নেতৃত্ব সম্পর্কে কথা বলতে গেলে হয়তো কেউ আর শুনতে চাইবেন না। কারণ বিষয়টি নতুন কিছু নয়; আমরা অসংখ্যবার এই নেতৃত্ব সম্পর্কে শুনেছি। যে কোন সমাজে, প্রতিষ্ঠানে বা সংস্থায় নেতা রয়েছে, বা তা থাকতেই হয়। তা না হ’লে সেই দেশ, সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সঠিক পথে চলতে পারে না। তবে সেই নেতা কেমন মানুষ হবে, কেমন হবে তার গুণাবলী তা জানা দরকার। বর্তমানে আমরা বেশীর ভাগ নেতাকেই দেখি জগতের মূল্যবোধ অনুসারে নিজে চলে আর অন্যদেরও চালায়; অথচ সত্যিকারের খ্রিস্টীয় নেতা স্বর্গের মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে নম্রভাবে সেবকের মত নেতৃত্ব দেয়। আমরা আসলে এমন নেতা চাই, যিনি হবেন যিশুর মত যিনি প্রকৃত মেষপালক। আর “প্রকৃত মেষপালক নিজের মেষদের জন্য নিজের জীবনও দিতে পারেন” (যোহন ১০:১১)।
১। যারা দলের বা সংস্থার নয়, তাদের প্রতিও মনোযোগী
যে কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে যত মানুষ আছে, তার চেয়েও বেশী মানুষ রয়েছে বাইরে। আমাদের দলের না হলেও তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছুই শিখতে পারি, যা দলের মানুষের কাছে সহভাগিতা করতে পারি। ১২০ কোটি খ্রিস্টভক্ত সদস্য নিয়ে কাথলিক মণ্ডলি একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস শুধু কাথলিকদের কাছেই নয়, অকাথলিক সকল মানুষেরই কাছে পৌছে যাচ্ছেন ভ্রাতৃত্বের ও শান্তির বাণী নিয়ে। মণ্ডলির পূর্বের পোপগণও একইভাবে সকল সদিচ্ছাসম্পন্ন মানুষের জন্য শিক্ষাদান করেছেন। পোপ ফ্রান্সিস শিক্ষা দিয়েছেন যে, ঈশ্বর সকল মানুষের জন্যই পরিত্রাণ দিয়েছেন, শুধু কাথলিকদের জন্য নয়। এই শিক্ষা সকল মানুষকে কাছে টানতে পারে – আর নি:সন্দেহে মানুষে মানুষে মিলন সমাজ গড়তে সহায়ক হতে পারে।
২। ঝুঁকি নেওয়া
যিনি সত্যিকারের নেতা তিনি সংস্থা বা দলের ভাল বা মঙ্গলের জন্য ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত এবং অন্যদের বিপদে না ফেলে নিজে বিপদের ঝাঁপ দেন। পোপ ফ্রান্সিস যখন ছোট ছিলেন তখন একবার কঠিন অসুখে পড়েন। একজন ধর্মব্রতিনী সিষ্টার নার্স যিনি তাঁর সেবা করছিলেন, তিনি ডাক্তারের নির্দেশের বাইরে গিয়ে তাকে তিন গুণ এন্টিবাইয়োটিক ঔষধ খেতে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই ঝুঁকি না নিলে তিনি তাঁর এই শিশু রোগীকে বাঁচাতে পারবেন না। পোপ মহোদয় বিপন্ন ও দরিদ্রদের জন্য ঝুঁকি নেওয়ার বিষয় বলতে গিয়ে এই উদাহরণ দিয়ে থাকেন। যে গাঁ বাঁচিয়ে চলে সে ফলপ্রসূ নেতা হতে পারে না। আমাদের জীবনে আমরা প্রতিদিনই এরূপ ঝুঁকির মুখোমুখী হই।
৩। নিজের দল বা সংস্থার নবায়ন আনা
“শুধু বদলানো নয় – নবায়ন করা” সংস্কার নেতার কাজ। পোপ ফ্রান্সিস একজন নির্ভিক সংস্কারবাদী। তিনি একটার পর একটা সংস্কার করে মণ্ডলিতে যে প্রয়োজনীয় নবায়ন আনছেন তাতে তাঁকে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হচ্ছে, কিন্তু তিনি পিছ পা হন নি। কাথলিক মণ্ডলিকে সকলের জন্য একটি উন্মুক্ত মণ্ডলি, একটি আনন্দের ধর্ম, করে তুলতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি একজন সত্যিকারের নেতার মতই কাজ করছেন। সত্যিকারের নেতা জানেন যে দু’একটি বিষয় বদল করলে কোন সমাজ বা সংস্থার কোন মঙ্গল আনা সম্ভব নয়; সমাজ ও সংস্থায় অব্যাহতভাবে আমূল পরিবর্তন ও নবায়ন করতে হবে।
৪। ধৈর্য্যশীল হওয়া
নেতা অনবরত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে বা নবায়ন করে। কোন কিছুই হঠাৎ করে বা রাতারাতি বদল হয় না, সত্যিকারের নবায়ন বা রূপান্তর ঘটাতে অনেক লম্বা সময় লাগে। পোপ ফ্রান্সিস ইতিমধ্যেই মণ্ডলিতে অনেক নবায়ন এনেছেন। তা কিন্তু রাতারাতি হয় নি। বিবাহ বিচ্ছেদ-প্রাপ্ত ও পুণরায় বিবাহিত দম্পতিদের কমুনিয়ন গ্রহণ, সমকামী নারী ও পুরুষদের বিবাহ, নারী যাজকত্ব, ইত্যাদি বিষয়ে তিনি ধৈর্য্যের সঙ্গেই শিক্ষাদান করে আসছেন। এতে তাঁকে অনেকেই ভুল বুঝেছে, তাঁকে সমালোচনা করেছে। কিন্তু তিনি ধৈর্য্যসহকারে তাঁর শিক্ষাদান করে যাচ্ছেন। এইসব বিষয়ে ঈশ্বর যা চান ভবিষ্যতে, তা-ই তিনি করবেন। আমাদের ধৈর্য্য ধরে সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
৫। মাঠে নামা
স্রোতসিনী নদীর পাড়ে বসে কোন নেতা কাউকে সাতার শিখাতে পারেন না। যে সমস্ত পুরোহিত শুধু অফিসে বসে থাকে পোপ ফ্রান্সিস তাদের মাঠে নামার পরামর্শ দিয়েছেন। আর্জেন্টিনা দেশের বুয়েনস্ আয়েরস্ এর বিশপ থাকা কালে পুরোহিতদের পোশাক পড়ে হর্গে মারিও বেরগলিও রাতের বেলায় তারঁ খ্রিস্টভক্তদের সাথে দেখা করতে যেতেন; বিশেষভাবে বস্তিবাসীদের দুঃখ দুর্দশা দেখতে যেতেন। পোপ হয়ে যাবার পরে তিনি সেখানকার কয়েকজন বিশপকে একান্তে বলেছিলেন, “আমি এখন এই কাজটি করতে পারব না, তাই এখন আপনারাই এই কাজটি চালিয়ে যাবেন”। পোপ ফ্রাসিস চান যেন কাথলিক মণ্ডলি দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগণের সেবার জন্য রাস্তায় নেমে আসবে; মণ্ডলির যাজক-বিশপগণ যেন সাধারণ ও নম্র জীবন যাপন করেন। তিনি নিজে পোপ হয়ে পোপীয় প্রাসাদে বসবাস করতে যান নি; বরং এখন অবধি তিনি ভাটিকানের অতিথিভবনে অন্যান্যদের সঙ্গেই বাস করে আসছেন। একইভাবে, সবচেয়ে ফলপ্রসূ নেতা তিনিই, যিনি তার অধীনস্তদের কাছাকাছি থাকতে পারেন। নেতৃত্বের একটি ভাল গুণ হলো অন্যদেরকে কাজের দায়িত্ব দিয়ে কাজ আদায় করে নেওয়া; কিন্তু তাই বলে নিম্নস্তরের অধীনস্তদের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা কোন ভাল নেতার কাজ নয়।
৬। অন্যদের কথা শোনা
নেতাদের চার পাশে একই মনোভাবাপন্ন অনেক মানুষ থাকে যা খুবই স্বাভাবিক। তাতে সামাজিক মর্যাদা ও সমতা রক্ষা হয় বলে ভাল লাগার ও ফলপ্রসূতার একটা নিশ্চিয়তা থাকে। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ভাল হয় না। এই বিষয় পোপ ফ্রান্সিস যা করেছেন তা অভাবনীয়। ‘রোমান কুরিয়ার’ (কাথলিক মণ্ডলির সর্বোচ্চ দপ্তর সমূহের প্রধান কার্ডিনাল ও বিশপগণ) কার্ডিনাল ও বিশপগণ থাকা সত্তে¡ও, তিনি সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৮ জন বাছাই করা কার্ডিনালকে নিয়ে একটি বিশেষ পরামর্শক কমিটি গঠন করেছেন। তিনি তাঁদের পরামর্শ অনুসারে মণ্ডলি পরিচালনা করছেন।
৭। প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার লক্ষ্যকেই প্রাধান্য দেওয়া
যে সমস্ত গুণাবলী কোন ব্যক্তির নিজের সংস্থায় উচ্চ পদ পেতে সহায়ক হয়, সেই সব গুণাবলী নম্রতার কাছে কিছুই নয়। যে সংস্থায় বা প্রতিষ্ঠানে কোন ব্যক্তির লক্ষ্য পূরণের চেয়ে সংস্থার বা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য পূরণ করাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। পোপ ফ্রান্সিস সেই রকমই একজন মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে পোপ ফ্রান্সিসের কাছে মণ্ডলির স্বার্থ ও লক্ষ্য পূরণই প্রধান বিষয়, নিজের কোন সুনাম বা আত্ম-প্রশংসা নয়। কথিত আছে তিনি পোপ হতেও আগ্রহী ছিলেন না।
৮। জীবন দৃষ্টান্ত দিয়ে নেতৃত্ব প্রদান
বুয়েনস্ আয়ার্সের বিশপ থাকা কালে আর্চবিশপ র্বেগলিও কিছু সাহসী পুরোহিতকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বস্তি এলাকার ধর্মপল্লী ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতেন। সেখানে প্রতিনিয়তই থাকতো অপহরণের ভয় ও মৃত্যুঝুঁকি। কিন্তু আর্চবিশপ নিজে সেখানে যেতেন নিয়মিত তাদের সাহস দিতে ও খ্রিস্টভক্তদের বস্তিবাড়ীতে চা খেতে। পোপ হওয়ার পর তিনি আসিসির সাধু ফ্রান্সিসকে তাঁর আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন আর অতি সাধারণভাবে জীবন যাপন শুরু করেন। তিনি ব্যয়বহুল প্রাসাদে মধ্যে থাকা, দামী গাড়ী ব্যবহার করা, গলায় সোনার ক্রশ পরিধান ইত্যাদি বর্জন করেন। ভাটিকান চত্তরে গৃহহীনদের স্নান করা ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এমন কি ভ্রমনের সময় তাঁর নিজের হাত ব্যাগ নিজেকেই বহন করে নিতে দেখা যায়। এর মধ্য দিয়ে পোপ ফ্রান্সিস সকল যাজকদের ও বিশপদের দেখিয়ে যাচ্ছেন ফলপ্রসূ নেতার গুণাবলী কেমন হওয়া উচিত।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও