কলাম: জন-জীবনের কথা
ফাদার সাগর কোড়াইয়া
রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ার মথুরাপুর, বোর্ণী, বনপাড়া, ভবানীপুর, ফৈলজানা ও গোপালপুর ধর্মপল্লীর প্রায় অধিকাংশ খ্রিস্টভক্তদের আদিনিবাস হচ্ছে ঢাকার ভাওয়াল অঞ্চল; অর্থাৎ নাগরী, তুমিলিয়া, দড়িপাড়া, রাঙ্গামাটিয়া এবং মঠবাড়ি ধর্মপল্লী। আজ থেকে ১০০ বছর পূর্বে গাজীপুরের ভাওয়াল অঞ্চলের খ্রিস্টভক্তগণ তাদের জীবনের অবস্থা পরিবর্তন এবং অন্যান্য নানাবিধ কারণে পাবনা জেলার মথুরাপুর ধর্মপল্লীতে এসে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। গাজীপুরে থাকাকালীন সময়ে ও পরবর্তীতে রাজশাহীতে এসে বসতি গড়ে তোলার পর খ্রিস্টভক্তদের নিজ বা পিতৃকর্ম, পেশা, আচার-আচরণ বা অন্যান্য কারণে বিভিন্ন খেতাবি নামে ডাকা হতো। আর এ খেতাবি নামগুলো এমনই জনপ্রিয়তা পায় যে তাদের নিজ খেতাবি নাম দ্বারাই বাড়ির নামকরণ হয়ে যায়। ভাওয়াল অধ্যূষিত গাজীপুরের ধর্মপল্লীগুলোর অনেক বাড়ির খেতাবি নামের সাথে তাই রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ার বাঙ্গালী খ্রিস্টানবাড়িগুলোর নামের মিল থাকাটাই স্বাভাবিক। দক্ষিণ ভিকারিয়ার ধর্মপল্লীগুলোতে এ রকম বহু বাড়ির খেতাবি নাম রয়েছে। তবে আমরা অধিকাংশই বাড়ির খেতাবি নামগুলোর উৎপত্তির ইতিহাস জানি না। শুধুমাত্র নামের সাথেই পরিচিত। আর নাম না জানাটাই স্বাভাবিক; কারণ উৎপত্তির ইতিহাস কোথাও লিখিতাকারে নেই; বরং ইতিহাসগুলো লোকশ্রুতি হিসাবেই প্রচলিত। এমনকি লোকের মুখে প্রচলিত হয়ে অবশেষে এমন রূপ লাভ করেছে যেখানে হয়তোবা আসল ইতিহাস হারিয়ে যাবার পথে। এই লেখার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ভিকারিয়ার ধর্মপল্লীগুলোতে অবস্থিত প্রচলিত খেতাবি বাড়ির নামকরণের ইতিহাস তুলে আনার প্রচেষ্টা করেছি।
মথুরাপুর ধর্মপল্লীর প্রতিটি গ্রামেই খেতাবি নামের বাড়ি রয়েছে। পল গমেজ নাগরী ধর্মপল্লীর বাগদী গ্রাম থেকে ১৯২০/২১ খ্রিস্টাব্দের দিকে রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ার লাউতিয়া গ্রামে এসে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। তিনি পলু শিকারী নামেই পরিচিত ছিলেন। পল গমেজ শিকারের উদ্দেশ্যে এসে এ এলাকায় থেকে যান। পরবর্তীতে তাঁর এ শিকারের নেশার কারণে বাড়ির নামই হয়ে যায় শিকারী বাড়ি বা শিহারী বাড়ি। বর্তমানে কাতুলী ও লাউতিয়া গ্রামে পলু শিকারীর পরবর্তী প্রজন্মের বাস। ‘১৬৭০ থেকে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ধর্ম প্রচারক দোম-আন্তনীও ডি’রোজারিও কর্তৃক রাঙ্গামাটিয়া গ্রামের প্রথম দীক্ষিতদের প্রজন্মের তিন ভাই পাচু দোম-আ, ফেচু দোম-আ ও গাছু দোম-আ গমেজ পদবী গ্রহণ করে দীক্ষা নেন। আর দোম-আ নেবার পিছনে দোম আন্তনীও ডি’রোজারিও কর্তৃক দীক্ষাপ্রাপ্ত হওয়াও কারণ হতে পারে। দোম আন্তনীও যেহেতু ভূষণার রাজপুত্র তাই তিনি দীক্ষা লাভ করার পর পর্তুগীজ শব্দ দোম অর্থ্যাৎ রাজপুত্র শব্দটি রেখে দেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করে ধারণা করা হয় দোম-আন্তনীওর নামানুসারেই দোম-আ বা দোমা গোষ্ঠির উৎপত্তি’ (দ্রষ্টব্য: দোম-আ বংশাবলী- ২০১৮, বীরমুক্তিযোদ্ধা ইগ্নাসিউস গমেজ (ইনু মাস্টার)। উপরোক্ত ইতিহাস বিতর্কিত হওয়ার সম্ভাবনাও ফেলে দেবার নয়। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশের খ্রিস্টমণ্ডলির ইতিহাসে ধনী বংশ থেকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা লাভ করেছে বলে শোনা যায় না। হিন্দু ধর্মের নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও অচ্ছুৎ-অস্পৃশ্য তথাকথিত নিচু জাত বিশেষভাবে মুচি, তাঁতী, চামার, নাপিত, ডোম, জেলে ও অন্যান্য অবস্থা থেকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা লাভ করে। দীক্ষা লাভের পর প্রথমদিকে অনেকেই তাদের পুরনো পেশা ছাড়তে যে পারেনি তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আবার পর্তুগীজ পুরোহিতগণ নতুন দীক্ষা দিয়ে নিজেদের পদবীগুলোই দীক্ষার্থীদের প্রদান করেছেন। তাই ডোম যেহেতু একটি পেশা আর খ্রিস্টানগণ দীক্ষা নেবার পূর্বে ও পরে অনেকেই ডোম পেশার সাথে জড়িত ছিলেন বিধায় ডোম শব্দটি যে অপভ্রংশ হয়ে ডোমাতে রূপান্তরিত হয়েছে তা গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়।
জগতলা গ্রামে ঘানি বাড়ির অবস্থান। নাগরী গ্রামের লুদুরীয়াতে কানু কোড়াইয়া ঘানি ভাঙ্গানো (গরু দিয়ে সরিষার তেল ভাঙ্গানো) পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে কানু কোড়াইয়ার ছেলে পেদ্রু কোড়াইয়া জগতলা এসে বসতি স্থাপন করার পর ঘানি পেশার সাথে জড়িত থাকায় তার বাড়ির নাম হয় ঘানি বাড়ি। মথুরাপুরের খরবাড়িয়াতে কাদেরমার বাড়ির অবস্থান। রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীতে থাকাকালীন কাদেরমার বাড়ি নামকরণ করা হয়। কাদেরমার বাড়ি নামকরণে দু’টি ইতিহাস জানা যায়। একজন মুসলিম মহিলা কাদের নামক তার সন্তানকে কোলে করে নিয়ে সে বাড়িতে কাজ করতে আসতেন বিধায় কাদেরমার বাড়ি। আরেকটি হচ্ছে- যে জায়গায় কাদেরমার বাড়ির অবস্থান সে জায়গা নাকি কাদের নামক একজন মুসলিম ব্যক্তির মায়ের জায়গা ছিলো। পচা পালমা রাঙ্গামাটিয়ার কাদেরমার বাড়ি থেকে খরবাড়িয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। শব্দের অপভ্রংশের কারণে একটি শব্দ যে তার আগের অবস্থানে থাকে না তার প্রমাণ হচ্ছে চুরেগো বাড়ি। চর এক সময় চৌরাতে এবং পরবর্তীতে চুরে পরিণত হয়। কথিত রয়েছে যে, চুরেগো বাড়ির পূর্বপুরুষ কেউ শৈলপুর ধর্মপল্লীর নিকটবর্তী পদ্মা নদীর চরে বাস করতেন। পরবর্তীতে পদ্মায় চর ডুবে গেলে আত্মিয়-স্বজন নিয়ে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর বড় সাতানীতে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। রাঙ্গামাটিয়া থেকে মথুরাপুরে এসে বসতি গড়ে তুললেও চুরেগো বাড়ি নাম মুছে যায়নি; যা আজও পর্যন্ত প্রচলিত। খরবাড়িয়া গ্রামে পাদাগো বাড়ির অবস্থান। লোকশ্রুতি রয়েছে- রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর ছোট সাতানীতে পূর্বপুরুষ কেউ একজন নাকি জনসমাবেশে পাদ (বায়ু ত্যাগ) দিয়েছিলেন বিধায় সবাই পাদাগো বাড়ি নামকরণ করেন। পাদাগো বাড়ির জন, আগষ্টিন ও আন্তনী কস্তা তিন ভাই খরবাড়িয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। যারা মদ বানানো পেশার সাথে জড়িত তাদের হুড়ি বলা হয়। মথুরাপুর ধর্মপল্লীর খরবাড়িয়া, গোয়ালবাড়িয়া, বোর্ণী ধর্মপল্লীর দিঘইর ও বনপাড়া ধর্মপল্লীর বাহিমালিতে হুড়িদের বাড়ির অবস্থান। হুড়িদের বাড়ি নয়াবাড়ি নামেও প্রচলিত। কালু কস্তা (পন্ডিত) রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর দেওলিয়া গ্রামে বাস করতেন। তার প্রচন্ড শারীরিক শক্তি ছিলো। কালু কস্তার শরীরের শক্তি দেখে অনেকে বলতো ওর মহিষের মতো শক্তি। আর এরপর থেকে বাড়ির নাম হয়ে যায় মইশান (মহিষান) বাড়ি। কালু কস্তার ছেলে আন্তনী কস্তা (মাষ্টার) খরবাড়িয়াতে এসে বসতি গড়েন। ডাঙ্গির বাড়ির নামকরণের পরবর্তী ঘটনা বেশ হাস্যরসাত্মক। ডাঙ্গির বাড়ি নাম পরিবর্তনের অনেক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে কিন্তু সবই ব্যর্থ হয়। তবে যার কারণে ডাঙ্গির বাড়ি নামকরণ হয়েছে বাবু রোজারিও ছিলেন রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর বড় সাতানী গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি পালতোলা নৌকা ও লোকজন নিয়ে ব্যবসা করতে বের হতেন। একবার ঝড়ে নৌকার বাদামের লাঠি (ডাং নামেও পরিচিত) ভেঙ্গে যায়। বাবু রোজারিও নাকি চিৎকার করে বলেন, ডাং ভেঙ্গে গিয়েছে! আর এর পর থেকে ডাং শব্দটি ডাঙ্গিতে রূপ লাভ করে। মথুরাপুরের উত্থলী, বোর্ণী ও বনপাড়াতে ডাঙ্গির বাড়ি রয়েছে।
ডাল্লাগো বাড়ির নামকরণের দুটি ঘটনা প্রচলিত। রাজু রোজারিও জয়রামবের গ্রামে বাস করতেন। তিনি ও তার সন্তান টমাস রোজারিও নৌকাযোগে ডালায় করে পেঁয়াজ, রসুন বিক্রি করতেন বিধায় ডালা শব্দটি এক সময় ডাল্লাতে রূপ লাভ করে। আবার আরেকটি ঘটনা হচ্ছে- ডাল্লাগো বাড়ির একজন নাকি জাহাজে চাকুরী করতেন। একদিন টাকা পানিতে ভিজে গেলে ডালায় ভেজা টাকা দিয়ে রোদে শুকাতে দেন বিধায় ডালা থেকে ডাল্লাগো বাড়ি। ক্যারালী গমেজ রাঙ্গামাটিয়ার ছোট সাতানী থেকে ভাদড়া গ্রামে এসে বসতি গড়েন। তারপর ভাদড়া গ্রাম থেকে নাটোর জেলার কোন এক স্থানে বসতি গড়েন; পরবর্তীতে নাটোর থেকে মানগাছা ও অবশেষে আবার মথুরাপুরে এসে বাস করেন। যেহেতু তার নাম ক্যারালী তাই জনগণ ডাকার সুবিধার্থে ক্যারালীকে কের্যাইল্লে নামে ডাকতে থাকেন। অতঃপর ক্যারালী থেকে কের্যাইল্লে বাড়ি। কাইতানু গমেজ রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীতে অবস্থানকালীন কারো বাড়িতে কাজের চুক্তি নিলে সব সময় ফাঁকি দিতেন। গ্রামীণ আঞ্চলিকতায় এই ফাঁকি দেওয়াকে বলা হয় ফইচকে যাওয়া। অবশেষে কাইতানু গমেজের নাম এই ফাঁকি দেওয়া থেকে ফইচকে এবং অবশেষে হয় ফঁচকা; অতঃপর ফঁচকারবাড়ি। কাইতানু গমেজের ছেলে জুজু গমেজ রাঙ্গামাটিয়া থেকে ভাদড়া গ্রামে বসতি গড়েন। বোর্ণী, বনপাড়া ও ভবানীপর ধর্মপল্লীতে ফঁচকার বাড়ির অবস্থান। গেদা ইসিদোর কস্তা খুবই দ্রুত গতিতে হাঁটাচলা করতেন। একবার তিনি চাটমোহর রেলস্টেশন থেকে অনেকের সঙ্গে হেঁটে বাড়িতে আসছিলেন। তিনি আগেই বাড়িতে চলে আসেন। অন্যরা আর তাকে খুঁজে পায় না। সকলে বলাবলি করতে থাকে ওতো বাতাসের আগেই বাড়িতে চলে গিয়েছে। এরপর থেকে গেদা ইসিদোরের বাতাস এবং বাড়ির নামকরণ হয় বাতাসের বাড়ি। গেদা ইসিদোর কস্তা তুমিলিয়া ধর্মপল্লী থেকে মথুরাপুরে বসতি গড়েন। জোলা বলা হয় যারা সাধারণত কাপড়ের ব্যবসা করে। তবে জোলা বাড়ির নামকরণ হয়েছে অন্য কারণে। ধারণা করা হয় পূর্বপুরুষ কেউ সব কিছু ভুলে যেতো বলে জোলা (বোকা) ডাকা হতো; তারপর জোলা থেকে জোলাবাড়ি। লুকাশ পালমা (জোলা) রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লী থেকে মানগাছাতে এসে বসতি গড়েন। পরবর্তীতে কাতুলী গ্রামে চলে আসেন। ঠাকুর বা ঠাহুর বাড়ির নামকরণ তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর বাঙ্গালহাওলা থেকে মথুরাপুর এসে বসতি গড়ার পর করা হয়। তুমিলিয়াতে থাকাকালীন বাড়ির নাম ছিলো গাইয়েন বাড়ি। মাইকেল রোজারিও আসর জমিয়ে খুবই ভালো গল্প বলতে পারতো। আসর জমানোটা মনে হতো যেন হিন্দু ঠাকুরের পূজা-অর্চনার মতো। গল্প শোনার জন্য শ্রোতারাও সব সময় অপেক্ষায় থাকতো। মাইকেল রোজারিও গল্পের আসরে এলে উপস্থিত শ্রোতারা নাকি বলতো, এই যে ঠাকুর বা ঠাহুর এসেছে এবার গল্প শুরু হবে। আর এই ঠাকুর বা ঠাহুর থেকেই পরবর্তীতে ঠাহুর বা ঠাকুর বাড়ির নামকরণ। মানুষের পেশার কারণেও বাড়ির নামকরণ হয়েছে; যেমন গাছি বাড়ি। ফ্রান্সিস রোজারিও প্রতি শীতের ঋতুতে খেঁজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরী করতেন। আর যারা খেঁজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তাদের গাছি বলা হয়। আইড়াগো বাড়ি নামকরণের পিছনেও ঘটনা রয়েছে। গাজীপুরে থাকাকালীন আইড়েগো বাড়ির লোকজন আইড়া বা বলদ (গরু) পালন করতেন বিধায় আইড়েগোবাড়ি। মথুরাপুরের গোয়ালবাড়িয়া, বোর্ণী ধর্মপল্লীর বাগবাচ্চা, পারবোর্ণী ও ভবানীপুরের শ্রীখন্ডি গ্রামে আইড়েগোবাড়ির অবস্থান। গাজীর বাড়ির নামকরণের ইতিহাস জানা যায়নি। তবে আমরা জানি যে, ইসলাম ধর্মের শিক্ষানুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেলে শহীদ আর জীবিত থাকলে গাজী। এছাড়াও গ্রাম-বাংলায় গাজীর গান বলতে এক প্রকার গানের পরিচয় পাওয়া যায়। সুতরাং গাজীর বাড়ির নামকরণে এ দুটি কারণের একটি সংযুক্ত বলে ধারণা করা যেতে পারে।
বোর্ণী ধর্মপল্লীর পারবোর্ণী গ্রামের সবচেয়ে প্রচলিত বাড়িগুলোর নাম হচ্ছে বৈরাগী বাড়ি, স্যান্ডাইল বাড়ি, খাডাস বাড়ি (খাটাস বাড়ি), কানার বাড়ি, নকীর বাড়ি। এ বাড়িগুলোর নামকরণের ইতিহাসও বেশ আকর্ষণীয়। বৈরাগী বাড়ির নামকরণ হয়েছে পূর্বপুরুষ এ্যালেন কস্তার কৃতকর্মের জন্য। এ্যালেন কস্তা বাস করতেন মঠবাড়ি ধর্মপল্লীর ভাসানিয়া গ্রামে। এক সময় এ্যালেন কস্তা দড়িপাড়া গ্রামে (বর্তমানে ধর্মপল্লী) মেয়ের বাড়িতে যান। একদিন তিনি প্রকৃতির কাজ সম্পন্ন করে বদনা (নোডা) হাতে নিয়ে ফিরছিলেন। আর তাই দেখে বেয়াইন (মেয়ের শাশুড়ী) বললেন, “দেখ তো যেন বৈরাগী আসছে” (বৈরাগী হচ্ছে হিন্দুদের একটি সম্প্রদায়; যারা সব সময় হাতে পাত্র নিয়ে ভিক্ষার জন্য ঘুরে বেড়ায়)। এরপর থেকে এ্যালেন কস্তার খেতাবি নাম হয়ে যায় বৈরাগী। অতঃপর বৈরাগী বাড়ি; যা আজও বিদ্যমান। এ্যালেন কস্তার ছেলে বিছান্তি কস্তা ভাসানিয়া গ্রাম থেকে এসে পারবোর্ণী গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে এ্যালেন কস্তাও পারবোর্ণীতে ছেলের কাছে চলে আসেন। বলা চলে পারবোর্ণী গ্রামে বৈরাগী বাড়িই প্রথমদিককার বসতি। পরবর্তীতে বৈরাগী বাড়ির অনেকেই পারবোর্ণী গ্রামে বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলেন। নকীর বাড়ির বংশধরগণ বৈরাগী বাড়িরই অংশবিশেষ। ফ্রান্সিস কস্তা (বৈরাগী) নকী নামক একজন মুসলমান লোকের জমিতে বসতি গড়ে তোলাতে ফ্রান্সিস কস্তার বৈরাগী খেতাবি বিলুপ্ত হয়ে বাড়ির নাম নকীর বাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে।
স্যানাল হিন্দুদের একটি পদবী। বর্তমানে পারবোর্ণীতে যেখানে স্যান্ডাইল বাড়ি সেই জায়গা স্যানাল পদবীযুক্ত এক হিন্দু লোকের অধীনে ছিলো। পরবর্তীতে আন্তনী মোংলা (স্যান্ডাইল) সেই জায়গা ক্রয় করে বসতি গড়ে তোলাতে সেই বাড়ি স্যানাল পদবীর অপভ্রংশ স্যান্ডাইল নামে পরিচিতি লাভ করে। বোর্ণীতে বসতি স্থাপন করার পর যে বাড়ির খেতাবি নাম সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়তা লাভ করে তা হলো খাডাস বা খাটাস বাড়ি। পিতর ও নিকোলাস রোজারিও’র বাবা খাকুড়ি রোজারিও ভাওয়াল থেকে এসে পারবোর্ণীতে বসতি গড়ে তোলেন। খাকুড়ি একবার ধনিয়া চাষ করেন। সে বছর ধনিয়ার দাম কম হওয়াতে তিনি ধনিয়া বিক্রি করতে চাইলেন না। তাই দেখে নাকি একজন ব্যাপারী বললো, “এ কোন খাটাস রে!” এরপর থেকে খাকুড়ি রোজারিও’র বাড়ির নাম খাটাস বা খাডাস বাড়িতে রূপ লাভ করে। বর্তমানে খাডাস বাড়ির বংশধরগণ পারবোর্ণী গ্রাম ছাড়িয়েও দিনাজপুর ধর্মপ্রদেশের সুইহারী ধর্মপল্লীর গোসাইপুর গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন। আন্তনী রোজারিও নাগরীর তিরিয়া গ্রাম থেকে এসে পারবোর্ণী গ্রামে বসতি গড়েন। আন্তনী রোজারিও’র সংগীতের প্রতি আগ্রহ ছিলো বেশ। একবার দো-তারা মেরামত করার সময় দো-তারার তার ছিঁড়ে চোখে লাগে। সবাই বলতে থাকে, “কিরে আন্তনী তোর চোখ তো কানা হয়ে গিয়েছে”! আর এরপর থেকে আন্তনী রোজারিও’র নাম হয়ে যায় কানা আন্তন। অদৌ তিনি কানা বা অন্ধ ছিলেন না। কানার বাড়ি বোর্ণী ধর্মপল্লীর পুরনো অধিবাসীদের মধ্যে অন্যতম।
ভক্তবাড়ি বোর্ণী ধর্মপল্লী তথা কাশিপুর গ্রামের পুরনো বসতি। ভক্তবাড়ির নামকরণের ইতিহাস বেশ পুরাতন। ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে বংশগুরু উদপ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। সেই সময় নাগরীর গির্জা ছিলো ছনের ছাউনিতে ঘেরা। রাত হলে গির্জার চালে বড় বড় ঢিল পড়তো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। প্রচার হয়ে পড়ে যে এ ভৌতিক কান্ড। এই ঢিল দেওয়া বন্ধের জন্য উদপ নিজের ইচ্ছায় পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র একরাত্রি রোজারিমালা প্রার্থনা করে এই ভৌতিক কান্ড বন্ধ হওয়ায় উদপ রোজারিও’কে ভক্ত উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরদের বাড়িগুলোকে ভক্তবাড়ি নামেই আখ্যায়িত করা হয়। আগষ্টিন পিউরীফিকেশনের বাড়ি ছিলো নাগরীর ছাইতান গ্রামে। তিনি চুক্তি হিসাবে অন্যের বাড়িতে ঘর ছাউনি বাঁধার কাজ নেন। কিন্তু অল্প কাজ করেই আগষ্টিন পিউরীফিকেশন শুধু বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকতেন। এভাবে অনেকদিন কেঁটে যাবার পর বাড়ির মালিক বললেন, কিরে আগষ্টিন আর কত হুবি (ঘুমাবি)? আর এরপর থেকে আগষ্টিন পিউরীফিকেশনের নাম হয়ে যায় হুবি। পরবর্তীতে আগষ্টিন পিউরীফিকেশনের ছেলে ফ্রান্সিস (ফরান) পিউরীফিকেশন কাশিপুর গ্রামে এসে বসতি গড়লেও হুবি খেতাবি নামেই পরিচিতি পান। আর হুবির বউ হুইবানি নামে পরিচিত হন।
তারা ক্রুশ ও সাধ্বী আন্নার বাড়ি ছিলো দড়িপাড়া গ্রামে (বর্তমানে ধর্মপল্লী)। তারা ক্রুশ মারা গেলে সাধ্বী আন্না জীবিকা নির্বাহের জন্য মোয়া তৈরী করে বিক্রি করতো। আর এক সময় সাধ্বী আন্না মোয়া-অলি নামেই পরিচিতি লাভ করে। আর এ মোয়া অলি শব্দটি এক সময় মোয়ালিতে রূপ লাভ করে। বর্তমানে দিঘইর গ্রামে মোয়ালিদের বাড়ির অবস্থান। এছাড়াও বনপাড়া গ্রামের ছাইতানগাছা গ্রামেও মোয়ালিদের বাড়ি রয়েছে। গোছাল বাড়ির নামকরণে দ্বিমত বিদ্যমান। তবে অনেকের মতে গোছাল বাড়ির পূর্বপুরুষগণ ভারত থেকে এসেছেন। বংশধরদের মধ্যে কেউ বা কারা ঘোষের (যারা দুধ দিয়ে পানিয় বা মিষ্টি তৈরী করে) পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বিধায় ঘোষ থেকে গোছাল নামকরণ হয়েছে। আবার কারও মতে, পূর্বপুরুষ কেউ নাকি প্রচুর গোছ (মাংস) খেতে পারতেন। আর গোছ (মাংস) খেতেন বলেই নাকি নামকরণ হয়েছে গোছাল বাড়ি। বংশের পূর্বপুরুষ নসু গোছাল চড়াখোলা থেকে এসে সর্বপ্রথম কুঠিবাড়ি গ্রামে বসতি গড়েন। বর্তমানে দিঘইর গ্রামে গোছাল বাড়ির অবস্থান। রাফায়েল কস্তা নাগরী ধর্মপল্লীর পানজোরাতে ফাদারের জমিদারীতে কেরাণীর কাজ করতেন বিধায় পরবর্তীতে তাকে সবাই কেরাণী বলে ডাকতো। কেরাণী থেকে অতঃপর কেরাণী বাড়ির নামকরণ। ছিটকীগাড়ি গ্রামে কেরাণী বাড়ি রয়েছে। রাফায়েল কস্তা বোর্ণী ধর্মপল্লীর ব্যক্তি; যিনি তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। বালির বাড়ির অবস্থান ছিটকীগাড়ি গ্রামে। ব্যালেস্টাইন নামের অপভ্রংশ হচ্ছে বালি।
যারা ঘানি ভাঙ্গিয়ে সরিষার তেল সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে কুলু বলা হয়। ভাওয়ালের রাঙ্গামাটিয়া মিশনের ভোলা দেশাই এ কুলু পেশার সাথে জড়িত ছিলেন বিধায় তার বাড়িকে কুলু বাড়ি নামে আখ্যায়িত করা হয়। পরবর্তীতে জন দেশাই বোর্ণী ধর্মপল্লীর আদগ্রামে এসে বসতি গড়েন। যদিও তিনি আদগ্রামে এসে এ কুলু পেশার সাথে জড়িত ছিলেন না তথাপি কুলু নামটি প্রচলিত থেকে যায়। জেলেদের পেশা মাছ ধরা; আর মাছ ধরার জন্য বিভিন্ন প্রকার জালের ব্যবহার দেখা যায়। বেলীর বাড়ির কে নাকি বেল জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। আর এ বেল জাল ব্যবহারের কারণে সেই বাড়িকে বেলীর বাড়ি নামে ডাকা হয়। বেলীর বাড়ির বুলু রোজারিও দড়িপাড়া থেকে এসে আদগ্রামে বসতি স্থাপন করেন। বুলু রোজারিও নিজেও বেল জাল দিয়ে মাছ ধরতেন বলে শোনা যায়। তোপাইন্নে বাড়ির অবস্থান আদগ্রামে। মার্টিন গ্রেগরী নাগরীতে কোন এক ঝড়ের (তুফান) সময় জন্মগ্রহণ করেন বিধায় তুফান শব্দটি এক সময় তোপাইন্নেতে রূপ লাভ করে তোপাইন্নে বাড়ি হয়ে ওঠে। হাইচ্ছের বাড়ি সংগ্রামপুর গ্রামে। ইগ্নাসিউস গনসালভেস ও সোহাগী পিউরীফিকেশনের বাড়ি ছিলো মঠবাড়ির ভাসানিয়া গ্রামে। তাদের প্রতিবার সন্তান হবার পর মারা যেতো বিধায় প্রতিবেশীরা পরমার্শ দেন যে, সন্তানের ডাক নাম যদি যেমন-তেমন রাখা হয় তবে বাঁচবে। সন্তান হবার পর তারা সন্তানের নাম রাখেন হাছুইন্নে হিলারিয়াস। তবে পরবর্তীতে হাছুইন্নে পছন্দ না হওয়াতে হাইচ্ছে রাখা হয়। ইগ্নাসিউস গনসালভেস মঠবাড়ি থেকে এসে বোর্ণী মিশনের দিঘইর গ্রামে বসতি গড়েছিলেন। শিমন রোজারিও ও মারীয়া পিউরীফিকেশন নাগরীর ধনুন থেকে এসে সংগ্রামপুরে বাড়ি করেন। তাদের সন্তান নিকোলাস রোজারিও বুধবারে জন্মগ্রহণ করায় সবাই নিকোলাসকে বুইদ্দে বলে ডাকতো। পরবর্তীতে ডাক নাম বুইদ্দে খেতাবি নামে রূপ লাভ করে। সংগ্রামপুর গ্রামের নিকোলাস রোজারিও’র অসুস্থ্যতার কারণে পা খোঁড়া হয়ে যাওয়াতে তাকে নেংড়া বলে ডাকা হতো। অতঃপর নেংড়ার বাড়ি। যোসেফ পেরেরা সংগ্রামপুর গ্রামের ঝাড়-জঙ্গলে এসে বসতি গড়াতে ঝাড় থেকে তাকে ঝাইর্যা যোসেফ বলে ডাকা হয়। পরবর্তীতে ঝাইর্যা যোসেফের বাড়ি।
ভূঁইয়া বাড়ির নামকরণ হয়েছে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীতে। ভূঁইয়া বাড়ির নামকরণ যার মাধ্যমে হয়েছে তিনি নাকি একবার কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে মাঠে গিয়েছেন। কিন্তু ভুলে গিয়েছে যে লাঙ্গল-জোয়াল তার কাঁধে। তিনি আবার বাড়িতে ফিরে আসেন। স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতেই স্ত্রী তার কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল দেখিয়ে দিতেই তিনি বলেন, “আমি শুধু ভুইল্লে যাই”। আর এ ‘ভুইল্লে’ শব্দটি এক সময় অপভ্রংশ হয়ে ভূঁইয়াতে পরিণত হয়। অতঃপর ভূঁইয়া বাড়ি। ভাওয়াল অঞ্চলের নাগরী থেকে ডাকু ও তারু রোজারিও তাদের বিরাট জনগোষ্ঠী সঙ্গে নিয়ে চামটা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন যা পরবর্তীতে বড়বাড়ি নামে পরিচিতি পায়। চামটা গ্রামের বড়বাড়ির অংশ পরবর্তীতে ছিটকীগাড়ি ও বোর্ণী গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করে। সাধুর বাড়ির অবস্থান বোর্ণী গ্রামে। যোসেফ যার দ্বারা সাধুর বাড়ির নামকরণ নিজেকে তিনি লালন ফকিরের অনুরাগী হিসাবে পরিচয় না দিলেও নিজের মধ্যে চলন-বলন, কথা-বার্তা ও আচার-আচরণে একটা বৈরাগ্যভাব সব সময় বজায় রাখতেন। সাধু যোসেফ যেহেতু গাছ-গাছড়া ও কবিরাজীর কাজ করতেন তাই তাঁকে এলাকার সবাই চিনতো। কবিরাজী হিসাবে নামও কামিয়েছিলেন বেশ। পানি পড়া ও গাছ-গাছড়ার ঔষধে তিনি কঠিন রোগও সারিয়ে তুলতে পারতেন। একবার স্বর্গীয় আর্চবিশপ মাইকেল রোজারিও সাধু যোসেফকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আচ্ছা তুমি যে পানি পড়া দাও এটাতো কাথলিক ধর্মবিরোধী কাজ। উত্তরে সাধু বলেছিলেন, আমি এক প্রভুর প্রার্থনা ও এক প্রণাম মারীয়া বলে পানি পড়ে দিই, এতে রোগী ভালো হয়ে যায় তাতে আমার কি। কথিত রয়েছে যে, একবার ফাদার কান্তনের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলীতে মারাত্মক ক্ষত বা ঘা হয়। কোন চিকিৎসকই ফাদারকে সুস্থ করতে পারছিলো না। ফাদার কান্তনের পায়ের ক্ষত এমন এক পর্যায়ে পৌঁচ্ছায় যে তাঁর পা কাঁটার উপক্রম হয়েছিলো। আর তাই ফাদার কান্তন নিজ দেশ ইটালীতে যাবার মনস্থির করেন। এই সময় সাধু যোসেফ ফাদার কান্তনকে ভরসা দিয়ে নিজে ফাদারের চিকিৎসা করার বাসনা ব্যক্ত করেন। ফাদার কান্তনও সাধু যোসেফকে অনুমতি দেন। আর এমনই আশ্চর্য যে, সাধু যোসেফের গাছ-গাছাড়ী ও কবিরাজী চিকিৎসায় ফাদার কান্তনের পায়ের ক্ষত একদম সেরে যায়। ফাদার কান্তনও সাধু যোসেফকে পুরস্কারস্বরূপ ‘সাধু’ নামে আখ্যায়িত করেন। এরপর থেকেই যোসেফ গমেজকে জনসাধারণ সাধু নামে ডাকা শুরু করে। সাধু যোসেফও ফাদার কান্তনকে গুরু বলে মানতেন। নয়া বাড়ি বাগবাচ্চা গ্রামে অবস্থিত। আগুনে ঘর পুড়ে যাওয়ায় নতুন ঘর তৈরী করা হয়েছিলো। যেহেতু বাংলা নতুন শব্দের প্রতিশব্দ হচ্ছে নয়া তাই নতুনকে নয়া আর ঘরকে বাড়ি আখ্যায়িত করে নয়াবাড়ি নামকরণ করা হয়। শারীরিক সমস্যাকে কেন্দ্র করেও অনেকের নামকরণ করা হয়েছে। দ্বারিকুশী গ্রামের বার্ণাড কস্তা নাকে নাকে কথা বলতেন বিধায় তার বাড়ির নামকরণ হয় নাহাকুডির বাড়ি।
গোপীগো বাড়ির অবস্থান বনপাড়া ধর্মপল্লীর দক্ষিণ বনপাড়া গ্রামে। পূর্বপুরুষ একজন কেউ গল্প বা গপ্প বলতে পারতো বলে গোপীগো বাড়ি নামকরণ হয়। গোপী বাড়ির মনু কস্তা তুমিলিয়া মিশনের পিপ্রাসইর গ্রাম থেকে এসে বনপাড়াতে বসতি গড়েন। কাইতানু কোড়াইয়া তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর পিপ্রাসইর গ্রাম থেকে বাহিমালী গ্রামে এসে বসতি গড়ে তোলেন। কাইতানু কোড়াইয়ার ছেলে দঙ্গু কোড়াইয়া রামাগাড়ি ইউনিয়নের সরকারী কাচারীতে কাজ করতেন বিধায় স্থানীয় মুসলিমরা সন্মান জানিয়ে দঙ্গু কোড়াইয়াকে মন্ডল নামে ডাকতো। অতঃপর বাড়ির নাম হয় মন্ডল বাড়ি। জার্মেইন কোড়াইয়া তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর আড়িখোলা গ্রাম থেকে বাহিমালীতে চলে আসেন। তিনি হেঁটে দূর-দূরান্তে বিচার কাজ, বিবাহের জন্য পাত্র-পাত্রী ঠিক করতে যেতেন বলে হাঁটা শব্দটি আঞ্চলিকতায় আডার বাড়িতে রূপান্তরিত হয়। আন্তনী রোজারিও কথা বলার সময় তোতলাতেন বিধায় বাড়ির নামকরণ হয় থেথড়বাড়ি। আন্তনী রোজারিও মঠবাড়ির উলুখোলা গ্রাম থেকে বাহিমালীতে এসে বসতি গড়েন। বনপাড়া সাববাড়ির নামকরণ বনপাড়াতে বসতি গড়ে তোলার পর হয়েছে। জানা যায় যে, ধনাই ও মনাই রোজারিও দুই ভাই তুমিলিয়া ধর্মপল্লীর চড়াখোলা গ্রাম থেকে কালিকাপুর গ্রামে এসে বসতি গড়েন। বর্তমান সাধু যোসেফের উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর দিক দিয়ে এক সময় প্রমত্তা বড়াল নদ ছিলো। বড়াল নদে বড় বড় জাহাজ ভিড়তো। দুই ভাই ধনাই ও মনাই রোজারিও জাহাজে বিদেশী সাহেবদের রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজ করতেন। যেহেতু সাহেবদের সাথে তাদের উঠাবসা তাই দেখে অনেকে দুই ভাইকে সাহেব ডাকতো। অবশেষে সাহেব শব্দটি সাবে রূপ লাভ করে। বনপাড়াতে বাঘার বাড়ি বেশ জনপ্রিয় এবং বাঘার বাড়ি ভবানীপুর ধর্মপল্লীতেও রয়েছে। পেদ্রু পিউরীফিকেশন দড়িপাড়ায় থাকতে বন্দুক দিয়ে বাঘ মারতে পারেননি বিধায় হাত লাঠি দিয়ে আঘাত করে বাঘ মারেন। আর তাঁর এই কর্মকান্ডের জন্য তাঁকে বাঘা ডাকা হতো এবং অতঃপর বাঘার বাড়ি। বনপাড়ার গায়েন বাড়ি বেশ পরিচিত। বনপাড়াতে এখনো পর্যন্ত গায়েন বাড়ির মানুষ গান-বাজনায় বেশ দক্ষ। গায়েন বাড়ি থেকে দুই ভাই আলেকজান্ডার ও সুব্রত গমেজ ঠাহুরের বা ঠাকুরের গীত গেয়ে থাকেন।
বোর্ণী ধর্মপল্লীর বৈরাগীবাড়ি ও বনপাড়ার বৈরাগীবাড়ির নামকরণের ইতিহাস এক নয়। বনপাড়ার কালিকাপুরের এ্যালেন রোজারিও একতারা বাজিয়ে গান গাইতেন; এছাড়া তার গাঞ্জা সেবনের অভ্যাস ছিলো বিধায় তার বাড়ির নাম হয়ে যায় বৈরাগী বাড়ি। এই বৈরাগী বাড়ি ডাঙ্গির বাড়ি নামেও পরিচিত। আইলসেগোবাড়ি চড়াখোলায় যেমন প্রচলিত তেমনি বনপাড়াতে আসার পরও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। আইলসেগোবাড়ি নামকরণ হলেও বাস্তবে এই বাড়ির মানুষ একেবারেই অলস নয়। যাদের কৃতকর্মে এই বাড়ির নামকরণ হয় তাদের কেউ একজন মাঠে কঠোর পরিশ্রম করে গাছতলায় ঘুমাচ্ছিলেন। গাছ থেকে পাখি মুখয়োবে পায়খানা করে দিলেও বুঝতে পারেননি। আর তাই দেখে কে বা কারা নাকি বললো, এ কোন আইলসেগো! অতঃপর আইলসেগো বাড়ি। যোসেফ রোজারিও’র বাবার নাম চার্লি রোজারিও। মঠবাড়ি ধর্মপল্লীর বাঁশবাড়িতে থাকাকালীন যোসেফ রোজারিও’র অন্যান্য ভাইবোন মারা গেলে কারো পরামর্শে ৮/১০ বছর বয়সে বনপাড়াতে চলে আসেন। অল্প বয়স হওয়াতে কেউ যোসেফ রোজারিও’কে তেমন কেউ চিনতো না। তবে যোসেফ রোজারিও ভালো যাত্রাপালা জানতো। অনেক জায়গায় পুরস্কার আনতে গেলে অনেকেই নাকি জিজ্ঞাসা করতো, এই ছেলেটি কে! আর তা শুনে যোসেফ রোজারিও যে বাড়িতে থাকতো সেই বাড়ির মালিক বলতো, এ উমুকের নাতি! এরপর থেকে যে শুরু হয়েছে নাতি অতঃপর নাতির বাড়ি। তুমিলিয়া ধর্মপল্লীতে বেনেডিক্ট ক্রুজ (বেন্তু মালী) ২২ বছর মালীর কাজ করেন। পরবর্তীতে বনপাড়া ধর্মপল্লীর কালিকাপুরে এসে বসতি গড়ে তোলেন। বেন্তু মালীর স্ত্রী ফিলোমিনা রোজারিওকে সবাই মালীর স্ত্রী লিঙ্গ মাইল্লানী বলে ডাকতো; অতঃপর মাইল্লানীর বাড়ি রূপ লাভ করে।
ভবানীপুর ধর্মপল্লীতে ছৈয়ালবাড়ি অবস্থিত। আন্তনী কস্তা (পচা) রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর ছোট সাতানী গ্রামে ঘর ছাওয়ার কাজ করতেন। আর এই কারণে এ বাড়ির নাম হয় ছৈয়ালবাড়ি। আন্তনী কস্তার ছেলে যোসেফ কস্তা, আগষ্টিন কস্তা, জন কস্তা রাজশাহীতে এসে বোর্ণীর চামটা গ্রামে বসতি করেন। তারপর বনপাড়া বাজারের নিকটে বাড়ি করেন এবং পরবর্তীতে শ্রীখন্ডি ও ভবানীপুরে বসতি গড়েন। এখানে এসেও ছেলেরা ছৈয়ালী কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। দাগু রোজারিও দড়িপাড়া থেকে ভবানীপুরে এসে বাড়ি করেন। যেহেতু তিনি গাজীপুরের ভাওয়াল থেকে এসে বসতি করেন তাই তাকে বাউল্লে এবং পরবর্তীতে বাউল্লেগোবাড়ি নামকরণ হয়। বোর্ণী ধর্মপল্লীর কুঠিবাড়ি ও বাগবাচ্চাতে বাউল্লেগোবাড়ি রয়েছে। বাঁশি কস্তা তুমিলিয়ার চড়াখোলা থেকে ১৯৪৭/৪৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীখন্ডিতে এসে বসতি গড়েন। চড়াখোলায় নাকি বিশাল বাড়ি ছিলো। ঘরের টুয়া বা উপরের অংশ এত উঁচুতে ছিলো যে সবাই উপরে তাকিয়ে দেখতো। এছাড়াও টুয়াদের বাড়িতে বড় ফিরিঙ্গি নামক একজন নাকি শারীরিকভাবে অনেক লম্বা (টুয়ার সমান) ছিলেন। সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে তাকে দেখতো। আর এ থেকে বাড়ির নামকরণ হয়ে যায় টুয়াগোবাড়ি। বর্তমান প্রজন্মের দুই পুরুষ পূর্বে চড়াখোলা গ্রামে সাত ভাই ছিলো। তাদের মধ্যে এক ভাইয়ের নাম চাঁন্দা। আর সে ভাইয়ের নামানুসারে বাড়ির নামকরণ হয় চাঁন্দাগো বাড়ি। দুই ভাই পেদ্রু পেরেরা শ্রীখন্ডি মনু পেরেরা ফৈলজানা ধর্মপল্লীতে এসে বসতি গড়েন।
ফৈলজানা ধর্মপল্লীতে মুলাগো বাড়ির অবস্থান। কথিত রয়েছে মুলার বাড়ির লোকজন হিন্দু থেকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পরও পুরুষরা দাঁড়ি রাখতো। আর পুরুষদের দেখতে মুসলিম মোল্লাদের মতো মনে হতো। আর তাই দেখে সবাই বলতো মোল্লাগো বাড়ি। অতঃপর মোল্লা শব্দটি মুলাগো বাড়িতে রূপ লাভ করে। মুলাগো বাড়ি নামকরণের আরেকটি কারণ রয়েছে বলে মনে করা হয়। এ বাড়ির লোকজন মুলা চাষ করতো। সমগ্র এলাকায় মুলা পাওয়া না গেলেও এ বাড়িতে মুলা পাওয়া যেতো। কোন শব্দ উচ্চারণে কঠিন মনে হলে শব্দটিকে সহজ করার জন্য বিকৃত উচ্চারণ করতে দেখা যায়। রাঙ্গামাটিয়ার জয়রামবের গ্রামের নরেশ রিবেরুকে নরেশ না ডেকে নরেছ বলে ডাকার কারণে এক সময় নরছেগো বাড়ি হয়ে যায়। ফৈলজানার ডিয়ারপাড়া ও কলিমহলে নরছেগো বাড়ির অবস্থান। রাঙ্গামাটিয়ার জয়রামবের গ্রামের সাব বাড়ির যার কারণে সাববাড়ি নামকরণ সে পূর্বপুরুষ গরু চড়াতে গিয়ে ফাদারদের খ্রিস্টযাগের পোশাকের মতো পোশাক গায়ে জড়িয়ে খ্রিস্টযাগ উৎসর্গ খেলা খেলেন। তিনি দেখতেও নাকি ছিলেন বিদেশী সাহেবদের মতো। আর মানুষের মধ্যে ফাদারদের সাহেব ডাকারও অভ্যাস ছিলো। তাই তাঁকে সবাই সাহেব ডাকা শুরু করেন। পরবর্তীতে সাহেব সাবে পরিণত হয়। যোসেফ রোজারিও (সাব) ফৈলজানাতে এসে বসতি গড়েন। কথিত রয়েছে যে, হিয়ালবাড়ির কারো অবৈধ্য সন্তান শিশু অবস্থায় মারা গেলে গোপনে কবরস্থ করা হয়। পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে গেলে প্রচার হয়ে পড়ে যে, শিশুটিকে শিয়ালে নিয়ে গিয়েছে। এরপর থেকে শিয়াল থেকে হিয়াল এবং পরবর্তীতে হিয়ালবাড়ি। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গামাটিয়া থেকে পল কস্তা (পলু) ফৈলজানাতে এসে প্রথম বসতি গড়ে তোলেন। এছাড়াও হিয়ালবাড়ি লাউতিয়া ও মথুরাপুরে রয়েছে। যোসেফ গমেজ, আন্তনী গমেজ ও বার্ণার্ড গমেজ নরেন্দ্রনাথ চাকী নামক একজন হিন্দুর জায়গা-জমি, বাড়ি, গরু-বাছুর ক্রয় করে বসতি গড়ে তোলায় চাকীর বাড়ি নামকরণ হয়।
আদিতে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা মানুষের সহজাত একটি প্রবৃত্তি। অনেক সময় অনেকে আদিতে ফিরে যেতে ভয় পায়। যদি কোন ময়লা-আবর্জনা বেরিয়ে আসে! তবু চিরন্তন সত্য যে, অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া না করলে সত্য বেরিয়ে আসে না। আর সে সত্য জানা থেকে সবাই বঞ্চিত হয়। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ার ধর্মপল্লীতে অবস্থিত খেতাবি বাড়িগুলোর নামকরণের ইতিহাস রয়েছে। নামকরণগুলো এক একটি ইতিহাস। খেতাবি নামগুলো যেন ব্র্যান্ড; যেগুলো আমাদের পরিচয় বহন করে। যদিও নামকরণের ইতিহাসগুলো অনেক সময়ই সুখকর নয়; তবু তো সত্য। আর সে সত্যকে স্বীকার করে নেওয়াই বরং বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখা দরকার যে, খেতাবি নাম যাই হোক না কেন, মানুষের গুণই নামকে পরিচিতি লাভ করতে সাহায্য করে। শুধুমাত্র নিজের নামকেই নয় বরং যুগ যুগ ধরে বংশ, বংশধর, পরিবার তথা সমগ্র সমাজকে অন্যের মাঝে তুলে ধরতে প্রচেষ্টা চালায়। আমাদের নমস্য এই পূর্বপুরুষদের চরণে অশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি; কারণ তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা ও কৃতকর্মের জন্য খেতাবি নামগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। আর এই খেতাবি নামের জোরেই আমরা নিজেদের অন্যের মাঝে পরিচয় দিতে পারি। রাজশাহী ধর্মপ্রদেশের দক্ষিণ ভিকারিয়ার খেতাবিনামের বাড়িগুলোতে গিয়েছি খেতাবি নামকরণের ইতিহাস জানতে। অনেকে ইতিহাস বলতে পেরেছেন আবার অনেকেই কোন ইতিহাসই জানেন না। লোকমুখে খেতাবি নামকরণের ইতিহাস যতটুকু জানতে পেরেছি তা সাজিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। খেতাবি নামকরণের ইতিহাস শুনে ও লেখাটি লিখতে গিয়ে মনে হয়েছে যেন আমি নিজেই সেই ঘটনার সাথে ছিলাম। যাই হোক এই লেখার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে- সবাইকে তার মূল চিনিয়ে দেওয়া। সবাই উপলব্ধি করুক যে, নিজেকে জানা না থাকলে সবই ব্যর্থ। আর নিজেকে জানতে হলে অতীতে ফিরে যেতে হবেই। বর্তমান প্রজন্ম জানুক তার অতীত। অজস্র শ্রদ্ধা নমস্য পূর্বপুরুষগণ; যাদের জন্য আমরা পরিচয় পেয়েছি!
উত্তরবঙ্গে ভাওয়াল অভিবাসন শতবর্ষ পূর্তিতে “শতবর্ষের অনুগ্রহ” স্মরণিকায় প্রকাশিত (২৭-২৮ মে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ)