ফাদার সুনীল রোজারিও। বিশপ হাউজ, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
ভূমিকাঃ রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিস, প্রতি বছর বিষয়ভিত্তিক পালকীয় আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে। বিষয়ভিত্তিক মূলভাব নেওয়া হয়, সময়ের প্রয়োজনে চার্চের পালকীয় জীবনকে সুদৃঢ় করার জন্য। দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে মানুষ তাদের প্রচেষ্টায় স্বনির্ভর হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেলেও- আধ্যাক্তিক জীবন প্রাচুর্য্যরে মধ্যে নিমজ্জিত হওয়ার স্রোত গতিতে এগুচ্ছে। মানুষের পার্থিব জীবন সমৃদ্ধ হবে- তাতে দোষের কিছু নেই- কিন্তু আধ্যাক্তিক জীবন বাদ দিয়ে নয়। তবে এটাও ঠিক, প্রতি বছর ধর্মপ্রদেশ পালকীয় কর্মশালায়- ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ছাড়াও কৃষ্টি-সংস্কৃতি, পারিবারিক জীবন, তাদের আয়-ব্যয়, সন্তান প্রতিপালন এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার দিকেও আলোপাত করে থাকে। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য হলো- ২০১০ খ্রিস্টাব্দের পালকীয় সম্মেলনের বিষয়ভাব- “আমার ধর্মপল্লী-আমার দায়িত্ব।” সেই পালকীয় সম্মেলনে, মণ্ডলিকে স্বাবলম্বী করে তোলা এবং নিজে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো। এই দু’টি দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রত্যেক খ্রিস্টভক্ত ঈশ্বরের কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ দান লাভ করেছেন।
১. কীভাবে আমরা এই দান গ্রহণ করবোঃ ঈশ্বর যে আমাদের অনুগ্রহ দান করেছেন, তিনি কী তার প্রতিদান চান ? ঈশ্বর কাঙাল নন যে, আমাদের কাছ থেকে চেয়ে নিবেন। ঈশ্বর বলেছেন, “আমি প্রেমেই প্রীত, বলিদানে নয়, আহুতির চেয়ে ঈশ্বর জ্ঞানেই বরং আমি প্রীত (হোসেয়া ৬:৬)।” ঈশ্বর আমাদের অন্তর দেখতে চান- কিন্তু অযথা কোনো আয়োজন নয়। তিনি দেখতে চান, তাঁর অশেষ দানের জন্য আমরা কতোটুকু কৃতজ্ঞ। আমরা এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি অন্যকে ভালোবেসে। আমাদের পালকীয় ক্ষেত্র হলো প্রতিবেশী, মানুষ। মানুষকে ভালোবাসলে তা মানুষের মধ্যদিয়ে ঈশ্বরের কাছে গিয়ে পৌঁছে। যিশু বলেছেন, “আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, আমার এই তুচ্ছতম ভাইদের একজনের জন্য তোমরা যা কিছু করেছো, তা আমার জন্যেই করেছো (মথি ২৫:৪০)।” মানুষের প্রতি ভালো কিছু করার পাশাপাশি অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধেও মানুষকে দাঁড়াতে হবে। কারণ বিশ্বের সব অশান্তির মূল কারণ মানুষ। মানুষ যখন অকৃতজ্ঞ হয়, তখন অন্যায়, অন্যায্যতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বসৃষ্টি মানুষের হেফাজতে রেখেছেন সবার কল্যাণের জন্যে। মানুষ কিন্তু মালিক নন- দায়িত্বপ্রাপ্ত বা ভারপ্রাপ্ত সেবক মাত্র। ঈশ্বরের যাবতীয় অনুগ্রহ দানের প্রতিদান হলো, “কৃতজ্ঞতা” প্রকাশ করা।
২. কিভাবে ধন্যবাদ দিতে হবেঃ মানুষের মধ্যে যে সৃজনশীলতা রয়েছে- তা কিন্তু পবিত্র-আত্মার দান। এই দান বিভিন্নজনকে বিভিন্ন মাত্রায় দেওয়া হয়েছে। “ঐশ আত্মাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা প্রত্যেককে দেওয়া হয় সকলেরই মঙ্গলের জন্য (১করি ১২:৭)।” এই ঐশদান নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য নয়। পবিত্র আত্মা একেকজনকে একেক প্রতিভা দিয়েছেন- সবাই সবার মঙ্গল করার জন্যে, বিশ্বসৃষ্টিকে রক্ষার জন্যে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন অহেতুক কোনো বাসনা নিয়ে নয়- কিন্তু মানুষের জন্যে, ভবিষ্যতের জন্যে, বিশ্বসৃষ্টির জন্যে। যখন আমরা তাঁর সেই অভিপ্রায় ও আহ্বানে সাড়া দেই- সেটাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রতি আমাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
৩. ঐশ অনুগ্রহদানকে পদদলিত করো নাঃ ঈশ্বর অনুগ্রহ দান ক’রে মানুষের প্রতি তাঁর আস্থা রেখেছেন। এই আস্থার জবাব দিতে হয় আমাদের সৃষ্টি করার মধ্যদিয়ে। এই সৃষ্টি হলো, তাঁর অনুগ্রহের প্রতি আমাদের জবাবদিহীতা। “তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের প্রত্যেককেই একদিন নিজের সম্বন্ধে পরমেশ্বরের কাছে হিসাব দিতেই হবে (রোমীয় ১৪:১২)।” দীক্ষাস্নানের মধ্যদিয়ে আমরা খ্রিস্টের শিষ্যত্ব লাভ করেছি আর সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়ে ওঠেছি। এই দায়িত্ব পালন করতে হয় ঈশ্বরের দেওয়া অনুগ্রহ সৎ কাজে লাগিয়ে। “তোমাদের বলছি, তোমরা যেন সৎ কাজ করেই চল, কখনো ক্লান্তি না মান ( ২থেসা ৩:১৩)।” ঈশ্বর গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করে মানুষের হাতে দিয়েছেন- আরো সৃষ্টি করার জন্য, বসে থাকার জন্য নয়। আমরা যখন সৃষ্টি করি তখন ঈশ্বরকে সহায়তা করি। আর যখন অলস হয়ে থাকি তখন ঐশ অনুগ্রহদানকে পদদলিত করি।
মণ্ডলির বড় সম্পদ হলো খ্রিস্টসমাজ। এই খ্রিস্টসমাজ ঈশ্বরের দান। এই খ্রিস্টসমাজকে আধ্যাক্তিকভাবে সমৃদ্ধশালী করে তোলার দায়িত্ব মণ্ডলির। অন্যদিকে মণ্ডলির প্রতি ভক্তসমাজের দায়িত্বও খাটো করে দেখার বিষয় নয়। মণ্ডলিকে স্বাবলম্বী করে তোলার দায়িত্ব যেমন ভক্তমণ্ডলির- তেমনিভাবে ভক্তসমাজ নিজেও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু খ্রিস্টভক্তগণ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে কতোটুকু এগিয়েছে- তা নিজেদের বিশ্লেষণ করে দেখার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। পৃথিবী প্রতিদিন সমৃদ্ধির পথ ধরে এগুচ্ছে- সেই তুলনায় “আমাদের খ্রিস্টভক্তদের অনেকেই এখনো মঙ্গলসমাচারের শিক্ষায় সমৃদ্ধ না হয়ে দায়িত্বহীন, স্বেচ্ছাচারী, মাতাল ও অলস কর্মচারীর মত জীবন যাপন করছে।” এই প্রবণতা ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনিশ্চিতের মধ্যে ঠেলে দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। আর ঐশ অনুগ্রহদানকে এইভাবে পদদলিত করার জন্য ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহী করতে হবে। “শাস্ত্রে তো লেখাই আছে, প্রভু বলেন, আমার জীবনের দিব্য, প্রতিটি জানু আমার সামনে নত হবেই…(রোমীয় ১৪:১১)।” আমরা যেনো সেই অলস কর্মচারীর মতো না হই, যে মনিবের দেওয়া অর্থ মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিলো। ঈশ্বর আমাদের প্রতিভা দিয়েছেন ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে কর্মযজ্ঞে পরিনত করার জন্য- অলস হয়ে থাকার জন্য নয়। আমাদের একদিন হিসাব দিতেই হবে।
৪. হিসাব দিতে হবে, জবাবদিহী করতে হবেঃ যিশু বলেছেন, “তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও, বিশ্বসৃষ্টির কাছে তোমরা ঘোষণা কর মঙ্গলসমাচার (মার্ক ১৬:১৫)।” যিশুর এই আমন্ত্রণ হলো আমাদের প্রত্যেককে একজন করে মিশনারি হয়ে ওঠার আহ্বান। এই মিশনারি যাত্রায় আমাদের সাথে রয়েছেন পবিত্র আত্মা। আমাদের স্ব স্ব অবস্থানে থেকে এই মিশনারি কাজ করতে হবে। এই মিশনারি দায়িত্ব হলো- ১. মণ্ডলির সেবা করা, ২. মানুষের সেবা করা এবং ৩. বিশ্ব প্রকৃতির সেবা করা। পোপ ফ্রান্সিস তাঁর “তোমার প্রশংসা হোক” সর্বজনীন পত্রজুড়েই বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি মানুষের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা যদি জবাবদিহী করতে ব্যর্থ হই- প্রকৃতি ব্যর্থ হবে না, সে তার আপন নিয়মে প্রতিশোধ নিবে। আজকের এই মহামারি তার বড় প্রমাণ। মণ্ডলির প্রতি আমাদের জবাবদিহীতার স্বাক্ষর রাখতে পারি- আমাদের ‘সময়’ আমাদের ‘সামর্থ্য’ ও আমাদের ‘অর্থ-কড়ি’ দান করার মধ্যদিয়ে। কারণ মণ্ডলি ‘আমার-আমাদের-প্রত্যেকের।’
৫. বিশ্বাসের ফল- বিশ্বাস নিস্ফল নয়ঃ বিশ্বাসই আমাদের চালিত করে সেবার লক্ষ্যে। ভালোবাসা ও আশা নিয়েই মানুষ বিশ্বাসের পথে এগিয়ে যায়। বিশ্বাস এমনই একটি পবিত্রাত্মার দান যা সীমাহীন। বিশ্বাস মানুষের মধ্যে যতো বিলানো যায় ততোই বৃদ্ধিলাভ করে। বিশ্বাসের শেষ নেই- বিশ্বাস নিস্ফল হয় না। এই বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা শুরু হয় পরিবারে। এই গুণগুলো পরিবার থেকেই বিস্তারলাভ করে। খ্রিস্টের শিষ্য হিসেবে পবিত্রাত্মার এই দানসমূহ নিজের মধ্যে সীমিত রাখার কোনো অবকাশ নেই। তাই যিশু বলেছেন, “বিনা মূল্যে যা পেয়েছ, বিনা মূল্যেই তা দিয়ে যাও (মথি ১০:৮)।” পোপ ফ্রান্সিস তাঁর “আমরা সকলে ভাইবোন” নামক সর্বজনীন পত্রে লিখেছেন, “ঈশ্বর কিন্তু আমাদের সবকিছু দেন বিনা মূল্যে, এমনকী যারা অকৃতজ্ঞ তাদেরও তিনি দেন একইভাবে।” যিশু তাঁর শিষ্যদেরও এই বিষয়ে বলেছেন, “কারণ সৎ-অসৎ সকলেরই জন্য তিনি ফুটিয়ে তোলেন তাঁর সূর্যের আলো (মথি ৫:৪৫)।” সুতরাং আমাদের মধ্যে পবিত্র-আত্মার দান বিশ্বাসের ফল অন্যের মধ্যদিয়েও প্রকাশ করতে পারি। বিশ্বাসের ফল যেনো নিস্ফল না হয়।
৬. সন্তানের কাছে পৌঁছে দাওঃ “আমাদের যা আছে তার সর্বোত্তমগুলো সন্তানদের বা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।” শুরুতেই “পরিবারে সন্তানদের এমন গঠন দিতে হবে, যেনো তারা ‘কৃতজ্ঞ’ হ’তে শিখে।” শুধু পরিবার নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিশ্বাসের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য যিশু বলেছেন, “তোমরা পৃথিবীর সর্বত্র যাও।” পঞ্চাশত্তমী পর্বদিনে আমরা পবিত্র আত্মাকে লাভ করে সর্বজনীন হয়ে ওঠেছি- আমরা মিশনারি হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। আমাদের “ধর্মবিশ্বাস” সর্বজনীন করে তোলার জন্য এই আমন্ত্রণ। মণ্ডলির পালকগণ, ধর্মব্রতীগণ এবং খ্রিস্টসমাজ- প্রত্যেকেরই নিজ নিজ পেশা ও কর্মস্থান থেকে এই ধর্মবিশ্বাস অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হয়েছি। আমরা দায়িত্ববান হলে সন্তানেরাও হবে দায়িত্বশীল। সন্তানদের শিখাতে হবে যত্নের সংস্কৃতি। তারা যেনো জীবনের শুরু থেকেই শিখতে থাকে কীভাবে বড়দের সম্মান করতে হয়, কীভাবে বৃদ্ধদের যত্ন নিতে হয়।
৭. বাণী প্রচার ও ঐশরাজ্য বিস্তারঃ বাণী প্রচার ক’রে ঐশরাজ্য বিস্তার করা প্রত্যেক খ্রিস্টভক্তের দায়িত্ব। এই বাণী প্রচার ও ঐশরাজ্য বিস্তার একটি আহ্বান। “তবে আমি তো নিজে থেকে তা করি না, আসলে আমার ওপর ন্যস্ত কর্তব্য ব’লেই তা করি (১করি ৯:১৭)।” যিশু রোগীদের সুস্থ করার পর তাদের বারণ করতেন- প্রচার না করতে- গোপন রাখতে বলতেন। কিন্তু যিশু তাদের যতোই বারণ করতেন ততোই তারা ”রটাতো।” ঠিক একইভাবে আমরাও পবিত্রাত্মাকে লাভ করেছি ‘সুসংবাদ’ গোপন ক’রে রাখার জন্য নয় “রটাবার” জন্য। এই রটানো হলো মানুষের কাছে ঐশরাজ্য ঘোষণা। এই ঐশরাজ্য ঘোষণার মধ্যদিয়ে আমার খ্রিস্টের পরিত্রাণকর্মের সহকর্মী, সহযোগী হয়ে উঠি।
উপসংহারঃ পরিশেষে আমরা যিশুর প্রতিপালক, মারীয়ার দায়িত্বশীল স্বামী এবং মন্ডলির প্রতিপালক সাধু যোসেফের বিষয়টি ধ্যান করি। তাঁর ছিলো একটি কৃতজ্ঞ হৃদয়, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং ঈশ্বরের আহ্বানের প্রতি বিশ্বস্ততা। পোপ ফ্রান্সিস, “সাধু যোসেফ বর্ষ” ঘোষণা ক’রে, ঈশ্বরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হিসেবে সাধু যোসেফের আদর্শকে জীবনে ধারন ক’রে তাঁর সঙ্গে যাত্রা করার আহ্বান জানিয়েছেন। ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞপ্রাণ নিয়ে আমাদের এই যাত্রার লক্ষ্যসমূহ হলো- পরিবার, ভক্তসমাজ, মণ্ডলি এবং গোটা বিশ্বজগত। তাহলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবক হিসেবে আমাদের মধ্যদিয়ে মূর্ত হয়ে উঠবে খ্রিস্টের এই আমন্ত্রণ, “তোমরা জগতের সর্বত্রই যাও, বিশ্বসৃষ্টির কাছে তোমরা ঘোষণা করো মঙ্গলসমাচার (মার্ক ১৬:১৫)।”