযত না হই তবে কোনো লাভ হবে না। নিজের জীবন বাঁচিয়ে অন্যের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এই উপলব্ধিটা কেনো জানি মানুষের মধ্যে কাজ করছে না। শুধু বাংলাদেশের কথা বলবো কেনো, পশ্চিমা অতি সভ্য দেশেও দেখা গেছে এই লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে। করোনাভাইরাসের জন্মস্থান চীনদেশে এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। ওখানে সরকারি নিয়ম অমান্য করার সাহস কারো নেই। সরকার এই ব্যাপারে অনেক কঠোর। নিউ জিল্যান্ডে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত। ওখানে মানুষের মধ্যে সচেতনতা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার অভাব নেই।
বাংলাদেশ সরকার ভ্যাকসিন আমদানিতে অনেক দেশ থেকে এগিয়ে আছেন এবং বিনামূল্যে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। এতো সুবিধার পরেও কিন্তু খবরে বলা হচ্ছে যে, এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে অণীহা বাড়ছে। এই অণীহার কারণ কী গুজব, অবহেলা নাকী অন্যকিছু। গুজবগুলো মানুষের কাছে যতো তাড়াতাড়ি পৌছে, সত্যটা অতো সহজে পৌছে না। গ্রাম-গঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে ভ্যাকসিনের সুফলটা পৌছে দেওয়ার বিভিন্ন ব্যবস্থা পৌছে দিতে হবে। এই কাজ করতে গিয়ে শুধু সরকারের পক্ষে বা আইন প্রয়োগকারিদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে- ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নানা সংগঠনকে। ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে ওয়ার্ড কমিশনগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে এবং পালন করতে হবে। দেখভালের জন্য মনিটর সেল গঠন করতে হবে। গ্রাম-গঞ্জের অশিক্ষিত মানুষকে সহায়তা দিতে হবে- ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে এবং সেই সাথে নিবন্ধন করতে। কিছু বেসরকারি সাহায্য সংস্থা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থ-কড়ি, মাস্ক, সেনিটাইজার বিতরণ করছে। বলতেই হবে এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আরো ভালো হতো যদি টিকা নেওয়ার জন্য সাধারণ, অশিক্ষিত জনগণকে নিবন্ধন করতে সহায়তা দেওয়া হতো। অর্থ-কড়ি বিলানো যতো সহজ, নিবন্ধন ততো সহজ নয়। তবুও করতে হবে কারণ এই নিবন্ধনের কাজটি সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজ নয়। এই কাজের জন্য সুবিধাও তাদের নেই। আর্থিক সহায়তা এই ভাইরাস বিনাশের স্থায়ী সমাধান নয়- টিকাই আপাতত সমাধান। আমার মনে হয়েছে আর্থিক সহায়তা দেওয়া সত্বেও- সেখানে টিকা গহণকারিদের সংখ্যা কম। একটি প্রশ্ন হলো- চার্চের সহায়তায় যতো মানুষকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে, তারা কী সবাই টিকা নিয়েছেন ? বা টিকা নিতে তাদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে ?
রাজশাহী ডাইয়োসিসের দক্ষিণের চার্চগুলোতে সঙ্গত কারণেই আর্থিক সহায়তা কম। এই এলাকাগুলোতেও প্রযুক্তির মাধ্যমে নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে সীমাবন্ধতা রয়েছে। কিন্তু এখানে এই ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতনতা লক্ষ্য করা গেছে। ধর্মীয় নেতাদের কথা এখনো এদেশের মানুষ অমান্য করে না- এটা তার প্রমাণ। দেখেছি একজন খ্রিস্টান নার্স তার অবসর সময়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কীভাবে মানুষকে সহায়তা দিচ্ছেন। তারা কোনো বেসরকারি সাহায্য সংস্থার কর্মীও নন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। এটা হলো সেবা। চাকুরি আর সেবা এক জিনিস নয়। সবশেষে বলতে চাই, এই জাতীয় সমস্যা মোকাবেলার জন্য আসুন, আমরা যার যার অবস্থান থেকে আপামর জনগণকে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসি। আমাদের সাধ্য মতো তাদের জীবন ধারণও দেখতে হবে- সেই সাথে ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে সর্বাক্তক সহায়তা দিতে হবে। তাই বলতে চাই- কোভিড- ১৯ নির্মূলে স্থায়ী ভ্যাকসিন- সহায়তাদান। আসুন, নিজে সুস্থ থেকে অন্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করি। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: