বরেন্দ্রদূত রিপোর্টার : ফাদার বাবলু সি. কোড়াইয়া
গত ২৮ এপিল ২০২১ খ্রিস্টাব্দে, রাজশাহীর উকান (UCAN) নিউজ রিপোর্টার কর্তৃক রচিত একটি সংবাদ তাদের অনলাইন পেইজে প্রকাশ করেছে/ ছাঁপানো হয়েছিল। যার শিরোনাম করা হয়েছিল (Santal Christians return to ancestral faith in Bangladesh) যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “বাংলাদেশের সান্তাল খ্রিস্টানগণ আবার তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসে ফিরে যাচ্ছে।” এর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য আরেকটা উপশিরোনাম করেছেন, (Scores of people from the indigenous community are embracing their old Sarna religion, claiming the Church has neglected them). যার অর্থ এভাবে করা যেতে পারে, ‘আদিবাসী কমিউনিটির লোকদের দাবি, চার্চের অবহেলার কারণে তারা তাদের পুরানো সর্ণা ধর্ম গ্রহণ করে পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসে ফিরে যাচ্ছে।’ তাই সংবাদটা নিয়ে যথেষ্ট সময় ধরে আলোচনা, পর্যালোচনা এবং অনুসন্ধান করা হয়েছে বিভিন্ন সত্য উৎসের বা সূত্রের কাছে; সেই সত্যের উপর ভিত্তি করে বরেন্দ্রদূত অনলাইন উপস্থাপন করতে যাচ্ছে, “জেনে নেওয়া যাক্ আসল সত্য কোনটা।”
এই সত্য অনুসন্ধান করতে বরেন্দ্রদূত অনলাইন উপস্থিত হয় নিয়ামতপুর উপজেলার পুঙ্গি গ্রামে, যে গ্রামের ঘটনাটা নিয়ে উক্ত সংবাদটি করা হয়েছিল। উকান (UCAN) নিউজ রিপোর্টার সম্ভবত: নিজেও জানতেন না যে, ঘটনাটা আসলে নিয়ামতপুরের কোন গ্রামে ঘটেছে। তাই সংবাদে রিপোর্টার এভাবে লিখেছেন, ‘নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুরে সাওতাল গ্রামে।’ আসলে কখন, কোথায়, কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছিল তা আরও ভালভাবে অনুসন্ধ্যান করার প্রয়োজন ছিল। এমন কী কাথলিক চার্চের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরোহিতের নিকট উপস্থিত হয়ে সত্য ঘটনা জেনে নিয়েই কেবল সংবাদ করলে আসল ঘটনাটি জানা সম্ভব হতো। তাই সত্যের অনুসন্ধানে বরেন্দ্রদূত অনলাইন ঘটনাস্থলে যায় এবং গ্রামবাসী সকলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা থেকে যা বেরিয়ে এসেছে তাহলো এই, ‘পুঙ্গি গ্রামের একটি সান্তাল খ্রিস্টান মেয়ে একজন অখ্রিস্টান (বেদিন) ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে। কিন্তু কাথলিক ধর্মের নিয়মানুযায়ী সাধারণত বিবাহ আর্শীবাদ দেয়া হয় একজন কাথলিক ছেলের সাথে আরেক কাথলিক পক্ষের মেয়ের এবং তা করা হয় কাথলিক গীর্জায়। সেই সাথে এটাও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যদি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু ঘটে অর্থাৎ মিশ্র বিবাহের ক্ষেত্রে তারপরও বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে হবে গীর্জায় এবং মণ্ডলির পক্ষ থেকে একজন যাজক এবং ২ জন বিশ্বাসী সাক্ষীর উপস্থিতিতে। এ নিয়মের বাইরে কিছু করতে চাইলে কোন পুরোহিতই অন্য পন্থায় বিবাহ আর্শীবাদ দিতে পারে না। এটা কাথলিক মণ্ডলি কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ম। এখন, উকান (UCAN) সংবাদে যে বিবাহের কথা বলা হয়েছে তা কাথলিক মণ্ডলির নিয়ম বহির্ভুত, বিধায় একজন কাথলিক পুরোহিত সেই ধরণের বিবাহের অনুমতি দিতে পারেন না। আর এ ক্ষেত্রে যদি কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তা সংঘটিত করতে চায় সেখানে মণ্ডলি কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন উকান (UCAN) নিউজের রিপোর্টার? তাই বলা যেতে পারে আপনি যদি ফেসবুকের তথ্যের উপর ভিত্তি করে আসল সত্যটা অনুসন্ধ্যান করতে চান, তাহলে আপনি কি আসল সত্যটা জানতে পারবেন? এই ভাবে সত্যের উৎঘাটন করা সম্ভব কী?
যাদেরকে নিয়ে উক্ত সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছে বরেন্দ্রদূত অনলাইন সরাসরি তাদের মুখোমুখি হয়ে এই প্রশ্ন করে, “উকান (UCAN) নিউজের রিপোর্টার বলেছেন যে, সান্তাল সমাজের নেতারা দাবি করছেন যে, অবহেলা ও সামাজিক সহায়তার অভাবের কারণে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস ফিরে যাচ্ছেন” এ বিষয়ে আপনি /আপনারা কী মনে করেন?
পুঙ্গিঁ গ্রামের মিঃ গাব্রিয়েল মার্ডী গ্রাম প্রধান, যাকে মাঞ্জিহারাম নামে ডাকা হয়। তিনি বরেন্দ্রদূত অনলাইনকে জানান যে, “কাথলিক মণ্ডলি সবসময় আমাদের পাশে আছে। কাথলিক মণ্ডলির অবহেলা ও সামাজিক সহায়তার অভাবের কারণে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসে ফিরে যাচ্ছেন এই মর্মে উকান (UCAN) নিউজের রিপোর্টার যে সংবাদ প্রচার করেছে তা একটা মিথ্যা সংবাদ। আসলে যারা সংবাদ লেখক তারা তো কখনও আমাদের কাছে আসে নাই বা আমাদের নিকটা হতে কোন তথ্যও নেয়নি”।
যে পরিবারকে নিয়ে উকান সংবাদ তৈরী করেছে সেই পরিবারের পিতা গণেশ টুডু (যার ছদ্দনাম দেয়া হয়েছে নরেশ টুডু) বলেন যে, “মণ্ডলির কাছ থেকে অবহেলা, আধ্যাত্মিক যত্ন বা সামাজিক সহায়তা পাচ্ছি না বলেই যে আমি সর্ণা ধর্মে ফিরে গেছি তা নয়। বরং আমার মেয়ে ১০ বছর পূর্বে সনাতন ধর্মের একটি ছেলের সাথে অবৈধভাবে বসবাস করছিলো। কিন্তু ছেলেটি কোনভাবেই ক্যাথলিক মণ্ডলির নিয়ম মেনে বিয়ে আশীর্বাদ নিতে না চাওয়ায় উপায় না পেয়ে শুধুমাত্র বিবাহের জন্য আমার পরিবার সনাতন ধর্মে ফিরে গেছে। এখানে অন্য কোন কারণ নেই”।
এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, বিধায় এই ধরণের ঘটনাকে সার্বজনীন করার কোন সুযোগ নেই। শুধু বর্তমান কালেই নয়, যীশুর সময়েও এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে। যারা পবিত্র বাইবেল পাঠ করে তাদের তো তা অজানা থাকার কথা নয়। যিশুর সত্য শিক্ষা মেনে নিতে না পেরে শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের পুরনো জীবনে ফিরে গেলেন; তাঁরা যিশুর সঙ্গে চলাফেরা বন্ধ করে দিলেন (যোহন ৬: ৬৬)। ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান বাস্তবতায়ও কাথলিক মণ্ডলি প্রদত্ত শিক্ষা-রীতি-নীতি অনেকে নিজেদের স্বার্থপরতা-অজ্ঞতা-ক্ষীণ বিশ্বাসের কারণে মেনে নিতে অস্বীকার করে বা ভ্রান্ত মতবাদীদের দ্বারা বিপথে চলে যায়। এটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। মণ্ডলি শিক্ষা, পরামর্শ, সহায়তা ও অনুপ্রেরণা দিতে পারে, কিন্তু তা গ্রহণ ও পালন করার দায়িত্ব তো ব্যক্তির নিজের। মণ্ডলি জোরপূর্বক কাউকে ধর্মান্তরিত করে না আবার জোর করে মণ্ডলি থেকে তাড়িয়েও দেয় না।
ভূতাহারা গ্রামের নিয়ামতপুর ১নং ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মিঃ ঈশ্বর টপ্প্য। যিনি একজন কাথলিক খ্রিস্টান। তিনি উক্ত বিষয়ে এভাবে তার মতামত তুলে ধরেন, “আমার মতে উকান (UCAN) নিউজে একটা ভূয়া বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করে আমাদের আদিবাসী সমাজ তথা কাথলিক মণ্ডলিকে অবমাননা করেছে। কারণ তারা সরেজমিনে না এসে উক্ত বিষয়টির সত্যতা যাচাই না করেই সংবাদ রচনা করেছে। তাই আমার জোর দাবি যারা সংবাদটি লিখেছে তারা যেন গ্রামে এসে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে সঠিক তথ্য নিয়ে সত্য সংবাদ প্রচার করে এবং ভুল সংবাদ পরিবেশন করে জনমনে যে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে”।
উক্ত সমস্যা নিয়ে বরেন্দ্রদূত অনলাইন পুঙ্গিঁ গ্রামে উপস্থিত হলে, পুঙ্গিঁ গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে এই দাবী তুলে ধরা হয় যে- “আমাদের পুঙ্গিঁ গ্রামের খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের বিরুদ্ধে যে ভূয়া, বানোয়াট, মনগড়া তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। সেই সংবাদ দাতাকে বা উকান (UCAN) নিউজকে সরেজমিনে এসে সত্য ঘটনা জানার জন্য অনুরোধ করছি। প্রচারিত সংবাদের সাথে জড়িত সংবাদ দাতা বা উকান নিউজকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য পুঙ্গিঁ গ্রামের খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবী জানাচ্ছি”।
উকান নিউজ রিপোর্টার আবার এটাও লিখেছে যে, আদিবাসীরা কিছু পাওয়ার লোভে কাথলিক ধর্মগ্রহণ করে এখন তা পাচ্ছে না বলেই তারা তাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসে ফিরে যাচ্ছে! এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
এই বিষয়ে ভূতাহারা ধর্মপল্লীর পাল-পুরোহিত শ্রদ্ধেয় ফাঃ লুইস সুশীল পেরেরা বলেন, “তারা (আদিবাসীরা) কোন কিছু পাবার জন্য নয়, বরং বিশ্বাস ধারণ করতেই স্বেচ্ছায় তারা কাথলিক খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। দীক্ষাগ্রহণের পূর্বে তারা নিজেরাই সেভাবে আবেদন করেন যে, তারা ধর্ম ও ধর্মীয় জীবন চায়”।
উকান (UCAN) নিউজের রিপোর্টার আরও বলেছে যে, সান্তাল সমাজের নেতারা দাবি করছেন যে, অবহেলা ও সামাজিক সহায়তার অভাবের কারণে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের পুরনো বিশ্বাসে ফিরে যাচ্ছেন এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে ফাঃ লুইস সুশীল পেরেরা বলেন যে, “তাদের কোনভাবে অবহেলা করা হয়নি। করোনা ভাইরাস থাকা সত্ত্বেও তাদের নানা সামাজিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। এলাকার আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায় নানাভাবে সামাজিক সহায়তা ও যত্ন পেয়েছে”।
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের বিশপ মহোদয় উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন যে, আমি এই খবরে আশ্চর্য হয়েছি এই জন্য যে এই খবরের ভিত্তি না থাকলেও কেন উকান (UCAN) ঘটা করে খবরটি প্রকাশ করলো? ঘটনাটি ঘটেছে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর থানার ভূতাহারা কাথলিক ধর্মপল্লীর অধীনে পুঙ্গি গ্রমে। নিয়ামতপুরের পুঙ্গি গ্রামে যা ঘটেছে তা নতুন কিছু নয়। মঙ্গলবাণী প্রচার করতে গিয়ে কাথলিক মণ্ডলী প্রথম থেকেই অনেক চ্যালেঞ্জ ও কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করে আসছে। এখনও তা করছে। রাজশাহী ডাইওসিস কোন ব্যতিক্রম নয়। মিশনারীদের সময়েও তাদের উপস্থিতিতেও অতীতে এরূপ ঘটনা অনেক ঘটেছে। কিছু মানুষ তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্ম ধরে আবার ছাড়ে, এটা নতুন কিছু নয়। আমাদের ধর্মপ্রদেশের উপর যে কেউ সংবাদ প্রকাশ করুক, তাতে আমাদের কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে সেই সংবাদ যেন হয় বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য। কারণ আমি মনে করি সংবাদ কর্মী বা সংবাদ মাধ্যমের প্রধান কাজই হলো সকল মানুষের কাছে সত্য খবর প্রকাশ করা এবং মানব জাতির প্রকৃত অগ্রগতিতে সহায়তা করা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে পুঙ্গি গ্রামের ঘটনাটি উকান (UCAN) যেভাবে প্রকাশ করেছে তা মিথ্যার এক কল্পকাহিনী। আর উকান (UCAN) যে সকল মানুষের ফেসবুক বা সাক্ষাতের উপর ভিত্তি করে এই মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছে, তারা অখ্রিস্টান। তারা নিশ্চয়ই কাথলিক মণ্ডলীর পক্ষে কথা বলবে না! আর কাথলিক মণ্ডলীর মধ্যেও অনেক মানুষ আছে যারা মণ্ডলীর অর্থে শিক্ষা দীক্ষা পেয়েছে, মানুষ হয়েছে, তারা আরও পাবার লোভে মণ্ডলীর বিরুদ্ধে দাড়াতে পিছ্ পা হয় না। কিন্তু আমরা যারা মণ্ডলীর দায়িত্বপ্রাপ্ত, আমরা তো মণ্ডলীর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে পারি না। প্যারিসের ফাদারগণও তা দিতে পারেন না। ঈশ্বরের কাছে আমাদের সকলকেই জবাবদিহী করতে হবে। তাছাড়া পুঙ্গি গ্রামে যে অখ্রিস্টান ছেলেটি একটি কাথলিক মেয়েকে চার্চের বাইরে আদিবাসীদের সনাতন নিয়মে বিয়ে করেছে, তাতে ভূতাহারা প্যারিসের পাল-পুরোহিত বা ফাদারগণ কি করতে পারতো? তারা তো ফাদারদের কাছে যায় নি বা ফাদারদের পরামর্শ শোনেনি। তাই আমার একটিই কামনা যেন সংবাদকর্মীরা বা কোন সংবাদ মাধ্যম শুধু টাকা পয়সা উপার্জনের জন্য “হলুদ সাংবাদিকতা” না করে, বা মিথ্যার বেসাতি না করে। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের পক্ষ থেকে সকলকে শুভ কামনা জানাই।
উকান (UCAN) নিউজের রিপোর্টার যে, সত্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে সংবাদ সংগ্রহ করেননি তার একটি জ¦লন্ত প্রমাণ হল রিপোর্টের শেষে নরেশ টুডু নামে যে ব্যক্তিটির পরিচয় তুলে ধরেছেন সেখানেই ব্যক্তিটির নামের পাশেই লেখা আছে এটা তার আসল নাম নয়। এর থেকে কি এটাই পরিষ্কার হয়ে উঠছে না যে সংবাদটি একটি মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে? সুধী মণ্ডলী/ পাঠক ও উকান (UCAN) অনলাইনের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা? এর সঠিক জবাব পাব কী?
জেনে নেওয়া যাক্ আসল সত্য কোনটা!
Please follow and like us: