পোপ ফ্রান্সিস ২০২১ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব সামাজিক যোগাযোগ দিবসের জন্য মূলভাব বেঁধে দিয়েছেন- “এসো দেখে যাও”। যোহনের দু’জন শিষ্য যখন যীশুকে অনুসরণ করছিলেন, যীশু তাদের জিজ্ঞেস করলেন “তোমরা কি চাও?” তারা বললেন “গুরু আপনি কোথায় থাকেন?” যীশু তাদের বললেন, “এসো দেখে যাও” (যোহন ১:৩৯)। একজন মানুষের সাথে আমাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয় যখন আমরা তাকে আমন্ত্রণ জানাই। মানুষে মানুষে যোগাযোগ হলো মানব সম্পর্কের পদ্ধতি। জন্মের পর থেকেই প্রতিটি মানুষ প্রতিদিন সম্পর্কের ইতিহাস রচনা করে চলে। যোগাযোগ ছাড়া সম্পর্ক বা আত্মীয়তা গড়া সম্ভব নয়। দিন যতই যেতে থাকে মানব সম্পর্কের ইতিহাস ততই বৃদ্ধি পায় ও সমৃদ্ধ হয়। সেই সম্পর্ক চলতে থাকে জন্ম জন্মান্তরে – পরম্পরাগতভাবে। আর সেই সম্পর্ক স্থাপিত হয় গল্প বলার মাধ্যমে। সেইজন্য পোপ মহোদয় সামাজিক যোগাযোগকে একটি গল্প বলার ইতিহাস হিসেবে তুলে ধরেছেন; বাইবেলে যেমনটি আছে, “… যেন তোমরা তোমাদের সন্তানদের এবং নাতি-নাতনীদের বলতে পার…” (যাত্রা ১০:২)। আমরা মানুযের দৃষ্টি আকর্ষণ করি আমাদের গল্প বলার জন্য। গল্প বলার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন ছাড়া আমরা সামাজিক সম্পর্ক গড়তে বা টিকিয়ে রাখতে পারব না। মণ্ডলির একটি গল্প আছে, আর সেই গল্প বা ইতিহাস হলো পরিত্রাণের ইতিহাস ও যীশুর গল্প। সব মানুষের জীবনেই গল্প আছে, গল্পের প্রভাব আছে। সে কেমন মানুষ হবে তা নির্ভর করে সে কেমন গল্পের প্রেরণা পেয়েছে।
তবে সব গল্পই ভাল গল্প নয়। এমন সব গল্প আছে যা আমাদের জীবনকে বিনাশের পথে নিয়ে যায়। আমরা যদি অন্যায় ও পাপের পোশাকে ভূষিত থাকি, যদি আমরা অসংখ্য মিথ্যার মধ্য থেকে সত্যকে খুঁজে নিতে না পারি, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হবো। যদি আমরা সত্যের গল্প দিয়ে আমাদের জীবন মুড়িয়ে নিতে পারি- তাহলে আমরা জীবনে সফল ও সুখী হবো। তাই আমাদের বেছে নিতে হবে সেই গল্প যা ঈশ্বর নিজেই লিখে দিয়েছেন। পবিত্র শাস্ত্র বাইবেল হলো মানুষকে বলা ঈশ্বরের ভালবাসার গল্প। এই গল্প আমাদের সব সময় আহ্বান জানায় আর বলে, ‘এসো দেখে যাও’। এই ‘গল্পের গল্প’ আমাদের অন্ধকার থেকে আলো দিকে নিয়ে আসে। মাতৃগর্ভে যেমন অদৃশ্যভাবে ও ধীরে ধীরে শিশুর দেহ সৃষ্টি হয়, তেমনি ক’রে আমাদের স্বভাব-চরিত্র ও আচার আচরণ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আমাদের অজান্তেই।
ঈশ্বর চান যেন সকল মানুষ পরিত্রাণ লাভ করে। যীশু বলেছেন, “তোমরা সমস্ত জগতে যাও, আর প্রচার কর মঙ্গল সমাচার” (মার্ক ১৬:১৫)। তাই ক্যাথলিক মণ্ডলি যীশুর শিক্ষানুসারে এই গল্প বা ইতিহাস পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে ঘোষণা করে চলেছে। এমনকি যারা কাছে নয় বা যাদের কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়, তাদের কাছেও ক্যাথলিক মণ্ডলির যোগাযোগ সেবাকর্মীগণ গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যীশুর এই গল্প বা পরিত্রাণের ইতিহাস পৌঁছে দিচ্ছেন বা যীশুকে অনুসরণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। আর এইভাবে যারা দূরে রয়েছেন বা যাদের কাছে যাওয়া সম্ভব নয়, তারাও যীশুর ভালবাসা ও মণ্ডলির নৈকট্য অনুভব করতে পারেন। খ্রিস্টান যোগাযোগ বা গণমাধ্যম কর্মীগণ তাদের আচরণগত মনোভাব, অভিজ্ঞতা, সাক্ষ্যদান, সাক্ষাৎ করা, ঘনিষ্টতা, ইত্যাদি অর্থাৎ নিজেদের জীবন দ্বারা সকলের কাছে এমন একটি গল্প বলে যায় যা চলতে থাকে কালের যাত্রা পথ ধরে। তাদের মনে রাখতে হবে যে তাদের মধ্যদিয়ে ঈশ্বর তাঁর গল্প বলে চলেছেন।
ষাটের দশক থেকে শুরু করে যখন কমিউনিষ্ট ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি নিজেদের ভিতর এক অর্ন্তমুখী রহস্যের দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছিল, সেসব দেশের নাগরিকদের বাক্-স্বাধীনতা বা মৌলিক মানব অধিকার হরণ করা হয়েছিল, তখনও গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানকার মানুষের কাছে প্রশান্তির আশা ও শান্তির বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন। নিকট অতীতে উত্তর কোরিয়া ও চীন দেশের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে বা এখনো চালানো হচ্ছে। মিয়ানমারে বর্তমানে যা ঘটছে তাও কিছু ব্যতিক্রম নয়। সেখানে নাগরিকদের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা অহরহই লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেসব দেশের জনগণের একমাত্র আশা ও ভরসা এখন গণমাধ্যম কর্মী ও সামিাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। গণমাধ্যমের বদৌলতে তারা সত্যের বাণী ও স্বাধীনতা অর্জনের আশা লাভ করে। মূহুর্তেই পৃথিবীর একপ্রান্তের খবর অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে। পূর্বে যা ছিল অসম্ভব- গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তা-ই সম্ভব করে তুলেছে।
‘এসো দেখে যাও’ মানে হলো- যোগাযোগ স্থাপন, জনগণের সাথে সাক্ষাত করা বা তারা যেখানেই থাকুক তাদের মুখমুখি হওয়া। জনগণের সাথে সাক্ষাতের জন্য বা তাদের মুখমুখি হতে হলে আমাদের বা যোগাযোগ কর্মীদের একটি গল্প থাকতে হবে। সাংবাদিকদের প্রতিপালক সাধু ফ্রান্সিস দ্য সেল্স্-এর জীবনের মূল আদর্শ ছিল যীশুর মূল্যবোধের গল্প। সেই গল্প তিনি পৌছে দিয়েছেন সর্বত্র সবার কাছে। যীশু নিজেই হচ্ছেন আমাদের কাছে পাঠানো ঈশ্বরের প্রেমের গল্প। সেই গল্প আমাদের নবায়ন করে। আমাদের অপরিচ্ছন্ন পাপময় জীবনকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র ক’রে নবায়ন করে। এই প্রেমের গল্প শুধু অল্প মানুষের জন্য নয়, বরং সকল মানুষের জন্য। যেখানেই আমরা থাকি না কেন, ঈশ্বর সেখানেই আমাদের কাছে আসেন, আমাদের গল্প বলেন।
এই করোনা মহামারির সময় সেই মূল্যবোধ বা সেই পরিত্রাণের গল্প আমরা মানুষের কাছে কিভাবে পৌছে দিতে পারি? কিভাবে আমরা মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলব বা তা টিকিয়ে রাখব? এই কঠিন সমস্যার সময় যোগাযোগ মাধ্যমই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে। এই বৈশ্বিক মহামারির সময় যখন আমরা সামাজিক দূরত্বসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছি, শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা গণমাধ্যমই দূরের মানুষকে কাছে আনতে পারে, দূরে থেকেও তারা আমাদের ঘনিষ্ঠতা ও ভালবাসা অনুভব করতে পারেন। সেই মাধ্যমগুলিতে আমরা বলতে পারি, ‘এসো দেখে যাও’, যা যীশু ফিলিপকে বলেছিলেন (যোহন ১:৩৯)। কিন্তু এই জন্য যোগাযোগ মাধ্যমকে মানুষের মনে সেই অনুসন্ধিৎসা জাগাতে হবে – অনুসন্ধিৎসা জাগাতে হবে সত্যের বিষয়ে। সেই সত্য ঈশ্বর নিজেই প্রকাশ করেছেন যীশুর মধ্যে। সেই জন্য গণমাধ্যমের কাজ হলো সত্যের সেবা করা; সকল মানুষকে আহ্বান ক’রে বলা ‘এসো দেখে যাও’ সত্য কি!
বিশপ জের্ভাস রোজারিও, ডি.ডি.
রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিস, বাংলাদেশ।
“এসো দেখে যাও”- একটি অনুধ্যান
Please follow and like us: