ফাদার সুশীল লুইস পেরেরা
প্রাথমিক কথা: রাজশাহী কাথলিক ধর্মপ্রদেশ এখন সাবালক, নিজের পথ ধ’রে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। অনেক আশা, উদ্দীপনা ও চেতনা নিয়ে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে সে তার যাত্রা শুরু ক’রে বর্তমানে তার পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করেছে। দেখতে দেখতে কত সময় চলে গেছে! অনেক চড়াই-উতরাই অতিক্রম ক’রে এক বিরাট এলাকায় তার বহুবিধ কাজ চালিয়ে বর্তমানে সে অনেক দূর এগিয়ে এসে এখন চিন্তা করছে ভবিষ্যতে নিজের আরো প্রসার ঘটাতে। আর এখনই তো তার জন্য সুসময়! কারণ নানা পর্যায়ে এ ধর্মপ্রদেশ অনেক সেবা দিয়েছে, যুগ-চলায় তার এসেছে নতুন অভিজ্ঞতা, চিন্তা, অগ্রাধিকার, দায়বোধ প্রভৃতি। এমতাবস্থায় কোন কোন পর্যায়ে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে চিন্তা ও আলোচনা চলছে: আমাদের ধর্মপ্রদেশ ভাগ করার সময় আসছে। অনেকে এ বিষয়ে জানে ও গুরুত্ব দেয়, অনেকে আবার এ বিষয়ে নির্বিকার। আর সেভাবেই কখনো বা কোথাও ভাসা ভাসা শোনা যায়Ñ উত্তরে “জয়পুরহাট” নতুন ধর্মপ্রদেশ হবে। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ দিনাজপুর ধর্মাঞ্চল থেকে ভাগ করার সময় স্থানের দূরত্ব, কঠিন যাতায়াত ব্যবস্থা, যাত্রা-সময়, কম কর্মী সংখ্যা, ভবিষ্যত কাজের সম্ভাবনা, সমন্বয় প্রভৃতি বিবেচনায় রাখা হয়েছিল। তখন তো আর বর্তমানের ডিজিটাল যুগ ছিল না, তাই তৎকালীন বাস্তবতা অনুসারে আলোচনা, সিদ্ধান্ত ও কার্যপন্থা এসেছিল। যাহোক, ঈশ্বর চাইলে অবশ্যই তা একদিন হবে। বর্তমানে আমরা কাজ করি এবং সে আশায় থাকি। ২০২১ খ্রীষ্টাব্দের ১২জুন বিশপভবনে অনুষ্ঠিত যাজক বর্গের সভায় প্রথমবার ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও এ বিষয়ে তার প্রাথমিক প্রস্তাব ব্যক্ত ক’রে খসড়া ধারণা দেন। পরে এর উপর অনেক আলোচনায় যাজকগণের চিন্তা, অভিজ্ঞতা, মতামত প্রভৃতি বেরিয়ে আসে। শেষে অধিকাংশ যাজক এর পক্ষে মতামত দেন। তবে তখন সবার উপলব্ধি এসেছে যে, কাজটি বেশ কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। যেহেতু বিষয়টি প্রথমবার, কিছুটা স্বপ্নের মত তাই আরো সময়, চিন্তা, বিশ্লেষণ প্রভৃতি প্রয়োজন। তবে নতুন ধর্মাঞ্চলের বিষয়ে এখানে সেখানে যাই শুনি বা বলি না কেন এর পক্ষে বা বিপক্ষে বেশ কিছু কথা, চিন্তা, যুক্তি, সম্ভাবনা প্রভৃতি আসছে বা আসতে পারে। এপর্যায়ে সেসব বিষয়ে কিছু কথা লিখতে চেষ্টা করছি।
নতুন ধর্মাঞ্চল গঠনের পক্ষে কিছু মতামত: আজ মনে হচ্ছে কত দিকে কত কাজ রাজশাহীর যেন বাকী পড়ে আছে, বিশেষভাবে উত্তরে। আজ পর্যন্ত কত এলাকায় যেন কোন কাজ করা হয়নি (ঠরৎমরহ খধহফ) বা কম কাজ করা হয়েছে! আরো সহজ ক’রে বললে বলতে হবে- কোন কোন অঞ্চলে পালকীয় সেবা কাজ একেবারেই করা সম্ভব হয়নি। অদ্যাবধি কাজের এমন অনেক ক্ষেত্র, পর্যায় ও স্থান আছে যেগুলি আমরা কখনো চিন্তাও করিনি, গুরুত্ব ও বিবেচনায় আনিনি। কত জনগণ খ্রিস্টধর্ম ও তার সেবা জানে না যদিও গুরু যিশু তার অমোঘ প্রতিশ্রুতি দিয়ে সর্বত্র তা জানাতে জোরালো ভাবে সকলকে দায়িত্ব দিয়েছেন: “সুতরাং যাও: তোমরা গিয়ে সকল জাতির মানুষকে আমার শিষ্য কর;…! তোমাদের যা-কিছু আদেশ দিয়েছি, তাদের তা পালন করতে শেখাও। আর জেনে রাখ, জগতের সেই অন্তিম কাল পর্যন্ত আমি সর্বদাই তোমাদের সঙ্গে আছি” (মথি ২৮:১৯-২০)। জগতের সর্বত্র, বিশ্ব সৃষ্টির কাছে মঙ্গল সমাচার ঘোষণা করার প্রভুর এটিই বিদায়ী ও চূড়ান্ত আদেশ। সেদিক থেকে বিভিন্ন স্থানে কত কাজ, দায়ভার, সেবাযাত্রা প্রভৃতি অবহেলায় অপেক্ষা করছে। আর সেভাবে আমাদের সবার উপর প্রভুর দেয়া দায়িত্ব রয়েছে সেসব অঞ্চলে, পর্যায়ে বাণী সেবা-প্রচার করতে। কোন কোন অঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে পালকীয় সেবা-কাজ করার ব্যাপক ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে বা হয়ে আছে। যারা বাণী গ্রহণ করতে আগ্রহী তাদের অনেকের ঘনবসতি উত্তরের এ সমস্ত এলাকায়। অন্যদিকে তার তো এখনই বিস্তারের সুবর্ণ সময়। আড়াই যুগের বেশী আগে যে ভক্ত সংখ্যা নিয়ে ধর্মপ্রদেশের কাজ শুরু করা হয়েছিল তা এখন বেড়ে দ্বিত্ব সংখ্যা অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে মানুষের শিক্ষা, মনোবল, জনবল, অর্থবল, অংশগ্রহণ প্রভৃতিও কিছু কিছু বেড়েছে। তবে কোথাও কোথাও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, কোথাও আবার তা কিছুটা কমছে বা থেমে আছে। যাহোক, ব্যাপক এলাকায় অসংখ্য মানুষ আজ অধিক সেবা চায়। কিন্তু দূরত্ব অনেক; রাজশাহী থেকে অনেক স্থানে যেতে নিজস্ব গাড়ীতে অবশ্যই ২/৩ ঘন্টা সময় লাগবে, সাধারণভাবে গেলে আরো বেশী সময় দরকার। উপরন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাস্তার অব্যবস্থা, নানা জটিলতা তো আছেই। তাই যাতায়াতে শ্রম, শক্তি যায়, কষ্ট-অসুবিধা আসে। ধর্মএলাকা ভাগ হলে এসব অসুবিধা কমতো। অন্যদিকে আলাদা ধর্মপ্রদেশ হলে, প্রশাসন ও কার্যক্রম, পরিকল্পনা, অর্থব্যয় প্রভৃতি আলাদা হলে বাণী বিস্তারের ও সবার কাজ ত্বরান্বিত হতো বলে মনে করি।
নতুন ধর্মাঞ্চল গঠনের বিপক্ষে কিছু মতামত: একজন বিশপের পক্ষে বৃহৎ এলাকায় পালকীয় কাজ জটিল হলে একজন সহকারী বিশপ নিয়োগের চিন্তা করলেও করা যেতে পারত। উত্তর এলাকায় ধর্মীয় আহ্বান ও সেক্ষেত্রে অংশগ্রহণ এখনো অনেক সীমিত অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সাড়া অনেক কম। তাই ভবিষ্যতে সে অঞ্চলে কারা কাজ করবে? কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ, সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা ও অংশগ্রহণ কম। উত্তর অঞ্চলে বেশী অবকাঠামো ও প্রতিষ্ঠান নেই। এর জন্য এখনো বেশী কাজ ও পরিকল্পনা করা হয়নি। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের ভিতরেই কোন কোন এলাকায় ভাল কাজ হয়নি সেসবও যেন বের হয়ে আসে, যেমন নাটোরের পূর্বে, সিরাজগঞ্জ এলাকায়, পাবনা অঞ্চলে এখনো অনেক কাজ করা প্রয়োজন। পুরাতন অঞ্চলগুলিতেও “নতুন ধারায়” বাণী প্রচার করার জোরালো ডাক আসছে। সেসব স্থানেও পালকীয় সেবার ব্যাপক ক্ষেত্র রয়েছে। পুরাতন ধর্মপ্রদেশের ধর্মপল্লীগুলিতেও বাণী প্রচার, ধর্মশিক্ষা, গঠন-প্রশিক্ষণ, দায়িত্বশীলতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে করণীয় অনেক রয়েছে। সেসবই আগে করা হোক পরে অন্য দিকে বা অন্য কাজ বিবেচনা করা যাবে। রাজশাহীর পুরাতন এলাকায় আরো অবকাঠামো, প্রতিষ্ঠান, ধর্মপল্লী প্রভৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন-সেগুলি আগে করতে হবে।
সমন্বয়ী কথা: উপরোক্ত মতামত, চিন্তা, যুক্তি যাই হোক আড়াই যুগের বেশী সময় চলে গেছে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের জয়যাত্রা শুরুর পর-তাই এখনই হতে পারে সময় পরবর্তী কাজের নতুন চিন্তা করার ও পরের সিদ্ধান্ত নেবার। যীশুর শিষ্য হিসাবে আমাদের বাস্তব কিছু করতেই হবে। আর সে দায়বোধ ও নানা প্রয়োজন থেকেই স্বপ্ন দেখা হচ্ছে, চিন্তা করা হচ্ছে ধর্মপ্রদেশের উত্তরাঞ্চল পাঁচবিবি উপজেলাসহ (যা আগে দিনাজপুরের সঙ্গে ছিল বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে) জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, চাঁপাই নবাবগঞ্জ প্রভৃতি জেলার সম্পূর্ণ অংশ বা কোন কোনটির খণ্ডাংশ নিয়ে ভবিষ্যত নতুন ধর্মাঞ্চল “ জয়পুরহাট ” করতে। তবে ঈশ্বরের পরিকল্পনা তো আমরা ঠিকভাবে জানি না-তিনি তার সময়ে ঠিকই কাজ করবেন হতে পারে “ জয়পুরহাটে ” বা অন্য কোন স্থানে। আর আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর অবশ্যই আমাদের সবার মাধ্যমে তা করাতে চান তবে সেজন্য সবাইকে আরো উদার, উন্মুক্ত, সক্রিয় ও তৎপর হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৭ সদস্যের কমিটি গঠন ও তার কাজে শুভ সূচনা: নতুন অঞ্চলের কাজ ত্বরান্বিত করতে ইতিমধ্যে ৭ সদস্যের এক কমিটি গঠন ক’রে প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা চালানো হচ্ছে। উক্ত দলের সদস্যরা হলেন: ফা. উইলিয়াম মুরমু, (আহবায়ক), ফা, লুইস পেরেরা, ফা. এমিল এক্কা, এসডিবি, ফা. ফাবিয়ান মার্ডী, মি. সুক্লেশ জি, কস্তা, মি. গোপীন হাসদা, মি. ডিপক এক্কা, (সম্পাদক)। কমিটি ইতিমধ্যে বিশপ মহোদয়কে ঘিরে আনুষ্ঠানিক সভাও করেছে ১০ জুন। আর এর মধ্য দিয়েই নতুন ধর্মাঞ্চল গঠনের কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক শুভ সূচনা বা যাত্রা শুরু হল। সেখানে বেশ কিছু কার্যকরী আলোচনা হবার পর কিছু বাস্তব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যেমন ১- সম্পূর্ণ ধর্মপ্রদেশে জরীপ করা হবে পরিবার, শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধর্মনৈতিক বাস্তবতা, ধর্মবিস্তারের সম্ভাবনা কোথায় বেশী প্রভৃতি বিষয়ে। এখানে বেশী উল্লেখযোগ্য যে, আমরা যদি পালকীয় কাজের ক্ষেত্র বাড়াতে চাই তবে যেখানে যেখানে বাণী প্রচারের বেশী সম্ভাবনা, সুযোগ ও উন্মুক্ততা রয়েছে সে জায়গাগুলি বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে হবে। সাথে সাথে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চিহ্নিত করতে হবে। আশা করা যায় এ কঠিন, ব্যাপক প্রাথমিক কার্যক্রম কয়েক মাসের মধ্যে সমাধান হলে পরের ধাপে অগ্রসর হওয়া যাবে। ২- আলোচনা ও বিশ্লেষণ ক’রে নতুন ধর্মাঞ্চলের সম্ভাব্যতা ও বাস্তবতা বিষয়ে বেশ কিছু বাস্তব পদক্ষেপের মধ্যে অগ্রসর হওয়া যাবে। ৩- ইতিমধ্যে এ ধর্মাঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান বিষয়েও পরিষ্কার করা হবে আলোচনা, চিন্তা, পরামর্শ, সাক্ষাৎকার প্রভৃতির পরে।
এজন্য ভাল জরীপ করা ও সাক্ষাৎকার নেয়া প্রয়োজন। মানুষদের প্রস্তুত করতে হবে। অন্যদিকে কাজের জন্য এলাকায় ধর্মীয় আহ্বান বাড়াতে হবে, কাঠামোর জন্য সুপরিকল্পনা করতে হবে বিশপ ভবন, সেমিনারী প্রভৃতির জন্য এবং সব কিছুর সমন্বয় করে সুনির্দিষ্ট সময়ে সিদ্ধান্তের জন্য সবার তৎপরতা প্রয়োজন।
শেষের কিছু কথা: মনে করি কাজ ইতিমধ্যে কিছুটা এগিয়ে গেছে; জয়পুরহাটের কাছে খঞ্জনপুর এলাকায় কিছু জমি মনোনয়ন ও ক্রয়ের পদক্ষেপ চলমান, সে স্থানে ইতিমধ্যে নানা পর্যায়ে কিছু আলোচনা ও কাজ চলছে, বিভিন্ন সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ধর্মীয় কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো। নতুন ধর্মপ্রদেশের জন্য স্থান ঠিক না হলেও বা মূল জয়পুরহাটে না হলেও প্রস্তাবিত নাম বলা হচ্ছে “জয়পুরহাট” ধর্মাঞ্চল। আমরা সে আশা-বিশ্বাস নিয়ে সবাই সক্রিয় সহযোগিতা করি আর প্রার্থনা করি ঈশ্বর চাইলে আমাদের কল্পিত নতুন ধর্মাঞ্চল জয়পুরহাটে তিনি জয়টিকা দিবেন বা অন্য কোন স্থান থেকে সুসময়ে তার পরিকল্পনার জয়যাত্রা শুরু করবেন।