কোভিড- ১৯ বা করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে প্রচন্ডভাবে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। সকল দেশের মানুষই এই তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। অসংখ্য মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে আর মৃত্যুবরণও করছে। ইতিমধ্যেই এই রোগে পৃথিবীর অর্ধকোটির উপর মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এবং এখনও মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা একই। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে ১০ লাখের উপর আর প্রাণ হানি হয়েছে ২০ হাজারের উপর। আমাদের সকলের একটাই প্রশ্ন- কখন শেষ হবে এই সংক্রমণ পরিবারে করোনা ভাইরাসের প্রভাব ও মৃত্যুর মিছিল? এর মধ্যে অনেক মানুষের চাকুরী চলে গেছে আবার অনেকে কাজের বেতন পাচ্ছে না দীর্ঘদিন ধরে। দরিদ্র পরিবারগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাদের আয় নেই, খাবার নেই, প্রয়োজনীয় কোন কিছু নেই। এই অবস্থায় লক ডাউনের পর লক ডাউনের কারণে ঘরে বসে অনর্থক সময় পাড় করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন মানুষ করোনা ভাইরাসের কারণে ঘরবন্দি ও বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে অধৈর্য্য ও অস্থির হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় মানুষ অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়ছে। এখন মুখে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে চাচ্ছে না। কোভিডকে অনেকেই এখন আগের মত ভয় করে না। তারা পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে তুলছে।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের পরিবারগুলোর অবস্থা কি হচ্ছে বা হয়েছে তা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে পরিবারে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এখানে একটি পরিবারের বাস্তব চিত্র দেওয়া যেতে পারে- যে পরিবারের তরুণ স্বামী একটি এনজিও-তে কাজ করত আর স্ত্রী কাজ করত স্থানীয় স্কুলে। তাদের দুটি শিশু সন্তান নিয়ে সংসার/পরিবার আনন্দেই কাটছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর, এক সময় স্বামী আর স্ত্রীর বেতন বন্ধ হয়ে যায় এবং পরে স্বামীটির চাকুরীও চলে যায়। পরিবারের সেই স্বাভাবিক গতি, আনন্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। কিছুদিন সঞ্চয়ের উপর ভর করে সংসার চলছিল, তবে কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয় সাংসারিক অনটন ও টানাপোড়ন। এতে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়- যা আগে ছিল না। তাদের ছোট সন্তানরা বাবা মায়ের মধ্যে এই পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারে না। তারা বাবা মায়ের কাছ থেকে আর পূর্বের সেই আদর ভালবাসা পায় না। তাদের বায়না মা-বাবা কেউ শুনতে চায় না। খেলনা, কাপড় চোপর, খাওয়া দাওয়া আর আগের মত পায় না। এই একটি সুখী পরিবারের সুখ পাখি উড়ে গেল নিষ্ঠুর করোনা ভাইরাসের প্রকোপে। এই বাস্তবতা একটা পরিবারের নয়- সারা বিশ্বে হাজারো পরিবারের। কোন কোন ক্ষেত্রে এর প্রভাবে পরিবার ও দাম্পত্য জীবন অস্থির হয়ে উঠছে এবং ভেঙ্গে যাচ্ছে।
করোনাকালে পরিবারগুলোর মধ্যে শুধু অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়, স্বামী-স্ত্রীর মানসিক অবস্থা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। পরিবার পরিচালনা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাদের হতাশা বেড়েই চলেছে। এই মানসিক চাপ গ্রহণ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। শিশুদের জীবন হয়ে আছে নিরানন্দ ও স্থবির। কিশোর-কিশোরী আর যুবক-যুবতীদের অবস্থাও ভাল নেই; তাদের জীবন ও ভবিষ্যত হয়ে গেছে ধূসর আঁধার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ অনির্দিষ্ট কালের জন্য। পড়াশুনা ও ক্লাস নেই, পরীক্ষা নেই, নেই কোন বাড়ির কাজ আর নেই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত খেলাধুলা। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে; কিন্তু বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রীদের এতে প্রবেশ করার সুযোগ নাই। পেটে যখন ভাত নেই, প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই আর বাড়িতে বা বাসায় কোন পরিবেশ নেই, সেখানে পরিবারের এই ভাবী প্রজন্ম নিরাশা ও নিরান্দের অন্ধকারে পতিত হচ্ছে। তাদের প্রচন্ড মানসিক চাপ ও হৃদয়ের ক্ষত সারিয়ে তোলার ব্যবস্থা ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে পরিবার ও সমাজকে।
ধনী পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা খারাপ না হলেও তাদের মানসিক অবস্থা ভাল নেই। তাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ছেদ্ পড়েছে এবং অস্বাভাবিক এক নতুন জীবন ধারায় হাপিয়ে উঠছে। ব্যবসা বাণিজ্য, কাজ কর্ম, ইত্যাদি, বন্ধ বা স্থবির হয়ে আছে; আয় রোজগার কমে গেছে। তাই পারিবারিক বাজেটে কাঁটছাঁট হয়েছে। আবার কোভিডের কারণে স্বাস্থ্যবিধি- যেমন হাত ধোয়া, মাস্ক পড়া, সামাজিক দূরত্ব বজায়ে রাখাসহ বিভিন্ন সরকারি ও সামাজিক বিধি নিষেধ তো আছেই। তার উপর আছে মাঝে মধ্যে লক ডাউন, সাট ডাউন, ইত্যাদি। ঘর বন্দি থাকতে থাকতে জীবনটা হয়ে আছে খাঁচায় বন্দি পাখির মত। আনন্দ আহ্লাদ নেই, সামাজিক ও পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান নেই, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ নেই। এসব আর কত সহ্য করা যায়- মেজাজ হয়ে উঠছে উত্তপ্ত ও খিটমিটে। তাই প্রায় সময় পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এর জন্য বড় কোন কারণ নেই, শুধুই নিজের উপর বিরক্তি থেকেই পরিবারে এই পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। এই পরিবেশ থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার উপায় কি, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। করোনার বেড়াজাল থেকে বেড় হতে না পেরে অনেকেই জীবনের উপর আশাই ছেড়ে দিয়েছে।
দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরবিারগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয় এই কথা বলাই বাহুল্য। মধ্যবিত্তরা এই করোনাকালে পড়েছে এক মহাসংকটে। তারা না পারে তাদের অবস্থা কারও কাছে বলতে, না পারছে কারও কাছে হাত পাততে। পরিবারের দুর্দশা লাঘবের কোন উপায় না পেয়ে নিরাশা নিরানন্দে জীবন কাটাচ্ছে। এরূপ পরিবারের সংখ্যা সমাজে নেহায়েত কম নয়। দরিদ্র পরিবারগুলোর অবস্থা বর্ণনাতীত দূরাবস্থায় পতিত হয়েছে। অনেক পরিবারে সদস্যদের দিন কাটে অর্ধাহারে বা অনাহারে। ক্ষুধার কষ্ট শিশু কিশোরদেরই বেশি। তারা তো করোনার কঠিন বাস্তবতা পুরোটা বুঝতে পারে না। আগে তারা অনেক না হোক, অন্তত পেট ভরে খেতে পেত, এখন তা আর নেই। শুধু তা-ই নয়, তারা খেলতে পারছে না, তাদের বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারছে না। এই অবস্থায় তারা অস্থির, দিশেহারা। দরিদ্র পরিবারগুলোর কান্না দিনে দিনে বাড়ছেই। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই করোনা যুদ্ধে সমাজের বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়ছে। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভাল হবে না। আমাদের সমাজের ও দেশের মঙ্গলের জন্য, এমন কি গোটা মানব সভ্যতার মঙ্গলের জন্য কাউকে টেকসই ও সমন্বিত উন্নয়ন থেকে বাদ বা বাইরে রাখা চলবে না। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন ধারা থেকে বাদ রাখলে টেকসই ও সমন্বিত উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। তাই দরিদ্রদের অভাব ও দুঃখ-কষ্ট দূর করা আমাদের সমাজের সকলেরই দায়িত্ব। সৃষ্টির সব কিছুই আমাদের প্রতি ঈশ্বরের দান, সেই দান রক্ষণাবেক্ষণ ও বাড়িয়ে তোলার দায়িত্ব ধনী-গরিব সকলের। অথচ এই করোনাকালে এটা স্পষ্ট যে ধনী গরিবের মধ্যে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। একদিকে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারগুলো আরও দরিদ্র হচ্ছে।
আর শিশু-কিশোরদের অবস্থা যেমন আগেই বলেছি- পরিবারের মধ্যে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা জানে না কোভিড- ১৯ আসলে কি জিনিস, কিভাবে এই রোগ মানুষের মধ্যে ছড়ায় আর কিভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। যেহেতু এই ভাইরাস দেখা যায় না, সেহেতু তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, সমাজ ও রাষ্ট্র কেন এই অদৃশ্য শত্রু মোকাবেলা করতে পারছে না। মানুষ যেখানে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড জয় করেছে, সারা বিশ্বে যখন বিজ্ঞানের জয় জয়কার, শক্তিশালী শত্রুকে পরাভূত করার জন্য মানুষের কাছে আছে যত মারণাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্রে মানুষ যখন অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে, তখন এই সামান্য অদৃশ্য ভাইরাসকে কেন সে পরাভূত করতে পারছে না? বাবা মা ও পরিবারের বয়োজ্যাষ্ঠদের উচিত- শিশু-কিশোরদের কাছে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়া, করোনা ভাইরাস কি ও কিভাবে এই ভাইরাস মানুষের মৃত্যু ঘটায়। শুধু তাই নয়, এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে কি কি করতে হবে, কেন করতে হবে- তাও বলতে হবে। এগুলো শুধু ধরে নেওয়ার বিষয় নয় যে, সন্তানেরা এমনিতেই দেখে শুনে বুঝে নিবে। বাবা-মা তাদের মমতা ও ভালবাসা দিয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলা মেলা আলাপ করতে হবে, সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করতে হবে, সময় করে শিশুদের পড়াশুনায় সাহায্য দিতে হবে এবং সন্তানদের সঙ্গে খেলা করতে হবে- কারণ তারা এখন বাইরে নিরাপদে খেলাধূলা করতে পারছে না। শিশু-কিশোরদের জন্য পরিবারের পরিবেশটি আনন্দময় করে রাখতে হবে, যেন তারা সংসারের অভাব-অনটন ও টানাপোড়নের কষ্ট ও স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধূলা না করতে পারার যন্ত্রণা ভুলে থাকতে পারে। করোনা ভাইরাস শিশুদের যে মানসিক কষ্ট নিয়ে এসেছে তা বর্ণনা করা কঠিন। পরিবারের সন্তানদের করোনার “নতুন স্বাভাবিকতা” বা নতুন কৃষ্টি গ্রহণ করতে শিক্ষা দিতে হবে। এই সময় তাদের সময় ও সঙ্গ দেওয়া বাবা-মা ও বড়দের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মানবিক কাজ। সময় সুযোগ হলে মাঝে মাঝে পরিবার নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদে হাটার দূরত্বে বেড়ানো যেতে পারে।
করোনাকালে স্কুল কলেজ বন্ধ বলে স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক রুটিন বাদ দিয়ে যখন যা খুশি তা-ই করতে দিলে তারা নিশ্চিতভাবে উচ্ছন্নে যাবে। যখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমে আসবে, শিশুরা আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু করবে, তখন তাদের পক্ষে স্বাভাবিক রুটিন জীবনে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই তাদের আনন্দের সাথে স্বাভাবিক রুটিন-জীবন সচল রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তারা বোঝে না বলে যখন বা যতক্ষন খুশি ঘুমাতে দেওয়া, যখন বা যতখুশি টেলিভিশন দেখতে দেওয়া, মোবাইল বা কম্পিউটারে সময় কাটাতে দেওয়া, যখন তখন ঘরের বাইরে সময় কাটাতে দেওয়া- কোন বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অথচ বেশিরভাগ বাবা মা-ই বর্তমানে এইভাবেই সন্তানদের পরিচালনা করছেন, কারণ এই পথটি সহজ। সন্তানদের মঙ্গল চাইলে, ভবিষ্যতে তাদের প্রকৃত উন্নতি চাইলে, সন্তানদের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চাইলে বাবা মা-কে অবশ্যই কঠিন ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ পথই অনুসরণ করতে হবে।
কোভিড-১৯ শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীদের জীবন তছনছ করে ফেলেছে। স্বাভাবিকতা হারানোর হতাশা-নিরাশা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, রুটিনবিহীন স্থবির নিরানন্দ জীবনের ভাড় বহন করতে না পারা, মাঝে মাঝেই বিভিন্ন কারণে বাবা-মায়ের বকুনী শোনা, ইত্যাদি কারণে তাদের আচরণে ফুটে উঠছে অস্বাভাবিকতা। দুঃখের বিষয় যে অনেক বাবা-মা সন্তানদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারছে না। আর যারা বুঝতে পারছেও, এই অবস্থায় সন্তানদের নিয়ে কি করবে তার কোন দিশা পাচ্ছে না। পেশাদারির মত পরামর্শ দিবার ক্ষমতা হয়তো সকল বাবা-মায়ের নাই। তবে তারা সন্তানদের সঙ্গ দিতে পারে, স্নেহ ভালবাসা দিতে পারে, প্রতিদিন রুটিন করে সন্তানদের কথা শুনতে পারে, একসাথে প্রার্থনা করতে পারে, খাওয়া দাওয়া করতে পারে, গল্প গুজব করে সময় কাটাতে পারে, কিছু সময় একসাথে টেলিভিশন দেখতে পারে। চাইলে এরূপ অনেক কিছুই বাবা-মা-এরা করতে পারে। এতে সন্তানদের সঙ্গে যেমন সম্পর্কের উন্নতি হবে, তেমনি হবে সন্তানদের কাঙ্খিত কল্যাণও। পরিবারের অর্থনৈতিক সংকট ও বাজেট ঘাটতির কথাও সন্তানদের বুঝিয়ে বলতে হবে। প্রয়োজনে সন্তানদের পরামর্শও চাইতে হবে।
আগেই বলা হয়েছে যে, করোনা ভাইরাস পরিবারের স্বামী- স্ত্রীদের দাম্পত্য জীবনকে করেছে ছন্দপতন ও বিপর্যয়। স্বাভাবিক সময়ে তাদের জীবনে একটা বাধাধরা নিয়ম বা ছন্দময় রুটিন ছিল। কিন্তু এখন করোনার নতুন স্বাভাবিকতায় তা আর নেই- সেখানে এসেছে ছন্দহীন অস্বাভাবিকতা। স্বামী কাজে যাচ্ছে না, বেতনও পাচ্ছে না, অনিয়মিত ঘুম থেকে ওঠা, অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া, অনিয়মিত বাইরে যাওয়া ও বাসায় ফেরা, সারাক্ষণ টেলিভিশন দেখা, খবরের কাগজ পড়া, সময়ে-অসময়ে বিছানায় শুয়ে থাকা, ইত্যাদি দেখে স্ত্রীর বিরক্ত হওয়া বা জানতে চাওয়ার ফলে তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটছে। স্ত্রীদের মধ্যেও অনেকে কাজ হারিয়েছে কিন্তু সারাক্ষণই বাসার কাজ করতে হচ্ছে একা একা। এতে তারাও ক্লান্ত ও বিরক্ত, কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই। স্বামী-স্ত্রীদের মনে রাখতে হবে যে, এক ছাদের নিচে থাকলেই ‘কাছে থাকা নয়’। তাদের জীবনের এই কঠিন অবস্থায়ও তাদের সমন্বিত দাম্পত্য জীবনের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পরস্পরকে চিনতে, পরস্পরের অনুভূতিগুলো বুঝতে, পরস্পরের কথা শুনতে, পরস্পরকে সমর্থন করতে ও প্রতিদিন পরস্পরের আরও কাছে আসতে স্বামী-স্ত্রীকে অব্যাহতভাবে চেষ্টা চালাতে হবে। এর জন্য পরস্পরকে “গুণ সম্পন্ন” সময় দিতে হবে। একে অপরকে নতুন নতুনভাবে আবিষ্কার করতে হবে, পরস্পরের সঙ্গে নিজের অনুভূতি সহভাগিতা করতে হবে। একে অপরের জন্য তারা যে ত্যাগ স্বীকার করছে ও ভালবাসার কাজ করছে তা স্পষ্ট করতে হবে। প্রতিদান পাবার জন্য নয়, স্বেচ্ছায় আনন্দের সঙ্গে এই ভালবাসার জন্য কষ্ট ও ত্যাগস্বীকারও স্পষ্ট করতে হবে। কারণ তারা তো এই জন্যই এই জীবনে প্রবেশ করেছে। বিবাহের সময় পরস্পরের কাছে প্রতিজ্ঞা ছিল যে তারা যে কোন পরিস্থিতিতেই একে অপরকে ভালবাসবে ও সমর্থন করবে। এই করোনা পরিস্থিতিও একটা অস্বাভাবিক অবস্থা, যা অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা। এখনই একে অন্যকে সমর্থন করার প্রয়োজন বেশি। এই সময় তাদের উচিত পরস্পরকে বুঝা ও গ্রহণ করা। তবে সব সময় মন মেজাজ একই রকম ভাল না-ও থাকতে পারে, তাই তাদের একে অপরকে সহ্য করারও প্রয়োজন আছে। সম্পর্ক শীতলতা বা অন্য জনের ভালবাসার প্রশ্ন নিয়ে মৃদু ঝগড়া হতে পারে কিন্তু তা পরস্পরকে আঘাত করার জন্য নয় বরং বরফ গলিয়ে কাছে আসার জন্য ও সর্ম্পকে উষ্ণতা আনার জন্য।
সবশেষে আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, করোনা ভাইরাসের অভূতপূর্ব ও মারাত্মক প্রকোপের সমাধান হিসেবে টিকা গ্রহণ করা আবশ্যক, যদিও সেটাই সব নয়। পরিবারের সকলকেই টিকা নিতে হবে- এখন প্রাপ্ত বয়স্কদের এবং পরে অবশ্যই সকল শিশু সন্তানকেও টিকা নিতে হবে। তবে পরিবারের সুরক্ষার জন্য সকল স্বাস্থ্যবিধি অব্যাহতভাবে মেনে চলতে হবে, কারণ কোভিড- ১৯ সহসাই এই ধরিত্রী থেকে বিদায় নিচ্ছে না- এটা নিশ্চিত। আমাদের সমাজের ক্ষুদ্রতম কোষ পরিবারকে সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে, সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করতে হবে। শুধু করোনা ভাইরাস থেকেই নয়, সকল মন্দতা ও ভালবাসাহীনতার ভাইরাস থেকেও পরিবারকে রক্ষা করতে হবে। তবে তার আগে মানব সভ্যতার স্বার্থে, ভাবী প্রজন্মের স্বার্থে, বিচক্ষণতাসহ পরিবারের যত্ন করতে হবে। পরিবার যদি রক্ষা করা না যায়, তাহলে মানব সভ্যতাই হুমকীর মুখে পড়বে। আমরা যেন শীঘ্রই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। পাঠকদের প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।
বিশপ জের্ভাস রোজারিও
রাজশাহী ক্যাথলিক ডাইয়োসিস, বাংলাদেশ।