সাধু আন্দ্রে ব্যাসেট-এর জীবনী ও কাজ
কানাডা দেশের মন্ট্রিয়াল নগরীর ৩২ মাইল দূরে সেন্ট গ্রেগয়ের দ্য আইবারভিল গ্রামের একটি ছোট্ট ঘরে ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট একটি শিশু জন্মগ্রহণ করেন। শিশুটি খুবই দুর্বল ও অসুস্থ থাকায় জন্মের পরই তাকে জলে দীক্ষা দেওয়া হয়। পিতামাতার ইচ্ছানুযায়ী তার নাম রাখা হয় আলফ্রেড। পরিবারের ১২ জন ভাইবোনদের মধ্যে আলফ্রেড ছিলেন অষ্টম। আলফ্রেডের পিতামাতা দু’জনই ধর্মনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন; যার দরুণ ছোটবেলায় খেলার ছলে সন্তানদের যীশু, মারীয়া, যোসেফ ও ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন গল্প শোনাতেন। আলফ্রেডের পিতা আইজাকের ছিল সাধু যোসেফের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সাধু যোসেফের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভক্তি রাখার প্রেরণা আলফ্রেড লাভ করেছিলেন তার পিতার কাছ থেকে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় জপমালা প্রার্থনার পাশাপাশি সাধু যোসেফের নিকট প্রার্থনাও ছিল তাদের পরিবারের দৈনন্দিন প্রার্থনার ও কাজের একটি অংশ। অল্প বয়সে পিতামাতাকে হারানোর পর সেন্ট সিসেয়োরের পালক পুরোহিত ফাদার আন্দ্রে প্রোভেঙ্কাল এর কাছে আশ্রয় নেন এবং ফাদার আলফ্রেডকে সাধু যোসেফ সম্বন্ধে সুন্দর সুন্দর গল্প বলতেন। উপরোক্ত উভয় কারণেই সাধু যোসেফের প্রতি আলফ্রেডের ভক্তি-শ্রদ্ধা আরও বৃদ্ধি পায়। বেঁচে থাকার লড়াই এ টিকে থাকতে জীবিকার সন্ধানে আলফ্রেড আমেরিকায় পাড়ি জমান। আলফ্রেড সাধু যোসেফের মতোই পরিশ্রমী ও প্রার্থনাময় জীবনযাপন করার চেষ্টা করেছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সাধু যোসেফের নিকট প্রার্থনা ও আলাপ-আলোচনা করা তাঁর একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। প্রবাসে থাকাকালীন সময়ে সাধু যোসেফের উপর আলফ্রেডের নির্ভরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। নিজ দেশে ফিরে এসে ফাদার আন্দ্রে প্রোভেঙ্কাল অনুপ্রেরণায় ও সুপারিশে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৫ বছর বয়সে আলফ্রেড পবিত্র ক্রুস ব্রাদার সমাজে প্রবেশ করেন। সুপারিশপত্রে ফাদার আন্দ্রে প্রোভেঙ্কাল লিখেছিলেন, “তিনি একজন সাধুকে পাঠাচ্ছেন”। সে উক্তিটি আজ যথার্থতা লাভ করেছে। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর আলফ্রেডের জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। ব্রত জীবনে প্রথম ধাপ ‘পোশাকদান’ অনুষ্ঠান তিনি সম্পন্ন করলেন। এই অনুষ্ঠানে আলফ্রেড ফাদার আন্দ্রের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ ‘আন্দ্রে’ নাম ধারণ করলেন। তখন থেকে আলফ্রেড হয়ে গেলেন ‘ব্রাদার আন্দ্রে’। স্বাস্থ্যগত কারণে ব্রাদার আন্দ্রেকে প্রথম ব্রত লাভ করার জন্য অনেক বাধা-বিঘ্ন পেরোতে হয়েছে; কিন্তু তার নিরন্তর প্রার্থনা ও সাধু যোসেফের প্রতি ভক্তি ও প্রার্থনার দরুন ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২ আগস্ট তিনি প্রথম সাময়িক ব্রত গ্রহণ করেন। প্রথম ব্রতের পরে তাঁকে নটরডেম মহাবিদ্যালয়ের দ্বাররক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হল। ৪০ বছর এই কাজ তিনি অতি নিষ্ঠার ও যত্নের সহিত করেছেন। দ্বাররক্ষকের কাজের পাশাপাশি তিনি ছেলেদের চুল কেটে দিতেন, হোষ্টেলে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতেন এবং রোগী বাড়িতে গিয়ে প্রার্থনা করতেন।
নটরডেমে তিনি ছোট্ট একটি ঘরে বাস করতেন সে ঘরের দেয়ালে ছিল একখানা ক্রশ ও কার্নিশের ওপরে সাধু যোসেফের একখানা মূর্তি যা কিনা রয়াল পর্বতের দিকে মুখ করে বসানো ছিল। সে মূর্তির সামনে প্রতিদিন প্রার্থনা করতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন সাধু যোসেফ ঐ পর্বতে বিশেষভাবে সম্মানিত হতে যাচ্ছেন, তার স্বপ্ন সত্যিই পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। তিনি রোগীদের জন্য সাধু যোসেফের মধ্যস্ততায় প্রার্থনা করতেন এবং তেল দিয়ে মালিশ করতেন; এভাবেই রোগীরা সুস্থ হয়ে যেত। তিনি কাউকে একটু তেল লেপন কওে, কাউকে বা শুধু সাধু যোসেফের মেডেল স্পর্শ করিয়ে বা মালিশ করে আরোগ্য দান করেছেন। সুস্থ হবার পর ব্রাদার আন্দ্রেকে কেউ ধন্যবাদ দিলে তিনি বলতেন, “আমি নই, সাধু যোসেফ তোমাকে সুস্থ করেছেন। তাঁর কাছে প্রার্থনা করো”। তিনি বহু রোগীকে সুস্থ্যতা দান করেছেন। এভাবে ধীরে ধীরে তিনি সবার কাছে ‘ভালো ব্রাদার আন্দ্রে’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। এখন তাকে মন্ট্রিয়ালের অলৌকিক কর্মসাধক হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ তিনি অসংখ্য মানুষকে সুস্থ্যতা দান করেছেন।
রয়াল পর্বতে একটি সুন্দর স্থানে তিনি একটি সাধু যোসেফের মেডেল পুঁতে রেখেছিলেন, সময় পেলেই তিনি সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন রয়াল পর্বতে সাধু যোসেফের জায়গার প্রয়োজন আছে। তাঁর সেই বিশ্বাস ও প্রার্থনা বিফলে যায়নি; ছোট প্রার্থনা গৃহ থেকে আজ তা হয়ে উঠেছে সাধু যোসেফের বিরাট মহামন্দির। সাধু যোসেফের ভক্ত ও বিনম্র সেবক ব্রাদার আন্দ্রে মহামন্দিরটির পরিপূর্ণতা দেখে যেতে পারেননি; কিন্তু তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এ কাজ সমাপ্ত হবেই। সাধু যোসেফের উপর নির্ভর করে তিনি সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছেন। সাধু যোসেফ ছিলেন তার অতি প্রিয়জন ও একান্ত আশ্রয়।
১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি তিনি পরলোকে গমন করেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে পুণ্যপিতা ষষ্ঠ পৌল ব্রাদার আন্দ্রেকে নমস্য বা পূজনীয় ঘোষণা দেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ২৩ মে পুণ্যপিতা দ্বিতীয় জন পল ব্রাদার আন্দ্রেকে ধন্য বলে ঘোষণা করেন। সর্বশেষে, ১৭ই অক্টোবর, ২০১০ খ্রিস্টাব্দে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ইতালির রোম নগরে সাধু পিতরের মহামন্দিরে ব্রাদার আন্দ্রেকে মণ্ডলির সাধু বলে ঘোষণা দেন। তিনি হলেন পবিত্র ক্রশ সংঘের প্রথম সাধু।
সাধু ব্রাদার আন্দ্রে ব্যাসেট-এর জনপ্রিয় উক্তি হলো: “ছোট্র রং-তুলিগুলি দিয়ে একজন শিল্পী অতি চমৎকাররূপে আঁকতে পারেন অনন্য সুন্দর ছবি।” এই উক্তির গভীর অর্থ হতে পারে ছোট্ট ছোট্ট সেবা কাজের মধ্য দিয়েও একজন হতে পারেন সৎ বিশ্বস্ত মানুষ, হতে পারেন সাধু-সাধ্বী। আর সাধু ব্রাদার আন্দ্রে তাইতো নটরডেম মহাবিদ্যালয়ের ‘দ্বাররক্ষক’-এর ছোট্ট দায়িত্ব নিষ্ঠার ও ভালোবাসার সাথে পালন করে, সাধু যোসেফের প্রতি গভীর বিশ্বাস নিয়ে প্রার্থনা করে, রোগীদের সেবা ও তাদের জন্য সাধু যোসেফের মধ্যস্থতায় প্রার্থনা করে হয়ে উঠেছেন ‘সাধু’। আর তাঁর বিশ্বাস, বিশ্বস্ততা ও প্রার্থনার গুণে তিনি ব্রতগ্রহণকারী ব্রাদার-সিষ্টার, যাজক তথা খ্রিস্টভক্তদের সামনে এক উত্তম আদর্শ। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে আমরাও হতে পারি ছোট্ট ছোট্ট সেবাদায়িত্বে বিশ্বস্ত, হতে পারি প্রার্থনার মানুষ, হতে পারি দরদী সেবক, হতে পারি এ যুগের সাধু-সাধ্বী।
সাধু আন্দ্রে ব্যাসেট ও ইউরোপে যোসেফ-ভক্তির বিস্তার
কানাডার মন্ট্রিয়ালের সাধু যোসেফ অরাটরি থেকে শুরু করে সমগ্র ইউরোপে সাড়া ফেলেছিল ব্রাদার আন্দ্রের যোসেফ ভক্তি, তাঁর প্রার্থনা ও সুস্থ্যতা দানের ঘটনা। যখনই শুনতেন কেউ অসুস্থ তিনি যত শীঘ্র সম্ভব তাকে দেখতে যেতেন এবং তার সাথে তার জন্যে সাধু যোসেফের মধ্যস্থতায় সুস্থ্যতা লাভের প্রার্থনা করতেন। কেউ যখন তাঁর কাছে আসতো, তখন তিনি নটরডেম কলেজের চ্যাপেলে তাকে নিয়ে যেতেন এবং সেখানকার জ্বলন্ত প্রদীপ থেকে তেল নিয়ে তা অসুস্থ ব্যক্তিকে লেপন করতেন। অনেকেই সুস্থ হতে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে রোগীর ভীড় বাড়তে থাকায় তাঁর কর্তৃপক্ষ অস্বস্থি বোধ করতে থাকেন, ধর্মপ্রদশেীয় মণ্ডলি কর্তৃপক্ষ কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে থাকেন, এমনকি ডাক্তাররা তাঁকে ‘হাতুড়ে’ ডাক্তার বলে অপমানজনক কথা বলতে শুরু করে। এসব কিছুর পরও ব্রাদার আন্দ্রে থেমে থাকেননি। তিনি বার বার বলতেন “আমি কাউকে সুস্থ করি না; সাধু যোসেফ সুস্থ করেন”। তাঁর কাছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ সাধু যোসেফের কৃপা ও সুস্থ্যতা লাভের আশায় আসতে থাকে এবং শেষে তাকে সাহায্য করার জন্য তিনজন সেক্রেটারী রাখতে হয়েছিল। এভাবে সমগ্র ইউরোপে তথা বিশ্ববাসীর সামনে সাধু যোসেফের মধ্যস্থতায় ঐশকৃপা ও সুস্থতা লাভের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সাধু ব্রাদার আন্দ্রে।

-ব্রাদার অর্পণ পিউরিফিকেশন, সি.এস.সি.

Please follow and like us: