২০১৭ খ্রিস্টাব্দে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশ সফর করেন। তিনদিন যাবৎ নানাবিধ সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করে মূল্যবান বাণী রাখেন। ২ ডিসেম্বর, বিকালে নটর ডেম কলেজে হাজারো যুবক-যুবতীর সমাবেশে তিনি যুবক-যুবতীদের উদ্দেশ্যে যে বক্তৃতা রাখেন সেখানেও মানবতারই জয়গান করেন। তিনি বলেন, তোমরা মোবাইলের পিছনে সময় নষ্ট না করে তোমাদের বৃদ্ধ দাদা-দাদীকে সময় দাও। তাদের কাছেই রয়েছে পূর্ণ জ্ঞানের ভান্ডার। পুণ্যপিতা বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় প্রবীণদের অসহায়ত্বের বিষয়ে অবগত। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে দিনকে দিন দেশের প্রবীণগণ অবহেলিত ও নিঃস্ব। তাই পুণ্যপিতা ফ্রান্সিসের যুবক-যুবতীদের উদ্দেশ্যে এই পরামর্শ মানবতার পক্ষে যুগোপযোগী এবং তাৎপর্যপূর্ণ বাণী।

পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস প্রবীণদের বিষয়ে চিন্তা করেন। তাই এই করোনা ভাইরাসকালীন সময়ে প্রবীণদের নিয়ে তার চিন্তার ফসল যেন জনগণের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করে সেই প্রচেষ্টার ফসল দাদা-দীদা ও প্রবীণ দিবস পালন। পুণ্যপিতা ফ্রান্সিস নিজেও একজন প্রবীণ তাই প্রবীণ ও দাদা-দীদাদের কষ্ট তিনি অন্তরে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। পরিবার ও সমাজে দাদা-দীদারা প্রতিনিয়তই অবহেলিত। যারা আজ নবীণ তারা সহজেই ভুলে যায় যে, তারাও একদিন প্রবীণ হবে। এটা সত্য যে, যে শিশু দাদা-দীদাদের সান্নিধ্য না পেয়ে বেড়ে উঠে তাদের বেড়ে উঠা অসম্পূর্ণ। এমনিতেই পরিবারের পিতামাতাগণ কাজের কারণে সন্তানদের সময় দিতে ব্যর্থ; আর যদি দাদা-দীদা সেই পরিবারে না থাকে তাহলে শিশুরা বলা চলে এক প্রকার এতিম। একটি শিশুর বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে পরিবারের বয়োবৃদ্ধরা অন্যতম ভূমিকা পালন করে। এটা সত্য যে, শিশুর মানসিক, আধ্যাত্মিক ও কাল্পনিক বিকাশের ক্ষেত্রে দাদু-ঠাকুরমারা অন্য রকম এক ভূমিকা রাখে। পরিবারে শিশুর প্রার্থনার জীবন কেমন হবে তাও গঠন করে দেয় দাদু-ঠাকুরমাগণ। এছাড়াও নানাবিধ গল্পের ঝুলি থাকে দাদু-ঠাকুরমাদের ভান্ডারে। শিশুরা তাদের কাছ থেকেই ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব, জ্বীন-পরী ও রাজা-রাণীর গল্প শুনে কল্পজগতে নতুন আরেকটি জগত সৃষ্টি করে। যে জগত শিশুর সামগ্রিক জীবন গঠনে ভূমিকা রাখে। বলা হয়ে থাকে যে, জ্ঞানের চেয়ে কল্পনাশক্তি বেশী গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞান যে কেও অর্জন করতে পারে কিন্তু কল্পনাশক্তি খুব কম মানুষেরই থাকে। কল্পনাশক্তি শিশুর কেমন হবে তাও দাদা-ঠাকুরমারা নির্ধারণ করে দেয়। শিশুর আহ্বান জীবন কেমন হবে তাও পরিবারের দাদা-ঠাকুরমাদের উৎসাহ-উদ্দিপনায় গঠিত হয়।

পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একই ধরণের হয়ে থাকে। শিশুর সাথে আমরা যে রকম স্নেহপূর্ণ আচরণ করি বৃদ্ধ দাদা-ঠাকুরমাদের সাথেও সে রকমই  স্নেহ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করতে হয়। আবার বয়োবৃদ্ধদের প্রতি কেমন আচরণ করি তা কিন্তু একটি শিশু ঠিকই খেয়াল রাখে। একটি গল্প বলি- পরিবারে বৃদ্ধ পিতাকে সন্তান ও সন্তানের বউ তেমন যত্ন করে না। সেটা আবার পরিবারের শিশু সন্তান খেয়াল করে। একদিন সন্তান ও সন্তানের বউ পরিকল্পনা করে বৃদ্ধ পিতাকে জঙ্গলে ফেলে আসবে। যেই কথা সেই কাজ। একদিন বৃদ্ধ পিতাকে ঝুড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জঙ্গলে। যাওয়ার সময় শিশু সন্তান পিতাকে ডেকে বললো, বাবা ফিরে আসার সময় ঝুড়িটা নিয়ে এসো। কৌতুহলবশত শিশুর বাবা সন্তানকে জিজ্ঞাসা করলো, কেন? শিশু সন্তানটি বললো, তোমরা যখন দাদুর মতো বয়ষ্ক হবে তোমাদেরতো জঙ্গলে ফেলে আসার জন্য এই ঝুড়িটা আমার দরকার পড়বে। যাই হোক- আমাদের দাদু-দীদারাও অনেক সময় অনেক পরিবারে এই পরিস্থিতির শিকার হন। আমরা কখনো ভাবি না যে, আমাদেরও একদিন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হতে হবে।

মানুষের আকাঙ্খা হচ্ছে দীর্ঘায়ু লাভ করা। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের বাইরে কেউ যেতে পারে না বিধায় সবাইকে একদিন বার্ধক্যের সোপানে পা ফেলতে হয়। মৃত্যুর মত বার্ধক্যও মানুষের জীবনে শুধুমাত্র একবারই আসে। তবে বার্ধক্যের স্থায়িত্বকাল একটি লম্বা সময় ধরে চলতে থাকে। আর এই সময়টিই দাদু-ঠাকুরমাদের জন্য অনেক সময় হয়ে উঠে দুঃসহনীয় ও বেদনার। তখন তারা অনেকটা শিশুর মতো হয়ে পড়েন। শিশু যেমন অভিভাবকের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেনা তেমনি তাদেরও দেখভাল করার জন্য একজনের দরকার পড়ে। দাদা-ঠাকুরমাদের অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে চলতে হয়। কয়েক বছর আগেও যেহেতু যৌথ পরিবারের বেশ অস্তিত্ব ছিলো; তাই পরিবারে কেউ প্রবীণ হয়ে পড়লে যৌথ পরিবারেই তাঁর সময় কেঁটে যেতো। কিন্তু বর্তমানে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাচ্ছে। বৃদ্ধ পিতামাতা কোন্ সন্তানের সাথে থাকবে এই চিন্তা যেন কারো নেই। বৃদ্ধ পিতামাতা যেন একটা বাড়তি বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়ছে।

বর্তমানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম করা হচ্ছে- প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু এটা আমাদের সমাজ ও দেশের একটা অবক্ষয়কেই সবার সামনে তুলে ধরে। আমাদের দেশে প্রবীণদের অবস্থা তো এ রকম ছিলো না। পরিবারের সদস্যদের সাথে আনন্দে থেকেই তো তাঁদের বাকি জীবনটা অতিবাহিত হতো। বর্তমানে প্রবীণদের কথা শোনার, সঙ্গ দেবার মতো কেউ নেই। আমরা ভুলে গিয়েছি যে, পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠিই হচ্ছেন একেকজন অভিজ্ঞ-জীবন যুদ্ধে লড়াকু সৈনিক ও আশীর্বাদ। তাঁদের কাছ থেকে আমাদের শিখার অনেক কিছু রয়েছে।

দুই বৃদ্ধার কথা শুনছিলাম। তাদের বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। সম্পর্কে দু’জন বোন। নিজেদের দৈনন্দিন দুঃখের কথা অবলীলায় বলে যাচ্ছিলেন। সন্তানরা এখন তাদের বোঝা মনে করে। তাই মাকে কোন ভাই দেখাশুনা করবে; এই বিষয়ে এক ভাই আরেক ভাইয়ের আশায় থাকে। মাকে আর নিজেদের কাছে রাখতে রাজি নয়। একজন বৃদ্ধাকে তার সন্তানরা বৃদ্ধাশ্রমে রাখার পরিকল্পনা করছে। দুই বৃদ্ধা বলতে বলতে চোখের জল ফেলছিলেন। আমি শুধু তাদের কথা শুনে গেলাম। যে মা সন্তানকে গর্ভে ধরেছেন, বহু কষ্টে মানুষ করেছেন সেই মায়ের কষ্টে সন্তানরা গেল কোথায়? মানুষ হিসাবে আমরা অহংকার করে থাকি কিন্তু পাশাপাশি অহংকার চূর্ণ হবার যে বহু কারণ বিদ্যমান সেগুলোর দিকে খেয়াল করিনা। আমাদের জন্য সত্যিই বড় লজ্জার বিষয় এটা।

প্রবীণদের জন্য ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, মণ্ডলি ও দেশের অনেক কিছু করার রয়েছে। যেহেতু প্রবীণরা হচ্ছেন একটি দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক। তাই তাদের যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা লাভ করার কথা বা সরকার যে বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করেছেন তা তাঁরা পাচ্ছেন কিনা তা তদারকি করা অত্যন্ত জরুরী। সমাজ ও পরিবারের উচিৎ প্রবীণ দাদা-ঠাকুরমাদের যথাযথ সন্মান প্রদান করা। এই দাদু-ঠাকুরমারা হয়তো কারো মা, বাবা বা আত্মিয়-স্বজন। এখন যারা বাহুতে বল ও মনে উদ্যমতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাদেরই প্রবীণদের পাশে এগিয়ে আসা উচিৎ। কারণ আমরাও একদিন প্রবীণ হবো।

ফাদার সাগর কোড়াইয়া

Please follow and like us: