ফাদার সুরেশ পিউরীফিকেশন
নুতন দিনের নতুন গান, জাগিয়ে তোলে আনন্দের বাণ,
পান্তা ভাতের বৈশাখে যেন খুঁজে পাই নতুন প্রাণ
প্রতিবছর সময়ের আবর্তনে আসে পহেলা বৈশাখ। পুরাতনকে ভুলে নুতনকে বরণের লেনাদেনার পসরা নিয়ে আসে যেন প্রতীক্ষিত এই দিনটি। বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে যেন নিবিড় ভাবে মিশে আসে এই পহেল বৈশাখ। আজও পহেলা বৈশাখ মিশে আছে বাঙালি সংস্কৃতির সাথে নাড়ীর বন্ধনের মত। প্রতিটি সংস্কৃতি-মনা মানুষের কাছে পহেলা বৈশাখ একটি গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়। এই মাসের নাম শুনলেই সকল সম্প্রদায়-ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রাণে নতুন স্পন্দন জাগে, খুঁজে পায় নতুন করে বাঁচার প্রেরণা। নববর্ষের আহবান হচ্ছে সমস্ত শক্তি ও প্রাণ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান। বৈশাখ আসে বারে বার যেন জাগিয়ে তোলে আমাদের সকলের প্রাণ। সকলকে জানিয়ে দেয় নতুন বছরের আগমনী বার্তা। আকাশ কাঁপিয়ে, ধুলো উড়িয়ে চেনা প্রকৃতিকে একেবারে নাজেহাল এবং পতিত করে দিয়ে বৈশাখ আসে। পহেলা বৈশাখের আবির্ভাব যেন আমাদের জীবনে এনে দেয় স্বস্তির নিঃশ্বাস।
নববর্ষের নতুন সূর্যের নতুন কিরণে বাংলা মায়ের প্রকৃতিতে লাগে নব দোলা, যে দোলায় দোলায়িত হয়ে বাংলা যেমন সাজে বিভিন্ন সাজে ও রূপে তেমনিভাবে একক সত্ত্বা হওয়া সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে আছে জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন পেশা ও ভিন্নতা। বাংলার কিছু পেশার মানুষের জীবন যাত্রা ও কাজেই প্রকাশ করে আমরা অনেক হয়েও এক জাতি সত্ত্বা। মানুষের জীবনে আবেগই দিয়েছে বেগ। তাই মানুষের জীবনে যতোগুলো অনুভূতি আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে সুখকর, আনন্দময় ও সুন্দর অনুভূতি হল ‘ভালবাসা’। আর মানুষের এই সুন্দর অনুভূতিটুকু আবর্তিত হয় তাঁর মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে কেন্দ্র করে। উক্ত বিষয়গুলোর সাথে সংস্কৃতি ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত। আর আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ, আনন্দমূখর ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব হল-পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ হল বাঙ্গালী জাতির প্রাণের উৎসব, আনন্দের উৎসব। এই দিনে প্রতিটি বাঙ্গালী নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পান্তা-ইলিশ খেয়ে থাকে। এদিনে ধনী-গরীব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালী অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে ও আয়েশের সাথে পান্তা ভাত খেয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, পৃথক জাতি স্বত্ত্বা হিসাবে গর্ববোধ করে। আজ মনে হয় যেন ধনী ও গরীবের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই; পান্তা আহারে সকল বাঙালীই যেন আজ একই আত্মার আত্মীয়। যদিও বা বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ও এই দুর্মূল্যের বাজারে ধনী শ্রেণী বছরের মাত্র একটি দিনই আয়েশের সাথে ও সখের বশে পান্তা-ইলিশ আহার করে, সেখানে গরীবেরা অর্থের অভাবে দৈনন্দিন জীবনে ক্ষুধা নিবারণে পান্তাভাত, পিয়াজ-লবণ-কাঁচা মরিচ দিয়ে তৃপ্তি সহকারে আহার করে ক্ষুধা নিবারণ করে থাকে। এছাড়া আজও গ্রাম-বাংলায় এ দিনকে কেন্দ্র করে বাঙালী জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে নানা ধরনের মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে শহুরে জীবনেও এর প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। এ উৎসকে কেন্দ্র করে গ্রামে-গঞ্জে ও শহরের বিভিন্ন স্থান হয়ে উঠে অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলার এক আনন্দযজ্ঞ। যাদের কথা ভেবে প্রজা কল্যাণকামী মহান সম্রাট আকবর বাংলা সনের সূচনা করেন, সেই গ্রামের কৃষক-কৃষাণীর ফসল সংগ্রহের সমাপ্তি লগ্নে এ উৎসব তাদের আনন্দকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলে। আর এ উৎসব আগামী দিনে তাদের চলার পথে দান করে অফুরন্ত ও নূতন প্রাণশক্তি। শুধু আহারেই নয়, পোশাক-পরিচ্ছদও প্রত্যেকের মধ্যে বাঙালীয়ানার পরিচয় প্রকাশ করে।
পাশ্চাত্যের তথাকথিত ফ্যাশনে বল পোশাক ছেড়ে আজ সবাই খাঁটি বাঙালী হবার প্রতিযোগিতায় নিজেকে একধাপ এগিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। বাঙালী ছেলেরা পাজামা-কুর্তা বা ফতুয়া ও বাঙালী ললনারাও শাড়ীতে জড়িয়ে নিজেদের তুলে ধরে প্রকৃত বাঙালী রূপে। কেননা এ যে তাদের আসল পরিচিতি। প্রাণে আনে নতুন জোয়ার। কিন্তু আজ এ কথা দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বর্তমান প্রজন্ম পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে ও ঢঙে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় হারাতে বসেছে। আমরা শুধুমাত্র বিশেষ কোন দিবসকে কেন্দ্র করে ও উপলক্ষ করে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে অপরের সামনে উপস্থাপন, অন্যদিকে সর্বদাই অপর বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি এক দুর্বার আকর্ষণ লালন করি আমাদের অন্তরে। শিকড়হীন কচুরিপানার মতো জীবনযাপন না করে নিজস্ব সংস্কৃতির পরিচয়ে পরিচিত হয়ে অপরের সামনে নিজেকে ও নিজের সংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরতে আমরা যেন কুন্ঠিত না হই।
আজও বৈশাখ আমাদের জীবনে নুতনের বার্তা নিয়ে আসে। পহেলা বৈশাখের উষ্ণ ছোঁয়া পুরাতন জরাজীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন করে তোলে। ভুলে যেতে সাহায্য করে পুরাতন স্মৃতিময় দিনগুলিকে। প্রাণে আনে নতুনের আনন্দ। পাপময় অবস্থাকে পুণ্যের আবিরতায় ঢেকে ফেলে পহেলা বৈশাখ শূন্যতার মাঝে পূর্ণতা নিয়ে আসে। পুরাতন বছরের সব জড়তা দূর করে নতুন বছরের সজীবতায় শুভাগমন ঘটায় বৈশাখ। অপ-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় গোড়ামী থেকে বেড়িয়ে আসার আহবান। বিশ্বপিতার নিমন্ত্রণে বিশ্ব ভ্রমণে বাহির হওয়ার আহবান। তিনি যে আমাদেরই সঙ্গী ভগবান। নিজেকে জানার, বুঝার ও মূল্যায়ণ করে সামনের দিকে দীপ্ত পদচারণায় এগিয়ে চলার আহবান। তাই আমাদের এই প্রাণের অনুষ্ঠানকে ঘিরে অন্তরের গভীরে থেকে ধ্বনি হোক একই সুর-আমরা সবাই বাঙ্গালী। পরম যত্ন ও ভালবাসার নিয়ে রক্ষা করব আমাদের এই স্মৃতিবিজরিত ও গৌরবময় হাজার বছরের ঐতিহ্য। শুধু একদিনের জন্য পান্তা ভাতের বাঙ্গালী না হয়ে আমরা যেন প্রতিদিনের জীবনের বৈশাখের সেই নতুনত্বে পরিবর্তন হবার চেতনায় সামনে পথ এগিয়ে চলি।
এসো হে পহেলা বৈশাখ
Please follow and like us: