ফাদার সুনীল রোজারিও। বিশপ ভবন, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
শত বছরের পরাধীন ভারতবর্ষের মহাকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে, বিদেশি শাসকদের মস্নদকে প্রবল বেগে ঝাঁকুনী দিয়ে ঝড়ের গতিতে পূর্ব থেকে পশ্চিমে অতিক্রান্ত হয়েছিলেন যিনি, তিনি হলেন অশান্ত অগ্নিগিরি, অতৃপ্ত স্রষ্টা, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ নামেই বেশি পরিচিত। এতো অল্প বয়সে, একটি কবিতার শিরোনামকে দিয়ে একজন কবির পরিচয় গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্যে বিরল। বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবিতা এতো প্রশংসিত বা সমালোচিত হয়নি- ‘বিদ্রোহী’ ছাড়া। বিদ্রোহী নিয়ে আলোচনায় বসলে প্রথমেই এর ‘গতি’ নিয়ে বলতে হয়। বিদ্রোহীর গতির মধ্যে কোনো অবসর নেই। বিদ্রোহীর ‘পুংতি’ কোথায়ও বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ দেয়নি। আবৃত্তি করতে গেলে কন্ঠ উদর থেকে তালু পযর্ন্ত নিমিষে নিমিষে উঠানামা করে- যেনো একজনের কন্ঠে গর্জে ওঠে শতজনের বজ্রকন্ঠ। কবিতার শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত যেনো একটা নিশ্বাস।
বিদ্রোহীর বিশাল ছন্দ জগতের মধ্যে বৈপরীত্য ও স্ব-বিরোধীতা স্পষ্ট। কবি, মনের আবেগে বিচরণ করতে গিয়ে কখনো হয়ে উঠেছেন দুর্বার, মহাপ্রলয়ের নটরাজ, মহাত্রাস। কখনো- যেমন রুদ্র ভগবানের ভূমিকায়, কখনো আবার শোক-তাপহানা খেয়ালী বিধির বক্ষে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার অঙ্গীকার। যুদ্ধের ময়দান থেকে নিমিষেই ছুটে গেছেন প্রেয়সীর অন্তরে। তরবারির ঝণঝণানীর মধ্যে শুনেছেন চপলা মেয়ের কাঁকন চুড়ির কণ্কণ্ শব্দ। ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হু্কংার শুনেছেন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে দাঁড়িয়েই আবার শুনেছেন বৃন্দাবনে শ্যামের বাঁশরি। বিদ্রোহীর ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ তূর্য।’ বিদ্রোহীর পরতে পরতে ভাব-ছন্দের এই যে বৈপরীত্য ও স্ব-বিরোধীতা এটা কিন্তু কবির অবাস্তব কল্পনা নয়, এটা মানুষের বাস্তব স্বভাবের তাড়না থেকে, সবল-দুর্বল আচরণ থেকে উৎসারিত। তাই বলা যায়, বিদ্রোহী কবিতায় বস্তুসত্য অপেক্ষা চৈতণ্যের আহ্বান বড় সত্য, বিভিন্ন ভাবের সমাবেশে হৃদয়ে তোলপাড় জাগানো বেসামাল তারুণ্যের প্রতি বিশ্বকে দাহণ করার একটি বিষবাণ।
বৃটিশ উপনিবেশ শক্তির বিরুদ্ধে কবির প্রতিটি কাব্য ছিলো ফনিমনসার ছোবল, প্রতিটি কবিতা ছিলো তরুণদের প্রতি অগ্নিবীণার হাতছানি, বিষের বাঁশির জ্বালাধরা উন্মাদনা। কবি নজরুলের ক্ষুরধার বাণী একদিকে যেমন বৃটিশ প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছিলো, অন্যদিকে তার রচনায় অসহ্য দরিদ্রতা, সমাজের ভন্ডামী, ধর্মের রাজনীতিতে দেশীয় তাবেদার ও ধনী সমাজের বিরুদ্ধে সব প্রতিবাদ একত্রিত হয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন যুগ-প্রজন্মের শীর্ষ সাম্যবাদী।
কবির বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। ১৩২৮ সালের পৌষ অর্থাৎ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে, একই সময়ে ‘বিজলী’ এবং ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো নজরুলের অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এমন অগ্নিঝরা শব্দবাণে কোনো বাঙালি কবির এটাই প্রথম আহ্বান। “আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি।” রক্ত উত্তপ্ত করে তোলার জন্য কি ক্ষুরধার বাণী।
বৃটিশ শাসনামলে যেসব বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের কাব্যগ্রন্থ নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হয়েছিলো, যারা দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে গিয়েছিলেন, নজরুল তাদের মধ্যে অন্যতম। নজরুলের যেসব কাব্য-কবিতাগ্রন্থ বৃটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙ্গার গান’, ‘প্রলয় শিখা’, ও ‘চন্দ্রবিন্দু।’
নজরুলের প্রথম নিষিদ্ধ নিবন্ধ গ্রন্থটি ছিলো ‘যুগবাণী।’ এটি ছিলো কোলকাতার ‘নবযুগ’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধের চমৎকার সংকলন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নভেম্বর বাংলা সরকারের এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ভারতে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টি এবং সরকারের তাবেদারদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভাষা প্রয়োগের জন্য যুগবাণী বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর পর বিভিন্ন সময়ে যুগবাণীর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন জানানো হলেও প্রায় ১৯ বছর পরে, ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি জানানো হয়- নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যাবে না। পরে ভারতবষের্র স্বাধীনতার পাঁচ মাস ১৪দিন আগে অর্থাৎ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ, সরকার যুগবাণীর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন।
যুগবাণী নিষিদ্ধ হওয়ার এক বছর পর ‘বিষের বাঁশি’ নিষিদ্ধ ঘোষণা ক’রে, ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। বিষের বাঁশির গোটা দেহ জুড়েই রয়েছে প্রাণ-স্পন্দনের গান। শোষণের বিরুদ্ধে বিষের বাঁশি ছিলো তরল-গরল, মরণ-বরণ। এ বিষয়ে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার মন্তব্য ছিলো, “কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে প্রচন্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষ-নিপীড়িত দেশবাসীকে মুত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।” ২১ বছর পর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ এপ্রিল বিষের বাঁশি’র উপর থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ তুলে নেওয়া হয়। বিষের বাঁশি বাজেয়াপ্ত হওয়ার কিছুদির পর ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ নভেম্বর বাজেয়াপ্ত হয় ‘ভাঙ্গার গান’ এবং এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর।
এর পর ভারত সরকারের রোষানল গিয়ে পড়ে নজরুলের কবিতাগ্রন্থ ‘প্রলয় শিখা’র উপর। প্রলয় শিখার উপর ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং পরের বছর বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। প্রলয় শিখার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে অর্থাৎ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রলয় শিখার পান্ডুলিপি পড়ে মুদ্রাকর ও প্রকাশকরা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে সরকার মোটেও রেহাই দিবে না। ভয়ে কোনো প্রকাশক রাজী না হওয়ায় কবি নিজের দায়িত্বেই গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। সে সময় বাংলা সাহিত্যে একই ব্যক্তি- লেখক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর হওয়ার গৌরব ছিলো এক বিরল ঘটনা। এই গ্রন্থে ‘নব-ভারতের হলদিঘাট’ নামক কবিতাটি ছিলো বাজেয়াপ্ত হওয়ার প্রধান কারণ।
প্রলয় শিখা নিষিদ্ধ হওয়ার মাত্র একমাস পরে অর্থাৎ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর এক গেজেট ঘোষণায় নিষিদ্ধ হলো নজরুলের আরোও একটি অপূর্ব সৃষ্টি ‘চন্দ্রবিন্দু।’ চন্দ্রবিন্দু কাব্যটি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কবিতায় ঠাসা ছিলো। কাব্য জুড়ে ব্যঙ্গ ভাষা থাকলেও সেগুলোর মধ্যদিয়ে কবির দেশাত্মবোধ প্রকাশ পেয়েছে। চন্দ্রবিন্দুর উপর থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ গেজেটের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর। নজরুল গবেষকদের মতে, ‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙ্গার গান’, ‘প্রলয় শিখা’, ও ‘চন্দ্রবিন্দু’- এই পাঁচটি গ্রন্থ বৃটিশ উপনিবেশ সরকার নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করার পরেও আরো কিছু গ্রন্থ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছিলো। সেগুলো হলো- অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা, ফণিমনসা, সর্বহারা ও রুদ্রমঙ্গল। কিন্তু নিষিদ্ধের সুপারিশ থাকলেও অজ্ঞাত কারণে নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করার কোনো সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
নজরুলের মোট ৫টি কাব্যগ্রন্থ নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হলেও কারাদন্ড হয়েছিলো অর্ধ-সাপ্তাহিক নিজের পত্রিকা ‘ধূমকেতু’তে নিজের লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ও একই সংখ্যায় একটি ১১ বছরের মেয়ের লেখা নিবদ্ধ ‘বিদ্রোহী কৈফিয়ৎ’ ছাপানোর জন্য। এগুলো প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। কাঠগড়ায় নজরুলের বিরুদ্ধে রাজ-দ্রোহিতার অভিযোগ এনে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছিলো। নজরুলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার ৬ মাসের কারাদন্ড হয়েছিলো ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তার প্রকাশিত ‘প্রলয় শিখা’ কাব্যের জন্য। ঠিক সেই সময় মহাত্মা গান্ধী লবণ সত্যাগ্রহের মধ্যদিয়ে যে আন্দোলন তৈরি করেছিলেন, সরকার একটা আপোষের মাধ্যমে আন্দোলন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ যে চুক্তি করেছিলো, সেটির নাম ছিলো, ‘গান্ধী-আরউইন চুক্তি।’ চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিলো- রাজবন্দির মুক্তি। এই চুক্তির ফলেই সেবার নজরুল কারাভোগ থেকে নিস্কৃতি পেয়েছিলেন।
১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অর্থাৎ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে, পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে বাংলার গৌরব, অপরূপ সুরস্রষ্টা, অবিনব গীতিকার, অশান্ত বুলবুল, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাংলার মেঠোপথে বাঁধনহারা এই বিদ্রোহী আত্মার বিচরণ মাত্র ২৫ বছর। এই ২৫ বছরেই ভারতবর্ষে বৃটিশদের দু’শো বছরের মজবুত শাসন ব্যবস্থাকে নজবড়ে করে দিয়েছিলেন। তরবারির চেয়ে লেখনী যে কতো শক্তিশালী, কবি সেটাই প্রমাণ করেছিলেন তাঁর শাণিত বাণীতে।
কাজী নজরুল ইসলাম একজন বিদ্রোহী কবি, একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চারণ কবি ও সুরের অপূর্ব সমাহার ও বৈচিত্রে যিনি একটি আলাদা ভূবন রচনা করেছেন, তিনি আমাদের জাতীয় কবি। বৈচিত্রময় জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কবি নিরবে বিদায় নিয়েছেন বাংলার মেঠোপথ থেকে। বৃটিশ শাসক ও তাবেদারদের কাছে তিনি নিষিদ্ধ হলেও বাংলার কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে কবি চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। এই অশান্ত বুলবুলের ১২২তম জন্ম-জয়ন্তীতে ‘বিদ্রোহী’ আত্মার প্রতি আমাদের প্রাণঢালা শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Please follow and like us: