ফাদার সুনীল রোজারিও। বিশপ হাউজ, রাজশাহী সিটি, বাংলাদেশ।
ভূমিকা ঃ “সবাই ভ্রাতৃসম” (Fratelli Tutti), হলো পোপ ফ্রান্সিসের তৃতীয় সর্বজনীন পত্র। গত ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ৩ অক্টোবর আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের মহামন্দিরে খ্রিস্টযাগ অর্পণের পর এই সর্বজনীন পত্রে পোপ স্বাক্ষরদান করেন। তার দ্বিতীয় সর্বজনীন পত্রটির নাম ছিলো, “তোমার প্রশংসা হোক” (Laudati Si)। আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের লেখা একটি গানের অংশ হলো, ‘তোমার প্রশংসা হোক।’ পোপ ফ্রান্সিস তাঁর দু’টি সর্বজনীন পত্রের অনুধ্যানেই আসিসির সাধু ফ্রান্সিসকে রেখেছেন। পোপ ‘ফ্রান্সিস, ‘তোমার প্রশংসা হোক’ সর্বজনীন পত্রে- আমাদের অভিন্ন বসতবাটির- কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো ‘মানবজাতি’ এবং বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি মানবজাতির দায়িত্ব। অন্যদিকে ‘সবাই ভ্রাতৃসম’ সর্বজনীন পত্রেও- সুখ, শান্তি ও সম্প্রীতি- কেন্দ্রীয় চরিত্রে ‘মানবজাতি’- এবং মানবজাতির প্রতি মানবজাতির দায়িতসমূহ। দু’টি সর্বজনীন পত্রেই বড় ক’রে মানুষকে দেখানো হয়েছে- যারা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে- ‘সুখ, শান্তি ও সম্প্রীতির’ পাত্র-পাত্রী। সর্বজনীন পত্র দু’টি নিয়ে আলোচনায় বসলে দেখা যাবে- প্রথমতঃ ‘তোমার প্রশংসা হোক’ সর্বজনীন পত্রে প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে যুক্তি-তর্ক মাত্র বিংশ শতাব্দির আলোচ্য বিষয়। দ্বিতীয়তঃ ‘সবাই ভ্রাতৃসম’ সর্বজনীন পত্রের দর্শন, ঐশতত্ব ও নৈতিক জ্ঞিজ্ঞাসা নিয়ে আলোচনা বহু শতাব্দি প্রাচীন।
“সবাই ভ্রাতৃসম” (Fratelli Tutti) ঃ “সবাই ভ্রাতৃসম” পোপ ফ্রান্সিসের এই সর্বজনীন পত্রের যুক্তি-তর্কের সঙ্গে মিশে আছে আজকের বিজ্ঞান, রাজনীতি, দর্শন এবং আধ্যাক্তিকতা। সর্বজনীন পত্রের প্রথম অধ্যায়েই বলা হয়েছে, ‘কৃষ্ণ মেঘে ঢাকা বিশ্ব’। বিশ্ব সৃষ্টির পিছনে, শিল্পীর যে ধ্যান-ধারণা, সেই সীমারেখা থেকে মানুষ সরে গেছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য থেকে সরে যাওয়ার পিছনে সামাজিক রোগ ও কারণগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে- “ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা সজ্ঞানতা দুর্বল হয়ে যাওয়া, সংস্কৃতিকে পরিত্যাজ্য করে দূরে সরিয়ে দেওয়া, মানবাধিকার বিকশিত না হওয়া, শরণার্থী নিয়ে ভয়-অবহেলা এবং আধুনিক যুগের অপরিণত ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার আগ্রাসন।” আজকের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারণা, সৃষ্টির মৌলিক ধারণার প্রতিকূল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে, আর মূখ্য হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত স্বচ্ছলতা। ফলে চলার পথে যাদের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়, তাদের প্রয়োজনের দিকটা অনুভব করলেও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাধা হয়ে উঠে। বাইবেলে বর্ণিত দয়ালু সামারীয় গল্পে যিশু বলতে চান, ঈশ্বরের আদেশ “তোমার প্রতিবেশীকে ভালোবাস, শুধুমাত্র আমাদের পদাধীকার বা সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করে না।” ভালোবাসা প্রচার করার চেয়ে তার মধ্যে বাস করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যারা অসহায়- তাদের মধ্যদিয়ে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ- বড় সুযোগ এবং সেখানেই ভালোবাসা বিদ্যমান। পথিক সামারীয় আমাদের পথের দিশারী।
পোপ তাঁর ‘সবাই ভ্রাতৃসম’ সর্বজনীন পত্রের তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে ”বিশ্বের প্রতি হৃদয় উন্মুক্ত” করার আহ্বান জানিয়েছেন। হৃদয়ের এই রূপান্তর কোনো নির্দিষ্ট স্বার্থ-সমৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধ নয়, প্রতিপত্তির মানদন্ডে যাচাই নয়। কিন্তু পরস্পরের মধ্যে অঙ্গীভূত হওয়া। প্রকৃতির মধ্যে যাকিছু বিদ্যমান- তা সবার জন্য, শুধু ক্ষমতাবানদের নয়। তাই সবাইকে সবার প্রতি তাদের হৃদয় উন্মুক্ত রাখতে হবে, উদার হতে হবে- জাতিগতসুত্রে পাওয়া সংস্কৃতি, মানুষের আর্থিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা, ইত্যাদির প্রতি। পোপ বলেছেন, “একজন মানুষ প্রয়োজনীয় মর্যাদা যদি ভোগ করতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে- অন্যে সেটার বাঁধার কারণ হয়ে আছে।” পোপের ভাষায়, আমাদের হৃদয় উন্মুক্ত করতে হবে যেনো, প্রকৃতির দান ‘সৃষ্টির’ উপর ‘বিশ্ব জাতি-গোষ্ঠীর’ অধিকার নিশ্চিত হতে পারে। বিশ্ব মহামারি প্রতিষেধকের প্রাপ্যতা নিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মহামারির প্রতিষেধক ‘সৃষ্টির দান’, তবে কেনো দরিদ্র জনগোষ্ঠী বঞ্চিত ? ঈশ্বর মানুষকে প্রতিভা দিয়েছেন সৃষ্টি করার জন্য এবং এই প্রতিভা একে অপরের জন্য।
পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম অধ্যায়ের শুরুতেই বলা হয়েছে বিশ্ব রাজনীতির কথা। পোপ বলেন, “সুস্থ রাজনীতি হলো সবার আগে সামাজিক ভালোবাসা; অর্থনীতি নয়- মানব কল্যাণ; বিভাজন নয়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, সব কাজে সব সময় আশাতীত ফল লাভ করা যায় না। তার পরও আমাদের প্রচেষ্টা ও বিশ্বাস রাখতে হবে, “জমিতে বুনে দেওয়া বীজের গোপন শক্তির উপরে।” আর তেমনি রাজনীতির শক্তি হলো মানুষের কল্যাণ সাধন, রাজনীতি হতে হবে- মানুষের কল্যাণের রাজনীতি- স্বার্থের নয়।
পোপ ফ্রান্সিস, তাঁর বিভিন্ন বাণী এবং রাষ্ট্রীয় সফরে সংলাপের উপর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তাঁর সর্বজনীন পত্রের এই অধ্যায়ে পোপ বলতে চান যে, সব ধর্মের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করার একমাত্র উপায় হলো ‘সংলাপ’। পোপ বলেছেন, “একসঙ্গে গল্প-গুজব করে সময় অতিবাহিত করা, উভয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া থেকে অবশ্যই ভালো, তবে তা প্রকৃত সংলাপ নয়।” সংলাপ হলো, আলোকিত অন্তর নিয়ে মিলিত প্রচেষ্টায় সত্যকে উদঘাটন করা, বর্তমান বিশ্বের সমসাময়িক ঘটনার উপর আলোকপাত করা এবং সমাজের মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারনা নির্ণয় করা। গত মার্চ মাসে পোপের ইরাক সফর ছিলো, বিশেষভাবে ইরাকের মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপের সফর। তিনি মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, দেশে শান্তি ফিরে আসবে না- যদি এক ধর্মের মানুষ অন্যকে ভিন্ন চোখে দেখে। তিনি বলেন, “কারা হারলো আর কারা জিতলো, এটা শান্তির দাবী নয়- কিন্তু আসল সত্য হলো সবাই ভাই-বোন এবং সবার লক্ষ্য হবে ঐক্যের দিকে যাত্রা।” আর সংলাপ ছাড়া ঐক্য সম্ভব নয়। সংলাপ হলো ‘সম্প্রীতির’ মধ্যদিয়ে শান্তির লক্ষ্যে এগিয়ে চলা।
সবশেষে পোপ ইংগীত দিতে ভুলেন নি যে, বিশ্বের ধর্মগুলোর বড় ভূমিকা হলো- আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ভ্রাতৃত্ববোধ/ভ্রাতৃসমাজ গড়ে তোলা। বিভিন্ন ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন পথের কথা উল্লেখ থাকলেও, বস্তুত লক্ষ্য তো একটাই- “মানবজাতি” এবং তার মধ্যদিয়ে “পরকাল”। এই মানবজাতির মধ্যে সর্বজনীন ধর্ম হলো ‘ভ্রাতৃত্ব’, মানবধর্ম। ধর্মীয় নেতাদের মিশন হলো, পুর্নমিলন এবং ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের জন্য বীজ বপন করা। যেনো বিশ্ববাসী অঙ্কুরিত হয়ে পুর্নজন্ম লাভ করতে পারেন। সৃষ্টিকর্তার ভালোবাসা আমাদের শিক্ষা দেয়- ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা ও প্রতিযোগিতা পিছনে ফেলে একটা সর্বজনীন ঐক্য স্থাপন করা, যেখানে একে অন্যকে ভাই-বোনের মতো করে গ্রহণ করতে পারেন।
উপসংহারে বলা যায় যে, আমরা ‘সবাই ভ্রাতৃসম’, কারণ সবাই তাঁরই সাদৃশ্যে নির্মিত। সবার মধ্যেই রয়েছে ঈশ্বরের প্রাণবায়ু। তিনি সূর্যের আলো ফুটিয়ে তোলেন সবার জন্য। তিনি বৃষ্টি নামিয়ে আনেন সবার জন্য। ঈশ্বর যদি তাঁর সৃষ্টির প্রতি এতো নিষ্ঠাবান থাকেন- তাহলে মানুষকে আরো না কতো কী করা দরকার। মানুষ হিসেবে- কারো উপর প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষ কাম্য নয়। সদাপ্রভু বলছেন, “তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো করে ভালোবাসো (লেবীয় ১৯:১৮)”, এবং তিনি আরো বলেছেনে, “যা তুমি চাও না তোমার প্রতি করা হোক, তুমিও তা কাউকে করো না (তোবিত ৪:১৫)।” অন্য কথায়, “অন্যের কাছ থেকে তোমরা যেমন ব্যবহার আশা করো, তার প্রতিও তোমরা সব কিছুতেই তেমনি ব্যবহার করো (মথি ৭:১২)।” জাতীয় কবি বলেছেন, “গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।” পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।

Please follow and like us: